দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাঞ্চল্যকর সব ঘটনার একটি ছিলো আমেরিকার বিমানঘাটি পার্ল হারবারে জাপানের অতর্কিত আক্রমণ, এবঙ এরই জের ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নাম লেখানো। অথচ ১৯৪১ সালের এই আক্রমণের আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি তেমন কোনো হস্তক্ষেপ ছিলো না। কী এমন হলো যাতে জাপান হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলো আমেরিকায় আক্রমণ করার। আর কে-ই বা জানতো এই আক্রমণের পরিণতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জাপানের দুটো জনবহুল শহর?
পার্ল হারবার আক্রমণের মূল কারণ জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে আরও ১০ বছর আগে ১৯৩০ এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা ইউরোপ, পশ্চিমা বিশ্ব এবং এশিয়া মহাদেশ পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছিলো অর্থনৈতিকভাবে। দ্বীপরাষ্ট্র জাপান চিন্তা করলো, এই অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের হয়ে আসতে হলে তাদের নিজেদের আয়তন প্রসারণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। চীনের সাথে ১৮৯৪-৯৫ সালের যুদ্ধ এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে ১৯০৪-০৫ সালের যুদ্ধ দুটির সফলতা নতুন করে হিংস্র করে তুলছিলো তখনকার সময়ের মারকুটে জাপানীদের। সেই সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের সফলতাও সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছিলো।
বিশ্বের বুকে নিজেদের হিংস্রতার পরিচয় নতুন করে দেয়ার জন্য আবারও প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো জাপানীরা। ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের মাধ্যমে সূচনা হয় জাপানের এই বিশ্ব দখলের লড়াই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হওয়া লিগ অফ নেশনস এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের শর্তানুযায়ী কোনো দেশই অন্য কোনো সার্বভৌম দেশের উপর অন্যায় আক্রমণ চালাতে পারবে না। জাপান তখন এই বিশ্ব সংস্থা থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে চীন আক্রমণে তাদের আর কোনো বাঁধা থাকে না। মাঞ্চুরিয়ার জনগণের উপর নেমে আসে খুন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো করুণ পরিণতি।
মাঞ্চুরিয়ার মতো করুণ পরিণতি নেমে আসে চীনা জাতীয়তাবাদী দলের রাজধানী নানজিংয়ের উপরও। ছয় সপ্তাহের এই অত্যাচারে খুন-জখম-ধর্ষণ থেকে বাদ যায়নি সামরিক এবং বেসামরিক কোনো নাগরিক। এগুলো হলো পৃথিবীর বুকে জাপানীদের নারকীয়তার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। তাদের মতো হিংস্র জাতি এই পৃথিবী খুব কমই দেখেছে। আজকের জাপানকে দেখলে মনেই হবে না একসময়ে তারা কতটা ভয়াবহ এক জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতো।
জাপানীদের এই কর্মকাণ্ড শুরু থেকেই ভালো চোখে দেখছিলো না আমেরিকা। তারা জাপানকে বারবার হুঁশিয়ার করে আসছিলো। শেষে উপায়ন্তর না দেখে জাপানের সাথে সকল প্রকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা। এর ফলে জাপান আমেরিকা থেকে বিমানের সরঞ্জামাদিসহ অন্যান্য ধাতব বস্তু এবং তেল ক্রয় করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলো। এরই মাঝে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা আশা করছিলো এই বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ফলে জাপানের এই হিংস্র মনোভাব অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিলো তার উল্টো।
১৯৪০ সালে জাপান অক্ষশক্তির দুটো পরাক্রমশালী দেশ জার্মানি এবং ইতালির সাথে মিলে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়ে জাপান সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করে। এরই মাঝে জাপান এবং আমেরিকার অনেক বৈঠক হয়েছে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে। কিন্তু এর কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। জাপানের কাছে আমেরিকার সাথে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া একপ্রকারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। এশিয়ার জনগণের উপর পশ্চিমাদের প্রভাব কখনোই ভালো চোখে দেখা হতো না। তার উপর বিশ্বের দরবারে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিলো না জাপানের কাছে। তাই আর কোনো পথ না দেখে জাপান সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয় আমেরিকা আক্রমণ করার।
