বিসমার্ক আর তার চীফ অফ জেনারেল স্টাফ মল্টকে কখনোই স্লেশউইগ-হোলস্টেইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দিতেন না। কারণ খুব সহজ। স্বাধীন স্লেশউইগ-হোলস্টেইন হাবসবুর্গ প্রভাব বলয়ে চলে গেলে প্রুশিয়ার উত্তর সীমান্ত অরক্ষিত হয়ে যায়। ফলে প্রথম থেকেই এই লড়াইতে বিসমার্কের উদ্দেশ্য ছিল দুই ডাচি প্রুশিয়ার অধিকারে নিয়ে আসা। এই যুদ্ধে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য ছিল, সেটি হলো সেনাবাহিনীর ব্যাপারে বিসমার্কের খবরদারি। বিসমার্ক বিশ্বাস করতেন সেনাবাহিনী কাজ করবে রাষ্ট্রের স্বার্থে, রাজনীতিবিদদের অধীনে। এ কারণে তিনি যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন সেনা অফিসারদের প্রশাসন থেকে দূরে রেখেছেন সবসময়, এবং যুদ্ধের ব্যাপারেও নিজের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। বিসমার্কের প্রথম এবং একমাত্র লক্ষ্য জার্মানির একত্রীকরণ এবং একে মধ্য ইউরোপের প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা। এ কাজে কূটনীতির উপরেই তিনি বেশি ভরসা করতেন।
ড্যানিশ প্রতিরক্ষা
জার্মানির দিক থেকে আগ্রাসন ঠেকাতে ডেনমার্কের পরিকল্পনা ছিল ডেনভির্ক বরাবর সেনা মোতায়েন করে শত্রুদের সেখানেই আটকে দেয়া। ডেনভির্ক কেন্দ্র করে তখন উত্তর ইউরোপের সবথেকে বড় প্রতিরক্ষা প্রাচীর অবস্থিত। উত্তর সাগর আর বাল্টিকের মাঝে ১৯ মাইল লম্বা এই মাটির প্রতিরক্ষা দেয়ালের উপর ড্যানিশদের ছিল অতিরিক্ত ভরসা। ১৮৬১ সাল থেকে ডেনভির্ক, ডুবেল আর ফ্রেডেরিসিয়ার দুর্গে কিছু কাজও করা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। ড্যানিশ সেনাবাহিনীতেও বিভিন্ন অফিসারদের দায়িত্ব সুচারুরূপে ভাগ করা ছিল না, তদুপরি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগও ছিল দুর্বল। ১৮৬২ আর ১৮৬৩ সালে ড্যানিশ সেনারা ডেনভির্কে মহড়া দেয়, তবে তা ছিল শুধুই প্রতিরক্ষামূলক।
ডেনভির্কের পূর্বে শ্লেই প্রণালী, যা স্লেশউইগকে পৃথক করে রেখেছে জাটল্যান্ড থেকে। পশ্চিমে জলাভূমি। ড্যানিশ সমরবিদদের ধারণা ছিল এই দুই অংশ প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত।ফলে সেদিকে তারা খুব বেশি সেনা মোতায়েন করলেন না।
১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে ড্যানিশ সেনাদলের সর্বাধিনায়ক হলেন জেনারেল ডি মেজা। জার্মানির সাথে লড়াইয়ের সম্ভাবনায় ড্যানিশ কম্যান্ড সেনাবাহিনীর হোলস্টেইন ইউনিটকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে সংরক্ষিত সেনা ডেকে পাঠাল। স্লেশউইগ ইউনিটেও উত্তেজনা দেখা দেয়। ১৮৬৪ সালের জানুয়ারিতে শীতের মধ্যে ড্যানিশরা ডেনভির্কে অবস্থান নেয়। তাদের সমরপরিকল্পনা ছিল যাচ্ছেতাই। শীতের কারণে তখন অনেক প্রণালী বরফে আচ্ছাদিত, ফলে শত্রুরা ইচ্ছা করলে সহজেই সেদিক দিয়ে পাশ থেকে তাদের আক্রমণ করতে পারে। যদি এই অবস্থান থেকে পিছিয়ে যেতে হয় তাহলে কি করতে হবে সেরকম কোনো বিকল্প পরিকল্পনাও করা হয়নি। সেনাদের সাহায্যের জন্য ছিল না সংরক্ষিত বাহিনীও।
যুদ্ধের সূচনা
অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যৌথ বাহিনীর কম্যান্ডার প্রুশিয়ান ফিল্ডমার্শাল র্যাঙ্গেল। আশি বছরের এই বৃদ্ধ সাধারণ মানের একজন জেনারেল, তার অযোগ্যতায় বিরক্ত বিসমার্ক পরে মে মাসে তাকে অপসারণ করেন। বেশ কিছু সংস্কারের পর প্রুশিয়ান বাহিনীর এটা ছিল প্রথম যুদ্ধ, ফলে সেনাদেরও জড়তা ছিল। সেদিক থেকে অস্ট্রিয়ানরা ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং দক্ষ।
৩১ জানুয়ারি র্যাঙ্গেলের তরফ থেকে স্লেশউইগে ড্যানিশ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি পাঠানো হলে ডি মেজা তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরের দিন দলে দলে অস্ট্রিয়ান আর প্রুশিয়ান সৈন্য স্লেশউইগে ঢুকে পড়ল। তারা অগ্রসর হল ডেনভির্কের দিকে। একদল গেল ড্যানিশ মধ্যভাগে আক্রমণ করতে, আরেকদল রওনা দিল শ্লেইয়ের দিকে। শ্লেই শীতে বরফ হয়ে যাবার ফলে এর উপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়া সম্ভব। পরিকল্পনা ছিল সেদিক থেকে ডেনভির্কের পার্শ্বভাগে ঝাঁপিয়ে পড়া।
ব্যাটল অফ মিজন্ডা
ডেনভির্কের একপ্রান্তে মিজন্ডা ((Mysunde) গ্রামের দুর্গ, শ্লেই প্রণালির তীরে। এখানের প্রতিরক্ষা অন্যান্য স্থানের থেকে দুর্বল হওয়ায় প্রুশিয়ান কম্যান্ড মিজন্ডা দিয়েই শ্লেই পার হবার চিন্তা করেছিল। এর কাছেই ডেনভির্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে কচেনডর্ফ দখল করে ফেব্রুয়ারির দুই তারিখ সকালে তারা মিজন্ডার নিকটে এসে পৌঁছে। পথিমধ্যে ড্যানিশ চৌকি তছনছ করে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে প্রুশিয়ানরা যখন এগিয়ে আসছিল তখন দুর্গ থেকে ক্যাপ্টেন আর্নটজ একদল সেনা নিয়ে রেকি করতে গেলেন। তাদের ধারণা ছিল এটি হয়তো প্রুশিয়ানদের কোনো ছোট বাহিনী। কিন্তু প্রুশিয়ানদের সাথে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর তিনি উপলব্ধি করলেন এটাই মূল বাহিনী।
ড্যানিশরা দুর্গে অবস্থান নিল। প্রুশিয়ানদের বিরুদ্ধে কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে প্রতিবারেই তাদের পিছিয়ে আসতে হয়। এদিকে দুপরের দিকে প্রুশিয়ান আর্টিলারি এসে পৌঁছলে হাউইৎজার আর অন্যান্য কামানের তোপে ড্যানিশ প্রতিরক্ষা কেঁপে উঠে। দুর্গ থেকে ড্যানিশ কামানও জবাব দিতে থাকে। কিন্তু কুয়াশার কারণে কেউই ঠিকভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারছিলনা। এর মধ্যেই প্রুশিয়ানরা চেষ্টা করল সরাসরি দুর্গে হামলা চালাবার। তবে শক্ত বাধার মুখে তারা ব্যর্থ হয়। প্রুশিয়ান কম্যান্ডার বুঝতে পারলেন এই দুর্গ দখল করতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই তিনি সেনাদের নিয়ে সরে আসেন। মিজন্ডাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষয়ের কোনো কারণ তিনি দেখতে পেলেন না। এই সংঘর্ষে ডেনমার্কের প্রায় ১৫০ এবং প্রুশিয়ার ২০০ লোক নিহত হয়।
৩ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রিয়ানরা ডেনভির্কের সামনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে নেয়। ড্যানিশ কমান্ডারেরা ভাবলেন শত্রুরা এবার নতুন করে শ্লেই অতিক্রমের চেষ্টা করবে।একবার তারা প্রুশিয়ানদের ঠেকিয়েছেন, কিন্তু দ্বিতীয়বারেও পারবেন কিনা সেই সংশয় ছিল।
