Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোম সাম্রাজ্যের উত্থান (পর্ব-৩৬): স্পার্টাকাসের দাসবিদ্রোহ (৭৩-৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

স্পার্টাকাসের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। বলা হয়, তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ার উত্তরের থ্রেস রাজ্যের বাসিন্দা। অ্যাপিয়ানের মতে, তিনি রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দি হন এবং দাস হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়। অন্য এক প্রাচীন ঐতিহাসিক ফ্লোরাস দাবি করেন, স্পার্টাকাস ছিলেন রোমান মার্সেনারি। সেনাদল ত্যাগ করে দস্যুবৃত্তির অভিযোগে তাকে বন্দি করে দাসত্বে আবদ্ধ করা হয়। সবাই একটা ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, স্পার্টাকাস দৈহিকভাবে লম্বা ও শক্তিশালী ছিলেন। তার বুদ্ধিমত্তা আর আচার-আচরণও ছিল সাধারণের থেকে অনেক উঁচুমানের। প্লুতার্কের বিবরণীতে বলা আছে, স্পার্টাকাসের সাথে তার স্ত্রীও দাস হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন এবং বিদ্রোহের পুরো সময়টাই তিনি তার স্বামীর পাশে ছিলেন। ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে স্পার্টাকাসের স্ত্রীর পরিচিতি ছিল।

স্পার্টাকাস; Image Source: pixabay.com

সেকালে শক্তসমর্থ দাসদের অনেকের ঠিকানাই ছিল গ্ল্যাডিয়েটর স্কুল। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণের পরে রোমে পাঠান হতো। অ্যাম্ফিথিয়েটারে হাজার হাজার হর্ষোৎফুল্ল রোমান নাগরিকের সামনে তারা নিজেরা নিজেরা অথবা হিংস্র পশুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। রোমানদের জন্য এটি ছিল বিনোদনের অন্যতম উৎস। স্পার্টাকাসের শারীরিক সামর্থ্য দেখে ব্যাটিয়াটাস নামে এক গ্ল্যাডিয়েটর প্রশিক্ষক তাকে কিনে নিলেন। স্পার্টাকাসের স্থান হলো কাপুয়ার এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এখানে নির্মম নির্যাতন আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তার দিন কাটতে থাকে।

একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০ বন্দি পালানোর পরিকল্পনা করল। কিন্তু এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। স্পার্টাকাসসহ ৭৮ জন দাস রান্নাঘর থেকে ছুরি সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষক আর মালিকদের হত্যা করে, এরপর শহর থেকে তারা গ্ল্যাডিয়েটরদের জন্য রাখা অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়ে পালিয়ে যায়। শহরে বহু দাস তাদের সাথে যোগ দেয়।

রোমান গ্ল্যাডিয়েটর © Gérôme, Jean-Léon/ Encyclopaedia Britannica

সেনাদল গঠন

দাসেরা মাউন্ট ভিসুভিয়াসের ঢালে শিবির করল। এখানে তারা তিনজন নেতা নির্বাচন করে- স্পার্টাকাস, ইনোম্যাস এবং ক্রিক্সাস। তবে দ্রুতই নিজের দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে স্পার্টাকাস সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে নেন, ইনোম্যাস ও ক্রিক্সাস তার অধীনস্থ জেনারেল হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কাপুয়া থেকে কিছু মিলিশিয়া তাদের দমন করতে এলেও বিদ্রোহীরা তাদের ধ্বংস করে দেয়। এরপর তারা ভিসুভিয়াসের আশেপাশে লুটতরাজ চালাল। লুণ্ঠিত মালামাল স্পার্টাকাস সমানভাবে তার সেনাদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। চারদিক থেকে আরো অনেক দাস পালিয়ে তার দলে যোগ দিতে থাকে।

রোমের ব্যর্থ চেষ্টা

প্রিটর ক্লডিয়াস তিন হাজার স্বল্প প্রশিক্ষিত সেনা নিয়ে স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। এরা তো যুদ্ধকৌশলের কিছুই জানে না, এরকম অবজ্ঞার ভাব নিয়ে তিনি পাহাড়ের উপরে থাকা দাসেদের অবরোধ করলেন। স্পার্টাকাসের শিবিরের চারিদিকে খাড়া পাহাড়, শুধু একদিকে দিয়ে নিচে নামার রাস্তা, যেখানে রোমানরা পাহারা দিচ্ছিল।

