Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোহিঙ্গা রঙ্গ ৫: রোহিঙ্গা রোষ – কেন এই এথনিক ক্লিঞ্জিং?

বার্মিজ নীলনকশা

রোহিঙ্গাদের ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সংখ্যালঘু ও চরম নিগৃহীত সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর চলা গণহত্যাকে জাতিগত নির্মূল (Ethnic cleansing) বলে স্বীকৃতি দেয়। অথচ ১৯৭৮ সাল থেকে বার্মিজ সামরিক জান্তা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের বার্মা থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা শুরু করে এবং ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বার্মার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সদম্ভে ঘোষণ দেন যে, মায়ানমারে রোহিঙ্গা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, আর কখনো ছিলও না!

১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বার্মায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী উ নু রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলেই ডাকতেন। ১৯৮২ সালে তাদের বার্মিজ নাগরিকত্বের অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবেই হরণ করা হয়। সাধারণ বার্মিজদের দেয়া হয় লাল পরিচয়পত্র আর রোহিঙ্গাদের দেয়া হয় সাদা পরিচয়পত্র, যার মানে রোহিঙ্গারা সাধারণ বার্মিজ নাগরিক নয়, বরং বহিরাগত। এর ফলে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার ও বার্মিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা লাভের কোনো অধিকারই থাকল না তাদের এবং দেশের ভেতরও আরাকান/রাখাইন বাদে অন্যান্য এলাকায় অবাধে ভ্রমণের অনুমতি হারাল তারা।

সামরিক জান্তা নিজ দেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিপীড়নের বৈধতা পেতে থেরাভেদা বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের উস্কে দিল ইসলাম বনাম বৌদ্ধ ধর্মের দোহাই দিয়ে। একইসাথে অভিবাসী আইনের আওতায় তাদের উপর ততমাদো এবং বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের নির্যাতন পেল বৈধতা!

রাষ্ট্রীয় মদদে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি; Image Source: Amnesty.org

দুটোর বেশি সন্তান নেবে না মর্মে মুচলেকা দিতে হয় রোহিঙ্গা দম্পতিদের। ১৯৯৪ সালে নতুন জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের সরকারি জন্মসনদের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেই চালানো হয় ২০১৪ সালের আদমশুমারি। বহু রোহিঙ্গার বসতভিটা ক্রোক করে নিয়ে বার্মার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা বৌদ্ধ সেটেলারদের দিয়ে দেয়া হয়েছে রাখাইনে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে। সেই সাথে প্রত্যেক সক্ষম রোহিঙ্গা পুরুষকে সপ্তাহে একদিন বাধ্যতামূলক সামরিক ক্যাম্পে বা সরকারি প্রকল্পে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয় এবং সপ্তাহে এক রাত বাধ্যতামূলক সেন্ট্রি ডিউটি দিতে হয়। ২৯ মার্চ ২০১৪ তারিখে বার্মিজ সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও নিষিদ্ধ করে দেয় এবং রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গালী’ বলে ডাকতে শুরু করে।

রোহিঙ্গা কারা?

রোহিঙ্গা শব্দটি প্রাক-উপনিবেশিক কালে ‘রুইঙ্গা’ বা ‘রোয়াঙ্গিয়া’ হিসেবে উচ্চারিত হত, যার মানে ‘রোহাং এর বাসিন্দা’। আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোহাং’ বা ‘রাখাঙ্গা’ বা ‘রোসাঙ্গা’ থেকে শব্দটি উদ্ভূত বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আবার অনেকের ধারণা, আরবী ‘রহম’ শব্দ থেকে নামটি এসেছে, যা আরবী বনিকদের দেয়া নাম। ১৭৯৯ সালে লেখা ফ্রান্সিস বুকানানের প্রবন্ধেও রোহিঙ্গাদের কথা এবং রোহিঙ্গাদের ভাষা রুইঙ্গার (Rooinga) উল্লেখ আছে।

