Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পন্টিয়াক’স ওয়ার: ব্রিটিশ ও আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

আঠারো শতকের কথা। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে নতুন পৃথিবীতে ইউরোপীয় বড় শক্তিগুলো শক্তি পরীক্ষার খেলায় মেতে উঠেছিলো। ফলে আধিপত্যের সীমানা বাড়িয়ে তোলার প্রতিযোগিতা ভয়ানক সব যুদ্ধের অশনি সংকেত দিচ্ছিলো। আর তা বাস্তব হতেও দেরি হলো না।

ইউরোপীয়দের কাছে নতুন এই পৃথিবীর প্রতি লোভ আর তা থেকে তৈরি হওয়া সংঘর্ষ স্থানীয় আদিবাসীদের অস্তিত্বের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

উত্তর আমেরিকা মহাদেশে প্রভুত্ব বিস্তারে ইংল্যান্ডের নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো ফ্রান্স। বিশেষ করে বর্তমান কানাডা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিলো। ১৫২৪ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের আমলে উত্তর আমেরিকায় প্রথম ফরাসি অভিযান পরিচালিত হয়। ১৫৩৪ সাল থেকে জ্যাক কার্টিয়ার ফ্রান্সের পক্ষে উত্তর আমেরিকায় অনেকগুলো অভিযানে নেতৃত্ব দেন। বর্তমান কানাডার কুইবেক অঞ্চল তার অভিযানের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৬৭৩ সালে বর্তমান মিসিসিপি, ইলিনয় ও আরকানসাস অঞ্চলে ফরাসি অভিযান সম্ভাবনার নতুন পথ দেখিয়েছিলো।

উত্তর আমেরিকায় জ্যাক কার্টিয়ারের অভিযান: Image Source: art.com

তবে ফরাসিদের সামনে প্রতিকূলতা নিতান্ত কম ছিলো না। বৈরী পরিবেশ, অপরিচিত আবহাওয়া, আদিবাসীদের আক্রমণ ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় শক্তির সাথে সংঘর্ষ ফরাসি উপনিবেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলো।

উত্তর আমেরিকায় ফরাসি উপনিবেশ হিসেবে নিউ ফ্রান্স বেশ বড় আর গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। মন্ট্রিল, তোয়াঁ-রেভিয়া (Trois-Rivieres), কুইবেক, নিউফাউন্ডল্যান্ড, আকাডি (acadie), প্লাসান্স (Plaisance) এসব এলাকা নিয়ে প্রায় পাঁচটি উপনিবেশ নিয়ে নিউ ফ্রান্স অঞ্চল গঠিত হয়েছিলো। তবে ১৬৮৮ সাল থেকে নতুন মহাদেশে ব্রিটেনের সাথে ফ্রান্সের সক্রিয় বিরোধ শুরু হয়, যা শেষ অবধি যুদ্ধে রূপ নেয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে হওয়া এসব যুদ্ধ ১৭৭৩ সাল অবধি চলছিলো।

যুদ্ধে জয়ের পাল্লা ইংল্যান্ডের দিকে কিছুটা ভারী ছিলো। ফ্রান্স পরাজয়ের ফলে ইংল্যান্ডের কাছে নিউ ফ্রান্স হারালো। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ সেনাপতি জেফ্রি আর্মহার্স্ট মন্ট্রিল দখল করে ফরাসি দখলদারিত্বের কার্যত অবসান ঘটান। তার সামান্য আগে ১৭৫৮ সালে ‘লেনাপে’ ও ‘শ’নি’ (Shawnee) গোষ্ঠীর সাথে ব্রিটিশ শক্তি চুক্তির মাধ্যমে মিত্রতা করেছিলো। এই চুক্তি ‘ট্রিটি অব ইস্টন’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতি ছিলো, ‘লেনাপে’ আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব এলাকা হিসেবে কথিত এলগেনি পার্বত্য এলাকায় তারা কোনো সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করবে না।

উত্তর আমেরিকায় অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ; Image Source: study.com

কিন্তু সেই যুগে যুদ্ধকালীন প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা খুব একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিলো না। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার মতো নতুন ভূখণ্ডে আদিবাসীদের সাথে করা চুক্তির প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে তা আরো বেশি সাধারণ ঘটনা ছিলো। ব্রিটিশরাও সময় ও সুযোগ বুঝে প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করেছিলো।

