Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি: মাদকবিরোধী অভিযান চালায় যে বিদ্রোহীরা

যুদ্ধে লড়তে হলে টাকা চাই প্রচুর। যুদ্ধ কতদিন ধরে হবে তা কেউ জানে না। কাজেই যেকোনো যুদ্ধেই সেনাদলকে অর্থ আর অস্ত্রের একটি নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই কারণেই মাদক কারবারের প্রতি একটি বাড়তি ঝোঁক দেখা যায়। ফার্ক থেকে শুরু করে তালেবান বা মায়ানমার-থাইল্যান্ডে পালিয়ে আসা চীনা কুয়োমিন্টাং দলের সেনাদলগুলোর মধ্যে মাদক কারবারের অভিযোগ অনেক পুরানো।

যেসব অঞ্চলে মাদকের রমরমা, সেসব এলাকার মানুষদের মধ্যে সংগত কারণেই নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান। মাদক কারবারীরা শক্তি সামর্থ্যে বলীয়ান। কাজেই এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানোটাও দারুণ সাহসের ব্যাপার। এমনই এক কাজ করেছে তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। মায়ানমারের এই বিদ্রোহীরা লড়ে যাচ্ছে নিজেদের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করবার জন্য।

তাংদের পরিচয়

তাং বা পালাউং লোকেদের বাস মায়ানমারের শান প্রদেশ, চীনের দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশ আর থাইল্যান্ডের উত্তরাংশে। পালাউং ভাষায় তারা কথা বলে। ধর্মে মূলত বৌদ্ধ। তাং জাতিগোষ্ঠীর লোকজন অতীতে মন-খেমার জাতিভুক্ত ছিল। বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ। ১৭৯৩ সালে এই তাং লোকেরা তাওংপেং নামের এক স্বাধীন রাজ্য গঠন করেন। তাং শাসকদের উপাধি ছিল সাওফা। ব্রিটিশরা তাংদের এই সাম্রাজ্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি, ভেটের বিনিময়ে তারা নিজেদের শাসন অক্ষুন্ন রাখবার অধিকার পেয়েছিল। নামশান হচ্ছে তাদের রাজধানী।

 তাং শরণার্থী; Image Source: The Week

স্বাধীন বার্মায় তাংদের অবস্থা বিশেষ সুবিধার ছিল না। ১৯৬৩ সালে গঠিত হয় পালাউং স্টেট লিবারেশন আর্মি। ১৯৯১ সালে তৎকালীন বার্মা সরকারের সাথে এদের একটা যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৫ সাল নাগাদ তারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পন করে। তবে সব তাং এতে সন্তুষ্ট ছিল না। দুজন তাং নেতা, তার আইক বং আর তার বন কিয়াও এ সময় গঠন করেন পালাউং স্টেট লিবারেশন ফ্রন্ট। এদেরই সেনাদলের নাম দেওয়া হয় তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি

বর্তমানে এদের অন্তত হাজার দেড়েক থেকে পাঁচ হাজারের মতো সৈন্য আছে। শান প্রদেশ মিয়ানমারের অন্যতম দুর্গম প্রদেশগুলোর একটি, এর অনেক অঞ্চলেই সরকারের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সাথে আবার বিদ্রোহী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি এবং উত্তর শান স্টেট আর্মির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। একযোগে এসব বিদ্রোহীরা বিরাট শান অঞ্চলে মিয়ানমার আর্মি ওরফে তাতমাদাও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে অধিকতর স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য। যদিও ২০১০ সালের পরে পালাউং সেলফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জোন গঠন করা হয়, তবে এতে তাংরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। মিয়ানমারের সবথেকে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে তাং/পালাউংদের এই আবাসস্থল।  

তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি; Image Source: www.bnionline.net