১৮১৫ সালে জোহান সেভেরিন ভাতেরও তার কম্পেন্ডিয়ামে রুইঙ্গাদের (Ruinga) নিজস্ব ভাষাসহ একটি বার্মিজ নৃগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ বার্মার আরাকানে ‘রোহিঙ্গা জামায়েতুল উলামা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ক্রিস্টিনা ফিঙ্কের মতো অনেকেই ভাবেন, রোহিঙ্গা আসলে জাতিগত পরিচয় না, বরং আরাকান/রাখাইনে একটি মুসলিম অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেয়া একটি রাজনৈতিক পরিচয়।

সদ্য স্বাধীন মিয়ানমারের এক রোহিঙ্গা নাগরিকের পরিচয়পত্র; Image Source: Arakan Times

আরাকানের রোহিঙ্গাদের সলুক সন্ধানে

মায়ানমার (বার্মা) এর একটি অঙ্গরাজ্য আরাকান । এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত এবং অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আরাকানের উত্তরে চীন ও ভারত, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর ও পশ্চিমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী নাফ নদীর মধ্যসীমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম।

পূর্বে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ইয়োমা পর্বতমালা। নাফ নদী আরাকান ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত রেখা হিসেবে কাজ করে। ব্রিটিশ শাসিত আরাকানের আয়তন ছিল ২০,০০০ বর্গ মাইল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য আরাকান বার্মার চিন প্রদেশে এবং দক্ষিণ আরাকানের কিছু অংশ লোয়ার বার্মার ইরাবতি প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত করায় বর্তমানে এখানকার আয়তন ১৪,২০০ বর্গ মাইল। ১৯৯০ সালে বার্মিজ সামরিক জান্তা আরাকানের নাম বদলে ফেলে এবং এখন এলাকাটি রাখাইন নামে পরিচিত।

ঐতিহাসিকভাবে, এই আরাকান প্রথমে ছিল বাংলার চন্দ্র রাজবংশের অধীনে করদ রাজ্য এবং উজালি বা বৈশালি ছিল এই রাজ্যের রাজধানী। আরাকান রাজবংশসমূহে শুরু থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকট প্রভাব লক্ষণীয়। তবে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই আরব্য বণিকেরা আরাকানে তাদের বাণিজ্য জাহাজ নোঙর করতে শুরু করে। আর ৭৮৮ সাল থেকে তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম প্রচারও শুরু করে এখানে। তাই রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাসের শুরুও এখান থেকেই।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বার্মিজ, বাঙালী, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি ত্রয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

নানা জাতির রক্ত এসে মিশেছে রোহিঙ্গাদের নৃপরিচয়ে; Image Source: Huffinton Post

খ্রিস্টীয় দশম শতক থেকে মধ্য বার্মার লোকেরা আরাকানে যাতায়াত শুরু করে। রাখাইনরা ছিল বার্মার পিউ নগর রাষ্ট্রের একটি আদিবাসী। তারাই প্রথমে মধ্য বার্মা থেকে আরাকান পর্বতমালা অতিক্রম করে আরাকানে আসে এবং লেমরো নদীর উপত্যকায় বসতি গড়ে তোলে।

১৪০৪ সালে আরাকান শাসন করতেন রাজা নরমিখলা। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা মেংশো আই আরাকান দখল করলে নরমিখলা তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহীর রাজবংশ গৌড় থেকে বাংলা শাসন করতেন। গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন শাহের সাহায্যে নরমিখলা ১৪৩০ সালে স্বীয় রাজ্য ফিরে পান। নরমিখলা ধর্মান্তরিত হয়ে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নামধারণ করেছিলেন। সেই থেকে আরাকানের রাজারা বৌদ্ধ নামের পাশাপাশি একটি মুসলিম নামও ধারণ করতে শুরু করেন। ন

