Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্ল্যানচ্যাট: মৃত আত্মাদের ডেকে আনার রহস্যময় এক উপায়

হলিউডের সাড়া জাগানো ‘অরিজিন অফ ইভিল’ সিনেমাটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। অন্ধকার ঘরে তিন-চারজন বন্ধু মিলে হাতে হাত ধরে মৃত আত্মাকে আহ্বান করে, পরে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নেমে আসে সাক্ষাৎ এক শয়তান! যারা সিনেমাটি দেখেননি, তাদের অনেকেই হয়তো জানেন এভাবে আত্মাকে ডেকে আনার ব্যাপারটি। কেউ কেউ শখের বশে, কেউ কৌতূহল থেকে, কেউ আবার সত্যিকারের বিশ্বাস থেকে এভাবে মৃতদের আত্মার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে থাকেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঘটনায় বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। মূলত বিদেহী আত্মাদের ডেকে আনার প্রাচীন ও চমকপ্রদ পদ্ধতি ‘প্ল্যানচ্যাট‘ নিয়েই আমাদের আজকের এ আয়োজন। 

OUIJA Origin of Evil সিনেমার পোস্টার; Image Source: thebearwitness.com

শুরুতেই একটি জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। প্ল্যানচ্যাট আর প্রেতসাধনাকে অনেকে একসাথে গুলিয়ে ফেলেন এবং দুটোকে একই পদ্ধতি বলে মনে করেন। এ দুটি মূলত ভিন্ন দুটি চর্চা। প্ল্যানচ্যাটে শুধুমাত্র মৃতদের আত্মাকে আহ্বান করা হয়ে থাকে বা তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অপরদিকে, প্রেতসাধনা করে মূলত শয়তানের অনুসারীরা। তারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং শয়তানের উপাসনা করে। প্রেতসাধকরা মূলত শয়তানের উপাসনার মাধ্যমে নিজেরা শয়তানের ন্যায় শক্তিশালী হতে পারবে- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে চর্চা করে থাকে। অপরদিকে, প্ল্যানচ্যাটে কোনো ভিন্ন শক্তির উপাসনা হয় না। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মৃতদের আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একটি চেষ্টামাত্র।

প্লানচেট টেবিল; Image Source: etsy.com

প্ল্যানচ্যাটের মাধ্যমে আত্মাদের ডেকে আনার ধারণাটি বেশ পুরনো। মূলত আঠারো শতক থেকেই প্ল্যানচ্যাট নিয়ে গবেষণা ও মৃতদের আত্মাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু হয়। ১৮৫৩ সালে অ্যালান কারডেক নামে এক ফরাসি ব্যক্তি সর্বপ্রথম আত্মাকে ডেকে আনার উপায় আবিষ্কার করেন বলে দাবি করেন। আত্মা নিয়ে বিজ্ঞানীদেরও যথেষ্ট কৌতূহল ছিলো বিধায় বিভিন্ন সময় আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গঠিত হয়েছিল একাধিক আত্মিক অনুসন্ধান কমিটি। ১৮৮২ সালে লন্ডনে গঠিত আত্মিক সমিতির সভাপতি ছিলেন খোদ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসর হেনরি সি জুইক। তার সহকারীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আর্থার জে বেলফোর। পরবর্তীতে মৃত আত্মাদের সাথে যোগাযোগের এই চর্চা ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশে।

Image Source: livwscifi.com

১৮৮৩ সালে ইউরোপীয় দেশগুলোতে সর্বপ্রথম আধুনিক প্ল্যানচ্যাটের গবেষণা ও ব্যবহার শুরু হয়। ফরাসি পরলোকগত তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এফ এস প্ল্যাঁশেত সারাজীবন আত্মার সঙ্গে জীবিত মানুষের যোগাযোগ ঘটানোর ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন। তাই তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে প্ল্যানচ্যাট। প্ল্যানচ্যাটের ধারণাটি আমেরিকাতে আসে উনিশ শতকের শেষদিকে। আমেরিকাজুড়ে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিলো। প্রতিদিন মারা পড়ছিলো শত শত মানুষ। প্রতিনিয়ত কারো মা, বাবা আবার কারো আদরের ভাই-বোন মারা পড়ছিলো সেই যুদ্ধে। এ অবস্থায় মৃত আত্মীয়দের আত্মার সাথে যোগাযোগ করার জন্য প্ল্যানচ্যাটের প্রচলন হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করা আমেরিকানদের অনেককেই তান্ত্রিকদের কাছে প্ল্যানচ্যাটের জন্যে ধর্না দিতে দেখা যায়। বাস্তবে আত্মা ডেকে আনা সম্ভব না হলেও আত্মীয় হারানোর শোকে কাতরদের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে এই প্ল্যানচ্যাট ব্যবসা বেশ ভালোই জমে উঠেছিলো তৎকালীন আমেরিকায়।

