Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্বসার আল ফরিদ: মরুভূমির বুকে এক প্রাচীন দুর্গ

আয়তনের বিচারে পশ্চিম এশিয়ার সবচাইতে বড় আরব দেশের নাম ‘সৌদি আরব’। সৌদি আরবের উত্তরে জর্ডান ও ইরাক, উত্তর-পূর্বে কুয়েত ,পূর্বে কাতার, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত অবস্থিত। এছাড়াও এর দক্ষিণ-পূর্বে ওমান ও দক্ষিণে ইয়েমেন অবস্থিত। সৌদি আরবের মরুভূমির বুকে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার হাজারো ইতিহাস।

প্রায় শতভাগ মুসলিমের বসবাস এই সৌদি আরবে। কিন্তু হাজার বছর আগে এখানেও ছিল ভিন্ন মতবাদ ও গোষ্ঠী এবং সামাজিক প্রথার মিলনমেলা। তাই এখানে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন সভ্যতার হাজারো নিদর্শন। তেমনই এক নিদর্শন সৌদি আরবের মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ‘একাকী দুর্গ’, যার আক্ষরিক নাম ‘ক্বসার আল ফরিদ’। একে আবার অনেকেই আল হেজার বলেও ডেকে থাকেন।

মানচিত্রে সৌদি আরবের অবস্থান; Source: nissanmaxima.me

আরব মরুভূমি পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বিশাল মরুভূমি। এটি ইয়েমেন থেকে পারস্য উপসাগর ও ওমান থেকে জর্ডান ও ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি আরবীয় উপদ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে করে আছে যার মোট আয়তন ২৩,৩০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মরুভূমি এবং এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। উত্তর সৌদি আরবের এ অংশে জনমানবের কোনো চিহ্ন নেই। এমনই এক স্থানে বিশাল এক পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয় এক রহস্যময় দুর্গ।

একপাশ থেকে দেখলে একে বৃহৎ গোলাকার পাথর খন্ড ছাড়া ভিন্ন কিছু মনে হয় না; Source: trover.com

সামনে থেকে দেখলে মনে হবে, এটি শুধুমাত্র বিশাল আকৃতির পাথরের অবয়ব ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু এই পাথর খন্ডের অন্য পাশে গেলেই ধরা পড়ে এর আসল সৌন্দর্য। পাথর খন্ডটির অপর পাশে ধরা পড়ে অসম্ভব দক্ষ হাতের কারুকাজ, যা দেখলে রীতিমত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। বিশাল এই পাথর খন্ডের প্রতিটি ফটকে রয়েছে সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া। দক্ষ হাতের কারুকাজ এবং এর বিশালত্ব যেকোনো পর্যটককেই করে তুলতে পারে দ্বিধান্বিত। স্বাভাবিক নিয়মেই মনে প্রশ্ন জেগে উঠতে পারে, কেনই বা এমন জনমানবহীন স্থানে এমন এক দুর্গ তৈরি করা হল? আর কারাই বা এই দুর্গ তৈরি করলেন?

মরুভূমির বুকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা ক্বসার আল ফরিদ; Source: flickr.com

এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে অনেকটা পেছনের দিকে। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে, আরব সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সময়কার যুগ। সেই সময়টিতে ছিল নাবাতিয়ান নামক এক যাযাবর গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য। যদিও ইতিহাসবিদদের কাছে নাবাতিয়ানদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসবিদদের মতে নাবাতিয়ানরা ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাধর এবং পরিশ্রমী জাতি। তাদের হাতের কাজ ছিল অসাধারণ এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা বিশাল বিশাল পাথর খোদাই করে অনন্য স্থাপনা তৈরি করতে পারতেন।

নাবাতিয়ান প্রকৌশলীদের হাতের কাজ ছড়িয়ে ছিল পুরো জর্দান জুড়ে; Source: wildfrontierstravel.com

যাযাবর হলেও তারা পরবর্তিতে ধীরে ধীরে বসতি স্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে তারা তৎকালীন পেট্রা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। পেট্রা ছিল মূলত প্রাচীন আরব সাম্রাজ্যের একটি অংশ যা বর্তমানে জর্দান নামেই বহুল পরিচিত। এখানেই নাবাতিয়ান সভ্যতার গোড়াপত্তনের ইতিহাস শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। বিশাল বড় বড় পাথরের উপর অতি অল্প সময়ের মধ্যে খোদাই করে এক অপরূপ সুন্দর নির্মাণশৈলী উপস্থাপন করতে পারতেন এই নাবাতিয়ানরা। ধীরে ধীরে অতিকায় বেলে পাথরের পাহাড় কেটে বাড়িঘর বা প্রাসাদ তৈরি করতে থাকলেন তারা।

নাবাতিয়ানদের হাতে গড়ে তোলা তৎকালীন বাণিজ্যিক শহর পেট্রা; Source: lonelyplanet.com

