Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর: এক বাঘের উত্থান

বর্তমান উজবেকিস্তান রাষ্ট্রটির পূর্ব দিকের একটি প্রদেশের নাম হচ্ছে ফারগানা। প্রদেশটির রাজধানীর নামও ফারগানা। শহরটি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দ থেকে ৪২০ কিলোমিটার পূর্বে এবং আন্দিজান শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে অবস্থিত। আমাদের আজকের আলোচনার বেশিরভাগের কেন্দ্রবিন্দুই হবে উল্লিখিত শহর দুটি। যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ১৪৬৯ সাল থেকে ১৫০৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই ফারগানা শহর এবং এর আশেপাশের বেশ কিছু শহর নিয়ে গঠিত হয়েছিলো ছোট্ট একটি রাজ্য। রাজ্যটির নাম- ফারগানা।

ফারগানা রাজ্যটি মোট ৭টি নগর নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাজ্যের দক্ষিণে ছিলো ৫টি নগরী আর উত্তর দিকে ছিলো ২টি নগরী। শুরুর দিকে এই রাজ্যের রাজধানী ছিলো আন্দিজান। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে ফারগানা রাজ্যটি ফলমূল উৎপাদনের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো। ফারগানার আনাজপাতি, আঙুর, তরমুজ আর নাশপাতি সত্যিকার অর্থেই বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো তখন। রাজধানী আন্দিজান পশুচারণের জন্য বেশ বিখ্যাত ছিলো। তাছাড়া এখানকার মানুষও বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলো।

রাজধানী আন্দিজানের লোকালয় কিংবা বাজার- সব জায়গাতেই তুর্কীদের আধিক্য ছিল। এই শহরের মানুষজন বেশ ধার্মিক ছিলো। শহরটির পানি ব্যবস্থাপনা ছিলো অত্যন্ত চমৎকার আর আবহাওয়াও ছিলো বেশ ভালো।  তৎকালে শহরটি ‘আনার’ আর ‘খুবানি’-র জন্য বিখ্যাত ছিলো।

ফারগানা রাজ্যটির আরেকটি নগর ‘অকশা’ বা ‘অকশি’ তৎকালে বেশ গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিলো। আয়তনে অকশা ফারগানা কিংবা আন্দিজান থেকে বেশ ছোট ছিলো। এই এলাকাটিতে কোনো গ্রাম ছিলো না, পুরোটাই শহুরে মানুষজনের আবসস্থল ছিলো তখন। উচ্চ মর্যাদা আর ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণে অকশা নগরীকে তৎকালীন শাসক উমর শেখ মির্জা তার রাজ্যের রাজধানী হিসাবে ব্যবহার করতেন। আর্থিক দিক দিয়ে বেশ স্বচ্ছল এই নগরীর তরমুজ খুব বিখ্যাত ছিলো।

বর্তমান সময়ের মানচিত্রে ফারগানা; Source: Wikimedia Commons

১৪০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিজেতা তৈমুর বেগ। গোটা মধ্য এশিয়াসহ আধুনিক পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কসহ বিস্তীর্ণ এক ভূখন্ড শাসন করতেন তিনি। কিন্তু তার মৃত্যুর সাথে সাথেই ভেঙ্গে পড়ে এই বিশাল তৈমুরি সাম্রাজ্য। একেবারে হঠাৎ করে এত বিশাল সাম্রাজ্যের ভেঙ্গে পড়ার পেছনে দায়ী মূলত যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আর সাম্রাজ্যের দাবী নিয়ে সংগঠিত গৃহযুদ্ধগুলো। অবশ্য সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তনও তৈমুরী সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিলো।

শেষমেষ ফলাফল এই দাঁড়ালো যে, তৈমুরি সাম্রাজ্যের বিশাল ভূখন্ড রাতারাতি বেদখল হয়ে গেলো। তবে তৈমুরের পৌত্র আবু সাঈদ মির্জা বিশাল এই সাম্রাজ্যের বেশ কিছু ভূখন্ড পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তৈমুরি সাম্রাজ্যের ঐক্য ধরে রাখতে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আর এই ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আবু সাঈদ মির্জার মৃত্যুর পর তৈমুরি সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশটুকু তার পুত্ররা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। আমাদের আলোচ্য ফারগানা রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন আবু সাঈদ মির্জার চতুর্থ পুত্র উমর শেখ মির্জা।

তৈমুরের সমাধিক্ষেত্রের বাইরের দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৪৮৩ সাল। এই দিনে ছোট্ট রাজ্য ফারগানায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেন। শিশুটির পিতার নাম উমর শেখ মির্জা। শিশুটির মাতার নাম কুতলুগ নিগার খানম। উমর শেখ মির্জা ফারগানা রাজ্যটির শাসক। তিনি সরাসরি তৈমুরের বংশধর। আর শিশুটির মাতা কুতলুগ নিগার খানম আবার সরাসরি চেঙ্গিস খানের বংশধর। কুতলুগ নিগার খানমের পিতার নাম ইউনুস খান। ইউনুস খান সরাসরি চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খানের বংশধর ছিলেন। সেই সূত্রে বাবর তৈমুর এবং চেঙ্গিস খান- উভয়েরই বংশধর। অর্থাৎ শিশুটি একইসাথে সরাসরি দুটি বিশ্ববিজয়ী বংশের রক্ত বহন করছে। এই রক্তই একসময় শিশুটিকে জয়ের নেশায় অস্থির করে রাখবে।

যা-ই হোক, তৎকালীন রীতিনীতি অনুযায়ী নবজাতক শিশুটির মাথার চুল কামানো উপলক্ষ্যে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হলো। শাসক পুত্র হওয়ায় নির্দ্বিধায় বলা যায় অনুষ্ঠানটি বেশ জাকজমকপূর্ণ ছিলো। এই দিনেই শিশুটির নাম রাখা হলো জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর বা বাবর। তার নামের শেষ অংশ, অর্থাৎ, ‘বাবুর’ শব্দটির অর্থ হলো ‘বাঘ’। শিশুটির পরবর্তী জীবনের কাজকর্ম আলোচনা করলে দেখা যায়, শিশুটি সত্যিকার অর্থেই বাঘের মতো সাহসী আর ক্ষিপ্র ছিলো। সেই আলোচনা যথাসময়ে আসবে।

বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জা তার পূর্বপুরুষের কীর্তি নিয়ে বেশ গৌরব করতেন। তবে তার ভেতরে হতাশাও ছিলো। তার পূর্বপুরুষরা একসময় পৃথিবীর বিশাল একটি অংশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক ছিলেন। কিন্তু তার বংশের সেই গৌরব আর তখন ছিলো না। তৈমুর বংশ সত্যিকার অর্থেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য বিচ্ছিন্নভাবে তখনও তৈমুর বংশের শাসকরা মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু ভূ-খন্ড শাসন করতেন। উমর শেখ মির্জা তাদের হারানো সেই গৌরব ফিরিয়ে আনার ব্যপারে বেশ উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, তিনি নিজে আর এই কাজটি করতে পারবেন না। তাই পুত্র বাবরের মাথায় এই ব্যাপারটি তিনি বেশ ভালোভাবেই ঢুকিয়ে দেন।

উমর শেখ মির্জার কবুতর পালনের বেশ শখ ছিলো। রাজধানী অকশায় তার প্রাসাদের ছাদের একটি অংশে তিনি কবুতর লালন-পালন করতেন। অকশার এই প্রাসাদটি একটি উপত্যকার ঠিক উপরে ছিলো। একদিন হঠাৎ ভূমিধ্বসে ফারগানার আমীর উমর শেখ মির্জা তার প্রিয় কবুতরদের সাথেই প্রাসাদের উপর থেকে উপত্যকার গভীরে গিয়ে পড়েন। এই পতনের সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনা ১৪৯৪ সালের ৮ জুন তারিখে সংঘটিত হয়েছিলো। মৃত্যুকালে উমর শেখ মির্জার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৯ বছর। উমর শেখ মির্জার পুত্র বাবর তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে চুঘতাই ভাষায় একটি বই লিখেন। বইটির নাম ‘তুজুক-ই-বাবরি’। বইটির বাংলা অনুবাদ ‘বাবরনামা’ হিসেবে পরিচিত। বাবরের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’ এ বাবর পিতার মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করেন এভাবে-

‘রমজান মাসের এক সোমবারে উমর শেখ মির্জা তার সমস্ত কবুতর উড়িয়ে দিলেন এবং নিজে বাজ হয়ে গেলেন।’

বাবুর পিতার ‘বাজ’ হয়ে যাওয়া দিয়ে আসলে পিতার মৃত্যুর ঘটনাকে বুঝিয়েছেন।

পিতা উমর শেখ মির্জা যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার বড় পুত্র বাবুর অকশা থেকে ৩০ মাইল দূরে আন্দিজানের চারবাগীতে অবস্থান করছিলেন। পিতার মৃত্যু ঘটনার একদিন পর তার কাছে এই মর্মান্তিক খবর পৌঁছায়। পিতার মৃত্যুর পর রাজ্যের শাসনভার সোজা তার হাতেই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের অভিজাতরা মাত্র ১১ বছর বয়সী বাবরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। কারণ ফারগানার পাশ্ববর্তী সমরকন্দের আহমেদ মির্জা উমর শেখ মির্জার মৃত্যুর এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইবেন। তিনি অবশ্যই সেনাবাহিনী নিয়ে ফারগানা অভিমুখে যাত্রা করবেন। এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এই ১১ বছরের কিশোর আহমেদ মির্জার হাত থেকে ফারগানা রাজ্যকে বাঁচাতে পারবে তো?

ফারগানার প্রবেশপথ; Source: whitesidesontheroad.com

রাজাদের জীবন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা হয় সিংহাসনে বসবেন না হয় কফিনে করে কবরে যাবেন। সাধারণ হিসাবে যার রাজা হওয়ার কথা, তিনি সিংহাসনে বসতে না চাইলেও পৃথিবীর কেউ না কেউ তাকে হুমকি হিসেবে নিবেই। এর ব্যতিক্রম ঘটনা খুব অল্পই পাওয়া যায়। আর তাই কিশোর বাবর কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই তার পিতৃ অধিকার আদায়ের জন্য নিজের বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে ফারগানা অভিমুখে যাত্রা করেন।

ফারগানায় বাবরের অবস্থানে রাজ্যের অভিজাতদের দ্বিধা আরো বেড়ে গেলো। তারা কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। কারণ ইতোমধ্যেই আহমেদ মির্জার অগ্রসরের খবর ফারগানায় পৌঁছে গিয়েছিলো। তবে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর ফারগানার অভিজাতরা ১১ বছর বয়সী কিশোর বাবুরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। ফারগানার বেগ দলপতিরাও বাবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে বাবর তার পরিবারের লোকজনের তীব্র সমর্থন ও সাহায্য পেলেন। এক্ষেত্রে কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেই নয়।

বাবুর তার প্রথম জীবনে আল মজালদ বেগ, হাসান ইবনে ইয়াকুব, কাসিম বেগ, বাবা কুল বেগ, নিজের নানি আলসান দৌলত বেগম, বাইসালঘা, মীর গিয়াস তগাই, কম্বর আলী, খ্বাজা কাজী, ঔজিগ হাসান, আলী দরবেশ খোরাসানীসহ বেশ কিছু মানুষকে নিজের চারপাশে বিশ্বস্ত হিসেবে পেয়েছিলেন। তাদের উদার সহায়তার ফলেই শেষ পর্যন্ত তিনি সিংহাসনে টিকে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাবর যে বয়সে সিংহাসনে বসলেন, তা একজন শাসকের জন্য সত্যিকার অর্থেই বিপজ্জনক। কারণ অল্প বয়স কিংবা অনভিজ্ঞতার সুযোগে তাকে সিংহাসন থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। সিংহাসনে টিকে থাকতে হলে তাই বাবুরকে বাঘের চেয়েও সাহসী আর ক্ষিপ্র হতে হবে। বাবরকে অবশ্যই তার নামের যথার্থতা প্রদর্শন করতে হবে। তবে বাবরকে প্রথমেই আহমদে মির্জার হুমকি মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিরক্ষার প্রথম কৌশল হিসেবে বাবর অকশা কেল্লার প্রাচীর উঁচু করে নিলেন। অকশার পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগাগোড়া ঢেলে সাজানো হলো। তবে সত্য কথা হচ্ছে, আহমেদ মির্জার আক্রমণে হয়তো ফারগানা টিকে থাকতে পারতো না। কিন্তু এসময় এমন একটি ঘটনা ঘটলো, যা বাবরকে ফারগানা রক্ষার সুযোগ তো করে দিলোই, সেই সাথে সামনে এগিয়ে সমরকন্দ দখলের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখাতে লাগলো!

