ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ডের গির্জাগুলোতে ধর্মীয় কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন শুরু হয়। সংস্কারকদের উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধিকরণ। তাদের প্রাথমিক বিশ্বাস ছিল যে ইংল্যান্ডের গির্জাগুলো রোমান ক্যাথলিক গির্জাগুলোর সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাদের গির্জাসমূহ থেকে সব রকমের জাঁকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান তারা বাদ দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। বাইবেলে যা বলা হয়েছে শুধু তাই হবে গির্জাতে সম্পাদিত আচারসমূহ- এই ছিল সংস্কারক তথা পিউরিটানদের নীতি। তাদেরই নামানুসারে পূর্ণ মাত্রার শুদ্ধি লাভের এই আন্দোলনকে বলা হয় পিউরিটানিজম।
পিউরিটানরা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের সাথে তাদের এক নিবিড় আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই মরমী জ্ঞানের কারণেই তাদের এই সংস্কারের অধিকার রয়েছে বলে তারা দাবী করতেন। ১৬২০-৩০ সালের মাঝে পিউরিটানদের কিছু দল ইংল্যান্ডের উত্তরাংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের হাত ধরেই পিউরিটানিজমের বিকাশ ঘটতে থাকে। অধুনা ইংল্যান্ডের সামাজিক স্তরবিন্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ভিত হিসেবে পিউরিটানিজমের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পিউরিটানিজমকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু মিথ বা ভ্রান্ত ধারণা সমাজে বহুল প্রচলিত, যেগুলোর সুদৃঢ় কোনো ভিত্তি নেই বললেই চলে। জনপ্রিয়তার বিচারে এসব ধারণাসমূহের গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী হলেও ইতিহাস কী সাক্ষ্য দিচ্ছে তা নিয়েই এই আয়োজন।
পিউরিটানরা ছিল গোঁড়া ডাইনী শিকারি
অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ডাকিনীবিদ্যায় পিউরিটানদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি এ ক্ষেত্রে আনা হয় সেটি হলো- পিউরিটানরা জাদুবিদ্যার অভিযোগ এনে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করত। আজকের আধুনিক বিশ্বের বহু মানুষের মতোই পিউরিটানরাও জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করত এবং বহুল প্রচলিত একটি বিশ্বাস হচ্ছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে তারা হাজার হাজার নারী পুরুষকে ডাইনী সাব্যস্ত করে বিনা বিচারে উন্মত্ত জনগণের কাছে সোপর্দ করেছে। জনগণ ক্ষণিকের উত্তেজনায় এদেরকে সুস্পষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে। এসব অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের মাঝে সর্বাধিক আলোচিত স্যালেম হত্যাকাণ্ড। স্যালেমে একইসাথে শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যা চর্চার অভিযোগ আনা হয় যাদের মাঝে ১৯ জনকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এই গেল পিউরিটানদের বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগ। এবারে আসল সত্যটা কী জানা যাক।
১৬২০ থেকে ১৬৯২ অবধি প্লাইমাউথ ও ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে ৬১ জনের বিরুদ্ধে ডাকিনীবিদ্যার অভিযোগ আনা হয় এবং দোষ প্রমাণিত হওয়ায় ১৯ জনকে সাজা দেওয়া হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সংখ্যার বিচারে সহস্রাধিক মানুষ হত্যার যে অভিযোগ পিউরিটানদের বিরুদ্ধে আনা হয় সেটি আক্ষরিক অর্থেই অতিরঞ্জিত।
যৌন জীবনের প্রতি পিউরিটানদের ঘৃণা
একটি অত্যধিক জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে, পিউরিটানরা যৌনক্রিয়ার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল, এমনকি বিবাহিত সঙ্গীর সাথেও তারা শারীরিক সম্পর্ককে অপছন্দের চোখে দেখত। বর্তমান বিশ্বের মানুষের মাঝে এই বিশ্বাসটি এতটাই বদ্ধমূল যে আধুনিক সমাজে যারা শারীরিক সম্পর্ককে পাপ, অশ্লীল এবং ঘৃণ্য কাজ বলে বিবেচনা করে তাদেরকে ‘পিউরিটানিক্যাল’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সত্যিই কি তা-ই? আত্মশুদ্ধির পথে পিউরিটানরা কি যৌনাচারকে অন্তরায় হিসেবে দেখত?
