Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি

১৫১৯ সালের শুরুর দিকে কাবুলের অধিপতি বাদশাহ বাবর আবারো হিন্দুস্তানে তাঁর অভিযানের ব্যপারে ভাবতে শুরু করলেন। এবার তিনি হিন্দুস্তান দখলের ব্যপারে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। হিন্দুস্তান দখলের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে তিনি তাঁর জেনারেলদের সাথে পরামর্শ সভার আহ্বান করলেন। সভায় তাঁর জেনারেলরা তাকে পরামর্শ দিলেন-

‘যদি হিন্দুস্তান অভিমুখে রওয়ানা হতে হয়, তাহলে পেছনে কাবুলে যথেষ্ট সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে মূল সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ কাবুলে রেখে যেতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ সেনা বাজৌরে রেখে যাওয়া প্রয়োজন, যেনো কাবুল কোনো হুমকির মুখোমুখি হলে দ্রুত তারা এসে ব্যবস্থা নিতে পারে। লাঘমানে একটি শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী আগে থেকেই মোতায়েন করে রাখা উচিত, যাতে মূল সেনাবাহিনী পৌছানোর পর পরই তারা অভিযান শুরু করতে পারে। কারণ কাবুল থেকে লাঘমান পর্যন্ত যেতে যেতে অশ্বারোহী বাহিনীর সেনা আর ঘোড়া- উভয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।’

বাবর তাঁর জেনারেলদের পরামর্শ মনোযোগের সাথে শুনলেন এবং তাতে একমত হয়ে সেভাবেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করলেন।

বর্তমান সোয়াত উপত্যকার একটি দৃশ্য; Source: dawn.com

১৫১৯ সালের শুরু দিকে বাবর তাঁর সেনাবাহিনীকে বাজৌর (Bajaur) থেকে ভেরা (Bhera) অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। ভেরা বর্তমান ঝিলাম নদীর (Jhelum River) তীরবর্তী একটি স্থান। একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাবর ‘দরিয়া-ই-সিন্দ’ বা সিন্ধু নদের তীরের সোয়াত উপত্যকায় এসে পৌছালেন। এখানে একরাত অবস্থান করে ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরের ভেতরেই বাবর তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে নিরাপদে সিন্ধু নদ অতিক্রম করলেন।

সিন্ধু নদের একটি অংশ; Source: hdfreewallpaper.net

২০ ফেব্রুয়ারী বাবর সেনাবাহিনীসহ কালদা কহারের উদ্দেশ্যে অগ্রযাত্রা করলেন। স্থানটি ভেরা থেকে প্রায় ২০ মাইল উত্তরে অবস্থিত জুদ পার্বত্য এলাকার মাঝামাঝি অবস্থিত। কালদা কহারে একদিন অবস্থান করে পরের দিন আবারো অগ্রযাত্রা শুরু করলেন। যাত্রাপথে হামতাতু নামক একটি জায়গা পড়লো। এখানকার অধিবাসীরা বাবরকে ব্যাপক অভ্যর্থনা জানালো। তবে বাবর হামতাতুতে অবস্থান না করে দ্রুত চির্খের কুরবান নামক স্থানে পৌছালেন। এই স্থানে তাঁর সাথে আবদুল মালি ও মুহাম্মদ খ্বাজাসহ আরো ৭/৮ জন ব্যক্তি দেখা করলেন। তারা সবাই স্থানীয় উপজাতি নেতা ছিলেন। তারা বাবরের প্রতি বিনা শর্তে আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন। বাবর এই স্থান ত্যাগ করে আবারো ভেরা অভিমুখে যাত্রা করলেন।

ভেরার নিকটবর্তী এলাকায় পৌঁছাতেই বাবরের সাথে দেখা করার জন্য হিন্দুস্তান থেকে একটি প্রতিনিধিদল এসে পৌঁছালো। তারা বাবরকে হিন্দুস্তানে দ্রুত অভিযান চালাতে অনুরোধ করলেন, সেই সাথে হিন্দুস্তান অভিযানের জন্য বাবরকে বেশ কিছু ভালো ঘোড়া আর উট প্রদান করলেন।