স্পার্টাকাস খেয়াল করলেন, পাহাড়ের উপর নানা জাতের আঙুরলতা জন্মেছে। সেই লতা দিয়ে মই তৈরি করে বিদ্রোহীরা খাড়া পাহাড় বেয়ে নেমে এল। রোমানরা একদিকের রাস্তা আটকে নিশ্চিন্তে ছিল। স্পার্টাকাস যখন পেছন থেকে হামলা করে বসলেন, তারা তখন হতবাক হয়ে গেল। ফলে ক্লডিয়াসের সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

পাব্লিয়াস আরেক দল সেনা নিয়ে এবার দাসবাহিনীর দিকে যাত্রা করলেন। তার সহকারি ফিউরিয়াস ২,০০০ সেনা নিয়ে স্পার্টাকাসের উপর হামলা করলে তাকে পরাস্ত হতে হয়। এরপর পাব্লিয়াস তার বাহিনী দু’ভাগে ভাগ করেন। কসিনিয়াস বড় একদল সেনা নিয়ে স্পার্টাকাসকে ধাওয়া করেন। স্পার্টাকাস তার শিবিরে হামলা করে কসিনিয়াসকে হত্যা করলেন। এরপর তিনি সরাসরি পাব্লিয়াসের মুখোমুখি হন। বেশ কিছু সংঘর্ষের পর পাব্লিয়াস পিছু হটে যেতে বাধ্য হন। বলা হয়, স্পার্টাকাস তার বাহিনীর এমন ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন যে রোমান সেনানায়ক তার নিজের ঘোড়াটিও হারান।

আক্রমণের ছক কষছেন স্পার্টাকাস © The Print Collector /Getty Images

কন্সুলার বাহিনীর সাথে সংঘাত

স্পার্টাকাস প্রায় ৭০,০০০ যোদ্ধা নিয়ে পথে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতে এগিয়ে গেলেন। নোলা, নুসেরিয়া, থুরি আর মেটোপন্টাম শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। রোমান সিনেট বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করল। এতদিন তারা স্পার্টাকাসকে সামান্য এক দস্যু ধরে নিয়েছিল। কিন্তু তার সামরিক সাফল্য রোমের অহঙ্কারে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। কন্সাল গেলিয়াস আর লেন্টুলাস আলাদা আলাদাভাবে সেনাদল নিয়ে বের হলেন।

এদিকে স্পার্টাকাসের দলে লোক বাড়তে বাড়তে  প্রায় লাখখানেক হয়ে গিয়েছে। তিনি আল্পস পার হয়ে ইটালি থেকে বের হয়ে যাবার পরিকল্পনা করলেন। সেখান থেকে তার বাহিনীর লোকেরা যে যার দেশে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ক্রিক্সাসের সাথে এ ব্যাপারে মতানৈক্য দেখা দিল। দাসদের অনেকে, বিশেষ করে যুদ্ধবাজ জার্মানিক গোত্রগুলো আল্পস অতিক্রম করে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে আশেপাশে লুটপাট করতে বেশি আগ্রহী ছিল। রোমের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করতেও তারা পিছপা ছিল না। স্পার্টাকাসের অধীনে পূর্ববর্তী সাফল্যগুলো তাদের অতি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। এরা ক্রিক্সাসের সাথে একমত পোষণ করল। ফলে দাসদের বাহিনী দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ক্রিক্সাস প্রায় ৩০,০০০ যোদ্ধাসহ পৃথক হয়ে গেলেও স্পার্টাকাস মূল বাহিনী নিয়ে উত্তরে আল্পসের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন।

গেলিয়াস ক্রিক্সাসের নাগাল পেয়ে গেলেন। তাদের হাতে ক্রিক্সাসসহ বেশিরভাগ দাস নিহত হয়। এরপর গেলিয়াস স্পার্টাকাসের দিকে অগ্রসর হলেন, ইচ্ছা তার পেছন দিক থেকে আঘাত করা। লেন্টুলাসের বাহিনীও এগিয়ে আসছিল। স্পার্টাকাস বুঝতে পারলেন, দুই বাহিনীকে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করতে দিলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা আছে। দুই কন্সালের বাহিনীকে একসাথে আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে স্পার্টাকাস পৃথকভাবে তাদের মোকাবেলার ফয়সালা করলেন।  তিনি দ্রুত লেন্টুলাসের পথরোধ করেন। তীব্র যুদ্ধে রোমানদের পরাজয় হয়। এরপর স্পার্টাকাস গেলিয়াসের দিকে ঘুরে যান। তার হামলায় গেলিয়াস বাধ্য হন পিছু হটে যেতে।