অকশা দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন ফারগানার কিশোর শাসক বাবর; Source: art.thewalters.org

আহমদে মির্জা যখন ফারগানার দিকে ধেয়ে আসছিলেন, তখন ফারগানার বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো। ফলে আহমেদ মির্জার আগমনের রাস্তা পুরোপুরি কর্দমাক্ত হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। রাস্তা এতটাই কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিলো যে, কোন ঘোড়া বা উট সামনে আগাতে পারছিলো না। একই সাথে আহমদে মির্জার সেনাবাহিনীর মাঝে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারীতে সৈন্যরা মারা তো যেতেই থাকলো, সেই সাথে সেনাবাহিনীর সাথে থাকা বিভিন্ন পশুপাখিও মারা যেতে লাগলো। আহমদে মির্জার এই অভিযানটি শেষ পর্যন্ত বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো। তিনি অভিযান পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে সমরকন্দে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

তবে তিনি আসলে আর কখনোই সমরকন্দে ফিরতে পারেননি। ফারগানা অভিযানের কষ্ট আর ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর অবশেষে ১৪৯৪ সালের জুলাই মাসের কোনো একদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় আহমেদ মির্জার বয়স হয়েছিলো ৪৪ বছর। আহমেদ মির্জার মৃত্যুর সাথে সাথে বাবরের জন্য প্রথম হুমকিটি দূর হয়ে যায়। নিজের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় এই ঘটনাকে তিনি তার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

পিতা উমর শেখের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিশোর বাবরের ভেতরে বেশ ভালোভাবে সঞ্চারিত হয়েছিলো। কারণ তিনিও তার পিতার মতো পূর্বপুরুষদের গৌরবের অংশ হতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি প্রথমেই নজর দেন তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দের দিকে! আহমেদ মির্জার মৃত্যুর পর সমরকন্দের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন তারই চাচাতো ভাই সুলতান হোসেন। এসময় সমরকন্দ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অশান্ত হয়ে উঠলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। বাবর এ সুযোগ কাজে লাগাতে সমরকন্দের দিকে এগিয়ে আসেন। সমরকন্দ অবরোধের সময় তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ১৩ বছর!

সূর্যাস্তের সময়ের রেজিস্তান স্কয়ার, সমরকন্দ; Source: Wikimedia Commons

১৪৯৬ সালের শেষের দিকে তিনি সমরকন্দ অবরোধ করেন। কিন্তু এ যাত্রায় শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। দীর্ঘদিনের অবরোধের কারণে বাবরের সেনাবাহিনীতে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তাছাড়া সেই বছর তীব্র শীত পড়তে শুরু করে। তীব্র শীতে অবরোধ চালানোর মতো উপযুক্ত প্রস্তুতি বাবরের সেনাবাহিনীর ছিলো না। কাজেই সেইবারের মতো অবরোধ তুলে বাবর ফারগানা ফিরে আসতে বাধ্য হন।

সমরকন্দের বিবি খানম মসজিদ; Source: Wikimedia Commons

এর ভেতরেই বাবর তার চাচা মাহমুদ মির্জার সাথে সাক্ষাত করেন। বাবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় মাহমুদ মির্জা অস্তারাবাদ ও খোরাসানের শাসক ছিলেন। ধারণা করা হয়, তৎকালীন তৈমুরের জীবিত বংশধরদের ভেতরে এই মাহমুদ মির্জা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন। তৈমুরের অন্যান্য বংশধররা মাহমুদ মির্জাকে খুব সম্মান করতো এবং তার কথা মেনে চলতো। চাচার সাথে দেখা হলে চাচা মাহমুদ মির্জা বাবরকে তার পিতার রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারটির অনুমোদন দেন। মাহমুদ মির্জার সমর্থন পেয়ে বাবর ফারগানায় তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

সিটি সেন্টার, ফারগানা; Source: Wikimedia Commons

বাবর প্রথমেই আন্দিজানের জিকরাকে কাসিম বেগের নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। এসময় এই এলাকায় জংলী উপজাতির লোকেরা বসবাস করতো। তারা বাবরের প্রতি তাদের আনুগত্য স্বীকার করে এবং রাজস্ব হিসেবে ২,০০০ ভেড়া ও ১,৫০০ ঘোড়া প্রদান করে। জিকরাক থেকে বাবুর তার সেনাবাহিনীকে ঔরাটিয়ার দিকে প্রেরণ করেন। ঔরাটিয়া একসময় উমর শেখ মির্জার অধিকারে ছিলো। কিন্তু পরে তা সৈয়দ আলী মির্জার দখলে চলে যায়। বাবুরের সেনাবাহিনীর অগ্রসরের কথা শুনে সৈয়দ আলী মির্জা ঔরাটিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান। ঔরাটিয়া বাবুরের দখলে চলে আসে। পরে অবশ্য বাবর আবারো ঔরাটিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারান।

১৪৯৭ সালে বাবুর আবার ফারগানা থেকে সমরকন্দ অভিমুখে যাত্রা করেন। এসময় হুসাইন মির্জা নামক একজন সুলতানের আক্রমণে খসরু শাহ, মাসুদ মির্জাসহ তৈমুরের অনেক বংশধরই নিজ নিজ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এসব মির্জারা দলে দলে বাবরের কাছে ভীড় করেন। বাবর তাদের সাহায্য করতে অস্বীকার করেননি। আবুল করিম নামক একটি স্থানে বাবুর হুসাইন মির্জাকে বাঁধা দেন। যুদ্ধে হুসাইন মির্জা পরাজিত হয়ে খোরাসানের দিকে চলে যান। পরবর্তীতে সমরকন্দ আক্রমণে বাবুর এসব মির্জাদের সহায়তা পেয়েছিলেন।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাবর হুসাইন মির্জাকে পরাজিত করে তাকে খোরাসানের দিকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন; Source: Wikimedia Commons

