Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেবার রানী: অসীম ক্ষমতাবান এক রানীর গল্প

বছরের পর বছর ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন গল্পে এক অসীম ক্ষমতাশালী রানীর নাম শোনা যায়। শেবার রানী নামেই যিনি বেশী পরিচিত। বাইবেল, কোরআন আর তানাখ তিনটি ধর্মগ্রন্থেই রয়েছে তার উপস্থিতি। তবে তার সঠিক নাম আর রাজ্যের সীমা নিয়ে বিতর্ক চলছে শতকের পর শতক ধরে, হয়তো চলবে আরো অনেক সহস্রাব্দব্যাপী।

শেবার রানী সলোমনের দরবারে © Gerhard Huber

শেবার রানীকে ঘিরে আছে রহস্য আর মুখরোচক গল্পের সমাহার। যদিও অনেকেই ধর্মগ্রন্থের বাইরে শেবার রানী নামক চরিত্রটির অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দিহান। তবুও তার উপস্থিতি পাওয়া যায় তুর্কি আর পার্সিয়ান চিত্রকর্ম, কাব্বালিসটিক গ্রন্থসমূহ, আর মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান চিত্রকর্মে যাতে তিনি ধরা দেন একজন দিব্যজ্ঞানের অধিকারিণী আর ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে।

আফ্রিকা আর আরবে এখনো শেবার রানীর গল্প ছড়িয়ে আছে এবং গত তিন হাজার বছর ধরে শেবার রানীকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

শেবার রানী এবং রাজা সলোমন (সুলাইমান (আ))-কে নিয়ে ইহুদী, ইসলাম আর খ্রিস্টান– এই তিন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাই এ বিষয়ে প্রচলিত বিভিন্ন গল্পের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমান ইয়েমেনই হচ্ছে দক্ষিন আরবের রাজ্য শেবা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন শেবা নামক রাজ্যটি আসলে পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। রাজ্যেটির সঠিক সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে বহুকাল ধরে। ইথিওপিয়াই ছিল শেবা, এর পক্ষে যুক্তিদানকারীরা বলেন, শেবার রানীর রাজত্ব ছিল অ্যাকজাম নামক রাজ্যের উপর। কিন্তু রাজা সলোমনের সময়ে এমন কোনো রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, এমনকি যখন বুক অভ কিংস সম্পাদিত হয় তখনও এমন কোনো রাজ্য ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আরবরা শেবার রানীকে বিলকিস আর ইথিওপিয়ানরা মাকেদা বলে সম্বোধন করে থাকে।

শেবা ছিল ধন-সম্পদ আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত রাজ্য © Wikimedia

শেবার এই রহস্যময় নারী শাসকের কথা ওল্ড টেস্টামেন্টেই সর্বপ্রথম উঠে আসে। তখনও ইহুদী, খ্রিস্টান আর ইসলাম নামক আলাদা ধর্মের সৃষ্টি হয়নি। সেখানে বলা আছে, শেবার রানী যখন জেরুজালেমের রাজা সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঈশ্বরের প্রতি তার অবিচল আস্থা এবং তার রাজ্যের প্রাচুর্যের গল্প শুনলেন তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজে উপস্থিত থেকে রাজা সলোমনের জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে সেই রাজ্যে যাবেন।

শেবার রানী নিজেও অত্যাধিক জ্ঞান, সম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন রাজা সলোমনকে তিনি কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে তার জ্ঞানের পরিধীর পরীক্ষা নেবেন। সেই অনুযায়ী তিনি তার সভাসদ, ভৃত্য আর প্রচুর উপহার সামগ্রী নিয়ে জেরুজালেমের পথে রওয়ানা দিলেন। তার কাফেলায় সোনা, মশলা, আর মূল্যবান পাথরের উপহার সামগ্রী ছিল, যা তিনি রাজা সলোমনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এতই বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমতি ছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাকে রাজা সলোমনের সমকক্ষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

রানী ছিলেন সূর্য-পূজারী আর রাজা সলোমন একেশ্বরবাদী। অবশেষে যখন তিনি তার প্রশ্নের সঠিক আর যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলেন তখন তিনি ঘোষণা দিলেন, “আমি আপনার জ্ঞান আর সাফল্যের যে কাহিনী শুনেছিলাম বাস্তবে তা সেই সীমা অতিক্রম করেছে (১ কিংস ১০:৭)”। সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে তিনি সলোমনের ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং ফিরে গিয়ে নিজের রাজ্যে মানুষের মধ্যে সেই ধর্মের প্রচার করলেন (১ কিংস ১০ ভ. ১-১৩)।

রানী নিজে রাজা সলোমনের পরীক্ষা নিতে জেরুজালেম যান © Pinterest

তারগুম শেনিতেও (দ্বিতীয় তারগুম – ইহুদী ধর্মগ্রন্থ) এই গল্পের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সেখানে একটু ভিন্নভাবে গল্পটাকে উপস্থাপন করা হয়েছ। তারগুম শেনি মোতাবেক, রাজা সলোমন গাছপালা, পশু-পাখীি এদের কথাবার্তা বুঝতে পারতেন (১ কিংস ৪:৩৩)।