রমিখলা আরাকানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে লঙ্গিয়েত থেকে ম্রোহং এ নিজ রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে বাংলার করদ রাজা হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। ম্রাউক-উ রাজবংশের রাজাগণ ১৪৩০-১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৫৫ বছরকাল আরাকানে রাজত্ব করেন।

তবে বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহর মৃত্যুর পর রাজা নরমিখলার পরবর্তী আরাকান রাজেরা ১৪৩৭ সালে রামু ও ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। এ সময় পর্তুগিজ হার্মাদ (পর্তুগিজ ‘আর্মাডা’ শব্দের অপভ্রংশ) জলদস্যুদের সহায়তায় আরাকানের মগ দস্যুরা বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্বিচারে ধর্ষণ চালাত।

সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বকালে বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম পর্তুগিজ হার্মাদ বণিকদের আবির্ভাব ঘটে। ক্রমে চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম ও হুগলি এদের বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। এরা তখন বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার নানা স্থানে ঘাঁটি বানিয়ে লুটপাট চালাত। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ অধিনায়ক মেলো বাণিজ্যের ছলে এসব স্থানে অত্যাচার শুরু করায় তাকে অনেকদিন গৌড়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম এদের সম্পূর্ণ অধিকৃত হয়।

প্রথমে এদের সাথে আরাকান-রাজের যুদ্ধ সংঘটিত হলেও পরে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা একত্রে মিলে যায়। সন্দ্বীপের মোগল-শাসনকর্তা এই দস্যুদের হাতে নিহত হওয়ার পর সেখানকার পরবর্তী মোগল-শাসক ফতে খাঁ হার্মাদদের চূড়ান্ত ধ্বংস করতে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে অভিযান চালান। নৌযুদ্ধে পারদর্শী পর্তুগিজগণ তাকে সৈন্যসহ পরাস্ত করে নিহত করে। এদের দস্যুনেতা সিবাশ্চিয়ান গঞ্জালিস সন্দ্বীপ দখল করে সেখানকার মুসলমানদের নির্মূল করে।

ইউরোপীয় শিল্পীর কলমে বঙ্গোপসাগরের বুকে হার্মাদ জলদস্যুদের জাহাজ; Image Source: Dhaka Tribune

এরপর গঞ্জালিস ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরাকান অধিকারে ব্যর্থ হয়ে আরাকান-রাজের সঙ্গে মিলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত দখল করে নেয়। মোগলরা এক প্রকাণ্ড বাহিনী এনে এদের পরাস্ত করে। তারপর গঞ্জালিস গোয়ার পর্তুগিজ শাসকের অধীনতা স্বীকার করে ডন ফ্রান্সিস নামক সেনাপতিসহ একদল সৈন্য এনে আরাকানের প্রান্তভাগ লুন্ঠন করে। আরাকান-রাজ ওলন্দাজদের সাহায্যে পর্তুগিজদের সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপ দখল করে নেন।

১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লির মোগল সম্রাট শাহজাহান মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্বরত শাহাজাদা সুজা রাজমহলে বসে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং রাজধানী দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন। তবে বাহাদুরপুরের যুদ্ধে আরেক শাহাজাদা দারার হাতে পরাজিত হয়ে সুজা রাজমহলে ফিরে আসেন। কিন্তু আরেক শাহাজাদা আওরঙ্গজেব শাহাজাদা দারাকে পরাস্ত ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর খাজোয়াতের (ফতেহপুর জেলা, উত্তর প্রদেশ, ভারত) যুদ্ধে আওরঙ্গজেব সুজাকেও পরাজিত করেন।

পরাস্ত শাহাজাদা সুজা এরপর বাংলা ত্যাগ করে আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজ বাহিনীর অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে সপরিবারে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং (ম্রৌকউ) পৌঁছান। আরাকানের রাজা ‘চন্দ্রসুধর্ম্মা’ সুজাকে সাদরে গ্রহণ করলেও পরে সুজার সম্পদ হস্তগত করে সুজার কন্যাদের জোরপূর্বক বিয়ের চেষ্টা করায় সুজার সঙ্গে রাজার বিরোধ বাঁধে। পরে সুজাকে তার পরিবার ও দলবলসহ নিপীড়ন করে হত্যা হয়। তবে সুজার সাথে আসা লোকেরা আরাকানেই বসতি গেড়েছিল।

