দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের টানাপোড়েনের মধ্য থেকে সূচনা হয় স্নায়ুযুদ্ধের। আমেরিকা পুরোমাত্রায় পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক, অপরদিকে সোভিয়েত রাশিয়া কমিউনিজমের আঁতুড়ঘর। দুই বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থার মোড়লেরা বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্যের থাবা বিস্তৃত করতে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছিল। শেষপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে, আমেরিকার নের্তৃত্বে বিশ্ব এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করে।
স্নায়ুযুদ্ধ আদতে শেষ হয়েছে কি না, এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। আমাদের এই সময়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য-যুদ্ধ চলছে, সেটিকেও অনেকে স্নায়ুযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কখনও আবার উত্তর কোরিয়া সাথে আমেরিকার সামরিক উত্তেজনা স্নায়ুযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। তাই বলা যায়, আমেরিকার প্রতিপক্ষ হয়তো পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়নি। তবে এ কথা সত্য, সোভিয়েত রাশিয়া যেমন শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল, আমেরিকার সাথে সমানে পাল্লা দিত, আমেরিকার এখনকার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তেমন সামরিকভাবে শক্তিশালী নয়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকার মনে হয়েছিল, আর্কটিক অঞ্চলে একটি 'নিউক্লিয়ার লঞ্চিং সাইট' তাদেরকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ সুবিধা এনে দেবে। কারণ, দূরত্বের স্বল্পতার ফলে সেখান থেকে বিশাল সোভিয়েত রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আঘাত হানতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এ কারণেই প্রজেক্ট আইসওয়ার্মের মতো দুঃসাহসী একটি মিশন হাতে নেয় আমেরিকা।
আর্কটিক অঞ্চলের মধ্যে স্থান নির্বাচন করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। অনেকগুলো বিকল্পের মাঝে পেন্টাগন শেষপর্যন্ত গ্রিনল্যান্ডকেই বেছে নেয়। কারণ, সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। এখানে আগে থেকেই মার্কিন বিমানঘাঁটি ছিল। আর জায়গাটা ও সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে কম আলোচিত হওয়ায় আমেরিকার গোপনীয়তা বজায় রাখতে ছিল সুবিধা হয়েছিল।
নামে গ্রিনল্যান্ড হলেও এখানে কিন্তু মোটেও বনাঞ্চল কিংবা সবুজাভ তৃণভূমি নেই। পুরোটাই বরফাবৃত অঞ্চল। সারা বছর প্রচন্ড ঠাণ্ডা থাকে। তাই এখানে গোপনীয়তা বজায় রেখে 'নিউক্লিয়ার লঞ্চিং সাইট' স্থাপন করা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু দেশটার নাম যে আমেরিকা!
ডেনমার্কের কাছ থেকে আগেই গবেষণার জন্য অনুমতি নিয়ে রেখেছিল আমেরিকা (বলে রাখা ভালো, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল)। নিজ দেশের জনগণ ও গণমাধ্যমের সামনে আমেরিকা প্রচার করে, আর্কটিক অঞ্চলে মাটির নিচে নির্মাণকাজের ব্যাপারে পরীক্ষা চালানো ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য তারা গ্রিনল্যান্ডে গবেষকদল ও সামরিক প্রকৌশলীদের পাঠাচ্ছে।
আমেরিকার জনগণ প্রজেক্ট আইসওয়ার্মের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে ১৯৯৭ সালে, যখন ডেনিশ পার্লামেন্ট একটি তদন্ত রিপোর্ট জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়।
গ্রিনল্যান্ডের 'থুলে' নামক জায়গায় আমেরিকার আগে থেকেই একটি সামরিক বিমানঘাঁটি ছিল। এই বিমানবন্দর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে প্রজেক্টের নির্মাণকাজ শুরু হয়। জায়গাটির নাম দেয়া হয় 'ক্যাম্প সেঞ্চুরি'। দক্ষ মার্কিন ইঞ্জিনিয়াররা সময়ের সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বরফের নিচে বিশাল সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ফেলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। বরফের পৃষ্ঠ থেকে ত্রিশ ফুট নিচে স্থাপন করা এসব সুড়ঙ্গে রেললাইন স্থাপন করা হয়। বিদ্যুতের সরবরাহের জন্য পৃথিবীর প্রথম 'মোবাইল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট' স্থাপন করা হয়, যেটি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা যেত।
স্থাপিত সুড়ঙ্গের মোট দূরত্ব ছিল প্রায় ৫২ হাজার মাইল! সুড়ঙ্গগুলো সবগুলোর একটির সাথে আরেকটির যোগাযোগ ছিল। সব সুড়ঙ্গ মিলিয়ে ছয়শো আন্তঃমহাদেশীয় নিউক্লিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রস্তুত করে রাখা হতো সবসময়। এই মিসাইলগুলোর নাম ছিল 'আইসম্যান'।
শুধু যে সুড়ঙ্গই নির্মাণ করা হয়েছিল, এমনটি কিন্তু নয়। দুইশো সৈন্যের কোয়ার্টার, গবেষণাগার এমনকি থিয়েটারও স্থাপন করা হয়েছিল।
একটু ভাবুন, বরফের পুরু আস্তরণের নিচে বায়ান্নো হাজার মাইল বিস্তৃত সুড়ঙ্গ স্থাপন করেছিল মার্কিন সামরিক ইঞ্জিনিয়াররা। এক মাইল কিংবা দুই মাইল নয়, বায়ান্নো হাজার মাইল, তা-ও আবার বরফের নিচে। সোভিয়েত রাশিয়ার বাড়ির উঠোনেই তুখোড় সোভিয়েত গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে এমন কাজ করা আমেরিকার পক্ষেই সম্ভব বটে!