শান প্রদেশ আর মাদক

শান প্রদেশের অবস্থান মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব অংশে। এটি সেই দেশের এটি বৃহত্তম প্রদেশ। মিয়ানমারে শতাধিক জাতির বসবাস। কিন্তু সরকার এদের সবাইকে এক নজরে দেখে না। শান প্রদেশ ব্রিটিশ আমল থেকেই অনেক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো। স্বাধীনতার পর এই প্রদেশ আর প্রদেশ সংলগ্ন অন্যান্য অঞ্চলে বর্মী শাসকদের সাথে স্থানীয় নেতাদের গোলমাল লেগে যায়।

শান প্রদেশ পড়েছে এশিয়ার কুখ্যাত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালে। দুর্গম পাহাড়ে ঠাসা এই অঞ্চলের লোকেরা চাষ করে আফিম। এই আফিম থেকে উৎপাদিত হেরোইন আর ইয়াবা চলে যায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে। ১৯৪৯ সালে চীন থেকে বিতাড়িত কুয়োমিন্টাং সেনারা এই অঞ্চলে এসে আফিম চাষের প্রচলন ঘটায়। পরবর্তীতে এখানকার অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও আফিম চাষকেই নিজেদের সেনাদল অর্থায়নের একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নেয়। খুন সা নামের এক শান নেতা এই অঞ্চলে গঠন করেন শান ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি। পরবর্তীকালে এই সেনাদল দুই ভাগ হয়ে শান উত্তর আর শান দক্ষিণ এই দুই সেনাদলে পরিণত হয়। এছাড়া শান প্রদেশে আছে আরো বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এদের মধ্যে আছে শান, কাচিন, কোকাং বা ওয়া জাতিভুক্ত লোকেরা।

শান পর্বতমালা; Image Source: IRIN News

শান প্রদেশ সহ মায়ানমারের উত্তরের অংশগুলোতে চীনা ব্যবসায়ীদের খুব রমরমা অবস্থা। রেঙ্গুন বা নেপিদাওয়ের সাথে এসব দুর্গম অঞ্চলের তেমন যোগাযোগ নেই। সেই অবসরে অঞ্চলটা ছেয়ে গিয়েছে চীনা ব্যবসায়ী আর বিনিয়োগকারীদের ভিড়ে। অনেক অঞ্চল, যেমন ওয়া স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে চীনা মুদ্রাই বাজারে ব্যবহৃত হয়। মানুষ চীনের সাথে বেশি একাত্ম, কারণ বর্মী সরকারের উপস্থিতি ওসব অঞ্চলে নেই বললেই চলে। দুর্গম এই পাহাড়গুলোতে অদ্যাবধি বহুল পরিমাণে আফিম আর ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদক বানানো হয়। কুখ্যাত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অংশ এই এলাকায় অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পাশাপাশি তাতমাদাওয়ের উঁচু কর্তারা মাদকের কারবার চালান। বাংলাদেশে যে ইয়াবা আসে তা-ও অধিকাংশই এই শান প্রদেশের ল্যাবরেটরিগুলোতে বানানো হয়। তবে তাতমাদাও সর্বক্ষেত্রে যে সরাসরি মাদকে জড়িত থাকে তা কিন্তু না। অনেক সময় স্রেফ চাঁদা তুলেও বিপুল অর্থ কামিয়ে নেন দুর্নীতিবাজ নেতা আর সামরিক কর্তারা। 

মিয়ানমারের একটি পপি ক্ষেত; Image Source: IRIN News

চা চাষীদের হাতে অস্ত্র

বৈচিত্র্যময় শান প্রদেশে বহু জাতির বাস। শান ছাড়াও এখানে আছে কোকাং, কাচিং, তাং, ওয়াসহ নানা জাতির লোকেরা। ঐতিহাসিকভাবে তাং বাদে বাকি সবগুলো জাত যোদ্ধাজাতি হিসেবে পরিচিত। জাপানীরা যখন বার্মায় হামলা করে, তখনো তাং গোত্র যুদ্ধে অংশ নেয়নি। প্রতিবেশী গোত্র আর মায়ানমার সরকার হরদম শান অঞ্চলে যুদ্ধ করে চলেছে জমি আর সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দখল নিয়ে। সেদিক থেকে তাংরা অনেক বেশি নিরুপদ্রব জীবনযাপনে অভ্যস্ত। মাদক নয়, তাদের অর্থনীতি চলে চা চাষ করে।

