রেল কেবল লোহালক্কড়ের গল্প নয়, এ জনপদের আধুনিক সভ্যতার দিকে পা ফেলবার ইতিহাস। রেল আসার পূর্বে বাংলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদীপথ। নদীপথে ছিল বিভিন্ন সমস্যা। বর্ষায় প্রবল স্রোতে প্রায়শই নৌকা ডুবে প্রাণহানী ঘটত। তাছাড়া ইঞ্জিনবিহীন বৈঠাচালিত নৌকা ছিল অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন। আবার অনেক ক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হলে নদীপথে কয়েকগুণ বেশি পথ পাড়ি দিতে হত। এ সমস্ত কারণে একদিনের পথ পাড়ি দিতে অনেক ক্ষেত্রে লেগে যেত এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময়। তাছাড়া সেসময় নৌপথে জলদস্যুরও অভাব ছিল না।
রেল যেমন এদেশে আধুনিকতার বার্তা নিয়ে এসেছে, ঠিক একইভাবে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিতকেও মজবুত করেছে। রেল যোগাযোগের ফলে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করতেও সুবিধা হয়েছে। তবে রেলসেবা থেকে এ দেশের মানুষ যে একেবারেই বঞ্চিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। রেল এ দেশের মানুষকেও আধুনিক হতে শিখিয়েছে। ব্রিটিশদের পাশাপাশি এ দেশের ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হয়েছে। সর্বোপরি রেলসেবা ব্রিটিশদের তুলনায় এ দেশের মানুষের জন্যই বেশি আশির্বাদ বয়ে এনেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের উপর রেলের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
উত্তরবঙ্গে রেলওয়ে আসল যেভাবে
আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলওয়ের আগমন ঘটে ১৮৬২ সালে রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭১ সালে সেই লাইনকে বর্ধিত করে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। গতপর্বে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উত্তরবঙ্গেও রেলওয়ে এসেছে ব্রিটিশদের ব্যবসায়িক সুবিধা নিশ্চিত করতে। তবে উত্তরবঙ্গে রেলওয়ের আগমনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল আসাম, শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ির উৎপাদিত চা। রেলওয়ে আগমনের পূর্বে ভারতের ৬৫% চা উৎপাদিত হত আসাম, সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এছাড়া বিহার দুর্ভিক্ষ এই রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।
বিহার দুর্ভিক্ষ
১৮৭৩ সালে বিহার, পশ্চিম বাংলার কয়েকটি উত্তরাঞ্চলীয় জেলা এবং আজকের বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ এক ভয়াবহ রকমের দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়। ১৮৭৩-৭৪ সালব্যাপী বিস্তৃত এই দুর্ভিক্ষ 'বিহার দুর্ভিক্ষ' নামে পরিচিতি। খরাজনিত এই দুর্ভিক্ষ ১,৪০,০০০ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।
স্যার রিচার্ড টেম্পল ছিলেন সেসময়ের বাংলার নবনিযুক্ত লেফট্যানেন্ট গভর্নর। স্যার টেম্পল দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা করেন। আসন্ন দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার আগে থেকেই আঁচ করতে পারে। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ৫০ মিলিয়ন রুপির বাজেট ঘোষণা করে।
href="http://www.self.gutenberg.org/articles/eng/bihar_famine_of_1873%E2%80%9374">দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের খাদ্য সংকট মেটাতে সরকার বার্মা থেকে ৪,৫০,০০০ মেট্রিক টন চাল নিয়ে আসে। এতে ব্রিটিশ সরকারের মোট ৪০ মিলিয়ন ব্রিটিশ ভারতীয় রুপি খরচ হয়। যদিও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় মোট বাজেট করা হয়েছিল ৫০ মিলিয়ন রুপি। ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চালকে মোট ৩০০ মিলিয়ন ইউনিটে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকদিন একটি পরিবারকে এক ইউনিট করে খাবার দেয়া হতো। আর এক ইউনিটে থাকতো প্রায় দুই কেজি চাল।
এছাড়া প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামগুলো পরিদর্শন করেন। যাদের কর্মসংস্থান প্রয়োজন তাদের নির্দিষ্ট একটি তালিকা তৈরি করে নিয়ে যান। পরে এ সমস্ত মানুষের কর্মসংস্থান মেটানো হয় বিভিন্ন সরকারি নির্মাণকাজে নিযুক্ত করার মাধ্যমে। ধারণা করা হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছিল দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার যথোপযুক্ত এবং স্থায়ী সমাধান।
সাঁড়াঘাট-শিলিগুড়ি রেল সেকশন