সমরকন্দে অভিযানের উদ্দেশ্যে বাবর প্রথমে প্রায় ৩০০ অশ্বারোহীর একটি দল ইয়ারলকের দিকে প্রেরণ করেন। দলটি কোন বাঁধা ছাড়াই ইয়ারলকে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। বাবর এখানে প্রচুর পরিমাণে গণিমত লাভ করেন। এর ঠিক ২ দিন পর বাবর সিরাজে পৌঁছান। সিরাজ বাবরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। সিরাজ থেকে বাবরের বাহিনী ইয়াম নামক একটি স্থানে পৌঁছায়। তৎকালীন সময়ে ইয়াম খুব বিখ্যাত একটি বাণিজ্যিক এলাকা ছিলো। এর কয়েকদিন পরই বাবর সমরকন্দের সীমানায় পৌঁছান। তিনি সমরকন্দ অবরোধ করলেন। সমরকন্দ অবরোধকালীন সময়েও তার আশেপাশে অনেক মির্জারা ভীড় করতে লাগলেন। বাবর এসব মির্জাদের উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-

‘মির্জাদের আরামপ্রিয়তা তাদের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তারা সোনা-রুপার পাত্রে শরাব পান করতো। নিজেদের আরাম-আয়েশের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি থাকতো। সামরিক ব্যপারে তারা পুরোপুরি উদাসীন থাকতো। এ সকল কারণে তাদের উপর মুসিবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছিলো। তারা পরাজিত হয়ে আমার আশেপাশে ভীড় করছিলো। আর এতে আমার সামরিক শক্তি বেড়ে যাচ্ছিলো। তারা সবাই আমার উপর এই আশায় বুক বাঁধছিল যে, আমি অলৌকিক কিছু একটা করে দেখাবো। আর তাদের হৃত রাজ্যগুলো পুনরুদ্ধার করে দিবো।’

বাবর প্রায় দীর্ঘ ৭ মাস সমরকন্দ অবরোধ করে রেখেছিলেন। দীর্ঘ অবরোধের ফলে সমরকন্দ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেইযুগের রীতিই ছিলো যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ী সেনাবাহিনী বিজিত রাজ্যে লুটপাট চালাবে। কিন্তু তৈমুরের রাজধানী হওয়ায় বাবর শহরটিকে ধ্বংস করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি কঠোরভাবে লুটপাট নিষিদ্ধ করেন। বাবরের এই সিদ্ধন্তে তার বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধাই অসন্তুষ্ট হয়ে বাবরকে ত্যাগ করে চলে যায়। সমরকন্দের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বাবরের হাতে খুব অল্প সংখ্যক যোদ্ধাই ছিলো।

সমরকন্দের উলুঘ বেগ মাদ্রাসা; Source: Wikimedia Commons

সমরকন্দ দখলের পর বাবর অবরোধের ফলে শহরের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। সেই সাথে শহরের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। এসময় প্রচন্ড ব্যস্ততায় তিনি ফারগানার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে ফারগানায় আবারো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সমরকন্দে অবস্থানকালে বাবর কিছুদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মৃত্যু হয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ফারগানার ষড়যন্ত্রকারী অভিজাত ব্যক্তিবর্গরা এই সুযোগে বাবরের সৎভাই জাহাঙ্গীর মির্জাকে ফারগানার সিংহাসনে বসিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর মির্জা বয়সে বাবরের চেয়েও দুই বছরের ছোট ছিলেন।

ফারগানার প্রাকৃতিক দৃশ্য; Photo Credit: Martin Klimenta

ফারগানা পুনরুদ্ধার করতে বাবর সমরকন্দের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সেনা মোতায়েন করে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ফারগানা অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি তার ফারগানা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন আন্দিজানের দক্ষিণাঞ্চলের অশপরী, তুরিকশর, চিচকরক দিয়ে। এসব এলাকা পুনরুদ্ধারের জন্য বাবর ইব্রাহীম সারু, ওয়াইশ লেঘারি এবং সাইয়িদি কারাকোর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে থাকেন। এসব এলাকা দখলের পর বাবর মর্ঘিননের দিকে অগ্রসর হন। মর্ঘিনন দখলের পর বাবর আন্দিজান পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দুর্গটি দখলের সিদ্ধান্ত নিলেন। দুর্গটি ‘কেল্লা কাশগড়ী’ নামে পরিচিত ছিলো। দুর্গটি বেশ ভালো প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদর্শন করলেও শেষপর্যন্ত বাবরের পদানত হলো। দুর্গ দখলের এই যুদ্ধে ৭০-৮০ জন বন্দী হয়েছিলো।

বাবর এরপর আন্দিজান নগরীর দিকে নিজের দৃষ্টি নিবন্ধ করলেন। আন্দিজানের দায়িত্ব তখন নাসির বেগ নামক একজন প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলো। নাসির বেগ বাবুরকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো, কিন্তু বাবরের দুর্ধর্ষ আক্রমণে আন্দিজানের পতন ঘটলো। আন্দিজানের প্রশাসক নাসির বেগ ও তার দুই পুত্র দোস্ত বেগ, মরিম বেগ বাবরের হাতে বন্দী হলো। পরে তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। আন্দিজানের পতনের পর অবশিষ্ট বিদ্রোহীরা অকশায় ঐক্যবদ্ধ হয়। বাবর অকশায় হামলা চালিয়ে অকশা নিজের পদানত করে নেন। তিনি অকশার দায়িত্ব ঔজিন হাসানের হাতে অর্পণ করে তাশখন্দের দিকে যাত্রা করেন।

বর্তমান ফারগানায় তৈরিকৃত কিছু হস্তনির্মিত তৈজসপত্র; Source: abercrombiekent.com.au

বাবর পরবর্তী ২ বছর আর আন্দিজান যেতে পারেননি। এই দু’বছরে আহমদ কম্বোল নামে কম্বর উপজাতির এক ব্যক্তির নেতৃত্বে আন্দিজানে মোট ৫ বার বিদ্রোহ হয়। ফলে বিদ্রোহ দমন করতে বাবরকে বারবার সমরকন্দ থেকে আন্দিজানে সেনাঅভিযান পরিচালনা করতে হয়। বাবরের শেষ অভিযানে আহমদ কম্বোল পরাজিত হয়ে পালানোর সময় পাহাড় থেকে পিছলে পড়ে মারা যান। তার মৃত্যুর সাথে সাথে আন্দিজানের ধারাবাহিক বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। এর ফলে বাবরের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা। কিন্তু আহমদ কম্বোলের এই মৃত্যুই আবার বাবরকে অন্য এক বিপদে ফেলে দিয়েছিলো।