একদা তিনি সব প্রাণীকে এক ভোজের নিমন্ত্রণ দিলেন। সমস্ত পশু-পাখি তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও বনমোরগ তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল না, কারণ ওর মতে, রাজা সলোমন আসলে সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর মহান রাজা নন, বরং শেবার রানীই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। সুতরাং রাজা সলোমন এই সম্মানের দাবীদার হতে পারেন না। এ কথা শুনে রাজা সলোমন শেবার রানীকে তার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন তাকে সম্মান দিতে এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মেনে নিতে। এবং রানী যাতে তার ক্ষমতায় মুগ্ধ হন তার জন্য তিনি তার অনুগত এক জ্বীনকে দিয়ে শেবার রানীর পুরো রাজ্য তার রাজ্যে নিয়ে এসে রানীর সামনে উপস্থাপন করেন।

এরপর মুগ্ধ রানী সলোমনের প্রাসাদের পানির মতো স্বচ্ছ কাঁচের মেঝেতে হাঁটতে হাঁটতে সলোমনকে কঠিন কঠিন সব ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করেন এবং রাজাও তার ঠিক ঠিক উত্তর দিলে রানী সন্তুষ্ট হয়ে রাজা সলোমনকে তার থেকে ক্ষমতাবান বলে মেনে নেন এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। বনমোরগও সন্তুষ্ট হয়ে রাজার দাওয়াত কবুল করে।

রানী মাকেদা এবং রাজা সলোমন © theleidencollection.com

কোরআনে সুরা আল-নামল এ সুলাইমান (আ) এবং শেবার রানী সম্পর্কে আয়াত আছে। আরবরা তাকে ‘বিলকিস’ নামে অভিহিত করে। যদিও কোরআনে কোনো নামে তাকে সম্বোধন করা হয়নি। সুরা আল-নামল এর ৩২ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে উঠে এসেছে শেবার রানী ও রাজা সুলাইমানের কাহিনী। নবী হিসেবে হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে আল্লাহ অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী বানিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ, জ্বীন এবং পাখি এই তিন প্রজাতি ছিল সুলাইমান (আঃ) এর সেনাবাহিনীর অংশ। সুলাইমান (আঃ) পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন।

‘হুদহুদ’ নামক এক পাখী একদা রাজা সুলাইমানকে এসে সাবাহ রাজ্যের খবর দিল, যারা ছিল ধনে-সম্পদে, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে উন্নত আর সমৃদ্ধ। তবে তারা ছিল সূর্য-পূজারী। সুলাইমান (আঃ) সেই হুদহুদ পাখীকে দিয়ে শেবার রানীর কাছে পত্র পাঠালেন যেন তিনি এবং তার রাজ্যের লোকজন ইসলাম কবুল করে এবং এক আল্লাহর অস্তিত্বে পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে। শেবার রানী সুলাইমান (আঃ) এর প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার কথা জানতে পেরে তাকে প্রচুর সোনা, মূল্যবান পাথর এবং মশলা উপহার হিসেবে পাঠালেন। কিন্তু রাজা সুলাইমান (আঃ) সেসব গ্রহণ না করে তা ফেরত পাঠালেন। এবার রানী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজে যাবেন রাজা সুলাইমানের (আঃ) সাথে দেখা করতে। তিনি দেখা করতে এলে সুলাইমান (আঃ) জ্বিনদের দিয়ে শেবা রাজ্য তুলে এনে রানীর সামনে উপস্থাপন করলেন। রাজা সুলাইমানের সততা, জ্ঞান ও আল্লাহর বাণী শেবার রানীকে মুগ্ধ করে এবং তিনি ইসলাম কবুল করেন।

সলোমন অ্যান্ড শেবা (১৯৫৯) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য © themovies.to

ইথিওপিয়ান ক্যাবরা নাগাস্টের (রাজাদের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী) ভাষ্যমতে, শেবার রানী মাকেদা আর রাজা সলোমন একে অপরের প্রেমে পড়েন এবং রানী যখন ফিরে যান তখন তিনি রাজা সলোমনের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করছিলেন। রানী শেবায় ফিরে গিয়ে মেনেলিক নামের এক ছেলেকে জন্মদান করেন। ইথিওপিয়ানরা বিশ্বাস করে রানী মাকেদা তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশ এবং শেবা রাজ্যটি ছিল বর্তমান ইথিওপিয়া।

যদিও এসব তথ্যের বাইরে ইতিহাসবিদরা শেবার রানীর বা তার রাজ্যের কোনো অস্তিত্বের প্রমাণ পাননি। ঐতিহাসিকভাবে শেবার রানী রহস্যে ঘেরা এক চরিত্রের নাম, যাকে নিয়ে নানা গল্প যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে হলিউড চলচ্চিত্রও। এখনও শিল্প সাহিত্যে একজন ক্ষমতাশালী রানী হিসেবে তার সরব উপস্থিতি বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও তা চলবে।

Related Articles