আমরা এতক্ষণ প্ল্যানচ্যাটের ইতিহাস ও উত্থান জানলাম। এবার দেখে নেই প্ল্যানচ্যাটের মাধ্যমে কীভাবে আত্মাদেরকে ডেকে আনা হয়, কিংবা কীভাবে ডেকে আনার চেষ্টা করা হয়।

বোস্টন প্ল্যানচ্যাট

এই প্ল্যানচ্যাটে মূলত একটি সাদা বোর্ডকে ব্যবহার করে করা হয়। প্ল্যানচ্যাটের জন্য তৈরি বিশেষায়িত বোর্ডটি সাধারণত কাঠ কিংবা তামা দিয়ে তৈরি করা হয়। বোর্ডের দুদিকে ছোট ছোট ক্যাস্টরদানা রাখা হয়, যাতে বোর্ডটি সুবিধামতো চক্রাকারে ঘুরতে পারে। বোর্ডের মাঝখানে পেন্সিল ঢোকানোর জন্য ছোট একটি ছিদ্র থাকে। পেন্সিলটির তীক্ষ্ম দিকটি ছিদ্র ভেদ করে বোর্ডের নিচে রাখা কাগজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই কাগজেই মূলত আত্মার সাথে যোগাযোগের কাজটি লেখা হয়।

বোস্টন প্ল্যানচ্যাট সাধারণত বিজোড় সংখ্যক মানুষ নিয়ে করতে হয়। অন্ধকার একটি কক্ষে সবাই সবার হাতের আঙুল ছুঁয়ে চক্রাকারে উপবিষ্ট থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সিয়ান্স বা প্রেতচক্র। তাদের মধ্য থেকে একজন মিডিয়াম হিসেবে থাকেন, যার মাধ্যমে অশরীরী আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। মিডিয়ামের হাতে পেন্সিলটি আলতোভাবে ধরা থাকে। প্ল্যানচেটের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসার বিদেহী আত্মা সেই মিডিয়ামের দেহে ভর করে তার হাত ধরে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখিয়ে নেয়।

বোস্টন প্ল্যানচ্যাট বোর্ড; Image Source: worthpoint.com

প্ল্যানচ্যাটের প্রচলিত আরেকটি পদ্ধতি হলো মুদ্রার নকশা ব্যবহার করে প্ল্যানচ্যাট করা। এ পদ্ধতিতে প্লানচ্যাটের বোর্ডের ওপর মুদ্রার নকশা আঁকা থাকে। এজন্য জোড়সংখ্যক মানুষ প্রয়োজন। সবাই বোর্ডে হাত রাখার পরে একটি কাচের গ্লাস নিতে হয়, যেটিকে উল্টো করে ধরে তাতে আগরবাতির ধোঁয়া দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। তারপর ধোঁয়াপূর্ণ গ্লাসটিকে প্ল্যানচ্যাট বোর্ডের উপর রাখতে হয় এবং যেকোনো মৃত মানুষের আত্মাকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়, যাতে সে তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যায়। তারপর চারজন মানুষ তাদের অনামিকা আলতোভাবে বোর্ডের ওপর রাখে। বোর্ডটি যখন ঘুরতে শুরু করে, তখন বোর্ডের ওপর থাকা নির্দেশকটি বিভিন্ন অক্ষরের মাধ্যমে উপস্থিত আত্মার পক্ষ থেকে যে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে তা অক্ষরের মাধ্যমে ফুটে ওঠে।