ক্রিক্সাসের উপর রোমান হামলা; Image Source: fineartamerica.com

আল্পসের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রোমান প্রিটর ক্যাসিয়াস সংবাদ পেয়ে দশ হাজার সেনা নিয়ে স্পার্টাকাসকে বাধা দিতে চাইলেন। স্পার্টাকাসের ততদিনে প্রায় ১,২০,০০০ পদাতিক আর বহু অশ্বারোহী সেনা নিয়ে বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছেন। ফলে, ক্যাসিয়াসের পরিণতিও কন্সালদের থেকে ভিন্ন হল না। স্পার্টাকাস ক্রিক্সাসে সম্মানে ৩০০ রোমান যুদ্ধবন্দিকে উৎসর্গ করেন। অবশিষ্টদের বাধ্য করা হয় একে অপরের সাথে গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো লড়াই করতে।

কন্সালদের উপর স্পার্টাকাসের আক্রমণ; Image Source: masculineepic.com

স্পার্টাকাসের যাত্রাপথ পরিবর্তন

আল্পস স্পার্টাকাসের সামনে উন্মুক্ত। তিনি চাইলে পর্বত পাড়ি দিয়ে রোমের নাগাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোনো এক অস্পষ্ট কারণে স্পার্টাকাস তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন। তিনি রোমের দিকে মার্চ শুরু করে পরে দক্ষিণে ঘুরে যান।

তৃতীয় দাসবিদ্রোহে স্পার্টাকাসের যাত্রাপথ; Image Source: mikeanderson.biz

এদিকে কন্সালদের ব্যর্থতায় সিনেট অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয় এবং তাদের পুনরায় যুদ্ধযাত্রা না করতে নির্দেশ জারি করে। একই সময় প্রিটর নির্বাচনের দিন চলে এলো। কিন্তু নির্বাচিত হলেই স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান করতে হবে বলে কেউ নির্বাচনে দাঁড়াতে চাইছিল না। তখন ক্রাসুস স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন। সুলার সাথে একসময় গাঁটছড়া বেঁধে এই ক্রাসুস কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন রোমের সবথেকে ধনবান ব্যক্তি। সিনেট সার্বিক দায়িত্ব তার হাতে অর্পণ করল।

ক্রাসুস (Marcus Licinius Crassus); © Carole Raddato/ Ancient History Encyclopedia

ক্রাসুসের অভিযান

স্পার্টাকাসের যাত্রাপথ পর্যালোচনা করে ক্রাসুস ধারণা করলেন তার বাহিনী সম্ভবত পিসেনামের রাস্তায় আসবে। ফলে তিনি মূল বাহিনী নিয়ে পিসেনামের সীমান্তে জড়ো হন। তার সহকারি মামিয়াসকে দুটি লিজিওন দিয়ে পাঠালেন শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তাকে সবসময় অবহিত রাখতে। স্পার্টাকাসের সাথে কোনোরকম সংঘর্ষে জড়াতে তিনি মামিয়াসকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেন। কিন্তু অতি উৎসাহী মামিয়াস তা শুনলেন না। তিনি একাই সব কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য স্পার্টাকাসের উপর হামলা করে বসেন। কিন্তু পাল্টা আঘাতে তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় বহু রোমান সেনা তাদের অস্ত্র ফেলে আসতে বাধ্য হয়, যা রোমান বাহিনীর নিয়মানুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো। 

অনুমিতভাবেই ক্রাসুস রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। মামিয়াসকে প্রচণ্ডভাবে তিরস্কার করা হয়। তিনি এরপর পালিয়ে আসা রোমান সেনাদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। তার নির্দেশে সবাইকে নতুন অস্ত্র দেয়া হলো। এরপর পালিয়ে আসা ৫০০ সেনাকে পঞ্চাশজনের দশটি দলে ভাগ করে প্রতি দল থেকে লটারির মাধ্যমে একজনকে হত্যা করা হলো। এই শাস্তিকে রোমানরা বলত ডেসিমেশন, যা ক্রাসুসের আগে বহু বছর কেউ কার্যকর করেনি। এসবই করা হয় সমগ্র সৈন্যদলের সামনে। ক্রাসুস চাইছিলেন, সেনারা যাতে তাকে স্পার্টাকাসের থেকে বেশি ভয় করে, তাহলে তারা বিদ্রোহীদের ভয়ে পালিয়ে আসার আগে দ্বিতীয়বার ভাববে।

