Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোহিঙ্গা রঙ্গ ১: বার্মিজ ইতিহাস পাঠ

রোহিঙ্গাদের কারণেই বাঙালি বার্মা অথবা মায়ানমারের নাম শুনেছে, তা তো আর না। বার্মা আজীবনই বাংলাদেশের লাগোয়া দেশ ছিল, আছে আর থাকবে। শরৎ বাবু তার পথের দাবী আর শ্রীকান্ত উপন্যাসে রেঙ্গুন শহর আর বার্মার সম্পদের যে বর্ণনা দিয়ে গেছেন তা বাঙালি পাঠক অনেক আগেই পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেনারেল স্লিমের বার্মা ক্যাম্পেইনের গল্প পড়তে গিয়েও আমরা বার্মার ব্যাপারে অনেক জেনেছি। বার্মাটিক কিংবা বার্মার সেগুন কাঠের আসবাবপত্র আর দরজা আমাদের খুব প্রিয়, বার্মিজ আচার আমরা খুব মজা করে খাই, বার্মিজ স্যান্ডেল পায়ে দেই, আর বার্মার ইয়াবার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করি।

কিন্তু বার্মা সম্পর্কে আসলেই কি আমরা যথেষ্ট জানি? প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটির ইতিহাস, বার্মা থেকে মায়ানমার কিংবা রেঙ্গুন থেকে ইয়াঙ্গুন, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অথবা বৈরিতা, বার্মিজ ইনসারজেন্সি, সামরিক শাসন আর বুদ্ধিস্ট এক্সট্রিমিজম সম্পর্কে আমরা আসলেই কতটা ওয়াকিবহাল?

ছবিতে মায়ানমার; Image Source: Blue Swan Daily

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়াবে কি? যুদ্ধে জড়ালে মিয়ানমার জিতবে না বাংলাদেশ? এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট কবে নাগাদ মিটবে? মিয়ানমার কি আদৌ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হবে? এই সংকট সমাধানে চীন, ভারত, রাশিয়া আর জাতিসংঘের ভূমিকা কেমন হবে? রোহিঙ্গারা যদি আর কখনোই ফিরে না যায় তাহলে কী হবে?

Image Source: Tehran Times

এসব নিয়েও আমরা সমান উদ্বিগ্ন! সুনাগরিক হিসেবে আমাদের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ভাবনা অত্যন্ত যৌক্তিক।

বার্মার ইতিহাস

যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১১ হাজার বছর আগে বার্মায় মানব সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। হাজার বছর ধরেই বার্মার সমুদ্র উপকূল আর নদীবিধৌত উপত্যকাগুলোতে মানুষের বসবাস ছিল। এছাড়াও প্রাচীন চীন এবং প্রাচীন ভারতের মধ্যে স্থলপথে ও নৌপথে যোগাযোগের রাস্তায় অবস্থিত হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বার্মা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবেশমুখ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে আসা পিউ জনগোষ্ঠী ইরাবতী উপত্যকা জুড়ে ছোট-বড় নগররাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। শ্রী ক্ষেত্র ছিল সেসব নগররাষ্ট্রের অন্যতম। দক্ষিণে বসতি গেড়েছিল কম্বোডিয়া থেকে আসা মন রা। নবম শতকের গোড়ার দিকে তিব্বত থেকে বামাররা এই এলাকায় আসতে শুরু করে। এরপর ১০৪৪ সালে রাজা আনারাথা বা অনিরুদ্ধ পাগান মতান্তরে বাগান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। ১২৮৭ সালে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান পাগান রাজ্য দখল করে নেন।

কুবলাই খান; Image Source: Wikimedia Commons

মোঙ্গলরা ফিরে যাবার পর সারা বার্মা জুড়ে আবারো ছোট ছোট রাজ্য জন্ম নিতে শুরু করে। এসব রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আভা, হান্থাওয়াদ্দি পেগু, শান এবং আরাকান। আভা রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত তন্গূ এলাকার লোকজনও এই সুযোগে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করল। এই তন্গূর রাজা তাবিনসেতি আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চয় করে আরাকান ছাড়া বাদবাকি প্রায় সব বার্মিজ রাজ্যগুলো জয় করে তন্গূ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৭৫২ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৭৪০ সালে দক্ষিণ বার্মার মন জনগোষ্ঠী যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল তার প্রেক্ষিতে ১৭৫২ সালে তন্গূ সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং কংবং সাম্রাজ্যের সূচনা হয় যা ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

বার্মিজ ইতিহাস পাঠের এই পর্যায়ে আমরা আরাকান নিয়ে আরেকটু বিশদ জেনে নেব। আরাকান বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত এবং অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বঙ্গোপসাগর এবং নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনাবেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকানকে বার্মার অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করেছে। এর প্রাচীন নাম ‘রাখাইনপিয়ে’। সংস্কৃত রাক্ষস এবং পালি ইয়াক্কা (যক্ষ) থেকে রাখাইন শব্দটি এসেছে, যার অর্থ দানব।