১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ সেনাপতি হুসেনবেগের সহায়তায় আরাকান-রাজকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে মোগলদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে তার সেনাপতি ওমেদ খাঁ ও হুসেনবেগ চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ দখল করে।

আরাকান-রাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারো মাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালাত। শায়েস্তা খাঁর এই দুর্ধর্ষ অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজ ও মগেরা অতি ক্ষিপ্রকারিতায় পালানোর (স্থানীয়ভাবে এই ঘটনা ‘মগ-ধাওনি’ নামে খ্যাত ছিল) সময় ১,২২৩টি কামান ফেলে যায়। এভাবে গোটা বাংলায় ‘মগের মুল্লুক’ এর অবসান ঘটে।

১৭৮৫ সালে বার্মিজ রাজা বোদাপায়া আরাকান দখল করলে ১৭৯৯ সালে প্রাণভয়ে প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ব্রিটিশ ভারতের অধীন চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। ব্রিটিশরা পরে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে জয়ী হয়ে সমগ্র বার্মা দখল করে নেয় এবং শুরু থেকেই তারা রোহিঙ্গাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল।

কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন-অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে ভারতীয় ও বাঙালিদের অধিবাসীদের অভিবাসিত করেছিল ব্রিটিশরা এবং বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোনো আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধও ছিল না।

আরাকান তথা রাখাইন প্রদেশের প্রাচীন রাজধানী ম্রৌক উ; Image Source: Myanmar Travel

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমর্থন অব্যহত রাখতে ব্রিটিশরা যুদ্ধের পর আরাকানকে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে বলে কথাও দেয়। এর ফলে ১৯৪২ সালে জাপানীদের চাপে ব্রিটিশরা বার্মা থেকে পিছু হটলে জাপান সমর্থক বৌদ্ধ রাখাইনরা আরাকানের ব্রিটিশ সমর্থক রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশ ছাড়া করে (আরাকান ম্যাসাকার-১৯৪২)।

১৯৪০ সালেই রোহিঙ্গা মুসলমানেরা বৌদ্ধ অধ্যুষিত বার্মা ত্যাগ করে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা শুরু করে। ১৯৪৮ সালে রোহিঙ্গা নেতারা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করে তাদের এই দাবী উত্থাপন করে এবং নর্থ আরাকান মুসলিম লিগ গঠন করে। কিন্তু বার্মিজ সমস্যায় নাক গলানো সমিচীন হবে না ভেবে জিন্নাহ এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হবার পর রোহিঙ্গাদের বার্মিজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মন্ত্রীসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তারা নিয়োগ পায়। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা সরকার গঠনের পর থেকেই রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ও নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু হয়।

মিয়ানমারের পার্লামেন্ট এই রোহিঙ্গারাও অলঙ্কৃত করেছিলেন; Image Source: The Daily Star

কেন এই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ?

প্রথমত, বার্মা স্বাধীন হবার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশদের দেয়া স্বাধীন আরাকানের প্রতিশ্রুতি যা ব্রিটিশরা রাখতে পারেনি। এর কারণে বার্মিজ ও রোহিঙ্গাদের মাঝে অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। উপরন্তু বার্মা স্বাধীন হবার আগেই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা নেতাবৃন্দ কর্তৃক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে তদবির করার ফলে বার্মিজদের আস্থাহীনতা আরো বাড়িয়ে দেয়। 

দ্বিতীয়ত, থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মের ধারক রাষ্ট্র হিসেবে বার্মা রোহিঙ্গাদের ধর্ম ইসলামকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি হুমকি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। জান্তা সরকার এই বিষয়টি কাজে লাগিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহানুভূতি পাবার পাশাপাশি বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুযোগে রোহিঙ্গাদের বার্মা ছাড়া করার চেষ্টা করে।   