১৪৫১ সালের ১৯ এপ্রিল দিল্লীর সৈয়দ রাজবংশের শেষ সুলতান আলাউদ্দীন আলম শাহ স্বেচ্ছায় বাহালুল খান লোদির কাছে দিল্লী সালতানাতের দায়িত্ব অর্পণ করে বাদাউনের দিকে চলে যান। দিল্লী সালতানাতের দায়িত্ব থেকে তাঁর এ অব্যহতির সাথে সাথেই পতন ঘটে দিল্লী সালতানাতের সৈয়দ রাজবংশের শাসনের। আর বাহলুল খান লোদির দায়িত্বপ্রাপ্তির মাধ্যমে উত্থান ঘটে দিল্লীর সালতানাতের লোদী রাজবংশের। ৩৮ বছর সফলতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করে বাহলুল লোদি ১৪৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

সুলতান বাহলুল লোদির মৃত্যুর পর ১৪৮৯ সালের ১৭ জুলাই দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর পুত্র নিজাম খান। সিংহাসনে বসে তিনি ‘সিকান্দার লোদি’ উপাধি ধারণ করেন। প্রায় ২৭ বছর শাসন করার পর ১৫১৭ সালে সুলতান সিকান্দার লোদি মৃত্যুবরণ করেন। এসময় দিল্লী সালতানাতের রাজনৈতিক অবস্থা বেশ ঘোলাটে হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। চারদিক থেকে বারবার বিদ্রোহ হচ্ছিলো। তারপরেও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিকান্দার লোদি পাঞ্জাব, জৈনপুর, মধ্য ভারত আর পশ্চিম বিহারে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

সুলতান সিকান্দার লোদির মৃত্যুর পর ১৫১৭ সালে দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ইব্রাহীম খান লোদি। অবশ্য দিল্লীর সিংহাসনে বসে তিনি কোন স্বস্তি পাননি। শীঘ্রই তিনি আফগান জায়গীরদারদের অবাধ্যতার মুখোমুখি হন। ইব্রাহীম লোদি এসব অবাধ্য আফগানদের দমন করার জন্য বেশ নিষ্ঠুর পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ইব্রাহীম লোদি রাজদরবারে আফগান আমিরদের সাথে অশোভন আচরণ করা শুরু করেন। ফলে সুলতানের প্রতি আফগানদের যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট ছিলো, তা-ও চলে যায়। এসময় আফগানরা জোটবদ্ধ হয়ে ইব্রাহীম লোদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। একে একে পাঞ্জাব, বিহার, ঔধ আর জৈনপুরের আফগান জায়গীরদাররা ইব্রাহীম লোদির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। বিহারে দরিয়া খান নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন।

দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লোদি; Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে সিকান্দার লোদির ভাই, অর্থাৎ ইব্রাহীম লোদির চাচা আলাউদ্দীন আলম খান দিল্লী সালতানাতের প্রতি তাঁর দাবী পেশ করতে থাকেন। গুজরাটসহ বেশ কিছু জায়গা থেকে আফগান নেতারা তাঁকে সমর্থন দিলে তিনি দিপালপুরে অভিযান চালিয়ে দিপালপুর দখল করে নেন। এদিকে লাহোরের বিদ্রোহী গভর্নর দৌলত খান লোদি আলাউদ্দীন আলম খান লোদিকে দিপালপুর থেকে পরাজিত করে বিতারিত করেন। দৌলত খান লোদিকে পরাজিত করতে আবার ইব্রাহীম লোদি বাহার খানের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। দৌলত খান লোদি ইব্রাহীম লোদির হাতে পরাজিত হলে লাহোর দিল্লীর অধীনে চলে আসে। উপায় না পেয়ে দৌলত খান তাঁর পুত্র গাজী খানকে কাবুলের দিকে প্রেরণ করেন। অন্যদিকে কোনোভাবেই নিজের অবস্থান শক্ত করতে না পেরে আলাউদ্দীন আলম খানও কাবুলের উদ্দেশ্যে দূত প্রেরণ করেন। তাদের দুজনেরই উদ্দেশ্য কাবুলের সুলতান এসে দিল্লী আক্রমণ করুক! এদিকে কাবুলের বাদশাহ জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর কী ভাবছেন?

