হয়তো মানুষটির সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক আপনার নেই। হয়তো আগে কখনো মানুষটির সাথে আপনার দেখাও হয়নি, ছিলেন দুজনে দুনিয়ার দুই প্রান্তে। তবুও, সংস্পর্শে এলে তার প্রতি আপনি অনুভব করেন অজানা অদ্ভুত কোনো টান। সম্পর্কহীনতার বাস্তবতায় বেঁচে থেকেও দুজনে জড়িয়ে আছেন কোনো এক কাল্পনিক সুতোর জালে। অদ্ভুত সে অনুভূতির উৎস মানুষটির উপস্থিতি দূর করে দেয় আপনার হৃদয়ের শূন্যতা। আপনার আজন্ম লালিত অসম্পূর্ণ সত্ত্বাকেও যেন তার সঙ্গ করে তোলে পরিপূর্ণ। আর এ মানুষটিকেই বলা হয় সোলমেট।
১৮২২ সালে স্যামুয়েল টেইলর কোলেরিজের লেখা একটি চিঠিতে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় “সোলমেট” শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। একজন মানুষের মন-মানসিকতার সাথে পূর্ণরূপে মানানসই ব্যক্তিকেই সোলমেট হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে বিখ্যাত ডিকশনারি ওয়েবসাইট মেরিয়াম ওয়েবস্টার।
সোজা ভাষায় বললে, যে মানুষটির প্রতি মন থেকে গভীর অকৃত্রিম অনুরাগ কাজ করে তাকেই বলা হয় সোলমেট। মনের মিল, ভালোবাসা, প্রেম, আদর্শ সম্পর্ক, স্বাচ্ছন্দ্য, অন্তরঙ্গতা, যৌনতা, আত্মিকতা, সঙ্গতি, আস্থা এসবের যে কোনো কিছুই হতে পারে সে অনুরাগের কারণ কিংবা বহিঃপ্রকাশ। সংজ্ঞা সে যা-ই হোক, সোলমেট শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই-ই পরিচিত।
কিন্তু, সোলমেটের সঙ্গ কেন আমাদের হৃদয়কে তৃপ্ত আর সতেজ করে তোলে? পাজেলের হারানো টুকরোর মতো সোলমেটের সাহচর্য কেন আমাদেরর মনে পরিপূর্ণতার অনুভূতি সৃষ্টি করে? সোলমেটকে আমরা কেন আমাদের বেটার হাফ হিসেবে পেতে চাই?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সবচেয়ে সুন্দরভাবে দিয়ে গেছেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো।
পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তির স্থপতি ও প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন দার্শনিকের মধ্যে দ্বিতীয়জন প্লেটো। একাধারে তিনি ছিলেন মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য এবং দার্শনিক অ্যারিস্টটলের গুরু। সমসাময়িক গ্রিসের আরেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন অ্যারিস্টোফানেস। হাস্যরসাত্মক ও প্রহসনমূলক নাট্য-রচয়িতা ছিলেন তিনি।
৩৮৫-৩৭০ খ্রিস্টপূর্বে প্লেটো রচনা করেন ‘দ্য সিম্পোজিয়াম’। আর সেই ঐতিহাসিক রচনায় উঠে আসা অ্যারিস্টোফানেস নির্মিত এক গল্প থেকেই পাওয়া যায় সোলমেট তত্ত্ব নিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও ব্যাখ্যা।
অ্যারিস্টোফানেসের ভাষ্যমতে, প্রাচীনকালে মনুষ্যজাতির ছিল ভিন্ন এক আদিরূপ। জন্মগতভাবেই তখন মানুষের ছিল চার হাত, চার পা আর দু’মুখো এক মাথা। এখানেই শেষ নয়। সেসময় মনুষ্যজাতি তিন লিঙ্গে বিভক্ত হতো- নারী, পুরুষ ও অ্যান্ড্রোজিনাস। তাদের প্রত্যেকের দেহেই ছিল এক জোড়া করে জননেন্দ্রিয়। সূর্যের সন্তান পুরুষদের ছিল এক জোড়া পুরুষ জননেন্দ্রিয়, পৃথিবীর সন্তান নারীদের ছিল এক জোড়া নারী জননেন্দ্রিয় এবং চন্দ্রের সন্তান অ্যান্ড্রোজিনাসদের ছিল একটি করে পুরুষ ও নারী জননেন্দ্রিয়।
অসাধারণ সে মানবসত্ত্বার দেহে ছিল ক্ষিপ্রতা, লড়াই করার প্রবণতা ও অপরিমেয় শক্তি। তারা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, একটা পর্যায়ে তারা দেবতাদের শাসন মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলো। দল বেধে মানবজাতি রওনা হলো অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায়। যুগে যুগে দেবতারা বজ্রের আঘাতে টাইটানদের ধ্বংস করে এসেছে। সে পরিস্থিতিতে মানবজাতিকেও তারা একইভাবে ধ্বংস করতে চাইলেন। কিন্তু, মানুষই যদি না থাকে, তবে দেবতাদের আরাধনা করবে কে?