এদিকে স্পার্টাকাস পিসেনামের দিকে না এসে লুসেনিয়ার পথ ধরলেন। তার ইচ্ছা ছিল, সাগরপথে সিসিলিতে চলে যাওয়া। বেশ কয়েকবার সেখানে বিদ্রোহ সংঘটিত হবার খবর তার জানা ছিল। তাই তিনি মনে করেছিলেন সেখানকার দাসদের উস্কে দিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি সহজ হবে। সম্ভবত সিসিলিতে তিনি নিজের ঘাঁটি করতে চাইছিলেন।

রোমান অবরোধ; Image Source: mikeanderson.biz

তার জাহাজ না থাকায় তিনি জলদস্যুদের টাকা দিয়ে হাত করলেন। তাদের সাথে চুক্তি মোতাবেক স্পার্টাকাস ব্রুটিয়ামে এসে হাজির হন। এখানে থেকে তাদের তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও দস্যুদের জাহাজের টিকিটিও দেখা গেল না। তারা অর্থ নিয়ে স্পার্টাকাসকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।

হতাশ স্পার্টাকাস রেগিয়াম পেনিন্সুলার দিকে সরে গিয়ে শিবির করলেন। মূল ভূখণ্ডের সাথে একটিমাত্র রাস্তা দিয়ে এর সংযুক্তি ছিল, যার দু’পাশেই সাগর। ক্রাসুস দেখলেন এই সুযোগ। তিনি সেনাদের দিয়ে অতি দ্রুত রাস্তার উপর পনেরো ফুট গভীর বিশাল এক পরিখা খনন করলেন। এর বাইরে দেয়াল দিয়ে পুরো রাস্তা বেষ্টন করা হলো। এরপর তিনি তার বাহিনীকে দেয়ালের বাইরে স্থাপন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ক্রাসুস জানতেন, বিরাট বাহিনী নিয়ে স্পার্টাকাস বেশিদিন অবরোধ সহ্য করে টিকে থাকতে পারবেন না। তার ইচ্ছা ছিল, কোনো যুদ্ধ না করেই কেবল দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের দমন করা।

স্পার্টাকাস বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও অবরোধ ভেদ করতে পারলেন না; উল্টো ৬,০০০ সেনা হারালেন। এরপর তিনি কাঠ আর দড়িদড়া ব্যবহার করে ভাসমান সেতু বানিয়ে সাগরের উপর দিয়ে মূল ভূখণ্ডে যাবার চেষ্টা করলেন। এবারও তিনি ব্যর্থ হন। আর কোনো উপায় না দেখে স্পার্টাকাস ক্রাসুসকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর উস্কানি দিতে চাইলেও ক্রাসুস তা অগ্রাহ্য করলেন। বিদ্রোহীদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে আসছিল। আরো কিছু সময় অবরোধ বজায় রাখতে পারলে ক্রাসুস হয়তো কোনো রক্তপাত ছাড়াই স্পার্টাকাসকে পরাজিত করতে পারতেন। কিন্তু তার দীর্ঘসূত্রিতায় সিনেট বিরক্ত হয়ে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ রোমান জেনারেল পম্পেইকে ডেকে পাঠাল। তিনি সবেমাত্র হিস্পানিয়ার রোমান বিদ্রোহীদের দমন করেছেন। এমন সময় সিনেটের আদেশ এসে পৌঁছলে পম্পেই ইতালির দিকে জাহাজ ভাসালেন।

ক্রাসুস পম্পেইয়ের কথা জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি জানতেন, পম্পেই এসে তার কৃতিত্বে ভাগ বসাবেন। কাজেই তিনি আসার আগেই স্পার্টাকাসকে নির্মূল করতে হবে। এদিকে এ সময়ই তুষারঝড়ে আচ্ছন্ন এক রাতে স্পার্টাকাস পরিখার এক অংশ মাটি আর গাছের কাটা অংশ ফেলে ভরাট করতে সক্ষম হলেন। সেদিক দিয়ে বাহিনী নিয়ে তিনি বের হয়ে যান।

