Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কম্বোডিয়ার রাজনীতিতে খেমার রুজদের উত্থান

ইতিহাসের হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমানে আমরা বাস করছি আধুনিক এক যুগে, যেখানে একদিকে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা আমাদের সার্বিক জীবনকে করেছে অনেক সহজতর, পাশাপাশি আধুনিকতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জটিলতার। মানবজাতির এই দীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে, যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে ‘ইতিহাস’ নাম দিয়ে। ইতিহাস আমাদেরকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে নিয়ে যায় হাজার বছর পুর্বে। ইতিহাস আমাদের জানায়, মানবজাতির পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। গত দুই হাজার বছরের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে- অসংখ্যবার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পৃথিবীর মাটি। স্রেফ কিছু বিভেদ কিংবা বৈরিতাকে মস্তিষ্কে গেঁথে সূচনা হয়েছে অসংখ্য ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের, যেগুলোতে অন্য কোনো প্রাণী নয়, মানুষের দ্বারাই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সংঘর্ষে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের সবচেয়ে বড় অংশ ছিল রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নিরপরাধ সাধারণ মানুষ।

অভিশপ্ত ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার পর এশিয়ার হাতেগোণা কয়েকটি দেশ বাদে প্রায় সব দেশকেই ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর দাসত্ব বরণ করে নিতে হয়েছিল। ঔপনিবেশিক যুগে এই দেশগুলোর মূল কাজ ছিল ইউরোপের বিশাল কলেবরের শিল্পবিপ্লবে বিরামহীনভাবে কাঁচামালের যোগান দিয়ে যাওয়া, উপনিবেশে প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রভূত সম্পদ গড়ার ‘উৎস’ হিসেবে কাজ করা। শত শত বছর ধরে ঔপনিবেশিক দেশগুলো থেকে বিশাল পরিমাণ সম্পদ পাচার করা হয়েছে, বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। যখনই এই নিরবচ্ছিন্ন পাচারে বাধা দেয়ার জন্য উপনিবেশগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেধে উঠেছে, তখনই শাসকেরা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে নির্মমতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলো যে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে, সেগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করাই যথেষ্ট। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে যখনই বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখনই দমনের জন্য নিপীড়নের সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে ভিনদেশি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে।

Hcjckckvlv
ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের সফলতা কম্বোডিয়ার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল; image source: asiatimes.com

কম্বোডিয়া দেশটি এশিয়া মহাদেশের সেই দেশগুলোর একটি, যেটি আর দশটি এশিয়ান দেশের মতোই ইউরোপের কোনো শক্তিশালী দেশের উপনিবেশ হিসেবে অভিশপ্ত সময় পার করে এসেছে। কম্বোডিয়ার জনগণের ভাগ্য আরও খারাপ বলতে হয়। কারণ এশিয়া মহাদেশের বেশিরভাগ দেশ যেখানে বাইরের আধিপত্যকামী উপনিবেশবাদী দেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে যেভাবে নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেদিক থেকে কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষের ভাগ্যে লেখা ছিল উপনিবেশকালের তুলনায় আরও ভয়ংকর সহিংসতা। উপনিবেশের নিগড় থেকে মুক্ত হওয়ার পর যে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়েছিল কম্বোডিয়ান জনগণ, সেই দলই দিনশেষে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের উপর। কম্বোডিয়ার জাতীয় রাজনীতিতে খেমার রুজ তথা কম্বোডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন কিংবা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের কারণে যে জনপ্রিয়তা তাদের ছিল, সেটি বিলীন হয়ে গিয়েছিল ক্ষমতায় আরোহণের পর তাদের সহিংস কাজকর্মের জন্য।

কম্বোডিয়ার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু গত দশকের চল্লিশের দশক থেকেই। ফরাসি ইন্দোচীনের একটি অংশ, ভিয়েতনামে শুরু হয়েছিল ফরাসিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। ভিয়েতনামের এই স্বাধীনতাকামী সংগ্রামের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কম্বোডিয়াতেও স্বাধীনতাকামীরা গোপনে সংগ্রাম শুরু করেন। প্রকাশ্যে না করার কারণ, তখনও খুব বেশি জনসমর্থন ছিল না এসব সংগ্রামের, আর ফরাসিদের দমন-পীড়নের কথা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ফরাসিরা কম্বোডিয়ার ক্ষমতা প্রিন্স নরোদম সিহানুকের হাতে অর্পণ করে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামীদের সাথে ফরাসিদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে সাফল্যের জন্য কম্বোডিয়ার স্বাধীনতাকামী বামপন্থীরা ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি তথা ভিয়েত কংয়ের শীর্ষনেতা হো চি মিনকে নিজেদের ‘গুরু’ মানতে শুরু করেছিলেন, তার কাছ থেকে সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিতেন তারা। পরবর্তীতে তার নির্দেশ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে কম্পুচিয়া কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছিল, যেটিকে ‘খেমার রুজ’ বলা হয়।

Hxjxkccl
ফরাসিদের প্রস্থানের পর প্রিন্স নরোদম সিহানুকের বিরুদ্ধে কম্বোডিয়ার কমিউনিস্টরা বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছিলেন;
image source: newyorker.com