ডেনভির্ক থেকে ড্যানিশ পশ্চাদপসরণ
৪ তারিখ হাই কমান্ডের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো ডেনভির্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে ৫-৬ তারিখ জুড়ে ড্যানিশরা ডেনভির্ক ছেড়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। ডি মেজা কোপেনহেগেনে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে যোগাযোগ কেটে দেন, তার ভয় ছিল সেখান থেকে তাকে বাধা দেয়া হতে পারে।
ডেনভির্ক থেকে ডেনমার্কের পিছিয়ে আসায় জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কোপেনহেগেনে রাজনীতিবিদদের মধ্যেও প্রচণ্ড অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, ফলে ডি মেজাকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ জারি হলো। এদিকে ৬ ফেব্রুয়ারি ফ্লিন্সবোর্গের কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে অস্ট্রিয়ানরা ড্যানিশদের একাংশের নাগাল পেলে তুমুল সংঘাত বেধে যায়, তবে ড্যানিশরা নিরাপদে পিছিয়ে যেতে সক্ষম হলো।
ড্যানিশ সমরবিদেরা ঠিক করলেন সেনাদের ভাগ করে ডুবেল, ফ্রেডেরিসিয়া আর স্লেশউইগ-ডেনমার্ক সীমান্তের শহর কল্ডিংয়ে রাখা হবে। তারা শত্রুদের জাটল্যান্ডে প্রবেশের মুখে আটকে দেবার চেষ্টা চালাবে।এদিকে প্রুশিয়ান বাহিনীর একদল গেল ডুবেলের দিকে, আরেকদল অস্ট্রিয়ানদের সাথে মিলে যাত্রা করল কল্ডিং বরাবর। কিন্তু অস্ট্রিয়ানরা কল্ডিংয়ে হামলা করতে দ্বিধা করছিল, কারণ কল্ডিং ডেনমার্কের মূল ভূখণ্ডে। ডেনমার্কের সাথে দ্বন্দ্ব ডাচি নিয়ে, সুতরাং তাদের মূল সীমান্ত অতিক্রম করা ঠিক হবে কিনা সেটা অস্ট্রিয়ানদের চিন্তা ছিল। আবার এরকম একটা ভয়ও আছে যে তেমন হলে ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলি আগেবারের মত ডেনমার্কের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
কিন্তু ড্যানিশ বাহিনীর বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয় তখন নেই বললেই চলে। একেক জায়গা থেকে একেকরকম আদেশ আসছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে কল্ডিং থেকে ড্যানিশ সেনার পিছিয়ে গেলে প্রুশিয়ান কিছু সৈন্য শহরে ঢুকে পড়ে। পরাশক্তিগুলো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালে মূল অস্ট্রো-প্রুশিয়ান বাহিনী সতর্কভাবে শহর দখল করে নেয়।
৮ মার্চ কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর ড্যানিশ সেনাবাহিনী জাটল্যান্ডের মধ্য দিয়ে উত্তরদিকে পিছিয়ে যেতে থাকে। তাদের পরিকল্পনা ছিল কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে নিজেদের সংগঠিত করে পুনরায় অস্ট্রো-প্রুশিয়ান সেনাদের উপর ঘন ঘন আঘাত করা। এভাবে শত্রুরা নিজেদের ঘাঁটি শক্তিশালী করবার আগেই তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হবে। কিন্তু ড্যানিশরা পেছাতে পেছাতে এত পিছিয়ে গিয়েছিল যে শত্রুরা জাটল্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তে মার্চের মাঝামাঝিতে শক্ত হয়ে বসে যায়। এখান থেকে ফ্রেডেরিসিয়ার দিকে রসদ চলাচল বন্ধ করে দেয়া সম্ভব ছিল, আবার প্রয়োজনে ডুবেলের দিকে অগ্রসরমান বাহিনীকে সহায়তায় সেনাও প্রেরণ করা যেত। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের ভেতরে ডুবেল আর ফ্রেডেরিসিয়া শত্রুদের দ্বারা এমনভাবে বেষ্টিত হয়ে যায় যে সেখান থেকে আক্রমণ করবার অবস্থা ছিল না।