রেগিয়াম ত্যাগ করার পরে কোনো কারণে বিদ্রোহীদের মধ্যে বচসা হলে তাদের ছোট একটি দল আলাদা হয়ে লুসেনিয়ান লেকের ধারে ক্যাম্প করে। মূল বাহিনী নিয়ে স্পার্টাকাস পেটেলিয়ার পার্বত্য এলাকার দিকে মার্চ করেন। ক্রাসুস এবার সরাসরি লড়াই করে তাকে পরাস্ত করার সংকল্প করলেন। পম্পেই আসার আগেই বিদ্রোহ মাটিতে মিশিয়ে দিতে হলে এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।

প্রথমে তিনি ক্যানিসিয়াস আর ক্যাস্টাসকে ৬,০০০ সেনা দিয়ে পাঠালেন লুসেনিয়ানের পাড়ে থাকা বিদ্রোহীদের ব্যবস্থা করতে। তারা চুপিসারে তাদের দিকে অগ্রসর হলেই ক্যাম্পের দুজন নারী তাদের দেখে ফেলে। বিদ্রোহীরা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কেবল ক্রাসুস মূল বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই পুরোপুরিভাবে তাদের পরাজিত করা সম্ভব হলো। বিদ্রোহী দলের প্রায় সবাই, বারো হাজারের বেশি মানুষ, ক্রাসুসের হাতে নিহত হয়।

এদিকে স্পার্টাকাস তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলছিলেন। ক্রাসুস তার যাত্রা শ্লথ করতে দুই রোমান অফিসার কুইন্টাস আর স্কোরফার অধীনে একদল অগ্রগামী সেনা প্রেরণ করেন। স্পার্টাকাসের সাথে সংঘর্ষে তাদের অনেকে হতাহত হলে বাকিরা পিছিয়ে আসে। এই বিজয়ে হিতে বিপরীত হলো। স্পার্টাকাসের সেনারা আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর হয়ে পড়ে। তারা স্পার্টাকাসের কাছে দাবি করে এভাবে পালিয়ে না গিয়ে খোলা প্রান্তরে ক্রাসুসের সাথে লড়াই করতে, যাতে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া যায়। স্পার্টাকাস তাদের কথা শুনে ঘুরে আবার লুসেনিয়ার রাস্তা ধরলেন। ক্রাসুস ঠিক এটাই চাইছিলেন।

বিদ্রোহের শেষ- ব্যাটল অভ সিলারিয়াস রিভার

সেলে নদীর তীরে ক্রাসুসের বাহিনীর সমরবিন্যাসের সামনে স্পার্টাকাস তার সেনাদের নিয়ে দাঁড়ালেন। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি নিজের ঘোড়াটি নিজেই হত্যা করেন। সাথীদের তিনি বললেন, বিজয়ী হলে পছন্দ করার মতো অনেক ঘোড়া তিনি পাবেন, আর পরাজিত হলে ঘোড়া আর কখনোই তার কোনো কাজে আসবে না।

ব্যাটল অভ সিলারিয়াস রিভার; Image Source: mirfaces.com

যুদ্ধ শুরু হলো। অল্পক্ষণেই তা তীব্র আকার ধারণ করে। স্পার্টাকাস অবস্থা দেখে বুঝতে পারলেন, একমাত্র ক্রাসুসকে হত্যা করার মাধ্যমেই তারা বিজয়ী হতে পারেন। নেতার অভাবে রোমান সেনাদলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যার সুযোগ স্পার্টাকাসের লোকেরা নিতে পারবে। ফলে তিনি দুর্বার বেগে ক্রাসুসের অবস্থানের দিকে ধাবিত হলেন। ক্রাসুসকে ঘিরে থাকা ব্যূহের দুই সেঞ্চুরিয়ন তার হাতে নিহত হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্পার্টাকাস পারলেন না। উরুতে আঘাত পেয়ে ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে তিনি মাটিতে বসে পড়েন। তারপরেও মাথার উপরে ঢাল ধরে তিনি প্রবল বিক্রমে শত্রুর প্রতি প্রত্যাঘাত করতে থাকেন। রোমানরা তাকে ঘিরে ফেলে। তাদের বারংবার আঘাতে অবশেষে স্পার্টাকাসের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বলা হয়, রোমানরা এরপরেও স্পার্টাকাসের নিথর দেহের উপর তাদের আক্রোশ মেটাতে থাকে। তার দেহ যুদ্ধক্ষেত্রে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়, পরে তা আর চিহ্নিত করা যায়নি।

