Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রঘু ডাকাতের আদ্যোপান্ত

বঙ্গদেশে রঘু ডাকাতের মতো ‘বিখ্যাত’ ডাকাত বোধকরি আর দুটো নেই। ছোটবেলায় ভয় দেখানোর গল্প থেকে শুরু করে ‘মানুষ রঘু ডাকাত’ পর্যন্ত গল্পগুলো এত বেশি জায়গা দখল করে আছে যে, রঘু ডাকাত বাঙালির কৃষ্টির সাথে মিশে গেছে। প্রকৃতপক্ষে রঘু ডাকাত সম্পর্কিত গল্প এত বেশি যে, সেখান থেকে আসল গল্পের খোঁজ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। সেই কষ্টের অবসান অবশ্য আবার গবেষণাসাধ্য। গবেষণা যে কিছু হয়নি তা নয়। কিছু গবেষক চেষ্টা করেছেন কল্পকথার ফাঁদ ছেড়ে রঘু ডাকাতের আসল কাহিনী খুঁজে বের করতে। সেসবের নিরিখেই রঘু ডাকাতের জীবনকথা জানার চেষ্টা করা হবে।

অধিকাংশ গবেষকের তথ্যমতে, রঘু ডাকাত জন্মেছিলেন প্রায় দু’শো বছর আগে। অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো একসময়। তার ভালো নাম ছিল রঘু ঘোষ। সেসময় বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে চলছিল কোম্পানির শাসন। বাংলার ধানী-ফসলি জমিতে তখন ইংরেজদের নীল চাষের পায়তারা চলছে। প্রথমে পাঁচ কাঠা, তারপর দশ কাঠা, এভাবেই দিন দিন নীল চাষের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বাংলার কৃষকদের উপর। যারা কোম্পানির নির্ধারিত জমিতে নীল চাষে আপত্তি জানাত, তাদের পেয়াদা দিয়ে তুলে এনে চলত বেদম প্রহার। নীলকর আর তাদের পেয়াদাদের অত্যাচারে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল সাধারণ বাঙালি কৃষকদের। রঘু ঘোষের বাবা ছিলেন এমনই একজন সাধারণ কৃষক। নীল চাষে অস্বীকৃতি জানানোয় নীলকরের পেয়াদা এক রাতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পেয়াদার প্রহারে অসহায়ভাবে মারা যান তার বাবা।

বাংলার ফসলি জমি নীলকরদের দখলে; Image Source: History4u3

পিতার মৃত্যুর বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রঘু ঘোষ। লাঠি খেলায় তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। সেই খেলার লাঠিই তার কাছে হয়ে ওঠে নীলকর বধের অস্ত্র। সেই অস্ত্র তিনি তুলে নেন নিজ হাতে, সেই সাথে অত্যাচারিত আরো মানুষদের সংগঠিত করেন। গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় রঘু ঘোষের এই বাহিনী। দলবল নিয়ে নীলকুঠিগুলোতে লুটপাট চালান রঘু ঘোষ। এরপর জ্বালিয়ে দেন নীলকরদের আস্তানা। ধীরে ধীরে এলাকার অত্যাচারী জমিদার আর সামন্তদের বাড়িঘর লুট শুরু করেন। যারাই সাধারণ মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে, তাদের বাড়িতেই হানা দেয় রঘু ঘোষের দল। লুটপাটের পর লুটের জিনিসপত্র ভাগ করে দেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে। ফলে, সাধারণ মানুষের কাছে রঘু ঘোষ ছিলেন একইসাথে প্রতিবাদ আর ন্যায়বিচারের প্রতীক। তবে, জমিদার আর নীলকরদের কাছে তিনি ছিলেন লুটতরাজকারী এক ডাকাত। পিতার মৃত্যুর সে ঘটনাই একজন সাধারণ মানুষ থেকে রঘু ঘোষকে করে তোলে ‘রঘু ডাকাত’।

‘রঘু ডাকাতের বাড়ি ঠিক কোথায় ছিল?’, প্রশ্নের জবাবে ঐতিহাসিকদের একটু দ্বিধান্বিত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেসময় হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া, বারাসাত, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, এমনকি খোদ কলকাতাতেও অসংখ্য ডাকাতের উপদ্রব ছিল। সাধারণ মানুষ তো বটেই, জমিদাররাও এসব ডাকাতের ভয়ে তটস্থ থাকতেন। ফলে, ইংরেজরা ডাকাত সমস্যার একটা সমাধানের পথ খোঁজেন। প্রতিটি থানায় খোলা হয় ডাকাত ধরার আলাদা দপ্তর। থানায় থানায় রেড এলার্ট জারি হয় সব ডাকাতকে জেলে পোরার জন্য। ফলে, ডাকাতদের মাঝে মাঝেই গা ঢাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আজ হুগলি তো কাল মুর্শিদাবাদ, পরশু নদীয়া, পরের দিন বর্ধমান। এভাবেই কাটত ইংরেজদের রোষানলে পড়া ডাকাতদের জীবন। তাই তাদের স্থায়ী নিবাস নির্ধারণ করা দুষ্কর। ফলে, রঘু ডাকাতের নিবাস নির্ধারণে একটু বেগ পেতে হয়। তবে হুগলি, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এই তিন অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে রঘু ডাকাতের ‘কীর্তি’। কিন্তু, অনেক গবেষকের দাবি- বাইরের নয়, একেবারে পুরোদস্তর কলকাতারই মানুষ ছিলেন রঘু। পরবর্তীতে, বিভিন্ন সাহিত্য-উপন্যাসেও অবশ্য এসেছে সেই কথার উল্লেখ।

