অ্যাপ্রাস্কিনকে সরিয়ে দিয়ে জারিনা এলিজাবেথ জেনারেল ফার্মরকে সেনাদলের নেতৃত্ব প্রদান করেন ১৭৫৭ সালের শেষদিকে। ফার্মর পূর্ব প্রুশিয়াতে প্রবেশ করেন প্রায় বিনা বাধায়। ১৭৫৮ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি এখানকার রাজধানী কনিগসবার্গ দখল করে নেন। ফ্রেডেরিক তখনো সিলিসিয়াতে ব্যস্ত, যেখানে তৃতীয় সিলিসিয়ান যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। এর ভেতর ইংল্যান্ডেও চলছে তুমুল বিতর্ক। ক্লস্টার-যেভেন কনভেনশন ইংলিশ পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। হ্যানোভারের প্রতিরক্ষা বাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার চাপিয়ে দেয়া ফরাসি শর্ত ব্রিটিশরা হজম করতে পারেনি। তারা পরিস্কার জানত যে ফরাসিরা যদি হ্যানোভারে দখল বজায় রাখতে সক্ষম হয় তাহলে আমেরিকা আর ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরা যত এলাকাই অধিকার করুক না কেন হ্যানোভারের বিনিময়ে সবই ছেড়ে দিতে হবে।
রোসবাহর যুদ্ধে ফ্রেডেরিকের বিজয় ইংল্যান্ডের নব-উদ্দীপনার সঞ্চার করল। দ্রুতই নতুন করে জার্মানিতে পর্যবেক্ষক সেনাদল গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল ব্রান্সউইকের ফার্দিন্যান্দকে। তিনি নভেম্বর আর ডিসেম্বর জুড়ে এই নতুন বাহিনীর প্রশিক্ষন দিতে লাগলেন। এর মধ্যে ফ্রেডেরিকের সাথে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের নতুন চুক্তির খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ চলতে থাকল। আগের মতোই ইংল্যান্ড নতুন এই পর্যবেক্ষক সেনাদলের খরচ বহনের কথা দিল। ১৭৫৮ সালের এপ্রিলে প্রুশিয়ার স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে প্রতি বছর তারা এজন্য ৬,৭০,০০০ পাউন্ড দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। দুই পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে শত্রুদের সাথে কোনো সন্ধি না করার ব্যাপারেও সম্মত হলো।
হ্যানোভার পুনর্দখল
ফার্দিন্যান্দ ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও কৌশলী সেনাধ্যক্ষ। অস্ট্রিয়ান সাকসেশন যুদ্ধে তিনি তার জাত চিনিয়েছিলেন। ব্যাটল অফ সুরে তার নেতৃত্বেই প্রুশিয়ানরা পাহাড়ে অস্ট্রিয়ানদের উপর আক্রমণ করেছিল, কাকতালীয়ভাবে যাদের কমান্ড করছিলেন তারই বড় ভাই। যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের কাজে সর্বদা ফ্রেডেরিকের সঙ্গী ছিলেন ফার্দিন্যান্দ। ফলে রাজার সাথে তৈরি হয়েছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তার হাতে কমান্ড তুলে দিয়ে তাই ইংল্যান্ড এবং ফ্রেডেরিক দুই পক্ষই নিশ্চিন্ত ছিল।
রিশেঁলিউ বুঝতে পেরেছিলেন নতুন এই সেনাদলকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে না দিলে তারা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বিরাট বাহিনী নিয়ে ফার্দিন্যান্দের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। চতুর ফার্দিন্যান্দ তার আগেই সরে যান। তিনি ৪০,০০০ সেনা নিয়ে নেদারল্যান্ডসের সীমান্তের কাছে রাইন পার হয়ে আসেন। ১৭৫৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি হ্যানোভার শহর কব্জা করেন। নিজের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে ফার্দিন্যান্দ এবার দ্রুত পুরো হ্যানোভার থেকে ফরাসিদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে থাকেন। বিভিন্ন জায়গায় ফরাসি গ্যারিসন তার হাতে হেনস্তা হয়।