বাবর যখন ভেরার কাছাকাছি পৌছান, তখন হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে আলম খান লোদি আর দৌলত খান লোদির প্রেরিত প্রতিনিধি দলটিই বাবরের সাথে দেখা করে হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালানোর অনুরোধ করে আসে। সেই সাথে হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালানোর জন্য তারা বাবরকে কিছু উন্নত মানের ঘোড়া আর উট উপহার হিসেবে দিয়ে আসে!

১৫১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী বাদশাহ বাবর তাঁর সেনাবাহিনীসহ ভেরাতে এসে পৌছান। এইসময় ভেরাতে বেশ কিছু স্থানীয় উপজাতি নেতা বাবরের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। বাবর ভেরাতে দুদিন অবস্থান করে ২৪ ফেব্রুয়ারী খুশাব এলাকার কাছাকাছি পৌছান। ২৬ ফেব্রুয়ারী বাবরের সেনাবাহিনী খুশাবের একটি চমৎকার সমতলভূমিতে অবস্থান নিলেন। তবে এখানে অবস্থানকালে বাবরের সেনাবাহিনী কিছুটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি পড়লো। এই স্থানে হঠাৎ করেই প্রচন্ড বর্ষণে এমন অবস্থা হলো যে, পুরো জায়গাটিই পানির নিচে তলিয়ে গেলো। এতে সেনাবাহিনীর ব্যবহার্য সমস্ত জিনিসপত্রই পানির নিচে চলে যায়। তীব্র পানি প্রবাহের কারণে সেগুলো সংগ্রহ তো দূরের কথা, ঐ স্থানে অবস্থান করাও সম্ভব হচ্ছিলো না। ফলে দ্রুত সেনাবাহিনী নিজেদের জিনিসপত্র ফেলেই স্থান ত্যাগে বাধ্য হলো। দুই দিন পর বৃষ্টি থামলে সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিলো।

বর্তমানে সড়কপথে ভেরা থেকে খুশাবে পৌছাতে মাত্র দেড় ঘন্টারও কম সময় প্রয়োজন হয়; Source: Google Map

সাময়িক এই বিপর্যয়ের পর বাবর ১৫১৯ সালের ১ মার্চ ভেরার দুর্গে অবস্থা নিলেন। সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব পুষিয়ে নেয়ার জন্য বাবর ভেরা থেকে রসদ সংগ্রহ করার নির্দেশ দিলেন। ভেরার জনগন স্বপ্রণোদিত হয়ে বাবরের সেনাবাহিনীর জন্য রসদের জোগান দিলো।

যেকোনো যুদ্ধেই প্রভাবক হিসেবে পাঁচটি মৌলিক ফ্যাক্টর সরাসরি কাজ করে। মোরাল ইনফ্লুয়েন্স বা নৈতিক প্রভাব, আবহাওয়া, যুদ্ধক্ষেত্রের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সেনাপতিদের ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং সেনাবাহিনীর ডক্ট্রিন বা লজিস্টিক অবস্থা। সেনাবাহিনী তখনই কারো জন্য যুদ্ধ করবে, যখন বাহিনীর প্রতিটি সেনা জানবে তারা কোনো নৈতিক কারণেই তাদের জীবনের উপর বাজি ধরতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধাদের কথা আলাদা। যা-ই হোক, এসব কারণেই বাবরের জন্য ভারত আক্রমণের নৈতিক একটি কারণ প্রয়োজন ছিলো। আর সত্যিকার অর্থে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বাবরের কাছে যথাযথ একটি কারণ ছিলোও। বাবর একজন তাইমূরীয় শাসক ছিলেন। তার পুর্বপুরুষ তাইমূর বেগ ১৩৯৮ সালে ভারতে অভিযান চালান। সিন্ধু নদ অতিক্রম করে তিনি তার অভিযান শুরু করে দিল্লী সালতানাতের সীমানা পর্যন্ত চলে আসেন। সে সময় দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে ছিলেন তুঘলক রাজবংশের সুলতানরা। তাইমূরের ভারত অভিযানে দুর্ভাগ্যবশত এত বেশি রক্তপাত হয় যে, তাইমূর খুব ভালোভাবেই বুঝে যান তিনি সরাসরি কখনোই ভারতকে শাসন করতে পারবেন না। তাছাড়া ভারত শাসনে তার ইচ্ছা ছিলো এমন কথাও সমসাময়িক তথ্যসূত্রে পাওয়া যায় না। যা-ই হোক, ভারত ত্যাগের পূর্বে তাইমূর খিজির খান নামক তার অনুগত একজনের কাছে পাঞ্জাবের শাসনভার অর্পণ করে তাঁর রাজধানী সমরকন্দে প্রত্যাবর্তন করেন।