নিশিরাগড় গ্রামের একটি মন্দির; Image Source: Unknown FACTS

রঘু ঘোষ কলকাতার মানুষ না বাইরের, সেই বিতর্ক পাশে সরিয়ে রেখে কিছু দূর এগোলে দেখতে পাওয়া যায়, রঘু ডাকাতের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা এক গ্রামের। ইংরেজরা তখন রঘু ডাকাতের পেছনে মরিয়া হয়ে পড়ে আছে। কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না তার। এদিকে রঘু ডাকাতও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পুলিশের থেকে। পান্ডুয়া নামের এক গ্রামে প্রথমে আশ্রয় নেন। এরপর লোকালয় অনিরাপদ হয়ে উঠলে আশ্রয় নেন দেবীপুরের পাশের ঘন জঙ্গলে। এখানে বলে রাখি, রঘু ঘোষের ভাই ছিলেন বিদুভুষণ ঘোষ। বিদুভুষণও রঘুর এই ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। দুই ভাই মিলে যখন গা-ঢাকা দেন দেবীপুরে ঘন জঙ্গলে, তখন অদ্ভুত এক বাসনা জাগে রঘুর মনে। এই জঙ্গলে তিনি গ্রাম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। রাতের আধারে তিনি একে একে ঘোষাল, চট্টোপাধ্যায়, বন্দোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য পাঁচঘর ব্রাহ্মণ গ্রামে আনেন। এদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় রঘু ডাকাতের গ্রাম। রাতের অন্ধকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে এই গ্রামের নাম হয় নিশিনগর। পরবর্তীতে গ্রামের নাম পাল্টে হয়ে যায় নিশিরাগড়। এভাবেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে রঘু ডাকাত গড়ে তোলেন একটি গ্রাম।

রঘু ডাকাতের প্রায় সব গল্পেই মা কালির এক বিশেষ অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। কারণ, রঘু ডাকাত নিজেই ছিলেন কালির ভক্ত। কথিত আছে, একদিন তিনি পুকুর ঘাট ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তিনি দুটি পাথরের মূর্তি দেখতে পান। একটি ছিল মহাদেবের, অপরটি তিনি চিনতে পারেননি। তবে নিশ্চিতভাবে সেটা ছিল কোনো দেবীমূর্তি। সেই রাতেই রঘু ডাকাত স্বপ্নে দেখেন- কালীর দেবীমূর্তি তাকে আদেশ করছে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য। কালবিলম্ব না করে সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রঘু ঘোষ। এরপর থেকেই ভক্ত বনে যান কালির। জানা যায়, অমিয় শক্তির দেবী কালীর পূজা করতেন নিয়মিত। পূজার ভোগ হিসেবে থাকত ল্যাটা মাছ পোড়া। সেই মহাভোগ খেয়েই ডাকাতির জন্য বেরোতেন রঘু ডাকাত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানেই এখনও কালি পূজার ভোগ হিসেবে ল্যাটা মাছ পোড়া খাওয়ানো হয়।

রঘু ডাকাত ছিলেন কালিভক্ত; Image Source: zeenews india

দিনকে দিন বাড়তে থাকে রঘু ডাকাতের শক্তি। তিনি রীতিমতো ছেলেখেলা শুরু করেন অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে। একসময় ডাকাতির পূর্বে তিনি জমিদারদের চিঠি দিতেন যে সেদিন তার বাড়ি লুট হতে চলেছে! রীতিমতো বলে-কয়ে ডাকাতি আর কী! রঘু ডাকাতের এই দুঃসাহসের পেছনেও ছিল কালীর অবদান। রঘু বিশ্বাস করতেন, পূজা দিয়ে ডাকাতি করতে গেলে কখনও ধরা পড়বেন না তিনি। তবে, এক্ষেত্রে তার ভাগ্যকে বেশ সুপ্রসন্নই বলতে হয়। সত্যি সত্যিই কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েননি রঘু ডাকাত। পুলিশ নিয়েও একটি মজার কাহিনি প্রচলিত আছে রঘু ডাকাতের জীবনে। তার উপদ্রব তখন তুঙ্গে। নৈহাটি থানার বড়বাবু তখন দূর্গাচরণ চক্রবর্তী। দূর্গাচরণের সাথে সুখসাগরের জমিদারের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে, জমিদারের কথায় রঘু ডাকাতকে ধরার একটা মস্ত বড় চাপ ছিল তার মাথার ওপর। কিন্তু রঘুর পাত্তা নেই। কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না তাকে। হঠাৎ একদিন বড়বাবু একটি চিঠি পেলেন। তাতে লেখা,