সময়টা ছিল বসন্তের শুরু। সবেমাত্র দীর্ঘ শীত কাটিয়ে ফরাসি সেনারা কিছুটা জবুথবু, তাদের রসদপত্রও কমতির দিকে। ফলে ফার্দিন্যান্দের চকিত হামলার জবাব তাদের কাছে ছিল না। দেখতে দেখতে বিস্তীর্ণ এলাকা ফার্দিন্যান্দের অধিকারে চলে আসে, সেখানে সেনাঘাঁটি বানিয়ে তিনি হ্যানোভারের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন।২৩ জুন ক্রেফেটে লুই দ্য বুর্বনের ৭০,০০০ সেনা তার হাতে নাকাল হয়। দক্ষিণের এলাকাতে কিছু সাফল্য পেলেও মোটের উপর ফার্দিন্যান্দের আক্রমণ হ্যানোভারে ফরাসিদের চোখের জল-নাকের জল এক করে দেয়। সব মিলিয়ে এখানে তার ২০০ সেনার বিপরীতে ফরাসিদের ক্ষতি হয় ১৬,০০০ সেনা। ফরাসি সেনাবাহিনীর মনোবলও ভেঙে খানখান। অন্যদিকে শত্রুপক্ষ আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর।
ফার্দিন্যান্দের সফলতার পর ব্রিটিশরা এই বাহিনীর নাম দিল হিজ ব্রিটানিক ম্যাজেস্টিজ আর্মি। ৩রা অগাস্ট সর্বপ্রথম ছয়টি ব্রিটিশ অশ্বারোহী এবং পাঁচটি ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট জার্মানির মাটিতে পা রাখে এই বাহিনীতে যোগ দিতে। ইতোমধ্যে ফরাসিরা হ্যানোভারে সমস্ত দখল হারিয়েছে। ফলে একে পুঁজি করে প্রুশিয়ার পশ্চিমে আঘাত করার সুযোগ আর নেই। যুদ্ধের বাকি সময় এই অবস্থা বজায় ছিল। হ্যানোভারে শত্রুদের মোকাবেলায় অনেক সেনা মোতায়েন থাকায় ইউরোপের বাইরে ব্রিটিশদের সাথে লড়াইতেও ফরাসিরা যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্য পাঠাতে পারছিল না।
মধ্য ইউরোপের পরিস্থিতি
অস্ট্রিয়ানরা সিলিসিয়ার শোয়াইডনিতজে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছিল। ১৭৫৮ সালের মধ্য এপ্রিলে ফ্রেডেরিক সেই ঘাঁটি দখল করে নেন। এরপর ঢুকে পড়েন মোরাভিয়াতে। এর প্রধান শহর ওল্মুতজ অবরোধ করে তিনি প্রত্যাশিত সাফল্য পেলেন না। উল্টো জুন মাসে অস্ট্রিয়ান হামলায় তার রসদ সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তরে পোমেরানিয়াতে সুইডিশ হামলা প্রতিহত করছিলেন জেনারেল লেভাল্ট। অন্যদিক থেকে জেনারেল ফার্মরের অধীনে রাশান সেনারা এগিয়ে আসছিল। তারা ১৫ অগাস্ট কুস্ট্রিন অবরোধ করে। সুতরাং ফ্রেডেরিক অবরোধ উঠিয়ে রাশানদের মোকাবেলা করতে মনস্থ করলেন।
ব্যাটল অফ জন্দোর্ফ (Zorndorf)
অডার (Oder) নদী ধরে ফার্মরের আসবার সংবাদ ফ্রেডেরিকের কাছে পৌঁছলে ১১,০০০ সৈন্য নিয়ে ফ্রেডেরিক রওনা হলেন। বাকিদের রেখে গেলেন সিলিসিয়াতে অস্ট্রিয়ানদের প্রতিরোধ করতে। অডারের কাছেই ছিল ২৬,০০০ প্রুশিয়ান সেনার এক রেজিমেন্ট, যা পরিচালনা করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডোহ্না। তার সাথে একত্রিত হয়ে জন্দোর্ফ গ্রামের সামনে ফার্মরের বিপক্ষে অবস্থান নিলেন ফ্রেডেরিক।
২৫ আগস্ট ছিল লড়াইয়ের দিন। ফার্মরের ৪৩,০০০ সেনা ক্যাম্প করেছিল জলাভূমির ধারে, চারিদিকে পাহাড় তাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষা দিচ্ছে। ফ্রেডেরিক সকাল নয়টার সময় প্রথমে দক্ষিণ দিক থেকে মার্চ করে ফার্মরের পেছন দিকে হামলা করতে চাইলেন। রাশান জেনারেল চট করে ফ্রেডেরিকের ফন্দি বুঝে তার সেনাদের ঘুরে যেতে আদেশ করলেন, ফলে তারা অগ্রসরমান প্রুশিয়ানদের মুখোমুখি হয়ে গেল। ফ্রেডেরিক এবার অন্য রাস্তা ধরলেন। তিনি ফন্দি আঁটলেন দুই পাশ থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের। প্রুশিয়ান কামান মুহুর্মুহু রাশিয়ান লাইনে গোলা ফেলতে লাগল।
