Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সত্যি না কল্পনা: ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান

তপ্ত মরুভূমির বালিতে হঠাৎ যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বালুর বুক চিরে জেগে উঠেছে গাঢ় সবুজে ঢাকা আস্ত একটি পাহাড়। তার গা বেয়ে ঝরনা নেমে আসছে তিরতির করে। সবুজের মাঝখানে থোকায়-থোকায় ফুটে আছে রঙ-বেরঙের কত নাম না জানা ফুল। হঠাৎ দেখলে বিভ্রম জাগতেই পারে। কিন্তু সত্যি এরকমই নাকি একদিন ছিল ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এই বাগানের মনোরম শোভায় এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বাগানটিকে তিনি প্রাচীন পৃথিবীর এক অপার বিস্ময় বলে অভিহিত করেছিলেন। ২৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনের এক পুরোহিত বেরোসাসের লেখা ‘ব্যাবিলোনিয়া’ বইয়ে প্রথম ‘ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যান’ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এরপরে আরও অনেকে এ বিষয়ে কথা বলেন।

ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যানের এক কাল্পনিক চিত্র

ঐতিহাসিকদের মতে, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মিত হয়। তবু বহু শতাব্দী ধরে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান একটি প্রহেলিকার নাম হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর সাতটি বিস্ময়ের অন্যতম হলেও এটি কোনো দিন ছিল কিনা, তা নিয়ে গবেষকদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যদিও কিংবদন্তী বলে, দ্বিতীয় সম্রাট নেবুচাদনেজার (৬০৫-৫৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য এই উদ্যান তৈরি করেন।

দ্বিতীয় সম্রাট নেবুচাদনেজার

সম্রাট নেবুচাদনেজার ছিলেন ভীষণ আমুদে। নিনেভেহ দখল করার সময় মিদিয়ার সম্রাট তাকে সহযোগীতা করেছিলেন। মিদিয়ার রাজকন্যার রূপে আকৃষ্ট হয়ে সম্রাট তাকে বিয়ে করেন। রাজার সেই পারসিক স্ত্রীর নাম ছিল আমিতিস। সেই রাণীর বাবার বাড়ি মিদিয়া ছিল সবুজ পাহাড় আর মনোরম উপত্যকা দিয়ে ঘেরা। এই রুক্ষ মরুভূমির দেশে এসে রাণীর ভারি মন খারাপ হতো। মরুময় পরিবেশ তার ভালো লাগেনি। মানিয়ে নিতে না পারায় রাণী হয়ে পড়েন গৃহকাতর। তাকে খুশি করতে রাজা ঠিক করেন, বালির বুকেই গড়ে তুলবেন সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক সবুজের গালিচা। কিন্তু কাজটা ছিল বড় কঠিন। একে তো মরুভূমির মাটি রুক্ষ, তার উপর জলের বড়ই অভাব। এহেন জায়গায় গাছপালা কীভাবে জন্মাবে? আবার গাছ লাগালেও তো শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো।

সম্রাট নেবুচাদনেজারের স্ত্রী আমিতিস

এসব নানা ভাবনা সকলের মনে কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত রাজার ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ডাকা হলো বিশেষজ্ঞদের। তাদের অভিজ্ঞ পরামর্শ চাওয়া হলো। তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ ছিল সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। কীভাবে এই কাজ এগিয়ে নেয়া হবে সেই বিষয়ে তাদের কাছে মতামত চাওয়া হলো।

মানচিত্রে পার্সিয়ান ও মিদিয়া রাজার অধীনে থাকা সীমান্ত

ঝুলন্ত বাগান শুন্যে ভাসমান ছিল না মোটেই। মরুভূমিতে মাটি ফেলে কৃত্রিম পাহাড়ের উপর বাগানটি তৈরি হয়। রোদে সেঁকা ইটের কলাম দিয়ে তৈরি করা হয় অনেক ধাপ। ধাপে ধাপে সেই পাহাড়ের গায়ে গাছপালা লাগানো হয়েছিল। দূর থেকে যা দেখলে মনে হতো, শুন্যে ঝুলে রয়েছে বাগানটি। এর প্রযুক্তিগত কৌশল ছিল চমকপ্রদ।

চতুর্ভূজাকৃতির বাগানটির প্রথমেই তৈরি করা হয়  ৮০০ বর্গফুট আকৃতির বিশাল এক ভিত। মাটি থেকে এর উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট। ৪,০০০ শ্রমিক রাত-দিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই বাগান। বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১,০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার প্রকার ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এই ঝুলন্ত বাগানে।

শিল্পীর তুলিতে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান

চতুর্ভূজাকৃতির বাগানটির ছাদেই গাছ রোপণ করা হয়েছিল। ছাদগুলো কিউব আকৃতির ছককাটা স্তম্ভের উপর দাঁড় করানো ছিল। ভিত্তিগুলো পর্যাপ্ত ভার যাতে সামলাতে পারে তাই মাটির বেশ গভীর পর্যন্ত ঢালাই করা হয়েছিল। এই আকৃতিতে ছাদ তৈরির ফলে সামনে থেকে বাগানটিকে পাহাড়ের মতো মনে হত। ছাদের উপরে উঠার জন্য পেঁচানো সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সিঁড়ির পাশ দিয়ে মোটা নল রাখার স্থান ছিল যাতে করে ছাদের একদম উপর পর্যন্ত পানি উঠানো যায়।