তৃতীয়ত, আরাকান/রাখাইন স্টেটে চীন ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক আগ্রহের কারণে বিপুল বিনিয়োগ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এই সম্ভাবনাময় প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের পথে সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের লাভবান হবার যে সম্ভাবনা আছে তা নস্যাৎ করতেই বার্মা থেকে রোহিঙ্গাদের চিরতরে বিতারিত করতেই এই নজিরবিহীন নিধনযজ্ঞ।

যা-ই হোক, এই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের মূল কারণ হলো জাতীয়তাবাদ উৎসারিত বর্ণবাদ।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিক্ষোভ; Image Source: Yahoo News

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাস্তবতা

২০১৬-১৭ সালের ভয়াবহ নির্যাতনের পূর্বে অনুমানিক দশ লাখ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করত বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ভেতর সেই এক মিলিয়নের মধ্যে সোয়া ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। সারাবিশ্বে বর্তমানে প্রায় পনের থেকে বিশ লাখ রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে। প্রতি সাতজন দেশছাড়া মানুষের একজন এখন রোহিঙ্গা। সেই বিশ লাখ রোহিঙ্গার ভেতর তের লাখের বেশি বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৯ জন। তাদের রাখা হয়েছে ৩৪টি শিবিরে। এদের নিরাপত্তা রক্ষায় আছে সাতটি টহলচৌকি কিংবা ৯৫০ জন পুলিশ সদস্য। গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের কাজ শুরু করা হয় এবং বাংলাদেশে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ১১ লাখ ৩ হাজার ২৭২ জন। কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবির এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির (৫,৪৭,৬১৬ জন শরণার্থী)। এই বাস্তবতায় গত ১ মার্চ ২০১৯ তারিখ হতে আর কোনো নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণা করা হবে না মর্মে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ।

মার্চ ২০১৯ এর পরিসংখ্যান মতে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ছোট বড় ৩৪টি ক্যাম্পে ৯ লাখ ৯ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত দুটি শরণার্থী শিবিরের মধ্যে একটি হলো উখিয়ায় অবস্থিত কুতুপালং শরণার্থী শিবির, আর অন্যটি হচ্ছে টেকনাফে অবস্থিত নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির। রোহিঙ্গাদের জন্য ইউএনএইচসিআর এর স্থাপিত কার্যালয়টি কুতুপালংয়ে অবস্থিত, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং আইকেইএ ফাউন্ডেশনের মতো সাতটি আন্তর্জাতিক সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।

কুতুপালং শরণার্থী শিবির; Image Source: Prothom Alo English

ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থী রোহিঙ্গারা স্বভাবতই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বার্মিজদের অত্যাচারের ফলে নিদারুণ মানসিক ও শাররীক ক্ষত তো আছেই। সেই সাথে পুষ্টিকর খাবার, বাসযোগ্য বাসস্থান আর স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশন সুবিধাবর্জিত রোহিঙ্গারা ক্রমাগত ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানাবিধ রোগশোকে কাতর। ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই গর্ভবতী এবং ক্যাম্পে বাল্যবিবাহ ছড়িয়ে পড়ায় গর্ভধারণের সংখ্যা আরো বাড়ছে। সেই সাথে এইডসের ঝুঁকিতেও আছে ভাসমান রোহিঙ্গা পতিতারা। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা পাচারের হুমকিতে আছে, যুবকরা ইয়াবা পাচারসহ নানাবিধ অপকর্মের দিকে ঝুকছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে চলে যেতে তারা বিভিন্ন বৈধ ও অবৈধ পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে।