আসল সত্য হচ্ছে শারীরিক সখ্যতাকে রহিত করার পক্ষে পিউরিটানদের অবস্থান ছিল না- অন্ততপক্ষে বৈবাহিক জীবনে তো নয়ই। খ্রিস্টীয় ভাবধারার বিভিন্ন মতবাদ যেরকমভাবে যৌনজীবনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল তৎকালীন সময়ে, সে তুলনায় পিউরিটানিজমের অবস্থান ছিল যথেষ্টই উদারপন্থী। পিউরিটান যাজকরা ধর্ম প্রচারের সময় শারীরিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করে থাকত। তারা বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে যৌনাচারকে আখ্যা দিয়েছিলেন “স্বীয় ইচ্ছার প্রতি পবিত্র দায়িত্ব” হিসেবে। এমনকি তৎকালীন পিউরিটান সমাজে একজন স্বামী তার স্ত্রীর যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে গির্জা কর্তৃপক্ষের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘোষণা করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। প্রাক-বৈবাহিক শারীরিক সম্পর্ককে ঘিরেও পিউরিটানদের কঠিন কোনো নিয়ম ছিল না। তবে ভয়ানক অপরাধ হিসেবে দেখা হত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, পরকীয়া এবং সমকামিতাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রবর্তন
এই বিষয়টিকে তুলনা করা যায় জল ঘোলা করার সাথে। আংশিক সত্য প্রচার যে কতটা দূর পর্যন্ত যেতে পারে তার একটি অনন্যসাধারণ উদাহরণ এটি। পিউরিটানরা ধর্মীয় স্বাধীনতা এনেছিল যুক্তরাষ্ট্রে- এটি স্বীকার করতেই হবে, তবে এই স্বাধীনতা শুধু তাদের নিজেদের জন্যই। তাই প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে স্থান নিয়ে সত্য উচ্চারণ করতে চাইলে বলতে হবে যে পিউরিটানরা মূলত তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা উপভোগের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিল; কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় আবহাওয়া বদলে দেওয়ার জন্য নয়। নিজেদের ধর্ম চর্চার বেলায় তাদের চিন্তা-ভাবনা ছিল ষোল আনা ঠিকঠাক, অথচ অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি তাদের মনোভাব ছিল একেবারেই ন্যাক্কারজনক। স্বাধীনতার সংজ্ঞা বুঝতে পারলেও পরমতসহিষ্ণুতার ধারণাটি তাদের ভাবনা জগতের চৌহদ্দিতে ছিল না।
পিউরিটান এবং পিলগ্রিম একই জনগোষ্ঠী
একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের পবিত্র ও বাধ্যতামূলক দায়িত্ব ছিল গির্জায় উপাসনাকাজে উপস্থিত হওয়া। উপাসনায় অংশগ্রহণ না করা ছিল একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উত্তর ইংল্যান্ডের একদল কৃষক প্রথাগত ধর্ম বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মতো করে ধর্ম চর্চা শুরু করলেন। তারা প্রতিষ্ঠিত গির্জাগুলোতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন এবং নিজেদের অন্তঃকরণকে অনুসরণ করে গোপনে উপাসনা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
তাদের এহেন কার্যক্রম যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল এ কথা তারা খুব স্পষ্টভাবেই জানতেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে পাকড়াও করা হলো এবং ধরা পড়লে দণ্ড প্রদান করা হতে লাগল। শাস্তির পাশাপাশি তারা তাদের পরিবার এবং জীবিকা নির্বাহের উপায় থেকেও বঞ্চিত হতে লাগল। তারা যখন বুঝতে পারলেন যে তাদের স্বীয় ধর্মবিশ্বাস বজায় রাখলে জীবন ধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভবপর নয় তখন তারা দেশ ছাড়তে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। পরবর্তীতে বহু অভিযান, সাগর পাড়ি দিয়ে তারা একটি স্থিতাবস্থায় আসেন এবং সর্বপ্রথম থ্যাংকসগিভিং উৎসবের উদযাপন করেন যাদেরকে আজ পিলগ্রিম বলা হয়ে থাকে।
পিউরিটানদের সাথে পিলগ্রিমদের সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্য ছিল তাদের বিশ্বাসে। পিলগ্রিমদের ধ্যান-ধারণা প্রায় পুরোটাই ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে পিউরিটানরা সংস্কারে বিশ্বাস করতেন; যে সংস্কার বা আধুনিকায়ন স্বীয় সত্তা থেকে উৎসারিত। অর্থাৎ, গির্জা ত্যাগের বা প্রচলিত সকল উপাসনা বর্জন করার কোনো চিন্তা তাদের ছিল না। গির্জাই হবে সংস্কারের উৎসস্থল- এমনই বিশ্বাস ছিল পিউরিটানদের। চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে পিউরিটানরা পিলগ্রিমদের চেয়ে বেশ উদারপন্থী ছিল। একটি জায়গায় এসে এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচরণ মিলে গেছে পুরোপুরি। তারা সবাই বিশ্বাস করত আত্ম-পরিশুদ্ধিতে এবং সমবেতভাবে প্রার্থনায়। একদল নিজেদের ভালো থাকার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত সকল উপাসনালয় বর্জন করল আর অন্যদল আধ্যাত্মিক ধারণার ভিত্তিতে নিজেদেরকে পৃথক বলে দাবী করলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি।
পিলগ্রিমদের মৌলবাদী ধ্যান-ধারণার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচয় দিতে এতটাই বদ্ধপরিকর ছিল যে ইংল্যান্ড ছেড়ে নেদারল্যান্ডে পাড়ি জমায়। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা পেয়েছিল, তবে সামাজিক স্তরবিন্যাসে তারা একেবারেই তলানির দিকে চলে গিয়েছিল সর্বদাই কম বেতনের চাকরি পাওয়ায়। অন্যদিকে সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে পিউরিটানরা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন না করায় সময়ের পরিক্রমায় সম্পদশালী হয়ে উঠতে পেরেছিল।
This is a Bengali about the true facts about some long believed false Puritan myths. All the necessary references are hyperlinked within the article.
Feature Image: history.howstuffworks.com