কালের পরিক্রমায়, খিজির খানের উত্তরাধীকারীরা সৈয়দ বংশের অধীনে হিন্দুস্তান শাসন করতে শুরু করেন। সৈয়দ বংশের পরে হিন্দুস্তানের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেন লোদি রাজবংশের সুলতানরা। আর তাই, হিন্দুস্তানকে বাদশাহ বাবর উত্তরাধীকারী সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর বৈধ রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করলেন। বাবর নিজেকে তাইমূরের বৈধ উত্তরাধীকারী দাবী করে ইব্রাহীম লোদির কাছে পাঞ্জাব হস্তান্তর করতে পত্র পাঠান। এ ব্যাপারে বাবর তাঁর আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’-তে উল্লেখ করেন,

‘৩ মার্চ আমার সাথীরা এই মত প্রকাশ করলেন যে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দিল্লী দরবারে বার্তাবাহক পাঠিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য সমর্পণের জন্য বলা হোক।’

৩ মার্চ, ১৫১৯ সাল। তাইমূরের বৈধ উত্তরাধীকারীর নিকট তাঁর রাজ্য শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করা হোক, এমন একটি লিখিত বার্তা দিয়ে দিল্লীর রাজদরবারে বাদশাহ বাবর মোল্লা মুরশিদ নামক একজন বার্তাবাহককে পাঠালেন। কয়েকদিনের ভেতরেই মোল্লা মুরশিদ লাহোরে পৌছালেন। লাহোর থেকে দিল্লীর রাজদরবারে তিনি বাদশাহ বাবরের পত্রটি পাঠালেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইব্রাহীম লোদি বাবরের এই দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেন। কয়েকমাস পর মোল্লা মুরশিদ কোনো উত্তর ছাড়াই বাবরের কাছে ফিরে এলেন। এর ফলে যা হবার তা-ই হলো। বাবর ভারতে অভিযান চালানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী একটি কারণ পেয়ে গেলেন!

 

৪ মার্চ, ১৫১৯ সাল। এইদিন বাদশাহ বাবর কাবুল দুর্গ থেকে পাঠানো একটি বার্তা গ্রহণ করলেন। বার্তায় তাকে জানানো হলো তাঁর আরেকটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। বাবর তাঁর এই পুত্রের নাম রাখলেন হিন্দাল। হিন্দাল নামের অর্থ ‘হিন্দুস্তান বিজেতা’। ‘বাবরনামা’-তে বাবর উল্লেখ করেছেন,

‘যেহেতু সেই সময়ে আমি হিন্দুস্তান বিজয়াভিযানে ছিলাম, সেহেতু সেই অভিযানের সঙ্গে মিলিয়ে আমি তাঁর নাম রাখলাম হিন্দাল।’

পরিণত বয়সে যুবরাজ মির্জা হিন্দাল। তবে ছবিটি আসলেই মির্জা হিন্দালের নাকি, সেটা নিশ্চিত না। এমনকি উইকিমিডিয়া কমন্সে ছবিটির শিরোনামেও একটি প্রশ্নবোধক (?) চিহ্ন দেয়া আছে। Source: Wikimedia Commons

৫ মার্চ, ১৫১৯ সাল। এই দিন বাবর হিন্দু বেগের কাছে ভেরার দায়িত্ব অর্পণ করে সামনে এগোতে থাকলেন। পথে বিভিন্ন স্থানীয় উপজাতিদের পাশ কাটিয়ে এগুতে হচ্ছিলো। কোন কোন উপজাতি স্বেচ্ছায় বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে নিলো। কেউ কেউ আবার বাবরের বাহিনীকে হামলা করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছিলো। যারা এমনটা করলো, তাদের সবাইকে দমন করা হলো।