ডিসেম্বর, ১৯৪১; প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে আমেরিকার প্রধান নৌ ঘাটি পার্ল হারবার। হাওয়াই থেকে ৪,০০০ মাইল দূরবর্তী জাপান থেকে আক্রমণ আসতে পারে এমন কোনো ধরনের চিন্তা কেউ করেনি। তাই অনেকটা অরক্ষিত ছিলো এই বিমানঘাটি। এটাই জাপানের জন্য সহজ করে দেয় পার্ল হারবার আক্রমণের জন্য। অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো কয়েক মাস ধরে নীল নকশা তৈরি করেন পার্ল হারবার আক্রমণের। হাওয়াই অঙ্গরাজ্য দখল করে নিলে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলে প্রভাব বিস্তার করা জাপানের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর সেই সাথে খুলে যাবে দক্ষিণে অগ্রসর হবার এক সুন্দর সুযোগ।
৭ই ডিসেম্বর ৩৬০টি বোমারু বিমান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায় জাপানী বিমান বাহিনী। হঠাৎ এই আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আমেরিকান নৌ বাহিনী। ৩০০টিরও বেশি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস হয়ে যায় এই আক্রমণে। আমেরিকার ৮টি যুদ্ধজাহাজই পড়ে আক্রমণের মুখে। ৮টির মাঝে ৪টি যুদ্ধজাহাজই ডুবে যায় জাপানের এই আক্রমণে। সেই সাথে নিহত হয় ২,৪০০ নাবিক। জাপানের প্রবল আক্রমণের সামনে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি মার্কিন বাহিনী। এই আক্রমণের পরই ৮ই ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রথমদিকে এই আক্রমণ সফল মনে হলেও, পার্ল হারবার আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলো জাপান বাহিনী। ইয়ামামোটো চাচ্ছিলেন পার্ল হারবারের সকল তেলের মজুদ, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সরাইখানা ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু জাপানের বোমারু বিমান সেগুলোতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- আমেরিকার একটি যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজেও আঘাত করতে পারেনি তারা। এটি প্রশান্ত উপকূলে প্রভাব বিস্তারে জাপানের জন্য একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো তাই পরিকল্পনা করেন দ্বিতীয়বার পার্ল হারবার আক্রমণের। কিন্তু দিনশেষে এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় জাপানীদের জন্য।
প্রথমবার পার্ল হারবার আক্রমণের ছয় মাস পর দ্বিতীয়বার আক্রমণের পরিকল্পনা করেন অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো। পরিকল্পনা মতো পার্ল হারবারের নিকটবর্তী উপদ্বীপ মিডওয়েতে ঘাটি গাড়ে জাপানী বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জাপানের রেডিও যোগাযোগের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় আমেরিকার কাছে। আমেরিকার একদল কোড ব্রেকার বের করে ফেলে জাপানের পরিকল্পনা এবং সাথে সাথে তা আমেরিকার প্যাসিফিক নৌ কমান্ডার অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিজকে বুঝিয়ে দেয়। জাপানিদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিজ।
৪ই জুন সকাল থেকে শুরু হয় সেই বিশেষ যুদ্ধ। রেডিও বার্তায় পাওয়া তথ্য থেকে আমেরিকা জানতো কবে এবং কোথায় আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে জাপানী বাহিনী। আমেরিকার যুদ্ধ বিমানগুলো জাপানীদের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। কিন্তু খেলা পাল্টে দেয় আমেরিকার বোমারু বিমানগুলো। বোমা-বারুদ লোড করার সময় হঠাৎ তাদের ধরে ফেলে আমেরিকার ডাইভ বোম্বার বিমানগুলো। মুহূর্ত দেরি না করে ডুবিয়ে দেয় জাপানীদের পূর্ণ শক্তির ৪টি যুদ্ধ জাহাজ আকাগি, কাগা, সরু এবং হিরু। সেই সাথে ডুবে যায় ৩২২টি যুদ্ধ বিমান এবং ৫,০০০ নাবিক। জাপানীরা তাদের অন্যতম বড় যুদ্ধ জাহাজ মিকুমা হারায় এই আক্রমণে।
৭ই জুন পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে জাপানীদের এই ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে আমেরিকানরা হারিয়েছিলো ১৪৭টি যুদ্ধবিমান এবং তিন শতাধিক নাবিক। কিন্তু মিডওয়েতে জাপানীদের এই বিশাল পরাজয় পাল্টে দেয় পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ। বদলে যায় উভয়পক্ষের পুরো যুদ্ধ পরিকল্পনা। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনাকে লেখা হয় 'ব্যাটল অফ মিডওয়ে' নামে। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আমেরিকা পারমাণবিক বোমা হামলা চালালে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় একসময়ের পরাক্রমশালী জাপান।
This is a Bengali article on why Japan attacked Pearl Harbor and then they lose in the Battle of Midway.
Featured image - MPI/Getty Image
All the references are hyperlinked.