আহমদ কম্বোলের মৃত্যুর পর তার স্বজাতির লোকেরা তার মৃত্যুর বদলা নিতে চাইলো। তাই তারা সরাসরি বুখারার শাসক শায়বানি খানের কাছে গিয়ে এই তথ্য দিলো যে- বাবর বুখারা দখল করতে বুখারার দিকে ধেয়ে আসছে! সেইসময় বুখারার শাসক উজবেক শায়বানী খান নিজেকে উজবেকদের একক অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো। বিভিন্ন ছোটবড় উজবেক সরদাররা শায়বানী খানের আশেপাশে ভীড় করে তার শক্তিবৃদ্ধি করছিলো। কাজেই বাবরের হুমকিকে গ্রাহ্য করার মতো মানসিক পরিস্থিতিতে শায়বানী খান ছিলো না। শায়বানী খান বাবরের অপেক্ষা না করে সরাসরি সমরকন্দে আক্রমণ চালিয়ে শহরটি দখল করে নিলেন।

শায়বানী খানের সমরকন্দ আক্রমণের সময় বাবর সমরকন্দের বাইরে অবস্থান করছিলেন। সমরকন্দ পতনের সংবাদ পেলে তিনি দ্রুত সমরকন্দে ফিরতে চাইলেন। কিন্তু শহরটির পতনের পর শহরের মির্জাদের পলায়নের সংবাদ শুনে বাবরের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধারাই ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেলো! বাবরের পক্ষে সেইবার আর সমরকন্দ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

সমরকন্দে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর বাবুর ফারগানার উপরেও তার নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্তভাবে হারিয়ে ফেললেন। বাবুরের কাছে এখন সমরকন্দও নেই, নেই ফারগানাও! এই ঘটনার প্রসঙ্গে বাবুর তাঁর আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় লিখেছেন-

‘আমার হাত থেকে সমরকন্দও চলে গেলো, ফারগানাও। এখন আমার আর জানা ছিলো না যে আমি কোথায় যাচ্ছি, আর কোথায় আমার মঞ্জিল।’

সমরকন্দ আর ফারগানা হারানোর পর বাবর বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন। তার অধিকাংশ যোদ্ধাই হয় তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে, নয়তো তিনি তাদের ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এসময় বাবর তার পিতার সময়ের বিশ্বস্ত কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে গোপনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তারাই গোপনে বাবরকে সহায়তা করতে থাকে। এছাড়া ফারগানার বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি জনসাধারণের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হন। বাবর ক্রমেই শক্তি অর্জন করতে থাকেন। বাবরের এই দুর্দশার সময়ও সিরাজ কেল্লায় ইব্রাহীম তরখান, সংগজারে কম্বর আলী এবং কোহবরে আবুল কাসিমের নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিলো। তারা যথাযম্ভব বাবরকে সহযোগীতা করলেন। নিজের সেনাবাহিনী মোটামুটি গুছিয়ে বাবুর আসফাদিকের দিকে যাত্রা করেন। বাবর শায়বানী খানের হাত থেকে আবারো সমরকন্দ দখলের পরিকল্পনা করতে থাকেন।

সমরকন্দ দখলের পর শায়বানী খান জানে ওয়াফা নামক একজনের কাছে শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে শহরটি ত্যাগ করে। সমরকন্দের দুর্গ রক্ষার জন্য প্রায় ৫০০-৬০০ জন সৈন্য দুর্গে অবস্থান করছিলো। সমরকন্দ দখলের সময় শায়বানী খান শহরে ব্যপক লুটপাট ও গণহত্যা চালায়। ফলে সমকরন্দবাসী শায়বানী খানকে পছন্দ করতেন না। সমরকন্দ পুনর্দখলের ক্ষেত্রে বাবর এই ব্যপারটি তার মাথায় রাখেন। কারণ, এর ফলে বাবরের আক্রমণের সময় শায়বানী খানের সৈন্যরা শহরবাসীর কোনো সাহায্য পাবে না।

সমরকন্দের শের-দর মাদ্রাসা; Source: advantour.com

১৫০০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সমরকন্দ বাবুরের পদানত হয়। এবারের বিজয় খুবই সহজ ছিলো। সমরকন্দের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা শায়বানী খানের বেশিরভাগ যোদ্ধাই নিহত হয়। সমরকন্দ অধিকারের পর বাবর যখন ঘোষণা দেন যে, তিনি আবারো সমরকন্দ দখল করে নিয়েছেন, তখন শহরটির অনেক মানুষই ব্যপারটি বিশ্বাস করেনি। বাবর সত্যিকার অর্থেই খুব সহজে সমরকন্দ পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে ‘বাবরনামা’য় বাবর লিখেছেন-

‘দুর্গ অধিকারের পর আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে নগর অভিমুখে রওয়ানা দেই। সেখানে পৌঁছে আমি ঘোষণা দেই এখন আর শায়বানী নয়, বরং সমরকন্দে আমার হুকুমত কায়েম হয়েছে। আমার এ ঘোষণায় নগরবাসী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তারা সহজে ব্যপারটি বিশ্বাস করতে পারছিলো না।’

সমরকন্দের তিলাকরি মাদ্রাসার সিলিং-এর কারুকার্য; Source: klogsandkangaroos.com

কিন্তু যখন সমরকন্দবাসী বাবরের বিজয়ের ব্যপারে নিশ্চিত হলো, তখন তারা আনন্দ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে আসলো। নগরের বেশিরভাগ এলাকা দখল করতে বাবরকে আর নিজের সৈন্য ব্যবহার করতে হয়নি। সমরকন্দে শায়বানীর যে সকল সৈন্য অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিলো, তাদের হত্যার দায়িত্বটুকু নগরবাসী নিজেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। লাঠি, ইট প্রভৃতি ব্যবহার করে নগরবাসী প্রায় ৪০০-৫০০ জন উজবেক সৈন্যকে হত্যা করে।

সমরকন্দ দখলের পর বাবর শহরটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আবারো ফারগানার দিকে নজর দিলেন। ফারগান পুনরুদ্ধার করার জন্য তিনি মির্জাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। কাশগড়ের কাছাকাছি এলাকায় তিনি মাহমুদ মির্জার ছোট ভাই আহমদ মির্জার সাথে দেখা করেন। আহমদ মির্জা তাকে জানান যে, মির্জাদের সমর্থন তার উপরেই রয়েছে। আহমদ মির্জা তাকে একথাও জানান যে, আয়ুশ নামক এলাকায় তার জন্য বেশ কিছু অস্ত্র ও সেনাসাহায্য পৌঁছে যাবে। কিন্তু যাত্রাপথের অর্ধেক পাড়ি দেওয়ার পর বাবরের সেনাবাহিনীর মাঝে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লো। আর তা হলো, মির্জারা বাবরের পক্ষে তাদের সমর্থন ত্যাগ করে ফারগানার বর্তমান শাসকের উপরেই আস্থা রেখেছে! এই গুজব ছড়ানোর পর এক রাতের মাঝেই বাবরের অধিকাংশ সৈন্য তাকে ত্যাগ করে একা রেখে চলে গেলো!