অদ্ভুত এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন দেবতাদের রাজা জিউস। মানবদেহকে দ্বিখণ্ডিত করার মধ্যে দিয়ে তাদের সকল অহংকার চূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন পুত্র অ্যাপোলোকে। একইসাথে, পরবর্তীতে এমন কোনো ধৃষ্টতা দেখালে, আবারও মানবদেহ অর্ধেক করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি। এ ঘটনার ফলে, মানবজাতি যেমন দুর্বল হলো, একইসাথে দেবতাদের আরাধনা করার মানুষের সংখ্যাও বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল।
কিন্তু, নিজ দেহের অর্ধাংশ হারিয়ে তাদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, দুঃখ কষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলে তারা দিনরাত কেবল হারানো অংশ ফিরে পাবার প্রার্থনাই করে যাচ্ছিল। ফলে, গণহারে মারা যেতে থাকলো তারা।
অবশেষে, করুণা হলো জিউসের। অ্যাপোলোকে নির্দেশ দিলেন, প্রত্যেকের মুখ তাদের কাটা অংশের দিকে ঘুরিয়ে দিতে যেন, তারা এ শাস্তির কথা কখনো ভুলে যেতে না পারে। পাশাপাশি, তাদের মিলন ও বংশবৃদ্ধির সুবিধার্থে জননেন্দ্রিয়ও একই পাশে আনতে বললেন। নির্দেশমতো, দেহের চামড়া পাকস্থলীর কাছে টেনে নাভিতে সেলাই করে তাদেরকে স্বাভাবিক করে তুললেন অ্যাপোলো।
এতে করে প্রত্যেকের দেহে তখন একটি মাথা, এক জোড়া চোখ, এক জোড়া হাত, এক জোড়া পা ও কেবল একটি করে জননেন্দ্রিয় অবশিষ্ট ছিল। আর সেই খণ্ডিত মানুষটি বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়, তার দেহ ও মনের অপর খণ্ডিতাংশ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষটির অপেক্ষায়। তার সত্ত্বা থেকে হারানো অপর লিঙ্গের মানুষটিই ছিল তার সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
কথিত আছে, যখন সত্যিই তারা একে অপরকে খুঁজে পেত, মিলন-সুখের বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার তাদেরকে এতটাই গভীরভাবে গ্রাস করতো যে, তাদের জীবনে অবশেষে আসতো পরিপূর্ণতা। আর সে সুখের কোনো তুলনাই হয় না।
ভালোবাসার অর্থ “পূর্ণতা অন্বেষণ”। আর সে কারণেই কেউ তার সোলমেটকে খুঁজে পেলে, সবসময় তার সাথেই থাকতে চায়। এ আকর্ষণকে যৌনতায় সীমাবদ্ধ করে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দেহের গণ্ডি ছাড়িয়ে মনের বিস্তীর্ণ লীলাভূমিতেই হয় এ সম্পর্কের অবাধ বিচরণ।
অ্যারিস্টোফানেসের মতে, শিল্পের ঈশ্বর হেফোস্টাস যদি প্রতিটি মানুষকে একটি ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ দিতেন, তবে সে অবশ্যই তার বেটার হাফকে পেতে চাইত। আর যে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে, সে চাইত কখনোই যেন মানুষটির সাথে তার বিচ্ছেদ না হয়, এমনকি শেষ নিঃশ্বাস অবধি তারা একসাথেই ত্যাগ করতে চাইত। আর এভাবেই সম্পন্ন হতো তাদের পূর্ণতা অন্বেষণ।
বর্তমান সময়ে ‘সোলমেট’ শব্দটিকে ব্যবহার করা হয় আদর্শ জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনীর ক্ষেত্রে, যার সাথে রয়েছে জন্ম জন্মান্তরের অটুট এক বন্ধন। ভালোবাসার সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায়, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ এ শব্দটিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করলেও, যেকোনো সম্পর্কের গভীরতায় একেই সর্বোচ্চ মাত্রা হিসেবে ধরা যায়।
আপনিও কি বিশ্বাস করেন যে সোলমেট বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সত্যিই আছে?