ব্যাটল অফ ডুবেল
দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধের প্রধান যুদ্ধ সংঘটিত হয় ডুবেলে। কৌশলগতভাবে ডুবেল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডুবেলের দুর্গ এমন এক জায়গায় যার পেছনে আলসুন্ড প্রণালী, ঠিক তার ওপারেই জন্ডেবোর্গ (Sønderborg) শহর। দুর্গের পেছনে ছিল ফেরিঘাট, আর আলসুন্ডের উপর দিয়ে সেতু। জন্ডেবোর্গ ছিল আলস দ্বীপের অন্যতম নগরী। সুতরাং ডুবেলের পতন ঘটলে আলস প্রুশিয়ানদের নাগালে চলে আসবে।
অবরোধের মাধ্যমে দুর্গের পতন ঘটানো সম্ভব। কিন্তু তাতে দীর্ঘ সময় দরকার। মিজন্ডার পর বিসমার্কের কাছে দ্রুত একটি চটকদার বিজয় খুব জরুরী হয়ে উঠেছিল। প্রুশিয়ান সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশও এর উদ্দেশ্য।সেজন্য ডুবেলে সরাসরি হামলার আদেশ জারি করা হয়। যদিও ডুবেলের প্রুশিয়ান কম্যান্ডার প্রিন্স ফ্রেডেরিক চার্লস এবং তার অফিসাররা এতে খুশি ছিলেন না, কারণ এর ফলে প্রচুর প্রুশিয়ান সেনার রক্ত ঝরবে। অন্যদিকে অবরোধ জারি করলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতিতেই হয়ত ড্যানিশদের বশ করা যেত।
এপ্রিলের ২ তারিখ থেকে প্রুশিয়ানরা ডুবেলে গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল কামান দেগে ড্যানিশদের মনোযোগ সরিয়ে রেখে জুন্ডেফট (Sundeved) উপদ্বীপের দিক থেকে আলসে ঢুকে পড়া। জুন্ডেফট পূর্বে আলসুন্ড আর জন্ডেবোর্গের পশ্চিমাঞ্চলের সাথে যুক্ত। ফলে সেদিক দিয়ে ডুবেলের পেছনে আঘাত হানা সম্ভব। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া জুন্ডেফট পার হতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে ৩ এপ্রিল এই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। এবার প্রুশিয়ানরা কামানের ছত্রছায়ার নিজেদের দিক থেকে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে খুঁড়তে ড্যানিশ অবস্থানের দিকে আগাতে থাকে। দুই সপ্তাহের মাথায় তারা ড্যানিশদের প্রায় ঘাড়ের উপরে এসে পড়ল। বলা হয় এই সময় প্রুশিয়ান আর্টিলারি প্রায় ৬৫,০০০ গোলা ছুড়েছিল।
ড্যানিশদের উপর সরাসরি হামলার জন্য আরো সৈন্য নিয়ে আসা হলে ১৬ এপ্রিল প্রুশিয়ানদের সংখ্যা দাঁড়াল ৪০,০০০, যা ড্যানিশদের থেকে বেশি। প্রুশিয়ানদের অব্যাহত কামানের তোপে ড্যানিশদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। কোনোদিকে থেকে সাহায্য না পেয়ে তাদের অবস্থা সঙিন হয়ে দাঁড়ায়। আলসুন্ড অতিক্রম করে জন্ডেবোর্গ থেকে যাতে অতিরিক্ত সেনা না আসতে পারে সেজন্য সেদিকেও প্রুশিয়ান কামান তাক করা ছিল। এদিক আলসুন্ডে ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজ রলফ ক্রেক (Rolf Krake) থাকলেও তারা সেখান থেকে প্রুশিয়ানদের উপর গোলা মেরে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছিল না।
