১৮৬১ সাল, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরই আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে, দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলমান বিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল এই গৃহযুদ্ধ। লিংকনের জন্য তখন চ্যালেঞ্জ এই যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করা, কিন্তু প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে তিনি চাইলেই দাসপ্রথা দূর করতে পারতেন না।
শত শত বছর ধরে চলে আসা দাসপ্রথা আমেরিকার সংবিধান প্রনয়ণের সময় পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং লিংকনের পূর্বে কোনো প্রেসিডেন্টই সংবিধান সংশোধনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেননি। অন্যদিকে আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যের যেহেতু স্বাধীনতা রয়েছে নিজস্ব আইন প্রণয়নের, তাই ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্য থেকে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু কট্টর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদ এত বেশি ছিল যে তারা দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে কোনো ভূমিকা নেয়নি, যা এই গৃহযুদ্ধ সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রাখে।
গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে লিংকনের প্রাধান্য ছিল বিদ্রোহ দমন করা। তার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে এমনটিই প্রতীয়মান হয়। ৬ আগস্ট, ১৮৬১ সালে তিনি একটি আইন পাশ করেন যা Confiscation Act নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্রোহে যারা সমর্থন জুগিয়েছিল তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যেহেতু দাসদেরকেও সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো, তাই এই আইন পাশের এক বছরের মধ্যে দশ হাজারেরও বেশি দাস ছাড়া পায়। কিন্তু এসব দাসেরা তাদের মালিকের কাছ থেকে ছাড়া পেলেও তারা আদৌ মুক্ত ছিল কি না এবং পরবর্তীতে অন্য কোনো মালিকের দাসে পরিণত হতে পারত কি না তা এই আইন ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তাই এই আইন তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, কিন্তু দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে যে রাজনৈতিক সমর্থনের দরকার ছিল তা এটি আদায় করতে সক্ষম হয়।
শুরুর দিকে লিংকন দাস মালিকদের এই প্রথা বিলুপ্তির বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সরাসরি দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটালে পরিস্থিতি আরও অচল হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু সংবিধানে দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল তাই এ সংক্রান্ত যেকোনো পরিবর্তন যুদ্ধের মতো সংকটপূর্ণ অবস্থাতেই নেওয়া সম্ভব হতো। তাই ১৮৬২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লিংকন Emancipation Proclamation ঘোষণা করেন, যা ১ জানুয়ারি, ১৮৬৩ থেকে কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না এরকম দক্ষিণাঞ্চলের ১০টি রাজ্যের দাস আইনসিদ্ধভাবে মুক্ত হয়। যেহেতু এটি যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্টের জরুরি ক্ষমতাবলে পাস হয়েছিল, তাই যেসব অঞ্চলে যুদ্ধ চলছিল না সেখানে এই আইন স্বভাবতই কার্যকর ছিল না।
এরপরের ১০০ দিন লিংকন সৈন্য প্রস্তুত করেন এবং বিদ্রোহীদের দমন করে ৩৫ লাখেরও বেশি আফ্রিকান আমেরিকান দাস মুক্ত করেন। এই ঘোষণাটি এমন সময়ে আসে যখন কেন্দ্রীয় সরকার বারবার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ না করলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিচ্ছিল। এছাড়া এটি দাসদের মধ্য থেকে উপযুক্ত ব্যক্তিদের বেতনসহ সরকারের সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করারও নির্দেশ দেয়। লিংকনের নির্দেশনায় ১৮৬৩ সালের শেষ নাগাদ জেনারেল লরেঞ্জো থমাস, মিসিসিপি ভ্যালি থেকে ২০ রেজিমেন্ট কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য নিয়োগ দেন। এই ঘোষণা দাস মালিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি, দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেনি, আবার দাসদের নাগরিকত্বও প্রদান করেনি। অনেকের মতে এটি শুধুমাত্র যুদ্ধ অবসান করে আমেরিকাকে পুনরায় একত্র করার জন্য প্রণীত হয়েছিল এবং লিংকন বিদ্রোহ দমনে একে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। লিংকন নিজেও এর আগে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,
দাসপ্রথাকে বাঁচানো বা বিলুপ্তি নয়, আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হচ্ছে আমেরিকাকে বাঁচানো। আমি যদি কোনো দাসকে মুক্ত না করেই আমেরিকাকে বাঁচাতে পারি, তাহলে আমি সেটা করব। আবার আমেরিকাকে বাঁচাতে যদি সকল দাস মুক্ত করা লাগে তাহলে সেটাও করব। দাসত্ব এবং বর্ণপ্রথা নিয়ে আমি যা কিছুই করি, আমি বিশ্বাস করি এটি আমেরিকাকে বাঁচাতে সাহায্য করবে। আমি মনে করি এটিই আমার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব কিন্তু আমার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা আছে, সকল জায়গার সকল মানুষ যাতে মুক্ত হতে পারে।