রোহিঙ্গারা যাতে ক্রমে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীতে মিশে যেতে না পারে এবং তাদের ঘিরে যেন কোনো রকম সশস্ত্র তৎপরতা গড়ে না ওঠে, তার নজরদারির জন্য কক্সবাজারের বর্তমান স্থান থেকে এদের সরানো জরুরি মনে করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা প্রস্তাব করে। উপকূলীয় জেলেরা একে ‘ঠেঙ্গারচর’ নামেও ডাকেন, যা মূলত সন্দ্বীপের ন্যায়ামস্তি ইউনিয়নের ভাঙন-পরবর্তী জেগে ওঠা জমি। হাতিয়া থেকে ১৮-১৯ কিলোমিটার এবং নোয়াখালীর মূল ভূমি থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এই চরের অবস্থান। ২০০৬ সালে সাগরের ভেতরে এই চর জেগে ওঠে। কিন্তু তখন পরিকল্পনাটি মানবাধিকার সংস্থা এবং ইউএনএইচসিআর-এর আপত্তির কারণে কার্যকর হয়নি।

নকশা অনুযায়ী সেখানে ১,৪৪০টি ঘর বানানো হয়েছে, যার প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে যদি চারজন করে সদস্য হয় তাহলে তাদের আলাদা একটা কক্ষ দেয়া হবে এবং তাদের জন্য আলাদা রান্নাবান্না ও টয়লেটের সুবিধাও রাখা হয়েছে।

বন্যা বা জলোচ্ছাসের পানি ঠেকাতে বাড়িগুলো মাটি থেকে চার ফুট উঁচু করে বানানো হয়েছে। এখানে মানুষের উচ্ছিষ্ট থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই গ্যাস দিয়েই চলবে রান্নাবান্না। এছাড়া বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। প্রতিটি স্থানে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য তিনটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো ভূমি থেকে ৭২০ ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং পর্যাপ্ত পুকুর।

ভাসান চরের মহাপরিকল্পনা; Image Source: Dhaka Tribune

কিন্তু রোহিঙ্গারা নানা অজুহাতে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী না। শরণার্থীদের মাঝে যেহেতু বিপুল নারী ও শিশু রয়েছে, সে কারণে প্রস্তাবিত স্থানান্তর-প্রক্রিয়া অবশ্যই স্বেচ্ছামূলক হতে হবে। জোর করে শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালী নেওয়ার অবকাশ নেই। মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশ এককভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রথমত, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। এখানে আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। বাংলাদেশের আগ্রহ ও অনুমোদনেই রোহিঙ্গাদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছে। ফলে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়াই সংগত হবে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ভাসানচরে বন্যার ঝুঁকি প্রবল। দ্বীপটি জেগে উঠেছে বেশি দিন হয়নি। এর ভূমি কাঠামো মানববসতির জন্য কতটা উপযোগী তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যেখানে হঠাৎ করে বিপুল মানুষের পুনর্বাসনে কক্সবাজারের বর্তমান অবস্থার চেয়ে অধিক ঝুঁকি তৈরি করে কি না, সে সন্দেহ রয়েছে।

এছাড়াও আশংকা রয়ে যায় যে এই স্থানান্তরের ফলে মিয়ানমার ভাবতে পারে, বাংলাদেশেই যেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাই তাদের আর ফেরত না নিলেও চলবে। বর্তমানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ‘উন্নত’ এবং স্থায়ী পরিসরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা মাত্রই মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের গ্রহণ এবং পুনর্বাসনে নিশ্চিতভাবে নিরুৎসাহ দেখাবে। বাংলাদেশের পুনর্বাসন উদ্যোগ মিয়ানমারের ওই প্রচারণাকেও শক্তি জোগাবে, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেরই নাগরিক’।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঝুঁকির দিক হলো আন্তর্জাতিক মহলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে এই স্থানান্তর-প্রক্রিয়া শুরু হলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনীতিক পরিসরে একা হয়ে যাবে। সেটাও পরোক্ষে মিয়ানমারের হাতকে শক্তি জোগাবে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বর্তমানে রোহিঙ্গাদের খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, ভৌগোলিক কারণেই ভাসানচরে সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে। স্থানটি সাগরের প্রবল জোয়ার-ভাটার আওতাভুক্ত। হাতিয়া থেকে নৌযানে ভাসানচরে যাওয়া সম্ভব প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টায়। সংগত কারণেই সেখানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মীদের জন্য যাতায়াত সহজ হবে না। প্রাকৃতিক ঝুঁকির কারণেই এরূপ যাতায়াত দ্রুত কমে যাবে। স্থানান্তর-প্রক্রিয়া নিয়ে মতদ্বৈধতা হলে এরূপ সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম থেকে ক্রমে সরে আসারও ঝুঁকি রয়েছে। সে রকম অবস্থায় ভাসানচরে পুনর্বাসিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ প্রশাসনের জন্য স্থায়ী বোঝায় পরিণত হতে পারে। তাই বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে ধীরে চলবার নীতি অবলম্বন করে বরং মায়ানমারে স্থানান্তর প্রক্রিয়ার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করেছে।