সকাল এগারটার দিকে প্রুশিয়ানরা রাশিয়ানদের ডান বাহুতে হামলা করে বসে। রাশান প্রতিআক্রমণ তাদের ঠেলে দিল নিজ বাহিনীর মধ্যভাগের দিকে। পরিস্থিতি ফ্রেডেরিকের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেডলিটজ তার অশ্বারোহী সেনাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিতে রাশানদের থামাতে সক্ষম হলেন। প্রুশিয়ান ডান বাহু এবার এগোতে শুরু করল যাতে রাশানদের বাম পাশ থেকে ঘিরে ধরা যায়। কিন্তু এতে তেমন কোনো সফলতা এলো না। বরং দুই পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে সংঘর্ষ চলে, অন্ধকার নেমে এলে দুই পক্ষই ক্ষান্ত দেয়। রাশিয়ানরা প্রথমে পিছিয়ে যায়, এরপর প্রুশিয়ানরা। রাশান হতাহত ছিল ১৯,০০০, ফ্রেডেরিকের ১৩,০০০। পরের দিন কোনো পক্ষই যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় ছিল না। তারা মুখোমুখি ক্যাম্প করেই পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়।
ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধকে অমীমাংসিত বলে বিবেচনা করেন। তবে ফ্রেডেরিকের ক্ষতি তুলনামূলক বেশি ছিল, রাশানদের মতো লোকবল ছোট্ট প্রুশিয়ার ছিল না। ফলে এত হতাহতের স্থান পূরণ করা ছিল দুঃসাধ্য। তবে ফ্রেডেরিক দমলেন না। ফার্মর ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যেতে থাকলে তিনি ডোহ্নাকে পাঠালেন কিছুদূর ধাওয়া দিতে। নিজে আবার মনোযোগ দিলেন অস্ট্রিয়ানদের প্রতি।
ব্যাটল অফ হহকার্শ (Hochkirch)
স্যাক্সোনিতে ফ্রেডেরিকের ভাই হেনরি তখন অস্ট্রিয়ান ফিল্ডমার্শাল ডন কর্তৃক অবরুদ্ধ। ফ্রেডেরিক তাকে সহায়তা করছে আসছেন শুনে ডন পিছিয়ে আসেন। পাঁচ সপ্তাহ ইঁদুর বিড়াল খেলা শেষে ফ্রেডেরিক হহকার্শ আর কদিৎজ গ্রামে এসে তাঁবু ফেললেন। তার সাথে ৩২,০০০ সেনা, যা ডনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। তবে তিনি ধারণা করছিলেন এখানে হয়তো ডন আক্রমণ করবেন না। ডন ঠিক তা-ই করে বসলেন।
১৪ অক্টোবর ভোর তিনটা থেকে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। পাঁচটার দিকে যখন অস্ট্রিয়ানদের মূল বাহিনী প্রুশিয়ানদের উপর আঘাত শুরু করে তখনও তারা পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারেনি। প্রুশিয়ান ডান বাহু হহকার্শ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। একই সময়ে বাম বাহু প্রবল আঘাতে পিছিয়ে আসতে থাকলে অস্ট্রিয়ানরা পার্শ্ববর্তী কদিৎজ গ্রাম দখল করে নেয়। এই সাফল্যের বিনিময়ে অস্ট্রিয়ানদের প্রচুর সেনা নিহত হয়, তাই ডন পলায়নরত শত্রদের পিছু ধাওয়া করতে পারেননি। ফলে প্রুশিয়ানরা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করে সিলিসিয়াতে ফিরে যেতে সক্ষম হলো। ফ্রেডেরিক হারালেন ৯,০০০ এর মতো সেনা আর ১০১টি কামান। জিতলেও মার্শাল ডন ৯,০০০ সৈন্য হারিয়ে বেশ ভাল রকম ক্ষতির সম্মুখিন হন।
বছরের সমাপ্তি
ডন এরপর ড্রেসডেনে প্রুশিয়ান শিবির ঘিরে ফেলেন। কিন্তু ফ্রেডেরিক দ্রুত আরেকদল সেনা নিয়ে তার দিকে অগ্রসর হলে তিনি ফিরে যান সুরক্ষিত পির্না নগরীতে। ১৭৬৮ সালের ক্যাম্পেইন এই পরিস্থিতিতেই শেষ হয়। ফ্রেডেরিক নিজের ক্ষতি গণনা করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিন বছরের যুদ্ধে এক লাখের বেশি অভিজ্ঞ প্রুশিয়ান সেনা হতাহত হয়েছে। তার বিরুদ্ধপক্ষের জনসংখ্যা মিলিতভাবে একশ মিলিয়নেরও বেশি, প্রুশিয়ার মানুষ হবে টেনেটুনে পাঁচ মিলিয়ন। তবে তিন পরাশক্তির বিপরীতে ফ্রেডেরিক এখনও টিকে আছেন, যা ইউরোপীয় রাজাদের সামনে প্রুশিয়ার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করে।
This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.
References
- Abbott, J. S. C. (1882). The history of Prussia. New York, Dodd, Mead, and company.
- Marston, D. (2013). The Seven Years' War. Botley. Oxford: Osprey Publishing Limited.
- Seven Years War. Encyclopedia Britannica
Feature Image © Military Art