এদিকে কম্বরদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শায়বানী খান আবারো সমরকন্দ দখল করে নেয়। চারদিক থেকে দুঃসংবাদ আসতে থাকায় বাবর আয়ুশ থেকে পিছু হটতে থাকেন। এসময় তার সাথে মাত্র ২০-৩০ জন বিশ্বস্ত সহযোগী অবস্থান করছিলো! এ সমস্ত ঘটনা ১৫০২-০৩ সালের মাঝামাঝি ঘটতে থাকে। সময়গুলো নিঃসন্দেহে বাবরের জন্য বেশ খারাপ যাচ্ছিলো।

সমরকন্দ এবং ফারগানা- দুটি শহরেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাবর খোরাসানের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাত্রা শুরু করে তিনি হিসারের কাছাকাছি আলাক-ইয়ালাক নামক স্থানে তাঁবু ফেলেন। এসময় তার সাথে মাত্র ৩০০ জনের মতো যোদ্ধা ছিলো। আলাক-ইয়ালাকে তিনি তিন-চারদিন অপেক্ষা করেন। তিনি আসলে এসময় সাহায্যের অপেক্ষা করেন। তার ধারণা ছিলো তার সাহায্যার্থে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। আলাক-ইয়ালাক থেকে তাঁবু গুটিয়ে বাবর হিসারের ইমাম মুহিব্ব নামক স্থানে পৌঁছান। এখানে খসরু শাহ বাবুরকে কিছু যোদ্ধা সাহায্যস্বরূপ প্রেরণ করেন। খসরু শাহের সাহায্য প্রাপ্তির পর বাবুর আরো সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এসময় তিনি বিভিন্ন গোত্র থেকে যোদ্ধাদের তার দলে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তেমন সফলতা পাননি। কবাদিয়ান নামক স্থানে পৌঁছালে বাবুরের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে তিরমিজ আর সফার শাসক বকল। সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি খসরু শাহের ছোট ভাই।

১০

কবাদিয়ান থেকে বাবুর কাহমর্দ আর বামিয়ান এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এসময় তার দলে খসরু শাহের ভাগ্নে আহমদ-ই-কাসিম যোগ দেন। এছাড়াও যাত্রাপথে বাবুরের বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন যোদ্ধা ও জেনারেলরা বাবরের সাথে পুনরায় যোগ দিতে থাকে। এদের মাঝে কাম্বার আলী, ইয়াদ আল বলাল অন্যতম।
এর ভেতরেই খসরু শাহ বাবুরের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাকে বাদশাহ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইলে অন্যান্য মির্জারা বাবুরকে নিজেদের প্রতি হুমকি মনে করতে শুরু করে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হুসাইন মির্জা, বদিউজ্জামান মির্জা, খসরু শাহ আর জুনিন বেগের নিকট থেকে বাবর কিছু পত্র পান। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিলো মাহমুদ মির্জা, আহমেদ মির্জা, উলঙ্গ মির্জা- এই তিনভাই জোটবদ্ধ হয়ে বাবরের দিকে ধেয়ে আসছে। এই তিনভাই মির্জাদের মাঝে খুবই প্রভাবশালী আর শক্তিশালী ছিলো।

এমতাবস্থায় বাবর খোরাসান যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্রুত কাহমর্দ ত্যাগ করে মুর্গ-এ-আব নামক স্থানে নিজের তাঁবু ফেললেন। এই জায়গাটি তৈমুরের আমলে তৈমুরি সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। মুর্গ-এ-আব থেকে বাবর তিরমিজের পার্বত্য এলাকা আর কিরকি উপত্যকায় পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। ইতোমধ্যে সায়বক খান আন্দিজান দখল করে নিয়ে হিসার, কুন্দুজ দখলের পরিকল্পনা করছিলেন। এসব অঞ্চল খসরু শাহের এলাকা ছিলো। তিনি সায়বক খানকে বাধা না দিয়ে সোজা বাবুরের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য হিসার আর কুন্দুজ ছেড়ে দিলেন। এর ভেতরেই চারদিক থেকে বাবরের অনুগত বিভিন্ন যোদ্ধারা বাবরের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ছুটে আসতে শুরু করেছিলো। এক দিনেই প্রায় ৪ হাজারের একটি অশ্বারোহী দল বাবরের সাথে যোগদান করে। এর ফলে তার সামরিক শক্তি বেশ শক্ত হয়ে উঠে।

৪ হাজার অশ্বারোহীর দলটি বাবরের সাথে যোগদান করলে খসরু শাহ কিছুটা দোটানায় পড়ে যান। খসরু শাহ আসলে বাবরকে সেনাসাহায্য দিয়ে তাকে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে বাঁধতে চাইছিলেন। কিন্তু বাবর নিজেই এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। ‘বাবরনামা’য় বাবর খসরু শাহের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন এভাবে-

‘আসলে খসরু শাহ হাওয়া বুঝে ছাতা ধরার মতো মানুষ ছিলেন। তিনি যেদিকে ওজন বেশি দেখতেন, সেই পাল্লাতেই বসে পড়তেন। তিনি বীর বাহাদুর নন, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মানুষ ছিলেন। নিজের জীবনের নিরাপত্তার উপরেই তিনি বেশি নজর দিতেন।’