১৮ এপ্রিল, ভোর চারটা।
ড্যানিশ ট্রেঞ্চে সৈনিকেরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। বেশ অনেকক্ষণ কামানের আওয়াজ নেই। কয়েকজনের তো চোখ মুদে আসছিল প্রায়। হঠাৎ কমান্ডারের ইশারায় সৈনিকেরা সচকিত হয়ে উঠল। দূরে কামান গর্জে উঠেছে।
দিগন্ত ঢেকে দিয়ে ড্যানিশ অবস্থানে আছড়ে পড়তে লাগল মুহুর্মুহু গোলা। আকাশ লালচে হয়ে গেল আগুনের তোপে। অন্য যেকোনো দিনের থেকে এদিন প্রুশিয়ান আর্টিলারি আঘাত ছিল অনেক বেশি। ছয় ঘণ্টা প্রচণ্ড আক্রমণ চলবার পরে ড্যানিশ প্রতিরক্ষা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। কামান থেমে গেলেও কিন্তু অবসর মিলল না। ড্যানিশরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দক্ষিণ দিক থেকে দলে দলে প্রুশিয়ান সৈন্য বেয়োনেট উঁচিয়ে ছুটে আসতে থাকে।
ট্রেঞ্চে থাকা ড্যানিশ সেনারাও মরণপণ লড়াই করল, কিন্তু প্রুশিয়ানদের সংখ্যাধিক্যে তারা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এমন সময় নতুন করে প্রুশিয়ানরা গোলাবর্ষণ শুরু করে ড্যানিশ অবস্থানের পেছনে, কারণ আলসুন্ড থেকে অতিরিক্ত কিছু সেনা এগিয়ে আসছিল। তারা পালিয়ে আসা সেনাদের নিরাপদে সরে যাবার সুযোগ দিতে প্রুশিয়ানদের উপর পাল্টা হামলা চালিয়ে বসে। কিন্তু এতে ড্যানিশদের ভয়াবহরকম ক্ষয়ক্ষতি হলো। দুপুর দুটোর মধ্যে সর্বশেষ ড্যানিশ সৈন্যও আলসুন্ড অতিক্রম করে চলে গেলে ডুবেল প্রুশিয়ার দখলে চলে আসে।এই লড়াইয়ে ১,২০০ প্রুশিয়ান সেনা মারা যায়, কিন্তু কেউ বন্দি হয়নি। ১,৭০০ ড্যানিশ সেনা নিহত হয়, যাদের অনেকেই ছিল অফিসার পদমর্যাদার। ৩,০০০ এর মত বন্দি হলো।
ডুবেলের যুদ্ধই ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ যেখানে রেড ক্রসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
হেলিগোল্যান্ডের যুদ্ধ
প্রথম স্লেশউইগ যুদ্ধের মতো দ্বিতীয় যুদ্ধেও বাল্টিকে ড্যানিশ নৌবাহিনী উত্তর জার্মানির বন্দরগুলির উপর অবরোধ জারি করে। ছোট্ট প্রুশিয়ান নৌবাহিনী তাদের কোনো বাধা দিতে পারেনি। ১৭ মার্চ রুগেন দ্বীপের কাছে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।তবে রেলপথের বিস্তৃতির কারণে এই অবরোধ জার্মানদের উপর আগেরবারের মতো কার্যকর হয়নি।
এর মধ্যে ড্যানিশ সেনাবাহিনী নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হলো। অ্যাড্রিয়াটিক থেকে অস্ট্রিয়ান জাহাজ এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এপ্রিলে দুটি অস্ট্রিয়ান ফ্রিগেট উত্তর সাগরে ঢুকে পড়ে, তাদের সাথে তিনটি প্রুশিয়ান গানবোট যোগ দেয়। ৯ মে ব্রিটিশ অধিকৃত হেলিগোল্যান্ড দ্বীপের কাছে তিনটি ড্যানিশ জাহাজ এই ছোট বহরের মুখোমুখি হয়। সবগুলো জাহাজই ছিল কাঠের, চলছিল স্টিম ইঞ্জিন আর পালের শক্তিতে। তবে অস্ট্রিয়ান আর ড্যানিশ জাহাজের গতির কাছে প্রুশিয়ান গানবোট ছিল নস্যি। ফলে লড়াইয়ের সময় তারা দূর থেকে কিছু গোলা ছোঁড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি।