৯ মার্চ বাবর পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে ঝিলাম নদী পাড়ি দিলেন। কোন বিপদ ছাড়াই সেনাবাহিনী নদী পাড়ি দিতে সক্ষম হলো। এসময় বিভিন্ন উপজাতি থেকে যোদ্ধার দল বাবরের আশেপাশে ভিড় করছিলো। বাবর তাদের যোগ্যতা যাচাই বাছাই করে নিজ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করে নিচ্ছিলেন।

বর্তমান ঝিলাম নদীর একাংশের একটি দৃশ্য; Source: wionews.com

২৬ মার্চ বাবরের বাহিনী শাইকিম নামক স্থানে পৌছালে প্রায় ১০০ জন স্থানীয় নেতা বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে হিন্দুস্তানের ভূখন্ডে বাবরকে স্বাগতম জানান। বাবরের প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রদর্শনের জন্য এসময় তারা বাবরকে করও প্রদান করে।

বাবর এরপর প্রায় বিনা বাঁধায় সামনে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন। তবে বাবরের কিছু বিশ্বস্ত যোদ্ধা যাত্রাপথে অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এদের ভেতরে বাবরের ঘনিষ্ঠ দোস্ত বেগও ছিলেন। দোস্ত বেগের মৃত্যুতে বাবর কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। তবে তিনি অগ্রযাত্রা বজায় রাখলেন। তিনি বিহজাদী নগর হয়ে খ্বাজা-সিহ-ইয়ারান নামক স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যাত্রাপথেই বাবরের সাথে ভেরার প্রশাসক হিন্দু বেগ দ্রুত এসে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি জানালেন, ভেরা আর বাজৌরে ইউসুফজাই উপজাতির লোকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। অগত্যা বাবরকে হিন্দুস্তান অভিযান স্থগিত করে ভেরা আর বাজৌরে সেনাবাহিনী পাঠাতে হলো। তবে তিনি নিজে এই বাহিনীর সাথে গেলেন না। তিনি অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে আগের জায়গাতেই অবস্থান নিলেন।

২৩ মে ১৫১৯ সালে সওয়াদ থেকে মালিক শাহ মনসুর ইউসুফজাইয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাবরের সাথে দেখা করলো। তারা বাবরের প্রতি তাদের পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করলেন। বাবর তাদের মাঝে বাজৌর আর সওয়াদের শাসনভার ভাগ করে দিয়ে রাজস্ব আদায়ের লিখিত অধিকারপত্র প্রদান করলেন। ইতোমধ্যেই ইউসুফজাই উপজাতির বিদ্রোহের তেজ কিছুটা প্রশমিত হয়ে গেছে। কিন্তু বাবরের ভাগ্য এবারো ভালো ছিলো না। তিনি গুপ্তচরদের মাধ্যমে কাবুলের অরাজক পরিস্থিতির সংবাদ পেলেন। এই সংবাদ শোনার সাথে সাথেই তিনি হিন্দুস্তান অভিযান পরিত্যাগ করে কাবুলে ফিরে গেলেন। বাবর আসলে ফারগানা আর সমরকন্দে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে পরিস্থিতির কোন পুনরাবৃত্তি চাচ্ছিলেন না। তাছাড়া হিন্দুস্তান অভিযানে সময় কাবুল বেদখল হয়ে যাওয়া মানে হিন্দুস্তান অভিযানও সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় রূপ নেয়া। তিনি কিছুতেই এমন কোন সম্ভাবনা পেছনে ফেলে হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন না।