Image Source: BBC

টেকনাফ উখিয়ার ৩৮টি শরণার্থী শিবির ও ১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৯২৬। এদের মধ্যে ৬০ হাজার ১১৯ জন কিশোরী ও ৬০ হাজার ৮০৭ জন কিশোর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্বেগের কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি। এসব গোষ্ঠী ইয়াবা ও মানব পাচার, খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো অপরাধে যুক্ত।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাদক, মানব পাচার, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি, অস্ত্র আইন ও ফরেনার্স অ্যাক্টে কক্সবাজার জেলায় ৪২৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৯৯০। এ সময়ে শরণার্থী শিবিরে হত্যা মামলা হয়েছে ৩৯টি। এর বাইরে মাদক মামলা ১৮২টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ৩০টি, অপহরণ ১৩টি ও ডাকাতির ৯টি মামলা হয়েছে।

মোটা দাগে কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়া বা কোনো কাজে সম্পৃক্ত না হওয়ার দুটি কারণ জানা যায়। প্রথমত, নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা হয়তো আর ফিরে যেতে চাইবে না। এমনিতেই শরণার্থী শিবিরের বাইরে গিয়ে অনেকেই খুব সস্তায় দিনমজুরের কাজ করছে, এতে করে স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ পাচ্ছে না। তাছাড়া এরা অন্যান্য কাজে দক্ষতা অর্জন করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই সন্তানদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে রাজি নন। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়ার পরও ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩৯ শতাংশ শিশু এবং ৯৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী শিক্ষাকেন্দ্রে আসছে না। কিছু অভিভাবক বলেছেন, লেখাপড়া তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।

রোহিঙ্গাদের মধ্য ২ হাজার ৬৪৫ জন যৌনবাহিত, ৩ লাখ ৬ হাজার ৫৬৬ জন ম্যালেরিয়া, ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৮২ জন ডায়রিয়া রোগাক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৭৬ ও এইচআইভি পজিটিভ সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১১২। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে এইডস-ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। গত মে মাস পর্যন্ত এইডস রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। এসব রোগী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে অবাধ চলাফেরা করায় এইডস ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু কক্সবাজার নয়, সারা দেশের মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে তারা এইডসে সংক্রমিত এ পর্যন্ত ২৪০ জন রোগীকে নিবন্ধিত করা হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে তাদের জানা নেই। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইডস রোগীর সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি।

Image Source: Dhaka Tribune

ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে অন্তত ১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। চলছে অস্ত্রের মহড়াও। গত সাড়ে চার মাসে খুন হয়েছে ৩২ রোহিঙ্গা। অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধও বাড়ছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের ১৪টি দল রয়েছে, যারা শিবিরের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানব পাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধকর্ম করছে।

২০১৬ সালের ১৩ মে টেকনাফের মুছনী রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে শালবন আনসার ক্যাম্পে হামলা চালায় হাকিম বাহিনী। এ সময় আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। নিয়ে যায় ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র। সর্বপরি, বর্তমানে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়ায় রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দা মাত্র সাড়ে ৫ লাখের মতো। তাই এই বিপুল শরণার্থীর চাপে স্থানীয়রাই এখন সংখ্যালঘু! তাই একটি সামাজিক বিপর্যয় প্রায় অত্যাসন্ন!