তবে ১৫০৪ সালের আগস্টের শেষের দিকে শেষপর্যন্ত খসরু শাহ বাবরের পক্ষে যোগদান করেছিলেন। এসময় খসরু শাহের সাথে তার ভাই জাহাঙ্গীর মির্জা আর মির্জা ওয়াইস খানও ছিলেন। খসরু শাহের সাথে ছিলো প্রচন্ড শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী। তবে বাবর খসরু শাহকে কাপুরুষ ও নিমকহারাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘বাবরনামা’য় সোজাসুজিই বলেছেন, প্রয়োজন না হলে তিনি খসরু শাহকে তার দলে নিতেন না।

১১

বাবর দীর্ঘদিন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করলেন। অবশ্য তখনো তার দলে বিভিন্ন যোদ্ধারা ভীড় করছিলো। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, বাবর কিছু একটা করে দেখাবেন। বাবুর যদি বড় কোনো রাজ্যের শাসক হতে পারেন, তখন তারা বাবরের সাথে থাকতে চায়।

বাবরের ভাগ্য এবার আর তার সাথে বিরুপ আচরণ করেনি। তিনি যখন দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন, তখন কাবুলের শাসক উলুঘ বেগ মির্জা মৃত্যুবরণ করেন। উলুঘ বেগ সম্পর্কের দিক দিয়ে বাবরের চাচা হন। উলুঘ বেগ মির্জার মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা আবদুর রাজ্জাক কাবুলের সিংহাসনে বসেন। মুহাম্মদ মুকিম নামে এক উপজাতি সর্দার মির্জা আবদুর রাজ্জাককে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে কাবুলের সিংহাসনে বসে। এ ঘটনার পর কাবুল রাজদরবারের একদল অভিজাত বাবরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে কাবুলের ক্ষমতা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। বাবর তাদের এই প্রস্তাব লুফে নেন। এবার তার পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর দিন শেষ হতে চলছে।

বাবর যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য হিন্দুকুশ পর্বতের মধ্যদিয়ে পর্বত পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। তিনি দ্রুত কাবুলে পৌঁছাতে চাইছিলেন। তার এ পরিকল্পনা খুবই বিপজ্জনক ছিলো। পুরো পর্বতশ্রেণী বরফে ঢাকা। তাছাড়া বরফের ভেতর দিয়ে চলার মতো পথও তার জানা ছিলো না। কিন্তু এছাড়া তার হাতে আর অন্য কোনো উপায়ও ছিলো না।

হিন্দুকুশ পর্বতমালা। কাবুল অভিযানের সময় বাবর এমন দুর্গম এলাকা পাড়ি দিয়েই কাবুল এসে পৌঁছান; Source: Wikimedia Commons

এর ভেতরেই আবার বাবরের পক্ষে আরো ৩০ হাজারের একটি সেনাবাহিনী বাবরের সাথে যোগদান করলো। তারা মূলত মাহমুদ মির্জার সৈন্য ছিলেন। কিন্তু মির্জার স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে তারা বাবরের পক্ষে যোগদান করে। বলাই বাহুল্য, এই ৩০ হাজার যোদ্ধা বাবরের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি পালটে দিলো! তবে হিন্দুকুশের বরফাবৃত পথের কষ্টের জন্য খসরু শাহ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি আর সামনে না এগিয়ে কাহমর্দ ফিরে যান। তিনি বাবরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি বাবরের সাথে কাবুলে দেখা করবেন। এই প্রসঙ্গে বাবর তার ‘বাবরনামা’য় লিখেছেন-

‘খসরু শাহের এই চরিত্রের কথা আমার কাছে অজানা ছিলো না। আমি আগে থেকেই জানতাম তিনি কাপুরুষ এবং কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি তার ছিলো না। তিনি আমার সাথে ওয়াদা করলেন, তিনি খোরাসান, ঘুলে ও দজানার রাস্তা ধরে খোরাসান উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তারপর তিনি কাহমর্দ থেকে নিজের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে কাবুলে আবার আমার কাছে ফিরে আসবেন। তবে আমার কাছে তার ওয়াদার কোনো গুরুত্ব ছিলো না।’

উল্লেখ্য, কাহমর্দে বাবর তার পরিবারকেও রেখে এসেছিলেন।

১২

কাবুলের উদ্দেশ্যে বাবরের যাত্রাপথে অবশ্য বারবার উজবেকরা তাকে তাড়া করছিলো। কিছু কিছু জায়গায় ছোটখাট সংঘর্ষ হচ্ছিলো। খ্বাজা জায়েদ নামক স্থানে এমনই একটি লড়াই হয়েছিলো। উজবেকরা বেশিরভাগ সংঘর্ষেই পরাজিত হয়ে পিছু হটছিলো। বাবর এর পরে কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই ঘুরবুন্দ, লমঘান তুরখানি এলাকা পাড়ি দিতে লাগলেন। এসব এলাকা মূলত আফগানদের অধিনে ছিলো। তারাও বাবরকে বাধা দেওয়ার সাহস করেনি।

অধিনেসনজিদের পাহাড়ি উপত্যকা পাড়ি দেয়ার সময় অবশ্য কিছু স্থানীয় উপজাতি গোত্রের যোদ্ধারা বাবরকে বাধা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু বাবর তাদের কোনো সুযোগ না দিয়ে বন্দী করে ফেলেন। পরে এসব উপজাতি যোদ্ধারা ক্ষমাপ্রার্থনা করলে বাবর তাদের ক্ষমা করে নিজ বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করে নেন। অবশ্য বিভিন্ন পাহাড়-পর্বত আর উপত্যকা পাড়ি দেয়ার সময় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা বাবরের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে বাবরের কিছু লোকহানি হয়।

এছাড়া দুর্গম বরফাবৃত পথের কারণে বাবরের বেশ কিছু সহযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করলে বাবর কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। বাবর এমনিতেই পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর জন্য বিপর্যস্ত ছিলেন। তার উপর যাত্রাপথের সংঘর্ষ আর দুর্গমতার জন্য বাহিনীর লোকক্ষয়ে তিনি আরো বিপর্যস্ত বোধ করতে লাগেলন। তিনি ভাবছিলেন কাবুল বিজয়ের আশা ত্যাগ করে আবার ফারগানার কিংবা সমরকন্দের দিকে ফিরে যাবেন কিনা। তিনি এ ব্যাপারে তার জেনারেলদের সাথে আলোচনায় বসলে, জেনারেলরা উত্তর দিলেন-