কাবুলে ফিরে বাবরকে বিশেষ কিছুই করতে হলো না। কাবুলে তাঁর উপস্থিতিতেই সব বিদ্রোহের সম্ভাবনা দূর হয়ে গেলো। তবে তিনি কাবুলে অলস সময় না কাটিয়ে শাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পদোন্নতি দিলেন। উপজাতি নেতাদের বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রাজস্ব আদায়ের অধিকার প্রদান করলেন। রাজস্ব আদায়ের অধিকার উপজাতি নেতাদের জন্যও লাভবান বিবেচিত হলো। আর বাবরও এর মাধ্যমে কাবুলকে নিরাপদ করতে সক্ষম হলেন। কারণ, বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি হয় এই উপজাতি গোত্রগুলো থেকেই। এখন যখন উপজাতি গোত্রের নেতারা দেখলেন বিদ্রোহ করার চেয়ে বাবরের অনুগত থাকাটাই তাদের জন্য বেশি লাভজনক, তখন তারা নিজেরাই কোন বিদ্রোহের সম্ভাবনা উঁকি দিলেই তা দমন করতে ঝাঁপিয়ে পরতেন। বাবর এক্ষেত্রে একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরিকল্পনাটি কাজে লেগেছিলো।

১৫২১ সালের শুরু দিকে বাবর তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র হুমায়ুনের সাথে দেখা করতে বাদাখশান যান। বাদাখশানে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি কান্দাহারের দিকে অগ্রযাত্রা করেন। তখন পর্যন্ত কান্দাহারের বেশ কিছু এলাকা বিজয় করা হয় নি। তিনি সেসব অবিজিত এলাকাগুলো দখল করে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। ১৯২২ সালের ২০ জুলাই শাহ হাসানের কাছে কান্দাহারের দায়িত্ব দিয়ে কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন।

বাদাখশানের প্রাকৃতিক দৃশ্য; Source: elevation.maplogs.com

একই সালের শেষের দিকে, অর্থাৎ, ১৫২২ সালের শেষের দিকে বাবর আবারো হিন্দুস্তান অভিযানের ব্যপারে ভাবতে লাগলেন। এইসময় বাবরের সাথে আবারো হিন্দুস্তান থেকে দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার খান দেখা করেন। তিনি বাবরকে দ্রুত হিন্দুস্তান আক্রমণের অনুরোধ করতে লাগলেন। বাবর দিলওয়ার খানকে প্রশ্ন করলেন,

‘তোমরা প্রায় ৪০ বছর যাবৎ লোদি বংশের নিমক খেয়েছো। এখন তাদের বিরোধী হয়ে গেলে কেনো?

দিলওয়ার খান কোন ভয়-ভীতি বা বিব্রত হওয়া ছাড়াই নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন,

‘বাদশাহ! আপনার এই প্রশ্নটি খুবই স্বাভাবিক। আমরা হিন্দুস্তানের আমিরেরা দীর্ঘদিন লোদি বংশের নিমক খেয়েছি এটা সত্য। তবে আমরা এখন নিমক হারামির কাজে নেমে পড়িনি। আমরা আমাদের শাহের (ইব্রাহীম লোদি) জুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আজ হিন্দুস্তানের কোন আমিরের মান-সম্মান, ইজ্জত-সম্ভ্রমের আর কোন নিরাপত্তা নেই। আমাদের শাহ ইব্রাহীম লোদি কিছু কুমন্ত্রণাদাতার ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে গেছেন। তিনি আমাদের ন্যায় পুরনো আমিরদের নির্মূল করে আমাদের জায়গায় নতুন আমিরদের বসাতে চাইছেন। আমাদের শাহ বিগত কিছু দিনে প্রায় ২৫ জন আমিরের প্রতি অকারণে রুষ্ট হয়ে শূলে চড়িয়েছেন নয়তো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। কোন আমিরকে কোন কারণে দোষারোপ করা হলে শাহ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ ছাড়াই বিনা তদন্তে তাদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিচ্ছেন। আজ হিন্দুস্তানের কোন আমির আর শাহের অধীনে নিরাপত্তা বোধ করছেন না।’

এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে দিলওয়ার খান আবারো বলেন,

‘আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো আলোর কিরণরুপে আপনাকে আমাদের সাহায্যকারী হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। এ জন্য আমি অন্যান্য আমিরদের নিয়ে আপনার সেবায় উপস্থিত হয়েছি। আপনি আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্য হলেও হিন্দুস্তানে আসুন!’

হিন্দুস্তানের অভ্যন্তর থেকেই এমন অনুরোধ পাওয়ার পর বাবরের আর কোন দ্বিধা থাকার কথা না!