তবে রাখাইনে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ চার পদস্থ সেনা কর্মকর্তার ওপর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে নতুন করে চাপে ফেলেছে। রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্ত শুরুর প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হচ্ছে মিয়ানমারকে। গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে রোহিঙ্গাদের যেভাবে রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তথ্যানুসন্ধানকারী দল। এ নিয়ে তদন্ত শুরু করতে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অনুমতি চেয়েছেন আদালতের কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা।

তদন্তসহ বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করতে যাচ্ছে আইসিসি। এছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। কূটনীতিকেরা বলছেন, হঠাৎ কিছুটা চাপে পড়ায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। আসিয়ানের এই চার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র মনে করে, রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তা মিয়ানমারের অখণ্ডতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার বছরখানেক না যেতেই রাখাইনে হামলা শুরু করেছে আরাকান আর্মি। আবার শানসহ বিভিন্ন জায়গায় আছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপস্থিতি। মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে একে অন্যের কাছাকাছি আসতে সহায়তা করবে। শেষ পর্যন্ত এটি ঘটলে তা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।

Image Source: Public Radio International

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলোর কাছে এই পর্যন্ত ৬৮২ মিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার ৭৯৭ হাজার কোটি টাকার তহবিল এসেছে। এর ফলে এই তহবিল থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ হাজার টাকা। এখন দেখার বিষয় এই টাকার কত অংশ রোহিঙ্গারা পেয়েছেন আর কত অংশই বা ব্যয় হয়েছে সংস্থাগুলোর প্রধান কার্যালয় বা মাঠপর্যায় পরিচালন ব্যয়ে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় পরিচালিত ত্রাণ কর্মসূচির পরিচালন ব্যয় এবং তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

রোহিঙ্গা শরনার্থীদের এসব বহুমাত্রিক সমস্যা সমাধানে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন কর্মপন্থা পেশ করা হয়। এ অনুযায়ী বারো লাখ রোহিঙ্গার জন্য প্রায় ৯২০.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান আশা করা হচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনমানে হয়ত সামান্য উন্নতি আসবে, কিন্তু শক্তিশালী বিশ্ব জনমতের অভাবে এবং চীন-ভারতের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের অনীহার কারণে দেশহারা রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ আজও অনিশ্চিত।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) রোহিঙ্গা রঙ্গ ১: বার্মিজ ইতিহাস পাঠ

২) রোহিঙ্গা রঙ্গ ২: ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাধীনতা এবং গৃহযুদ্ধ কাতরতা (১৮২২-১৯৮৮)

৩) রোহিঙ্গা রঙ্গ ৩: ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাধীনতা এবং গৃহযুদ্ধ কাতরতা (১৯৮৯ থেকে বর্তমান)

৪) রোহিঙ্গা রঙ্গ ৪: রোহিঙ্গা নিধন – ১৯৪২ সাল থেকে শুরু এক এথনিক ক্লিঞ্জিং

This article is in Bengali language. It tells the history of Myanmar.

Reference Books:

  1. Myanmar’s Enemy Within: Buddhist Violence and the Making of a Muslim ‘Other’ (Asian Arguments) – Francis Wade
  2. Myanmar: Democratisation, Foreign Policy and Elections – Amrita Dey
  3. The Rohingyas: Inside Myanmar’s Hidden Genocide – Azeem Ibrahim
  4. রোহিঙ্গা জাতির ইতিকথা – মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
  5. বার্মার রোহিঙ্গারা গণহত্যার ইতিহাস – ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন (অব:)

Related Articles