অস্ট্রিয়ানদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল টেগেটফ। ড্যানিশদের কামানে তার পতাকাবাহী জাহাজ শোয়ারর্জেনবার্গ খারাপভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তিনি বহর নিয়ে নিরপেক্ষ জলসীমাতে চলে যান। ড্যানিশ পতাকাবাহী জাহাজ জাইল্যান্ডও তখন ডুবুডুবু, ফলে তারাও পিছিয়ে আসে। কৌশলগতভাবে এটি ড্যানিশ বিজয়, কিন্তু এতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হলো না। কারণ স্থলে তাদের সেনাবাহিনী পর্যুদস্ত, আর অস্ট্রিয়ান মূল বহরের সাথে সংঘাতে যাবার সামর্থ্য ড্যানিশ নৌবাহিনীর কম।
লন্ডন সম্মেলন
ডুবেলের পতনের পর ২০ এপ্রিল লন্ডনের সম্মেলনে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া আর জার্মান কনফেডারেশনের সাথে ডেনমার্ক, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন এবং নরওয়ে একত্রিত হয়। উদ্দেশ্য স্লেশউইগ-হোলস্টেইন সমস্যার একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা। ১২ মে-২৬ জুন অবধি অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলো। এই ফাঁকে স্লেশউইগ বিভক্ত করে ডেনমার্ক আর জার্মানির মধ্যে ভাগাভাগির প্রস্তাবনা জোরেশোরে উঠে আসে। কিন্তু ডেনমার্কের নীতিগত অবস্থান ছিল এর বিরুদ্ধে। ২০ জুন কোপেনহেগেনের সভায় তাদের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হলো। ফলে অস্ত্রবিরতি শেষ হলে নতুন সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আলস দখল
ডেনমার্ক তখন পতনের মুখে। ফ্রেডেরিসিয়া দুর্গ থেকে এপ্রিলের শেষে সেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অস্ত্রবিরতির সময় ড্যানিশ সেনারা জড়ো হয়েছে ফুনেন আর জিল্যান্ড দ্বীপে। অল্প কিছু সৈন্য রয়ে গেছে আলস আর উত্তর জাটল্যান্ডে। আলস ছিল স্লেশউইগের সর্বশেষ অঞ্চল যা তখন পর্যন্ত ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে, ফলে তারা বিনা যুদ্ধে এই স্থান ছাড়তে রাজি ছিল না।
২৬ জুন অস্ত্রবিরতি শেষ হলে প্রুশিয়ানরা আলসে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। ২৯ জুন রাত দুটোয় জতুপ্সকভ (Sottrupskov) গ্রামের দিক থেকে প্রথমে ছোট ছোট ১৬৩টি নৌকাতে ২,৫০০ প্রুশিয়ান আলসে অবতরণ করে। তাদের সমর্থনে জুন্ডেফট থেকে প্রচুর গোলাগুলি চালানো হয় ড্যানিশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপর। এদিকে দ্বীপে দুই দলের তুমুল যুদ্ধ লেগে গেল।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজ রলফ ক্রেক দৃশ্যমান হলে প্রুশিয়ানরা নতুন করে আলসের দিকে নৌকা ভাসানোর সাহস পেল না। কিন্তু ইতোমধ্যেই ৫,০০০ প্রুশিয়ান সেনা আলসে পৌঁছে গেছিল। রলফ ক্রেকের ক্যাপ্টেন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধারনা করলেন ড্যানিশদের পয়াজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরকম ক্ষেত্রে তার উপর আদেশ ছিল সেনাদের ফিরিয়ে আনার। সুতরাং প্রুশিয়ানদের আক্রমণ না করে তিনি মনোনিবেশ করেন দ্বীপ থেকে স্বপক্ষের সৈনিকদের নিরাপদে সরানোর কাজে। ইত্যবসরে প্রুশিয়ানরাও কাজ চালানোর মত একটি সেতু বানিয়ে ফেললে দলে দলে প্রুশিয়ান ইউনিট আলসে প্রবেশ করে। পয়লা জুলাইয়ের মধ্যেই পুরো আলস প্রুশিয়ার দখলে চলে আসে। ড্যানিশরা ফুনেন আর জিল্যান্ডের দিকে পালাল। তাদের ৩,০০০ এর অধিক সেনা হতাহত আর বন্দি হয়, অন্যদিকে প্রুশিয়ার ক্ষতি ছিল ৩৭২ জন। আলসের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধে বড় সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি হলো।