খুব অল্প সময়ের মধ্যে পেট্রা নাবাতিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠল। অসম্ভব সুন্দর নির্মাণশৈলী উপস্থাপনা এবং অবস্থানগত সুবিধায় পেট্রা খুব অল্প সময়ের মধ্যে অন্যতম বাণিজ্যিক নগরী হয়ে ওঠে। আশেপাশের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক পথও হয়ে দাঁড়ায় এই পেট্রা নগরী। এছাড়াও শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, প্রকৌশল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে দক্ষ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। তাই বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের রোষানলে পড়তে থাকে পেট্রা নগরী। পরবর্তীতে ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ট্র্যাজান দখল করে নেন এই পেট্রা নগরী। এরপর ধীরে ধীরে গ্রীক-রোমান সংস্কৃতিতে হারিয়ে যেতে থাকে নাবাতিয়ান সভ্যতার অনন্য সব কীর্তি। তাই অনেকেই ধারণা করে থাকেন, মূলত নাবাতিয়ানদের হাত ধরেই তৈরি হয় এই ক্বসার আল ফরিদ।

মরুভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ক্বসার আল ফরিদ; Source: ancient-origins.net

কিন্তু অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকের মতে, এটি মূলত কোনো স্থাপনা নয়। সৌদি আরবের এই অংশটি মাদাইন-সালেহ নামে পরিচিত। মাদাইন-সালেহের পুরো অঞ্চল ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১১১টি পাথুরে সমাধিক্ষেত্র যার অনেকগুলোতেই পেট্রা নগরীর নির্মাণ শৈলীর সাথে মিল পাওয়া যায়। এছাড়াও এর ৯৪টি দুর্গ এখনও নাবাতিয়ান সভ্যতার ইতিহাস উপস্থাপন করে। তবে এই দুর্গগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এগুলো পাশাপাশি গুচ্ছাকারে নির্মাণ করা হয়েছিল। শুধুমাত্র ক্বসার আল ফরিদ দুর্গটিই দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথকভাবে।

মরুভূমির বুকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সমাধি; Source: deviantworld.com

এসব কারণেই এই সমাধিস্থলটি অন্য সমাধিগুলোর চাইতে অনেকটা আলাদা এবং রহস্যময়ও বটে। এই মরুভূমির অন্যান্য আলোচিত দুর্গের মধ্যে রয়েছে ক্বসার আল বিন্ত, ক্বসার আল সানি এবং জাবালে আল মাহজার। কিন্তু ক্বসার আল ফরিদের আয়তন, দেয়ালের কাজ, স্তম্ভের সংখ্যা ও উচ্চতায় ছিল অন্যান্য স্তম্ভগুলো হতে আলাদা। অন্যান্য সমাধিগুলোর সদরের বহির্ভাগে দুটি স্তম্ভ চোখে পড়ে, যেখানে ক্বসার আল ফরিদে রয়েছে চারটি স্তম্ভ। তাই প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, যিনি এই সমাধিক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, তিনি নাবাতিয়ানদের মধ্যে বিশেষ প্রাচুর্য ও বংশগৌরবের অধিকারী ছিলেন।

দুর্গের উপর অংশের সাথে নিচের অংশের পার্থক্য স্পষ্ট দৃশ্যমান; Source: panoramio.com

তবে অনেক গবেষকের মতে, ক্বসার আল ফরিদ বস্তুত অসম্পূর্ণ একটি শিল্পকর্ম। দুর্গটির চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এর উপরের দিকের কাজ অনেকটা গোছানো এবং দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এর নিচের দিকে কাজ অনেকটাই রুক্ষ এবং অমসৃণ। ফলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, দুর্গটির নিচের অংশের কাজ ঠিকভাবে শেষ করা হয়নি যার কারণে দুর্গটি অমীমাংসিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে কেনই বা এই কবরটি মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার উত্তর জানা কখনো সম্ভব হয়নি। তবে এমনও হতে পারে যে, এর নির্মাণশিল্পীরা দুর্গটিকে এভাবেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

ক্বসার আল ফরিদ দেখতে আসা অসংখ্য দর্শনার্থী; Source: flickr.com

তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, এত বছর ধরে কী করে একাকি দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বিশাল দুর্গটি? প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মরুভূমির বাতাসের মধ্যকার জলীয় বাষ্পের স্বল্পতা এবং প্রচন্ড তাপের কারণেই এখানকার দুর্গগুলো এখনও অক্ষত রয়ে গেছে। এখনও বিভিন্ন পর্যটককে অপার বিস্ময়ে বিস্মিত করে এই দুর্গগুলো। তাই প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে পর্যটকদের সমাগম। ২০০৮ সালের দিকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই পাথুরে দুর্গগুলোকে। সেই থেকে এটি সৌদি আরবের সর্বপ্রথম কোনো স্বীকৃত স্থান, যা বিশ্বের একটি ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

ফিচার ইমেজ- richardbangs.com

Related Articles