তাং যোদ্ধা; Image Source: steemitimages.com

তবে গোটা শান অঞ্চলের মাদকের রমরমা ব্যবসা দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে বসতকারী তাংদেরকে ছেড়ে দেয়নি। গ্রামের পর গ্রামের ছেলে-বুড়ো মাদকের নেশায় মজে যায়। তাংদের সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়তে থাকে। এর পাশাপাশি মায়ানমার সরকারের উৎপাত তো ছিলোই। কাজেই ২০১১ সালে যখন শক্তিশালী কাচিন আর্মি আর উত্তর শান আর্মি মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে, তখন এককালের নিরীহ তাংরাও তাতে যোগ দেয়। প্রতিবেশী গেরিলা গ্রুপগুলোর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র নিয়ে তারা তাদের পাহাড়ের পপি খামার আর ইয়াবা ল্যাবরেটরিগুলোতে হামলা চালাতে থাকে। মাদক সেবনকারীরাও তাদের হাতে শাস্তি পেতে থাকে। তাং সেনাবাহিনীর কোনো সদর দফতর নেই, অনেকটা ভ্রাম্যমান এই সেনাদল ওই অঞ্চলের মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষাত আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে। 

তাং যোদ্ধারা পপি ক্ষেত ধ্বংস করছে; Image Source: Free Burma Rangers

তাং অঞ্চলে কিছু দামী রত্নের খনি আছে। তাং নেতাদের ভাষ্যমতে, এসব খনি আর বিদেশ থেকে তাং সমর্থকদের পাঠানো টাকা দিয়েই তারা তাদের খরচাপাতি চালায়। নিজেদের সেনাদলের বেশিরভাগ তরুণই অতীতে মাদকাসক্ত ছিল। পরে তারা বর্তমানের মাদকবিরোধী অভিযানে অংশ নিতে থাকে।

বর্তমান অবস্থা

শান অঞ্চলের মাদকের এই রমরমা ব্যবসা বন্ধ করবার চেয়ে ঐ অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনাটাই মিয়ানমার সরকার তহতা তাতমাদাও এর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে তাই মিয়ানমারের সরকার এক কূট চাল চাললো। গোটা দেশজুড়ে অনেকগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে শান্তিচুক্তি করা হয়। তবে এদের মধ্যে তাংদেরকে ডাকা হলো না। কাচিন বা উত্তর শান প্রদেশের বিদ্রোহীদেরকেও এই সম্মেলনে না নেওয়াতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মিয়ানমার সরকার এই বিদ্রোহীদেরকে কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। ওদিকে শান ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি দক্ষিণের সাথে কিন্তু মিয়ানমার ঠিকই শান্তিচুক্তি করেছে। কাজেই তাং ও তাদের মিত্রদের সাথে মিয়ানমার সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ সেনাদলগুলোর যুদ্ধ ইদানিং প্রায়ই তীব্র আকার ধারণ করে। তাতমাদাও ঐ অঞ্চলে মুখে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছে বটে, তবে তাংদের অভিযোগ, জাতীয় সেনাদল কেবল মাদকের সাথে জড়িত গেরিলাদেরকেই সাহায্য করছে।

মিয়ানমারের আরো অনেক বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর মতো স্বাধীনতা তাংদের দাবি নয়। তারা একটি ফেডারেল সরকারের অধীনে মোটামুটি স্বায়ত্ত্বশাসিত একটা অঞ্চল চায়। তবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের মধ্যে বাস করে মাদকমুক্ত সমাজ গড়া খুব একটা সহজ হবে না, কারণ ইতোমধ্যেই ঐ অঞ্চলের স্থানীয় অনেক সেনাদল নিজেদের মাদক ব্যবসা অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। আর তাদেরকে মদত দিচ্ছে খোদ সরকার। কাজেই সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলটির বাসিন্দাদের সামনে খুব একটা আনন্দদায়ক ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে বলে মনে হয় না।

ফিচার ইমেজ – Frontier Myanmar

Related Articles