দারোগাবাবু, আপনার সাথে দেখা করতে আসছি।
ইতি রঘু ঘোষ

দারোগার তো চক্ষু চড়কগাছ। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। থানার সেপাই বাড়ালেন, আর আঁটসাঁট করে ফেললেন সবকিছু। এবার যে করেই হোক রঘুকে ধরতে হবে। একদিন এক জেলে এলো দুটো বড় রুই মাছ নিয়ে। জানালেন, জমিদারবাবু পাঠিয়েছেন তাকে। সেই সাথে একটা চিঠি। চিঠির ভাষ্য এই যে,

দারোগা বাবু, পৌত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে আমার পুষ্করিনীতে মাছ ধরেছিলাম। আপনি আসতে পারবেন না জানিয়েছিলেন। তাই দুটি মাছ আপনার জন্য লোক মারফৎ পাঠালাম। লোকটি আমার বিশ্বস্ত প্রজা।

দারোগা বাবু খুশি হয়ে জেলেকে দু’টাকা বকশিস দিয়ে বিদায় করলেন। কিছুদিন পর দারোগার কাছে আরেকটি চিঠি এলো,

দারোগা বাবু, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম আপনার সাথে দেখা করে আসব। সেদিন দেখা করে এসেছি। মাছ কেমন খেলেন?
সেবক রঘু ডাকাত

এভাবেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আর ভাগ্যের অসীম সহযোগিতায় চলতে থাকে রঘুর ডাকাতি। আগেই বলেছি রঘু ডাকাতি করত শুধুমাত্র অত্যাচারী মানুষদের ঘরে। আর ঘরের মেয়েদের রাখতো একেবারে নিরাপদ। ডাকাতি শেষে লুটের মালামাল বাট করে দিত অসহায় মানুষের মাঝে। ফলে, অসহায় মানুষের এক তীব্র আবেগ ছিল রঘু ডাকাতের প্রতি। সেই আবেগই ঢাল হয়ে রক্ষা করতো রঘু ডাকাতকে। তবে এতসব ভালোর মধ্যেও একটা খারাপ ব্যাপার ছিল রঘু ডাকাতের। দেবী কালির পূজার অংশ হিসেবে নরবলি দিতেন তিনি। কার্তিকের অমাবস্যার তিথিতে পূজো দেবার জন্য রাস্তা দিয়ে যে-ই যেত তাকেই ধরে এনে বেঁধে রাখা হতো।

একদিন সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন কালিভক্ত রামপ্রসাদ সেন। তাকে ধরে এনে বলি দেবার উদ্দেশ্যে বেঁধে রাখে রঘু ডাকাতের দল। তাকে বলি জন্য প্রস্তুতও করা হয়। তবে বলি দেওয়ার আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে দেবী কালীর সামনে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। রঘু ডাকাত অনুমতি দিলে রামপ্রসাদ ‘তিলেক দাড়া ওরে শমন বদন ভরে মাকে ডাকি’ গানটি গেয়ে শোনান। এমন সময় রঘু ডাকাত বলিকাষ্ঠে রামপ্রসাদের বদলে দেবী কালীকে দেখতে পান। এই ঘটনার ফলে রামপ্রসাদকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং পরদিন সম্মানের সাথে বাড়িতে পৌঁছে দেয় তার লোকজন। এরপর থেকেই নরবলির প্রথা বন্ধ করেন রঘু ডাকাত। চালু করেন মানুষের বদলে পাঠাবলি।

প্রকৃতপক্ষে, রঘু ডাকাতকে ঘিরে কল্পকথা এত বেশি ডানা গজিয়েছে যে তার কিংবদন্তি তাকেই ছাড়িয়ে গেছে। ফলে, যেটা তার নয় সেটাও ঘাড়ে এসে পড়েছে কিছু ক্ষেত্রে। কলকাতার পূর্ণদাস রোডের কালীমন্দিরের কথাই ধরা যাক। এই মন্দিরে এক ফুট উচ্চতার ছোট্ট একটি কালিমূর্তির পূজা করতেন মনোহর ডাকাত। কিন্তু, মনোহর ডাকাতের নামে নয়, লোক সেটাকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি বলে। এরকম আরো অসংখ্য রঘু ডাকাতের কালীমন্দির আছে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম আর হুগলি জেলায়। এসবের প্রতিষ্ঠাতা অন্য কেউ হলেও লোক এগুলোকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীমন্দির নামেই। এসবের কিছু কিছু মন্দির আবার ৫০০ বছরের পুরনো। তাই সময়ের হিসেবে সেসব রঘুর হবার যুক্তি মেলে না। অনেক সময় কল্পকথার বড় বড় নাম ইতিহাসের পাতার ছোট নামগুলোকে সরিয়ে দেয়। রঘু ডাকাতের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে।

Related Articles