১৫২৩ সালের ১০ নভেম্বর বাবর সেনাবাহিনী নিয়ে আবারো হিন্দুস্তানের দিকে এগিয়ে যান। তিনি ঝিলাম নদী অতিক্রম করে লাহোরের সীমান্তে অবস্থান গ্রহণ করেন। একই সময়ে ইব্রাহীম লোদি বিদ্রোহী দৌলত খান লোদিকে দমন করার জন্য একটি অশ্বারোহী বেলুচ রেজিমেন্ট প্রেরণ করেছিলেন। এই বাহিনীর জেনারেল ছিলেন বিহার খান। তিনি বাবরের অগ্রযাত্রার খবর শুনে দৌলত খান লোদিকে আক্রমণ না করে বাবরকে আক্রমণ করার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেন। সৈয়দপুরের কাছে বাবরের সেনাবাহিনী খুব সহজেই এই বাহিনীটিকে পরাজিত করে। বিহার খান পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেন। বিহার খানের এই বাহিনীর সাথে শিখ ধর্মগুরু গুরু নানক তাঁর অনুসারীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। যুদ্ধে পরাজিত হলে গুরু নানক বন্দী হন। পরে অবশ্য বাবর গুরু নানককে মুক্তি দিয়ে দেন।

ইব্রাহীম লোদির এই বাহিনীটি পরাজিত হলে বাজৌর, ভেড়া, শিয়ালকোট, সৈয়দপুরসহ প্রায় সমগ্র উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব বাবরের পদানত হয়ে যায়। এরপর বাবর লাহোরে প্রবেশ করেন। ইতোমধ্যেই লাহোরে ইব্রাহীম লোদির আরেকটি সেনাবাহিনীর হাতে দৌলত খান লোদি পরাজিত হয়ে বেলুচিস্তানের দিকে সরে যান। লাহোর দুর্গের নিরাপত্তায় ইব্রাহীম লোদির মাত্র ৫,০০০ সৈন্য অবস্থান করছিলো। বাবর খুব সহজেই এই বাহিনীকে পরাজিত করে লাহোরের দখল দিয়ে নেন। বাবর এরপর কিছুদিন লাহোরে অবস্থান করেন। তিনি হিন্দুস্তানে চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে এই দিকটা গুছিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। এ কারণে লাহোরের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি আবদুল আজিজকে লাহোরের দায়িত্ব দেন। এছাড়া খসরু কুকুলদাসকে শিয়ালকোট আর মুহাম্মদ আলী তাজিককে কালানৌরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

১৫২৪ সালের ২২ জানুয়ারী প্রায় বিনা বাঁধায় বাবর দিপালপুর অধিকার করে নেন। দিপালপুরের দায়িত্ব তিনি আলাউদ্দীন আলম খানের উপর ন্যস্ত করেন। এসময় বাবরের সাথে দৌলত খান লোদি দেখা করে পাঞ্জাবের দায়িত্ব নেয়ার ব্যপারে আগ্রহ প্রকাশ করলে বাবর তাকে জলন্ধর আর সুলতানপুরের দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবে দৌলত খান লোদী অপমানিত বোধ করেন। তিনি বাবরের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করলে বাবর তাকে গ্রেফতার করেন। পরে অবশ্য তাকে মুক্তি দিয়ে তাঁর কাছে জলন্ধর আর দিলওয়ার খানের কাছে কাছে সুলতানপুর অর্পণ করেন। এদিকে বাবর আসন্ন যুদ্ধের জন্য শিয়ালকোট আর লাহোরে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করে আরো সৈন্য সংগ্রহের জন্য কাবুল ফিরে যান।

তথ্যসূত্র

১। বাবরনামা- জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

২। হুমায়ুননামা- মূল গুলবদন বেগম (অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ)

৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান

৪। দ্য আর্ট অফ ওয়ার- সান জু (অনুবাদ: মেজর মোঃ দেলোয়ার হোসেন)

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা

২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ

৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল

৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক

৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল

৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল

৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন

৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য

৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র

১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান

১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো

১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে

ফিচার ইমেজ: Pinterest

Related Articles