১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ডে নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে একটি নতুন রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য সেবছরই ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩৩৬ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই রেলপথ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল তিনটি। প্রথমত, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। তৃতীয়ত, এবং প্রধান কারণ হলো ব্রিটিশদের ব্যবসায়িক এবং বাণিজ্যিক কারণে কলকাতার সাথে আসাম ও শিলিগুড়ির নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা। কারণ ওই অঞ্চল তখন চা ছাড়াও পাট, তামাক ও আখ শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ (৩.৩৭৫ ফুট) রেলপথ নির্মাণের ফলে বাংলায় সর্বপ্রথম মিটারগেজ রেলপথের পরিব্যাপ্তি ঘটে। পদ্মার উত্তরপাড়ে নির্মিত হয় সাঁড়াঘাট রেলওয়ে স্টেশন। সাঁড়াঘাট থেকে আব্দুলপুর, সুলতানপুর (সান্তাহার), পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী হয়ে চিলাহাটী দিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত এই লাইনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৭৮ সালে। সেবছরই ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে এই সেকশনটি উন্মুক্ত করা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হাওয়ার পর থেকে শিয়ালদহ-পার্বতীপুর সেকশনে ইস্ট বেঙ্গল মেইল এবং শিয়ালদহ-শিলিগুড়ি সেকশনে শিলিগুড়ি মেইল নিয়মিত চলাচল করত।
পোড়াদহ-রায়টা ঘাট রেল সেকশন
পদ্মার ওপাড়ে যখন শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হচ্ছিল ঠিক একই সময়ে পদ্মার এ পাড়েও শুরু হয় লোহালক্কড় নিয়ে রেলপথ নির্মাণের এক মহা কর্মযজ্ঞ। আগে থেকেই যেহেতু কুষ্টিয়া হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ ছিল, তাই কুষ্টিয়ার পোড়াদহ থেকে একটি ব্রডগেজ লাইন পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে ঠিক সাঁড়াঘাটের বিপরীতে দামুকদিয়া হয়ে রায়টা ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এতে পোড়াদহ স্টেশন থেকে জংশনে রূপান্তরিত হয়। অপরদিকে দামুকদিয়াতে একটি এবং দামুকদিয়া ঘাটে আরেকটি রেল স্টেশন নির্মিত হয়। সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্তু মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করে নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি, অপরদিকে ঠিক একই সময়ে পোড়াদহ থেকে রায়টা ঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি।
অর্থাৎ, ব্রিটিশদের চাহিদা অনুযায়ী কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলো, কিন্তু মাঝখানে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াল খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা। অবশ্য সে সময় কুষ্টিয়ার দামুকদিয়া থেকে ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাট পর্যন্ত নদী পারাপারের জন্য রেলওয়ে পরিচালিত স্টিমারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তাছাড়া ফেরীতে পারাপার করা হত কয়লাচালিত রেলওয়ে ওয়াগন ও বগি। মাঝখানে এই একমাত্র পদ্মা নদীর প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাত্রা ছিল নির্বিঘ্ন। তখনও ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। তখন ঈশ্বরদীর ব্যস্ততম স্টেশন হিসেবে পরিচিত ছিল সাঁড়াঘাট। তাছাড়া মাঝদিয়াতেও একটি রেল স্টেশন ছিল।
সাঁড়াঘাট
কলকাতা থেকে দামুকদিয়া পর্যন্ত ১৮৫ কিলোমিটার এবং সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩৩৬ কিলোমিটার, সর্বমোট কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব হলো রেলপথে ৫২১ কিলোমিটার এবং দামুকদিয়া থেকে সাঁড়াঘাট পর্যন্ত স্টিমারে ৩.৫ কিলোমিটার। আজ থেকে দেড়শ বছর আগের পদ্মা এখনকার মতো শান্ত ছিল না। তখন পদ্মার ছিল ভরা যৌবন, উত্তাল ঢেউ আর তরঙ্গমালা ছিল যার নিত্যসঙ্গী। সেসময় মানুষ কলকাতা থেকে ট্রেনে করে দামুকদিয়া আসত। সেখান থেকে রেলওয়ে পরিচালিত স্টিমারে করে নদী পার হয়ে সাঁড়াঘাট, এরপর সাঁড়াঘাট থেকে ট্রেনে করে শিলিগুড়ি চলে যেত।
রেলস্টেশন নির্মাণের বদৌলতে সাঁড়াঘাট হয়ে ওঠে জমজমাট এক নৌবন্দর। কত ব্রিটিশ বাবুসাহেব, কত বিদেশী বণিক, কত কবি, কত সবে বিয়ে করে ফেরা নবদম্পতি তরী ভিড়িয়েছে এই ঘাটে। কয়েক শতাব্দী পুরাতন এই ঘাট একসময় এদেশে সবচেয়ে বড় নৌবন্দরগুলোর মধ্যে একটি ছিল। কলকাতার সাথে আজকের বাংলাদেশ, আসাম, শিলিগুড়ি, মেঘালয়সহ এ অঞ্চলের রেলপথ ছাড়াও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদীপথ। আর এই সাঁড়াঘাট ছিল এই নৌরুটের প্রধান বন্দর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্র কুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক সাহিত্যিকই সাঁড়াঘাট সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁরা যে সাঁড়াঘাটে এসেছিলেন এবং সেই সময়কার সাঁড়াঘাটের অবস্থা জানতে পারা যায় তাঁদের সাহিত্যিক বর্ণনা থেকে।