তবে গণমাধ্যমে প্রজেক্ট আইসওয়ার্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পেন্টাগন যে তথ্য প্রচার করেছিল, তা একেবারেই মিথ্যা ছিল না। মার্কিন গবেষকরা বরফে জমাট বেঁধে থাকা অনেক পুরনো জীবাণু নিয়ে গবেষণা করেছিলেন সেখানে। এছাড়া পারমাণবিক বিক্রিয়া নিয়েও বেশ ভালো গবেষণা হয়েছিল সেখানে।
একটি প্রতিযোগিতায় জেতার পুরস্কার হিসেবে দুজন শিক্ষার্থীকে প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমেরিকান, আরেকজন ডেনিশ। ডেনিশ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ক্রিস্টিয়ান নিয়েলসন, যিনি কি না প্রজেক্ট ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন, তার লেখা চিঠি ও ডায়েরিতে প্রজেক্টের সৈন্যদের জীবনযাপন ও প্রজেক্ট সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। তার মতে, বরফের নিচে থাকা সৈন্যরা পরমাণুর গবেষণার ফলে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে বেশ শঙ্কায় ছিলেন।
কিন্তু এতকিছুর পরও আমেরিকার এই দুঃসাহসিক মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমেরিকা এই মিশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এই ব্যর্থতার পেছনে যেমন প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে, তেমনই রয়েছে রাজনৈতিক কারণও। গ্রিনল্যান্ডের বিশাল বরফখণ্ডগুলো জায়গা পরিবর্তন করছিল। ফলে নির্মিত সুড়ঙ্গগুলোর টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়াও সেখানকার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পেন্টাগনের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না।
ডেনিশ সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ক্রিস্টিয়ান নিয়েলসনের মতে, পুরো মিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেলরা নিজ নিজ পরিকল্পনা মতো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সাজাতে চাচ্ছিলেন। এর ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এদিকে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা সুড়ঙ্গে মিসাইল বসানোর ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব লাভ করতে চাচ্ছিলেন। এ নিয়েও দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এসব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিশন বন্ধ করার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
যা-ই হোক, ১৯৫৯ সালে শুরু করা প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম মাত্র এক দশকের মধ্যেই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় পেন্টাগন। আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই ফেলে আসা হয়, যেগুলো পরবর্তী সময়ে বরফের পুরু আস্তরণে ঢেকে গিয়েছে।
প্রজেক্ট আইসওয়ার্ম বন্ধ করে দেয়ার সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়টি তেমন আলোচিত ছিল না। তাই কোনো কিছু না ভেবেই পারমাণবিক চুল্লীর ভারি পানি, তেজস্ক্রিয় মৌল ফেলে আসা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে করা একটি গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে, চলমান শতকের শেষের দিকে প্রজেক্ট আইসওয়ার্মের ওপরের বরফের স্তর সরে যাবে। ফলে সুড়ঙ্গসহ পুরো প্রজেক্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
তবে কি বরফের স্তর সম্পূর্ণ সরে গেলে সেই সময়ে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে আসা পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন মৌলগুলো প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে? ভাববার সময় কিন্তু এখনই!
This is a Bangla article. This is about Icewrom project, an American military mission during the cold war.
Featured Image: Last Day Club
References:
1. Camp Century
2. When the Pentagon Dug Secret Cold War Ice Tunnels to Hide Nukes
3. Mysterious, ice-buried Cold War military base may be unearthed by climate change
4. Project Iceworm: The Plan to Put Nukes Under The Greenland Ice Sheet
5. Camp Century