বিজয়ী ব্রিটিশরা মহাদেশের উত্তর এলাকার ওহাইয়ো ও হ্রদ অঞ্চলে আধিপত্য কায়েম করতে মরিয়া হয়ে উঠলো। পূর্বে এসব এলাকা আদিবাসী ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত ছিল। ফরাসি দখলে থাকার সময় আদিবাসীরা ফরাসিদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিলো। কিন্তু নতুন ব্রিটিশ আধিপত্য তাদের স্বাতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বিজয়ী ব্রিটিশ শক্তি আদিবাসী ওডাওয়া এবং পোটাওয়াটোমি গোষ্ঠীকে পরাজিত হিসেবে ধরে নিয়েছিলো।

বিজয়ী ব্রিটিশ সেনাপতি ফরাসি আধিপত্যের সময় থেকে চলে আসা কিছু নিয়ম রদ করলেন। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের সাথে বাণিজ্য ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিলো। গানপাউডার ও বিস্ফোরক বিনিময় কার্যত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। বিশেষ উৎসবে আদিবাসীদের পাঠানো উপহার সামগ্রী তাচ্ছিল্যের সাথে অস্বীকার করা হয়েছিলো। ব্রিটিশ সৈন্যরা এসব উপহারকে ব্ল্যাকমেইল হিসেবে ধরেছিলো। বন্দুক বাণিজ্য বন্ধ হবার ফলে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ তীব্র বাধার মুখে পড়েছিলো। ব্রিটিশ সেনা অফিসার উইলিয়াম জনসন জেফ্রি আর্মহার্স্টকে এসব নীতি ত্যাগ করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাকে তার একরোখা সিদ্ধান্ত থেকে টলানো কঠিন ছিলো।

ব্রিটিশ নীতির কারণে আদিবাসীদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ জন্ম নিতে লাগলো। বিশেষ করে ডালাওয়ার গোষ্ঠীর ধর্মগুরু নেওলিন আদিবাসীদের এই দুর্দশার কারণ হিসেবে ইউরোপীয় জীবনধারার উপাদানকে দায়ী করতে লাগলেন। তিনি ইউরোপীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য এক বিশেষ জাগরণের ডাক দিলেন। ১৭৬১ সালে ওহাইয়ো অঞ্চলের মিঙ্গো আদিবাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। জনসনের মধ্যস্থতায় সেবারের মতো যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছিলো।

আদিবাসী আমেরিকান ডালাওয়ার গোষ্ঠী; Image Source: canstockphoto.com

তখন আদিবাসী ওডাওয়া গোষ্ঠীর প্রধান নেতা ছিলেন পন্টিয়াক। তিনি ওবানডিয়াং নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৭৬৩ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি বেশ কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠীর বিশিষ্ট সদস্যদের নিয়ে এক সভার আয়োজন করেন। এসব গোষ্ঠীর মধে কিকাপু, ম্যাসকটেন, মায়ামি, পিয়ানকা শ, মিঙ্গো, ওডাওয়া ও পোটাওয়াটামি উল্লেখযোগ্য ছিলো। সভায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের কাছে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানালেন। দখলদারদের কাছ থেকে ডেট্রয়েট দুর্গ ছিনিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করা হলো।

১ মে ৩০০ সশস্ত্র আদিবাসী যোদ্ধা নিয়ে ডেট্রয়েট দুর্গের উদ্দেশ্যে হামলা পরিচালিত হলো। আকস্মিক হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হলেও ব্রিটিশদের পূর্বপ্রস্তুতির জন্য তা বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। ৯ মে দুর্গ অবরোধ ও রসদ সরবরাহ বন্ধের নীতি নেওয়া হলো। ২৮ মে পর্যন্ত এই যুদ্ধনীতি ব্রিটিশদের কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছিলো। এছাড়া এলাকায় বেশ ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিলো। কিন্তু ব্রিটিশদের প্রতিরোধে বাধা দেওয়া যাচ্ছিলো না। উপরন্তু ৩১ জুলাই পন্টিয়াকের ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হলো।

আদিবাসীদের সম্মুখে পন্টিয়াকের বক্তব্য; Image Source: u-s-history.com

আদিবাসীদের আশা ছিলো, ব্রিটিশদের সাথে এই যুদ্ধে ফ্রান্স তাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তা অসম্ভব হবার কারণে অক্টোবরে ডেট্রয়েট দুর্গে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