আজকের ঈশ্বরদী বলতে তখনকার সাঁড়া থানাকে বোঝানো হত। আজকের ঈশ্বরদী রেল জংশন বা ঈশ্বরদী শহরের কোনো অস্তিত্বই তখন ছিল না। রেল স্টেশন ছিল সাঁড়াঘাটে। কালের পরিক্রমায় সেই বিখ্যাত সাঁড়াঘাট আজ তার জৌলুশ হারিয়ে ঈশ্বরদী শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে। একসময়ের রমরমা সাঁড়াঘাটে আজকে একটি অসমাপ্ত রাস্তা আর কয়েকটি টং দোকান ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু পদ্মাপাড়ের সাঁড়াঘাট থেকে গোধূলিলগ্নে দিগন্তবিস্তৃত লালাভ জলরাশি আর সূর্যাস্তের সেই অপার্থিব সৌন্দর্য আজও উপভোগ করা যায়।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ফেরী পারাপারের দুর্ভোগ ঘোচাতে খরস্রোতা পদ্মার উপর নির্মিত হয় ১.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১৯১২ সালে পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হলে এই সেকশনে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের ফলে আর সাঁড়াঘাটের প্রয়োজনীয়তা থাকল না। ফলে সাঁড়া স্টেশনটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। গড়ে ওঠে বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন। বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ড ছাড়াও ঈশ্বরদীতে নির্মাণ করা হয় লোকোশেড। এই লোকোশেডটি বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্রডগেজ লোকোমোটিভের মাতৃভূমি হিসেবে খ্যাত। এছাড়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পর পাকশীকে গড়ে তোলা হয় রেলওয়ে সদর দফতর হিসেবে। পাকশী ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সদরদপ্তর। পরে তা রাজশাহীতে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে পাকশী বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী বিভাগের বিভাগীয় শহর এবং সদরদপ্তর।
১৯২৬ সালে নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক পদ্মাপাড় থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে পুরো কলকাতা-শিলিগুড়ি রুটটি ব্রডগেজে রুপান্তরিত হয়। স্থাপিত হয় নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুততম যোগাযোগ ব্যবস্থা। সে সময় কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত চলাচল করত ঐতিহাসিক দার্জিলিং মেইল। এছাড়া কলকাতা-পার্বতী এর মধ্যে চলাচল করত নর্থ বেঙ্গল মেইল। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও বাংলার কিংবদন্তি ট্রেন দার্জিলিং মেইল এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এখনও যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে এদেশে নয়, কলকাতার শিয়ালদহ-দার্জিলিং রুটে ট্রেনটি নিয়মিত চলাচল করছে।
উত্তরবঙ্গে রেলওয়ে আগমনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বন্যা, খরা, নদীভাঙন এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত উত্তরবঙ্গে রেলওয়ে আগমনের ফলে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। কলকাতার সাথে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে সুগার মিল, জুট মিলসহ ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান।
মানুষের যাতায়াত সহজ হওয়ার ফলে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং আধুনিক জীবনব্যবস্থার প্রভাব পড়ে এ অঞ্চলে। আনাগোনা বাড়তে থাকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রেলপথের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে থাকে। রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের চা শিল্প এবং পাট শিল্পকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
উত্তরবঙ্গ বরাবরই তামাক এবং পাট শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পাট শিল্পে হু হু করে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। ফলে এ অঞ্চলের চাষীরা বেশ লাভবান হতে থাকে। সর্বোপরি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূলে পরিবর্তন করে দেয়। নদীপথে কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রায় ৫/৬ দিনের, রেলপথ নির্মাণের ফলে তা নেমে আসে এক দিনে। সে জন্য বলা হয়, রেল ছিল এ অঞ্চলের মানুষের আধুনিক সভ্যতার দিকে পা ফেলবার ইতিহাস। রেলের ইতিহাস ছিল এ সমাজ ও সভ্যতাকে বদলে দেওয়ার ইতিহাস। কার্ল মার্কসের ভাষায়- "একটা প্রযুক্তি একটা সমাজকে বদলে দেবে"; এ যেন ঠিক সে কথারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
This article is in Bangla. It is the third part of the series 'Rail History of Bangladesh', and History of Saraghat, Parbatipur and Siliguri railway sections is the theme this article.
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: Discover Live Stream