‘আমাদের এক মূহুর্তও থেমে থাকা উচিত নয়। শরৎ ঋতু শুরু হতে চলেছে। তার আগেই আমাদের লামঘান পৌঁছানো উচিত। সেখানে সমতল এলাকায় যুদ্ধের ফলাফল আমাদের অনুকূলে আসবে। আমরা নিজেদের কাবুল বিজেতা হিসেবে অভিহিত করতে চাই।’

সুতরাং সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছুঁড়ে ফেলে বাবর আর তার সেনাবাহিনী আবারো কাবুলের দিকে ছুটতে থাকলেন। আক সরাই উপত্যকা অতিক্রম করে তিনি কারাবাগ নামক স্থানে নিজের শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে বাবর আবা-কুরুকের দিকে অগ্রসর হলেন। এই স্থানেই বাবরের পরিবার তার সাথে মিলিত হলো। এই স্থান থেকে সামনে এগোনোর সময় বাবরকে কাবুলের তৎকালীন ক্ষমতা দখলকারী সুলতান মুহাম্মদ মুকিমের বাধা অতিক্রম করে এগোতে হচ্ছিলো।

মুহাম্মদ মুকিম বাবরের অভিযানের খবর পেয়ে গিয়েছিলো। তার বাহিনী রাস্তাঘাট, ব্রিজ ইত্যাদি ভেঙ্গে দিয়ে বাবরের যাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করছিলো। বাবর তাই অভিযানের সুবিধার্থে নিজের বাহিনীকে ৪টি ভাগে ভাগ করে নিলেন। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন হায়দার ত্বকী বাগ এবং কুল বায়জীদ, দ্বিতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খসরু শাহের ভাই জাহাঙ্গীর মির্জা। চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং বাবর। বাহিনী ৪টি কাবুলের আশেপাশের এলাকা দখল করতে করতে সামনে আগাচ্ছিলো। কাবুলের দুর্গে বাবরকে কিছু ছোটখাট সংঘর্ষে জড়াতে হলো। কিন্তু বড় ধরনের কোনো বাধা তাকে দেওয়া হয়নি। মুহাম্মদ মুকিম সামান্য কিছু প্রচেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে বাবরের সাথে সন্ধি করেন। সন্ধির শর্তানুযায়ী মুহাম্মদ মুকিম বাবুরের নিকট কাবুল সমর্পণ করে। এছাড়াও সন্ধির শর্তানুযায়ী মুহাম্মদ মুকিম রাজকীয় কর্মকর্তার মর্যাদা ভোগ করে এবং নিজের ধনরত্ন নিয়ে কান্দাহারের দিকে চলে যায়।

কাবুল অধিকারের পর বাবর কাবুলে প্রবেশ করছেন; Source: art.thewalters.org

কাবুলে আর বাবুরকে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না। ধীরে ধীরে কাবুল এবং সমগ্র গজনী এবার বাবুরের পদানত হলো। ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনানুযায়ী, এই ঘটনা ৯১০ হিজরির রবি উস-সানি মাসের শেষ ১০ দিনের ঘটনা। গ্রেগরিয়ান ক্যলেন্ডার অনুযায়ী, ১৫০৪ সালের অক্টোবরের ঘটনা এগুলো। এসময় বাবরের বয়স হয়েছিলো মাত্র ২৩ বছর।

বাবরের যৌবনের একটি ছবি; Source: Wikimedia Commons

১৩

যখন সমবয়সী একজন কিশোরের খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা, তখন সদ্য পিতা হারানো জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর বা বাবুর ফারগানার রাজসিংহাসনে বসেছিলেন। এসময় তার বয়স ছিলো মাত্র সাড়ে এগার কি বারো। ভাগ্য তাকে নিজের আত্মীয়স্বজনদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলো। বাবরের জীবন ছিলো বৈচিত্র্য আর যুদ্ধবিগ্রহে ভরা। কখনো তিনি শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসেছিলেন, আবার কখনো নিঃস্ব অবস্থায় পথে পথে ঘুরেছেন। কখনো তার সাথে হাজার হাজার সৈন্যের বিশাল সেনাবাহিনী ছিলো, আবার কখনো হাতেগোনা ১০/২০ জন লোক নিয়ে তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তার উচ্চাশা ছিলো আকাশচুম্বী।

পূর্বপুরুষ তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দের প্রতি ছিলো তার অদম্য টান। কাবুল বিজয়ের পূর্বে তিনি শহরটিকে দু’বার পদানত করেন। কিন্তু কোনোবারই শহরটির দখল ধরে রাখতে পারেননি। সমরকন্দের প্রতি এই অদম্য আকর্ষণের কারণে নিজ জন্মভূমি ফারগানা তার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। দ্বিতীয়বার সমরকন্দ হারানোর পর তিনি খোরাসানের দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বাধা পেলেন, তা-ও নিজের আত্মীয়দের দ্বারাই। শেষমেষ কাবুল দখলের স্বপ্ন যখন তাকে হাতছানি দিচ্ছিলো, তখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি।

একপর্যায়ে কাবুল দখলের আশা ছেড়ে ফারগানা কিংবা সমরকন্দের দিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কাবুল দখল করতে সক্ষম হলেন তিনি। কাবুল দখলের সিদ্ধান্ত বাবরের জন্য লাভজনক প্রতীয়মান হয়েছিলো। কাবুল দখল না করলে তাকে হয়তো সারাজীবন ফারগানা কিংবা সমরকন্দের ভেতরেই আটকে থাকতে হতো। কিন্তু যার নামই হচ্ছে বাবর, মানে ‘বাঘ’। তার জন্য তো এত ছোট কিছু মানায় না। নিজের নামের স্বার্থকতা প্রকাশ করতেই যেন তিনি তার পরবর্তী জীবনে আরো আকাশচুম্বী পরিকল্পনা করতে থাকলেন! সে আলোচনা আরেকদিন করা যাবে।

তথ্যসূত্র:
১। বাবরনামা- জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)
২। হুমায়ুননামা- মূল: গুলবদন বেগম (অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ)
৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান

এই সিরিজের আগের পর্ব

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা
২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ
৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল
৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক
৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল
৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল
৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন
৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য
৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস
১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র

ফিচার ইমেজ: islamic-arts.org (Captured by: Muzaffar Bukhari)

Related Articles