ফোর্ট ডেট্রয়েটের ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে ইন্ডিয়ানদের অন্যান্য গোষ্ঠীও যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বসে। ১৬ মে ওয়ান্ডন্ট গোষ্ঠীর যোদ্ধারা স্যানডাস্কি দুর্গ পুড়িয়ে দেয়। ২৫ মে সেন্ট জোসেফ দুর্গের পতন হয়। ২৭ মে মায়ামি ফোর্টের কমান্ডার নিহত হলে আদিবাসীরা এর দখল নেয়। ইলিনয় অঞ্চলে ফোর্ট কোয়ান্টন আদিবাসীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জুন মাসের শেষ অবধি ইন্ডিয়ানরা ব্রিটিশদের অনেক দুর্গ দখল করে নেয়।

সাময়িকভাবে আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলো। আর ব্রিটিশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো। উপায়ান্তর না দেখে জেফ্রি আর্মহার্স্ট আদিবাসী বন্দীদের হত্যার হুকুম দিলেন! এদিকে নিয়াগারা দুর্গে আক্রমণ করতে গিয়ে আদিবাসীরা পরাজিত হলো। সাধারণ ব্রিটিশদের মধ্যে আদিবাসী বিদ্বেষ বেড়ে চলছিলো। তাদের হাতে নিরীহ আদিবাসীদের নিহত হবার ঘটনা ঘটতে লাগলো। ‘প্যাক্সটন বয়েজ’ নামের একটি সশস্ত্র ব্রিটিশ সংগঠন আদিবাসী হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলো।

আদিবাসীরা ব্রিটিশ দুর্গ দখল করে নিলো; Image Source: musquetry.blogspot.com

১৭৬৩ সালের আগস্ট মাসে ইংল্যান্ড থেকে আর্মহার্স্টের বদলে মেজর জেনারেল থমাস গেজকে পাঠানো হলো। তিনি যুদ্ধরত আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সন্ধির পদক্ষেপ নিলেন। এছাড়া কিছু গোষ্ঠীর নিজেদের বিরোধকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। ফোর্ট নিয়াগারাতে একটি শান্তি আলোচনা হলো। এর ফলে কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী ব্রিটিশ পক্ষে চলে যায়।

যুদ্ধের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। সশস্ত্র ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্ত্র ত্যাগ করেছিলো। শুধু ইলিনয় অঞ্চলে কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৭৬৪ সালের বিভিন্ন শান্তি আলোচনা অন্যান্য স্থানে বারুদের গন্ধ কমিয়ে এনেছিলো। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশরা কূটনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সংঘর্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পদক্ষেপ নিলো। আদিবাসী ওডাওয়া গোষ্ঠীর নেতা পন্টিয়াককে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে ডেকে আনা হলো।

ইলিনয়ের আদিবাসী গোষ্ঠী শ’নি নেতা শার্লট কাসকে তখন অবধি ছোট আকারে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের সাথে কোনো রকম সন্ধি বা সমঝোতার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি আবারও ফরাসি সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু পন্টিয়াক ততদিনে কঠোর অবস্থান থেকে খানিকটা সরে এসেছিলেন।

১৭৬৬ সালের ২৫ জুলাই। নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের ফোর্ট অন্টারিয়ো।

পন্টিয়াক ও উইলিয়াম জনসন; Image Source: ohiohistorycentral.org

আদিবাসী নেতা পন্টিয়াক ও ব্রিটিশ মুখপাত্র উইলিয়াম জনসনের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। চুক্তি অনুযায়ী পন্টিয়াক ব্রিটিশ উপনিবেশ মেনে নিলেন। আর ব্রিটিশরা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার না করার প্রতিশ্রুতি দিলো।

এই যুদ্ধে দুই পক্ষেরই ব্যাপক পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছিলো। তখনকার রেকর্ড অনুযায়ী, প্রায় ৪০০ ব্রিটিশ সৈন্য ও ২,০০০ সাধারণ অধিবাসী ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে ব্রিটিশদের আক্রমণে আদিবাসীরাও ব্যাপক হারে হত্যার শিকার হয়। সে তুলনায় আদিবাসীদের হতাহতের প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে নিঃসন্দেহে এই সংঘর্ষ উপনিবেশ বিস্তারের বিরুদ্ধে আমেরিকার আদিবাসীদের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

Related Articles