স্পার্টাকাসের মৃত্যু; Image Source: allthatsinteresting.com

স্পার্টাকাসের মৃত্যুর পর বিদ্রোহীরা দ্রুতই সাহস হারিয়ে ফেলে। রোমানরা তাদের কচুকাটা করতে থাকে। অনেকে পালিয়ে যায়, বাকিরা বন্দি হলো। ক্রাসুসের দুর্ভাগ্য যে পম্পেই ইতোমধ্যে ইতালিতে অবতরণ করেছেন। তিনি ঠিক এই সময় বিদ্রোহীদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। পলাতক দাসেরা তার সামনে পড়লে তিনি তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেন। বন্দি ৬,০০০ দাসকে ভিয়া অ্যাপিয়া ধরে রোম থেকে কাপুয়ার রাস্তার দু’পাশে লাইন দিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। তাদের মৃতদেহ বহুদিন সেখানে ঐ অবস্থাতেই পড়ে ছিল।

ক্রুশবিদ্ধ দাসেরা; Image Source: welt.de

সত্যিকার অর্থে ক্রাসুসই স্পার্টাকাসকে পরাজিত করে বিদ্রোহের সমাপ্তি টেনেছিলেন। কিন্তু পলায়নরত দাসদের হত্যা করে পম্পেই বিদ্রোহ দমনের মূল কৃতিত্ব নিজের করে নেন। তিনি সিনেটকে চিঠি লিখে জানান যে, ক্রাসুস বিদ্রোহীদের সাথে ছোটখাট লড়াইতে জয়ী হয়েছেন বটে, কিন্তু বাকি সব দাসদের হত্যা করে বিদ্রোহের নাম-নিশানা মুছে দিয়েছেন পম্পেই। ফলে, তার জন্য সিনেট ট্রায়াম্ফের আয়োজন করে। বেচারা ক্রাসুসকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ওভেশন নিয়েই, যেখানে সবাই তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। কিন্তু ট্রায়াম্ফের জাঁকজমকের কাছে তা ছিল নস্যি।

স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের ফলাফল

তৃতীয় দাসবিদ্রোহ রোমকে বড় একটি ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও রোম স্পার্টাকাসকে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু সেই অর্থে কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্পার্টাকাস ফেলতে পারেননি। এই বিদ্রোহই ছিল সর্বশেষ, এরপর রোমে আর কোনো দাসবিদ্রোহ হয়নি। দাসদের অবস্থারও কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটেনি।

আঠার আর ঊনিশ শতক থেকে স্পার্টাকাসকে রোমান্টিসাইজ করার প্রবণতা তৈরি হয়। তাকে স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিভূ হিসেবে তুলে ধরা হয়, যে অত্যাচারী একনায়কের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন বই-পুস্তক, চলচ্চিত্র আর টেলিভিশন সিরিজ স্পার্টাকাসের চারিত্রিক এই রূপায়নের পালে আরো হাওয়া দেয়। যদিও ইতিহাসের নিরিখে এর সত্যতা সামান্যই। স্পার্টাকাসের মূল লক্ষ্য রোম জুড়ে দাসদের মুক্ত করা ছিল না, তিনি কেবল তার সাথীদের নিয়ে রোম থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেও কিন্তু দাসদের মুক্ত করতে এগিয়ে যাননি, বরং বহু দাস নিজে পালিয়ে গিয়ে তার সাথে যোগ দিয়েছিল। ইতিহাসের স্পার্টাকাস গল্প উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের স্পার্টাকাসের মতো মুক্তিসেনানী নন, তিনি শুধুমাত্র স্বদেশে ফিরে যেতে চাওয়া একজন মানুষ।

This is a Bengali language article as a part of the series about the rise of Ancient Rome. It describes the events of Spartacus's revolution.

References

  1. Three Slave Revolts
  1. Mark, J. J. (2016, March 04). The Spartacus Revolt. Ancient History Encyclopedia.

Featured Image: The Prodigal Son

Related Articles