লিংকন আদৌ দাসপ্রথার বিলুপ্তি চেয়েছিলেন কি না এটি ১৮৬৪ সালের পর তার বিভিন্ন পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়। Emancipation Proclamation এর সফলতার জের ধরে এ সময় তিনি সংবিধান সংশোধনে মনোনিবেশ করেন। প্রথমে প্রস্তাবটি সিনেটে পাস হয়, কিন্তু হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হওয়ায় খারিজ হয়ে যায়। ১৮৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে যখন সশস্ত্র বাহিনীর কাছে বিদ্রোহীরা একে একে পরাজয় বরণ করতে থাকে, তখন লিংকন আশঙ্কা করেন যে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আদালত হয়তো Emancipation Proclamation রদ করে দেবে এবং মুক্ত হওয়া দাসেরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। এতে করে তার সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবটি নস্যাৎ হয়ে যাবে, তাই তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই সংশোধনীটি পাস করাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তখন সবেমাত্র লিংকন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন এবং তখনও পূর্বের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে নতুনদের মাঝে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তাই লিংকনের অনেক ডেমোক্রেটদের ভোটেরও প্রয়োজন ছিল, কিন্তু নতুন রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসের অপেক্ষা না করেই তিনি সংশোধনী প্রক্রিয়া শুরু করেন।
প্রস্তাবটি পাস করাতে লিংকনের ফ্রান্সিস প্রেস্টন ব্লেয়ার নামের একজন উচ্চপদস্থ বিদ্রোহী রিপাবলিকান রাজনীতিবিদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল, যিনি তার প্রভাব দ্বারা বিদ্রোহী রাজ্যের রিপাবলিকানদের ভোট আদায় করতে পারতেন। যুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজয় আসন্ন দেখে এবং তার নিজের দুই ছেলে সরকারের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান করেছিল বলে ব্লেয়ার এই শত্রুতা দূর করতে রাজি হন। কিন্তু তিনি লিংকনকে শর্ত দেন যে, এই সমর্থনের বিনিময়ে লিংকনকে বিদ্রোহীদের সাথে শান্তি আলোচনা করতে হবে। লিংকন জানতেন, এই শর্ত উত্তরাঞ্চলের রিপাবলিকানরা মেনে নিতে পারবে না। তারপরও তিনি উদাসীন হওয়া সত্ত্বেও গোপনে এই শর্তে রাজি হন।
ইতিমধ্যে লিংকন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী উইলিয়াম সুয়ার্ড ডেমোক্রেটদের ভোট আদায়ে কাজ করতে থাকেন। লিংকন পরামর্শ দেন যে, তারা সদ্য সাবেক হওয়া ডেমোক্রেট, যারা এখনো ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি তাদেরকে টার্গেট করবেন। কেননা তারা ভোট দিতে বেশি নিরাপদ বোধ করবেন এবং এর বিনিময়ে লিংকন তাদেরকে সরকারি কাজের প্রলোভন দেবেন। যেহেতু লিংকন এবং সুয়ার্ড স্বয়ং তাদেরকে কোনো ঘুষ দিতে পারতেন না, তাই তারা প্রলোভন দেওয়ার জন্য গোপনে কিছু এজেন্টকে নিয়োগ দেন।
৩১ জানুয়ারি, ১৮৬৫ সালে যখন সংশোধনীটি হাউজে ভোটাভুটির জন্য প্রস্তাবিত হয় তখনই লিংকন খবর পান যে বিদ্রোহীরা শান্তি চুক্তি আলোচনার জন্য তার কাছে আসছে। তাই তিনি তাদেরকে ওয়াশিংটনের বাইরে রাখার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু এই খবর হাউজে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন লিংকন দ্রুত একটি চিরকুটে লিখে পাঠান, “যত দূর আমি জানি, শহরে কোনো শান্তি আলোচনাকারী নেই এবং তাদের থাকার কথাও নয়।” এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ভোট শুরু হয়, লিংকনের এতদিনের যোগসাজশই ব্যবধান গড়ে দেয় এবং মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে প্রস্তাবটি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে পাস হয়।
তাই বলা যায় যে, যুদ্ধ যত গড়িয়েছে লিংকনের প্রাধান্যে তত পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে তিনি শুধুমাত্র আমেরিকাকে একত্র করতে চাইলেও যখন তার কাছে সুযোগ এসেছে দাসদের মুক্ত করে এতদিনের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করার, তিনি তার সদ্ব্যবহার করেছেন। এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাকে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
This article is in Bangla language. It's about how Abraham Lincoln abolished slavery by his political prudence.
References:
James Oakes; 2013; Freedom National: The Destruction of Slavery in the United States, 1861-1865; page: 138-143
James McPherson; 1958; Battle Cry of Freedom; page: 356
Richard Carwardine; Lincoln
David Herbert; November 5, 1996; Lincoln
Letter to Horace Greely; Abraham Lincoln; August 22, 1862; The collected works of Abraham Lincoln
Doris Kearns Goodwin; 2005; Team of Rivals: The Political Genius of Abraham Lincoln; page: 687
Lincoln (2012) film
Featured Image: Victoriamedina.com