খেমার রুজরা প্রিন্স নরোদম সিহানুকের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের সশস্ত্র সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল- যেভাবে পার্শ্ববর্তী উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা পুরো ভিয়েতনামে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেভাবে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে পুরো কম্বোডিয়ায় তারা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করবেন। এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে, ঔপনিবেশিক সময়ে তাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন, কিন্তু ঔপনিবেশিক সময় শেষের পর তাদের লক্ষ্য দাঁড়ায় স্বাধীন কম্বোডিয়ায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা। প্রিন্স নরোদম সিহানুককে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য যে পরিমাণ জনসমর্থন দরকার ছিল, সেই পরিমাণ জনসমর্থন খেমার রুজদের ছিল না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাবাহিনী এবং উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধের সময় অসংখ্য ভিয়েতনামি শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনামে আশ্রয় নিয়েছিল। মার্কিনীরা ভিয়েতনামের শরণার্থীদের উপর হামলার অভিপ্রায়ে নিয়মিত কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ করতে শুরু করেছিল। এই বোমাবর্ষণে ভিয়েতনামি শরণার্থীদের পাশাপাশি অসংখ্য কম্বোডিয়ান নাগরিকও প্রাণ হারিয়েছিল।

মার্কিনীদের বোমা হামলা থেকে বাঁচতে খেমার রুজরা কম্বোডিয়ার শহরাঞ্চল ছেড়ে একেবারে দুর্গম গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিল। তারা সাধারণ মানুষদের মতোই চাষাবাদের মাধ্যমে জীবনযাপন করত। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষদের সামনে তারা নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন এবং এই দর্শন বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রামের ব্যাপারগুলো সফলভাবে তুলে ধরে। গ্রামে তাদের বেশ জনসমর্থন গড়ে ওঠে। অবশ্য কম্বোডিয়ার শহরাঞ্চলে এবং গ্রামের কিছু অংশে প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকারের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু কর্তৃত্বমূলক নীতি বাস্তবায়নের জন্য এই সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে আসে। কম্বোডিয়ান সমাজের মধ্যবিত্তরা কখনই চায়নি দেশটিতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা পাক, কারণ এতে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ উচ্ছেদ করা হতো। তাই খেমার রুজদের শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, গ্রামে জনসমর্থন তৈরির পর ধীরে ধীরে শহরের দিকে তারা অগ্রসর হবেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, সেটা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।

Gxjxkclvm
গুটিকয়েক দেশ বাদ দিয়ে এশিয়ার প্রায় সব দেশকেই ঔপনিবেশিক দাসত্ব বরণ করতে হয়েছিল; image source: thoughtco.com

১৯৭০ সালে কম্বোডিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। আমেরিকার পরোক্ষ সহায়তায় কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জেনারেল লন নল নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকারকে উৎখাত করে কম্বোডিয়ায় সামরিক জান্তা সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই ঘটনার পর খেমার রুজরা ক্ষমতা থেকে সদ্য উৎখাত হওয়া প্রিন্স নরোদম সিহানুকের প্রতি অনুগত বাহিনীর সাথে একত্রে রাজনৈতিক জোট গঠন করে। প্রিন্স সিহানুক নিজে এক রেডিও বার্তায় জনগণকে কম্বোডিয়ার স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক লড়াইয়ে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। সামরিক জান্তা সরকারের সাথে খেমার রুজ ও প্রিন্স সিহানুক জোটের মধ্যে ব্যাপকাকারে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমদিকে আমেরিকা ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনী সরাসরি সামরিক জান্তা সরকারের পক্ষে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে মার্কিন জনগণের তীব্র সমালোচনার প্রতিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এরপরও সামরিক জান্তা সরকারের পক্ষে মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনামি সহায়তা অব্যাহত ছিল।

কম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও চীন। একসময় উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা কম্বোডিয়া থেকে চলে যেতে শুরু করে। ততদিনে কম্বোডিয়ায় লড়াই করার মতো একটি বাহিনী দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল খেমার রুজরা। কিন্তু খেমার রুজদের সংকট ছিল অন্য জায়গায়। অস্ত্রশস্ত্র শেষ হয়ে আসতে শুরু করলে তারা মাও সে তুংয়ের চীনের প্রতি সাহায্যের আবেদন করে। চীন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। খেমার রুজ ও প্রিন্স নরোদম সিহানুকের রাজনৈতিক জোটের প্রতি কম্বোডিয়ান সাধারণ জনগণের সমর্থন দিন দিন বাড়তে থাকে, অপরদিকে রাজধানী নম পেনের দখল নিয়ে থাকা সামরিক জান্তা সরকার একঘরে হয়ে পড়তে শুরু করে। পাঁচ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল কম্বোডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তথা খেমার রুজরা সামরিক জান্তা সরকারকে পরাজিত করে রাজধানী নম পেন দখল করে নেয়। এর মাধ্যমে পুরো কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতা চলে আসে খেমার রুজদের হাতে, প্রিন্স নরোদম সিহানুককে চীনে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই একেবারে জনসমর্থনহীন এক বিচ্ছিন্ন আন্দোলন থেকে পুরো কম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয় খেমার রুজরা।

Related Articles