২০১১ সালে নিউ ইয়র্কের পুকিপসিতে অবস্থিত ম্যারিস্ট কলেজের রিসার্চ সেন্টারের অধীনে হওয়া একটি সমীক্ষায় নারীদের চেয়েও পুরুষদের মধ্যেই সোলমেটে তত্ত্বে বিশ্বাসের আধিক্য দেখা যায়। শতকরা ৭৪ ভাগ পুরুষ বিশ্বাস করেন যে, দুনিয়ার কোনো এক প্রান্তে তার জন্য অপেক্ষা করছে সত্যিকারের ভালোবাসা। ওদিকে নারীদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৭১ শতাংশ। এছাড়াও, ৪৫ বছরের চেয়ে কম বয়সীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের অধিক বয়সীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন সোলমেট তত্ত্বে।
যদিও মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, এ ধরনের বিশ্বাসের ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। সোলমেটে বিশ্বাসীদের অধিকাংশের ধারণা থাকে যে, পরিচয় থেকেই তার বেটার হাফের সাথে অসাধারণ মনের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে এবং একটা পর্যায়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সে সম্পর্ক গড়াবে প্রণয়ে।
অথচ, সোলমেট তত্ত্বে অতিরিক্ত বিশ্বাস, একজন মানুষের মধ্যে তার সম্পর্ক নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করার চেয়ে, ভিন্ন কোনো সঙ্গী/সঙ্গিনীর সাথে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, সোলমেট তত্ত্বে বিশ্বাসীরা সঙ্গী/সঙ্গিনীর প্রতি দ্রুত হতাশ হয়ে যান এবং অন্য কারো কাছে আকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা অন্বেষণ শুরু করেন।
কিন্তু, একটি সম্পর্কের সফলতা নির্ভর করে সে সম্পর্কের আওতায় থাকা মানুষ দুজনের পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা ও মনোযোগের ওপর। পাশাপাশি সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দুজন মানুষের মন থেকে চেষ্টা থাকাটাও জরুরী। এতে করে সম্পর্ক যেমন হয় আরও প্রাণবন্ত, তেমনি বৃদ্ধি পায় ভালোবাসা।
মহান দার্শনিক সক্রেটিস একবার ভালোবাসার প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো যুক্তি তর্কেই একে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। ভালোবাসার স্বরূপ খুঁজতে যুগে যুগে মানুষ ছুটে গেছে, ছাড়িয়ে গেছে নানা সীমা। অথচ, নিজের মাঝেই লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের ভালোবাসা দেখার চেষ্টা খুব কম মানুষই করেছে। কারণ, ভালোবাসায় বিশ্বাসী মানব মন কখনোই ভালোবাসাকে নোংরা, কুৎসিত কিছু হিসেবে চিন্তা করতে পারে না। ভালোবাসায় গড়া মানব মনের প্রকৃত সত্তায় মিশে থাকা ভালোবাসার আদিরূপ নিখুঁত, নিষ্কলঙ্ক ও চির-পবিত্র।
অ্যারিস্টোফানেসের এ তত্ত্ব যত অদ্ভুতই হোক না কেন, ভালোবাসার অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা চিরকালই থাকবে। কারণ হারানো সে মানুষটি সত্যিকার অর্থে আমাদের দেহের হারানো অংশ হোক বা না হোক, তার সাথে মিলনই আমাদের হৃদয়কে করে তোলে পরিপূর্ণ। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যে খুঁজে পায় না তার মানুষটিকে, জীবনে সম্পদ-শিক্ষা-সুখ এর প্রাচুর্য থাকলেও হৃদয়ের গহীন কোণে কোনো না কোনোভাবে সেই অভাব-অপ্রাপ্তি-অপরিপূর্ণতা নিয়েই সে বেঁচে থাকে চিরকাল।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is about the myth of the missing half and how the ‘Symposium’ explains the theory of ‘Soulmate.’
References:
When Zeus Split Human Beings | Medium
The Science of Soulmates | Science Of People
Why You Should not Believe in Soulmates | Psychology Today
The Dark Side of Believing in True Love | BBC
10 Elements of A Soulmate | Huffpost
Beware of The Soulmate Myth | Psychology Today
Symposium by plato : Summary of The Speech of Aristophanes | Grade Saver
What Plato Can Teach You About Finding A Soulmate | The Conversation
Plato's Other Half | Lapham’s Quarterly
Platonic myths: The Myth of Aristophanes | Outre-Monde
Searching For Your Other Half And Why It Is Complete Garbage| The Odyssey Online
Featured Image Source: Bluebig