কল্পিত ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন

ভাবতে অবাকই লাগে, অত দিন আগে অবিশ্বাস্য সেচ প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। এভাবে তৈরি হলো রাজা নেবুচাদনেজারের স্বপ্নের ঝুলন্ত বাগান। এই বাগানের সঙ্গে রাণীর জন্য একটি সবুজ রঙের মনোমুগ্ধকর প্রাসাদও তৈরি করা হয়। এই প্রাসাদকে রাজা নাম দিয়েছিলেন, ‘মানবজাতির বিস্ময়’।

বাগানকে ঘিরে রাণীর মনোমুগ্ধকর প্রাসাদ

কোথায় ছিল ব্যবিলনের এই বাগান? ধারণা করা হয়, আজকের ইরাক দেশের ব্যাবিল প্রদেশের হিল্লাহ নামক জায়গার কাছেই নাকি ছিল এই বাগান। তবে যদি এটি কোনোদিন থেকেও থাকে, তাহলে প্রথম খ্রিস্টাব্দেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী পারস্য রাজ্যের সাথে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই সুন্দর উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়- এমন অভিমত থাকলেও ব্যবিলনের ঝুলন্ত বাগানের অস্তিত্ব জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন এখনও।

গবেষকদের ধারণা, ইরাকে কোনো এক জায়গায়ে ছিল ঝুলন্ত বাগানটি

কারণ ঐতিহাসিকদের মতে, ব্যাবিলনিয়ার ইতিহাসে তো বটেই, স্বয়ং নেবুচাদনেজারের লিপিতেও কোথাও এই বাগানের কথা নেই। অনেক গবেষকের ধারণা, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান বলতে আদতে কিছুই ছিল না। এটি সাহিত্যিকদের মস্তিষ্ক প্রসূত। ব্যাবিলনিয়ান পুরোহিত বেরোসাসের লেখার উপর ভিত্তি করেই গ্রীক ইতিহাসবিদরা পরবর্তীতে এই বাগান সম্পর্কে লেখেন, যাদের কেউই আদৌ বাগানটি নিজ চোখে দেখেননি।

ব্যাবলনিয়ানের রাজ পুরোহিত বেরোসাসের মর্মর মুর্তি

আবার অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান আসলে ব্যাবিলনেই ছিল না। এটি ছিল ইরাকেরই প্রাচীন সাম্রাজ্য অ্যাসিরিয়ার নগর নিনেভেহতে। তবে এই দাবির স্বপক্ষে শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আবার অন্য ইতিহাসবিদদের মতে, বাগানটিতে পানি তুলতে যন্ত্রের সাহায্য নেয়া হতো। কারো কারো মতে, ইউফ্রেটিস নদী থেকে পানি তুলতে স্ক্রু পাম্প ব্যবহার করা হতো। তবে ধারণাটি তেমন একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ স্ক্রু পাম্প আবিষ্কার হয়েছে আরো অনেক পরে।

আর্কিমিডিসের তৈরি স্ক্রু পাম্প যা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান তৈরির অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়

১৮৯৯ সালে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডওয়ে ব্যাবিল শহরে খনন কাজ শুরু করেন। এই খনন কাজে নেবুচাদনেজার এর প্রাসাদ, দুর্গ, টাওয়ার অব ব্যাবিল এবং নগর রক্ষাকারী দেওয়াল সবই পাওয়া যায়। তিনি ১৪টি রুমবিশিষ্ট একটি স্থান খুঁজে পান যার ছাদ ছিল পাথরের তৈরি। এটিকে তিনি ঝুলন্ত বাগান বলে দাবি করেন। তবে গবেষকদের মতে, কোল্ডম্যান যে অংশটি ঝুলন্ত বাগান বলে দাবি করেছেন তা নদী থেকে অনেক দূরে। ফলে ইতিহাসবিদদের বাগানের অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা এবং পানি ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণা কোল্ডম্যানের দাবির সাথে মিলে না। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এই অংশটি কোনো উদ্যান হিসাবে নয়, বরং প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য এবং স্টোর রুম হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

বিংশ শতাব্দীর শিল্পীর চোখে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান

তাই অনেকে বলে থাকেন, ‘ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান’ প্রাচীন যুগের এক অপরূপ কল্পনা মাত্র। পুরাতত্ত্ববিদদেরও এখনও পর্যন্ত নিরাশই করেছে এই বাগানের অস্তিত্ব। কোনো প্রামাণ্য তথ্য তারা পাননি। তবু কল্পনার উচ্ছ্বাসে দিন দিন উজ্জ্বলতর হয়েছে এটি। চিরকালীন বিস্ময়ে তালিকা থেকে এটির নাম আজও মোছা হয়নি। কে বলতে পারে, হয়তো ইউফ্রেটিস নদীর কোনো এক গহীন অন্ধকারের নীচে কখনো এর চিহ্ন মিললেও মিলতে পারে।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Hanging_Gardens_of_Babylon
২) history.com/news/hanging-gardens-existed-but-not-in-babylon
৩) ancient.eu/article/129/
৪) The Mystery of the Hanging Garden of Babylon : An Elusive World Wonder Traced
৫) ancient-origins.net/news-history-archaeology/mysterious-gardens-babylon-may-not-have-been-babylon-all-00510
৬) thoughtco.com/hanging-gardens-of-babylon-112331

Related Articles