Image Source: Wikimedia Commons

আদি ও অনাদি কাল ধরে আরাকানে তামবুকিয়া, তুর্ক-পাঠান, কামাঞ্চি এবং রোহিঙ্গাদের বাস। তামবুকিয়াদের ইতিহাস শুরু হয়েছে অষ্টম শতক থেকে, যখন তাদের পূর্বপুরুষরা রাজা মহা তায়িং চন্দ্রের শাসনামলে আরবদেশ থেকে দক্ষিণ আরাকানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। তুর্ক-পাঠানরা আরাকানের সর্বশেষ রাজধানী ম্রোহং-এর শহরতলি এলাকায় তাদের প্রধান নিবাস গড়ে তোলে। আরাকানি রাজা মীন সোয়া মুয়ং ওরফে নরমিখলা বাংলার সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাঁর পূর্বপুরুষদের সহায়তায় রাজক্ষমতা পুনর্দখল করে। তামবুকিয়াদের মতো তারা রাজার অনুমোদনক্রমে আরাকানে স্থায়ী নিবাস গড়ে।

কামানঞ্চিদের পূর্বপুরুষ এসেছিল শাহ সুজার বংশধরদের মধ্য থেকে। আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসন দখলের পর তারই ভাই বাংলার গভর্নর শাহ সুজা সপরিবারে আরাকান রাজার দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তাদের বংশধরদের অনেককেই রমরী দ্বীপে দেখা যায়।

রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠির উদ্ভব সম্পর্কে মতভেদ সত্ত্বেও নির্ভরযোগ্য মত হলো, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকান রাজ্যে বসতিস্থাপনকারী চট্টগ্রামি পিতার ঔরসজাত ও আরাকানি মাতার গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের বসবাস প্রধানত উত্তর আরাকানে কেন্দ্রীভূত।

বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের সাথে ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে আরাকানের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্ষমতার রদবদল বা ওঠা-নামার সাথে দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বাংলার সুলতান বারবাক শাহর দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বোসাউপিউ ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলা দখল করে নেন। ১৬৬৬ সালে মোগলদের দ্বারা বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দুই শত কাল ধরে আরাকানিরাই এখানে রাজত্ব করে।

আরাকানিরা চট্টগ্রামে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য অধিকৃত অঞ্চলে অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে মাটির দুর্গ বা কোট নির্মাণ করে। চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে মীরসরাই, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে আরাকানিদের নির্মিত বেশ কিছু মাটির কোট বা দুর্গ ছিল। সীতাকুন্ডে তাঁরা নির্মাণ করেছিল কাঠের দুর্গ। সমুদ্রবেষ্টিত সন্দ্বীপেও ছিল কাঠের দুর্গ। কাঠগড় নামে পরিচিত সেসব স্মারকের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই।

পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম; Image Source: Dhaka Tribune

১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামের পতনের পর আরাকান রাজ্য সংকুচিত হয়ে একটি ছোট্ট অঞ্চলে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ১৭৩১ থেকে ১৭৮৪ সালের মধ্যে আরাকান রাজ্যকে ১৩ জন রাজা শাসন করেন এবং এ রাজাদের গড় শাসনকাল দু’বছরের বেশি ছিল না। ১৭৮৫ সালে কংবং সাম্রাজ্যের রাজা বোদাউপায়ার আরাকান দখল করেন।

প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ; Image Source: Wikimedia Commons

১৮২৪ সালে মনিপুর ও আসাম এলাকায় ব্রিটিশদের সাথে সীমান্ত বিরোধের প্রেক্ষিতে শুরু হয় ১ম এংলো-বার্মিজ যুদ্ধ এবং ১৮৮৫ সালের ৩য় এংলো-বার্মিজ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমগ্র বার্মা ব্রিটিশ রাজের করায়ত্ব হয়। স্বাধীন বার্মার শেষ সম্রাট থিবো সপরিবারে ভারতের রত্নগিরিতে নির্বাসিত হন। ১৯৩৯ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই বার্মিজরা ফের স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।

[চলবে]

This article is in Bengali language. It tells the history of Myanmar.

Reference Books:

1. Myanmar's Enemy Within: Buddhist Violence and the Making of a Muslim 'Other' (Asian Arguments) - Francis Wade

2. Myanmar: Democratisation, Foreign Policy and Elections - Amrita Dey

3. The Rohingyas: Inside Myanmar's Hidden Genocide - Azeem Ibrahim

4. রোহিঙ্গা জাতির ইতিকথা - মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

5. বার্মার রোহিঙ্গারা গণহত্যার ইতিহাস - ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন (অব:)

Featured Image: Time.com

Related Articles