লান্ডবির যুদ্ধ
লান্ডবি গ্রামের সংঘর্ষকে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ বলা কঠিন। বিক্ষিপ্ত একটি সংঘর্ষ হিসেবেই বরঞ্চ একে মানায়। এর মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলেস্টেইন যুদ্ধের সশস্ত্র পর্যায়ের পরিসমাপ্তি। তবে লান্ডবির কথা এই কারণে উল্লেখযোগ্য যে এখানে মাযল লোডিং রাইফেলের উপর ব্রিচ লোডিং বন্দুকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আলসের পর জাটল্যান্ড থেকে ড্যানিশ সৈন্যরা উত্তর-পূর্বের দ্বিপগুলোতে চলে যেতে থাকে। তাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণ নিশ্চিত করতে আলবোর্গ শহরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেকের অধীনে একদল সেনা অবস্থান নেয়। নিকটবর্তী প্রণালী পাড়ি দিয়ে দলে দলে ড্যানিশ সৈনিক তখন জাটল্যান্ড ত্যাগ করছিল। এদিকে প্রুশিয়ান একটি ঘাঁটি ছিল জাটল্যান্ডের হব্রো শহরে। জুলাইয়ের ১ তারিখে তিনটি ছোট ছোট প্রুশিয়ান সেনাদল সেখান থেকে আলবোর্গ বরাবর যাত্রা করে। সেখবর পেয়ে বেক রওনা হলেন পথিমধ্যেই তাদের মুখোমুখি হতে।
মেজর নিডার নেতৃত্বে জুলাইয়ের ৩ তারিখ ভোরে একটি প্রুশিয়ান দল লান্ডবি গ্রামে এসে পৌঁছে। বেক যে তাদের দিকে ধেয়ে আসছেন তা নিডার জানা ছিল না। তিনি লান্ডবিতে ১৩০ জন সেনা রেখে তার যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। লান্ডবিতে থেকে যাওয়া সেনারা কোনো সংঘর্ষের আশঙ্কা করেনি। ফলে তারা আশেপাশে কোনো পাহারাও বসায়নি।
লান্ডবির কয়েক মাইল দক্ষিণে গুন্ডার্প নগরী। বেক যখন এখানে এসে পৌঁছলেন তখন ক্ষুধা তৃষ্ণায় তার সেনারা মহাক্লান্ত। কয়েকটি শহরে প্রুশিয়ানদের নাগাল তারা পেতে পেতে পায়নি। গুন্ডার্পের বাসিন্দারা লান্ডবিতে প্রশিয়ান অবস্থান জানালে বেক বিশ্রাম না নিয়েই ছুটে যান। ৩ জুলাই সকালে তিনি লান্ডবির উপকণ্ঠে এসে পড়লেন।
প্রুশিয়ানরা তখন সবেমাত্র সকালের নাস্তা করতে বসেছে। এমন সময় দূরে পাহাড়ের উপর ড্যানিশ অশ্বারোহীদের দেখে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তাদের দলপতি ক্যাপ্টেন শ্লুটারবাখ তখন গিয়েছিলেন উত্তরদিকের রাস্তা পরিদর্শনে, খবর পেয়ে দ্রুত তিনি ফিরে এসে সেনাদের সংগঠিত করতে লাগলেন। দূরবীন ব্যবহার করে বেক দেখতে পেলেন তার এবং লান্ডবির দক্ষিণ প্রান্তের মাঝে একটি পাথুরে দেয়াল আছে, যার পেছনে অবস্থান নিতে পারলে প্রুশিয়ানদের হটানো কঠিন হয়ে যাবে। অবিলম্বে তিনি সৈনিকদের চার্জ করতে আদেশ করলেন, যাতে প্রুশিয়ানরা সংগঠিত হবার আগেই তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যায়।