সিনেমা থেকে নেয়া প্ল্যানচ্যাটের দৃশ্য; Image Source: mtv.com

এ তো গেলো প্ল্যানচ্যাট কীভাবে করতে হয় তার বর্ণনা। এবারে চলুন জেনে নেই প্ল্যানচ্যাটে নিয়মিত ব্যবহার করা ওইজা বোর্ডের (Ouija Board) ব্যাপারে। এটি প্ল্যানচ্যাটে ব্যবহার করা হলেও ডাকিনীবিদ্যার কাজেও অনেক সময় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ওইজা বোর্ডের আবির্ভাব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, বহু শত খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর আবির্ভাব হয়। প্রাচীন গ্রিক বা রোমানদের সময় থেকে এর ব্যবহার চলতে থাকলেও ঝামেলা বাধে যিশুখ্রিস্টের সময়কালে। যিশুখ্রিস্ট যখন নিজেই মৃতদের মাঝে আত্মা ফিরিয়ে দেয়া বা আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করার সক্ষমতা প্রকাশ করেন তখন প্ল্যানচ্যাট চর্চাকারীরা অনেকটা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরুপে আবির্ভূত হয়। এ নিয়ে যিশুর অনুসারী ও প্ল্যানচ্যাট চর্চাকারীদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এ কারণে দীর্ঘকাল খ্রিস্টানদের বড় একটি অংশ প্ল্যানচ্যাটকে খ্রিস্টধর্মের পরিপন্থী হিসেবে মনে করতো। ফলে অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়ে প্ল্যানচ্যাটে বিশ্বাসীরা। দীর্ঘদিন এ ধরনের টানাপোড়েন থাকার পরে মূলত আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে এটা আত্মা বিশারদদের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের মানুষদের নিকট ধীরে ধীরে আবার পরিচিতি পেতে শুরু করে। 

ওইজা বোর্ড; Image Source: art4clip.com

ওইজা বোর্ডের কার্যকারিতা ও ব্যবহারবিধির প্রয়োগ কাল-পাত্র-স্থানভেদে ভিন্ন। বোর্ডের পদ্ধতিভেদে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নিয়মে এর ব্যবহার প্রচলিত আছে। তবে সাধারণভাবে ওইজা বোর্ডের বিবরণ দিতে গেলে, এ বোর্ডে সাধারণত দুটি বৃত্ত থাকে, যেখানে প্রথম বৃত্তে ইংরেজি অক্ষরসমূহ, অর্থাৎ ‘A’ থেকে ‘Z’ পর্যন্ত সবগুলো অক্ষর থাকে এবং দ্বিতীয় বৃত্তটিতে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা থাকে। প্রথম বৃত্তের সবগুলো অক্ষর ‘হ্যাঁ’ প্রকাশ করে, আর সাথে দ্বিতীয় বৃত্তের সবগুলো সংখ্যা ‘না’ প্রকাশ করে। প্ল্যানচ্যাটে বিশ্বাসীদের মতে, এই ওইজা বোর্ডের উপর থাকা অক্ষর ও সংখ্যাগুলোর ব্যবহারের মাঝে উপস্থিত হওয়া আত্মারা প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ-না অথবা শব্দ লিখেও দিয়ে থাকে।

ওইজা বোর্ডের উত্তরগুলো কি আসলেই কোনো অশরীরী আত্মা দিয়ে থাকে, নাকি প্ল্যানচ্যাটে বসে থাকা ধুরন্ধর কারো চালাকি, তা আপাতত বলা যাচ্ছে না। আমদের মাঝে যারা বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে, তারা এ ধরনের অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তিতে বিশ্বাস করে না। তবে কি শত বছর ধরে চর্চা হয়ে আসা প্ল্যানচ্যাট আসলেই মৃতদের আত্মাকে ডেকে আনতে সক্ষম, নাকি পুরো ব্যাপারটিই একটি ভ্রান্ত ধারণা?

পৃথিবীতে কিছু রহস্যের সমাধান কখনোই হয় না। প্ল্যানচ্যাট সম্ভবত তেমনই একটি রহস্য হিসেবেই থেকে যাবে এর বিশ্বাসীদের কাছে।

This Bengali article is about planchat.

References - Hyperlinked in the article.

Featured image- sciencenordik

Related Articles