কাতারে কাতারে ড্যানিশ সেনারা অগ্রসর হলো। নাগালের মধ্যে আসতেই ড্রেইস নিডল রাইফেল গর্জে ওঠে। আগেই বলা হয়েছ যে, প্রতি মিনিটে ড্রেইস মাযল লোডিং রাইফেলের থেকে অনেক বেশিবার গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। প্রুশিয়ানদের হাতে মাযল লোডিং রাইফেল থাকলে বেক কিছু সেনা হারালেও খুব সম্ভবত তার চার্জে সফল হতেন। কিন্তু ড্রেইসের ক্ষমতা তখন পর্যন্ত তার অজানা। তার চোখের সামনেই প্রুশিয়ানদের অব্যাহত গুলিতে একের পর এক সৈন্য লুটিয়ে পড়তে থাকলে তিনি হামলার ইতি টানতে বাধ্য হন। মাত্র ১৩০ জন প্রুশিয়ানই তাদের রাইফেলের বদৌলতে ড্যানিশ চার্জ ঠেকিয়ে দিতে সমর্থ হয়। মাত্র বিশ মিনিটে বেকের ৩১ জন সেনা নিহত হয়, ৪৪ জন হয় আহত। দুজন অফিসারসহ ৩৯ জন ড্যানিশ প্রুশিয়ানদের হাতে বন্দি হলো। প্রুশিয়ানদের পক্ষে তিনজন সামান্য আহত হয়। শ্লুটারবাখ নিজেদের সংখ্যার স্বল্পতা বিবেচনা করে পলায়নরত ড্যানিশদের তাড়া করা থেকে বিরত থাকেন।
ভিয়েনা চুক্তি
দ্বিতীয় স্লেশউইগ-হোলস্টেইন যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ একটি অনর্থক লড়াই। ডেনমার্কের একগুঁয়েমির কারণেই রক্তক্ষয়ী এই সংঘাত সংঘটিত হয়। নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের ব্যাপারে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তাদের ডুবিয়ে দেয়। এমনকি ড্যানিশ জনগণই বিশ্বাস করত তাদের পরাজয় কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু আলসের পতনের পরে সবার মধ্যে আতঙ্কের ঢেউ বয়ে যায়। জাটল্যান্ড, ফুনেন, জিল্যান্ড সবই এখন অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার হাতের নাগালে। ড্যানিশরা এবার শান্তির জন্য আওয়াজ তুলল। জুলাইয়ের ৮ তারিখ নবম ক্রিশ্চিয়ান লিবারেল মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে রক্ষণশীল সরকার নিয়োগ দেন। তারা ২০ জুলাই থেকে অস্ত্রবিরতির আড়ালে শান্তি আলোচনা আরম্ভ করল।
১৮৬৪ সালের শরতে ভিয়েনাতে বিজয়ী অস্ট্রো-প্রুশিয়ান শক্তির সাথে ডেনমার্কের বৈঠক বসে। কতটুকু ছাড় ডেনমার্ক পায় শুধু তা-ই দেখার বিষয় ছিল। অন্য কোনো পরাশক্তি এখানে আমন্ত্রিত ছিল না। ৩০ অক্টোবর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে স্লেশউইগের একটি ছোট দ্বীপ ছাড়া পুরো স্লেশউইগ-হোলস্টেইন এবং ল্যুনবার্গ ডেনমার্কের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। একধাক্কায় ডেনমার্ক তার ভুমির দুই-পঞ্চমাংশ এবং জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হারিয়ে ফেলে। একীভূত জার্মানির পথে বিসমার্ক একধাপ এগিয়ে গেলেন। এবার অস্ট্রিয়ার ব্যবস্থা করার পালা।
This is a Bengali language article about the rise and eventual downfall of Prussia and how it led to a unified Germany. Necessary references are mentioned below.
References
- Clark, C. M. (2007). Iron kingdom: The rise and downfall of Prussia, 1600-1947. London: Penguin Books.
- Abbott, J. S. C. (1882) The history of Prussia. New York, Dodd, Mead, and company
- Adriansen, I. & Christensen, J. O. (2013) The Second Schleswig War 1864: Prelude, Events and Consequences. Museum Sønderjylland – Sønderborg Slot and Tøjhusmuseet.
Feature image: amazon.com