Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোমান ভন স্টার্নবার্গ: মঙ্গোলিয়াকে চীনের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন যে রুশ জেনারেল

যুদ্ধ আর ইতিহাসের মোড়ে চকিতে পাল্টে যেতে পারে জীবন। যুদ্ধংদেহী নৃশংস নেতা অথবা বিপ্লবী বীর, দুয়েরই জন্ম দিতে পারে মানব জাতির নিরন্তর সংঘর্ষের কারণে। আর এই মানুষগুলো যেসব কীর্তির জন্ম দেন সেগুলোও কম চমকপ্রদ নয়।

রোমান ভন স্টার্নবার্গ নামের এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ায়। বাবা এবং মা দুজনই ছিলেন জার্মান। তবে তিনি মূলত রুশ সম্রাটের সবচেয়ে পাঁড় সমর্থকদের একজন ছিলেন। রুশ গৃহযুদ্ধের সময় তিনি মঙ্গোলিয়ায় চলে যান। সেখানে চীনা হানাদারদেরকে পরাস্ত করে দখল করে নেন সেই অঞ্চল। মঙ্গোলিয়া থেকে আবার রাশিয়ায় অভিযান চালিয়ে রুশ সিংহাসন কব্জা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

কারো কারো মতে, এশীয় সেনাদলের সাহায্যে গোটা ইউরেশিয়া ভূখন্ডে তিনি সম্রাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। লাল ফৌজের বিপক্ষে যুদ্ধে হেরে শেষমেষ তার সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি ঘটে। বন্দীদের ওপরে নির্মম অত্যাচার, কড়া শাসন, ক্ষ্যাপাটে আচরণ তথা বৌদ্ধধর্মের একটি শাখার প্রতি তার বাড়াবাড়ি অনুরক্তি তাকে বিশেষ পরিচিত এনে দেয়। রুশ এই ‘ম্যাড ব্যারন’ এর জীবন বিতর্কিত হলেও অত্যন্ত কৌতূহলীদ্দোপক। 

জন্ম ও প্রথম মহাযুদ্ধ

রবার্ট নিকোলাস ম্যাক্সিমিলিয়ান ভন স্টার্নবার্গ এর জন্ম১৮৮৬ সালে, অস্ট্রিয়ায় (তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত)। তার মা-বাবা দুজনই বাল্টিক জার্মান ছিলেন। কিছুকাল পরে মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে মায়ের সাথে তিনি এস্তোনিয়ায় চলে আসেন। এস্তোনিয়া সেই আমলে রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু রোমানভ রাজবংশের শাসনামলে রুশ সাম্রাজ্যে জার্মানদের খুবই প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। বিখ্যাত রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন দ্য গ্রেট জার্মান বংশোদ্ভুত ছিলেন।

ম্যাড ব্যারন; Image Source: Wikimedia Commons

যা-ই হোক, স্টার্নবার্গ নিজের জার্মান আভিজাত্য নিয়ে খুবই অহংকার করতেন। এস্তোনীয়দের তিনি অশিক্ষিত এবং নিচু জাত হিসেবে গণ্য করতেন। কড়া রাজপন্থী এই লোকটি অবশ্য শিক্ষাদীক্ষায় মোটেও সুবিধা করতে পারেননি। পরে তাকে সেনাবাহিনীতে ঘোড়সওয়ারদের অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

যুদ্ধবিদ্যায় ভালোই পারঙ্গম হওয়ায় সেনাদলে দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে মঙ্গোলিয়া সীমান্তে দায়িত্ব পালনকালে স্টার্নবার্গ বুরিয়াত, মঙ্গোল প্রভৃতি জাতি, যাদের সংস্কৃতিতে ঘোড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পূর্ব এশীয় এসব যাযাবর জাতি এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতি তিনি বাড়াবাড়ি আগ্রহ দেখাতেন। স্টার্নবার্গ বিশ্বাস করতেন, বাবার দিক দিয়ে তিনি বাতু খানের বংশধর। উল্লেখ্য, বাতু খানের সেনাবাহিনী ১২৪১ সালে হাঙ্গেরি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল।

জারপন্থী কসাক সেনাদল; Image Source: Russia Beyond

উচ্ছৃঙ্খল, বদরাগী এবং অসহিষ্ণু হওয়া সত্ত্বেও স্টার্নবার্গ দারুণ সাহসী অফিসার ছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মান আর তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন আর পদক লাভ করেছেন। পরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে রাশিয়ার জারের পতন ঘটলে তিনি আরেক কট্টর জারপন্থী জেনারেল গ্রেগরি সেমিওনভের সাথে যোগ দেন। এসব সামরিক নেতা কেরেনস্কিকে মেনে নিতে রাজি হলেও কম্যুনিস্টদেরকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।

সেমিওনভ আর স্টার্নবার্গ কিছুকাল ইরানে থেকে সেখানকার আসিরিয়দেরকে নিয়ে তুর্কীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। দুজনই বিশ্বাস করতেন, এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলোকে দিয়ে বলশেভিকদেরকে তুলোধুনা করা যাবে। বুরিয়াতদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা চলে যান সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলে। 

রুশ গৃহযুদ্ধ এবং মাঞ্চুরিয়া

শ্বেতরক্ষীদের নেতা অ্যাডমিরাল কলচাকের সাথে স্টার্নবার্গ বা সেমিওনভের বনাবনি হতো না। পূর্বোক্তজনের কাছে কেরেনস্কির সরকার আপত্তিকর ছিল না। কিন্তু স্টার্নবার্গ আর সেমিওনভ ছিলেন কড়া জারপন্থী। তারা অন্যান্য শ্বেতরক্ষী সেনাদলগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেনা সমাবেশ করতে লাগলেন মাঞ্চুরিয়া আর রাশিয়া সীমান্তে। মাঞ্চুরিয়া হচ্ছে চীনের উত্তর-পশ্চিমের একটি বিরাট অঞ্চল। রুশ-জাপান যুদ্ধের পর এই এলাকায় জাপানীদের খুবই প্রভাব প্রতিপত্তি হয়।

স্টার্নবার্গ আর সেমিওনভ এই সুযোগটা নিলেন। জাপানী অর্থ আর অস্ত্রে নিজেদেরকে শক্তিশালী করে নিতে থাকলেন তারা। তাদের সেনাদলে রুশ কসাক, পোল, চীনারা তো ছিলোই, সাথে ছিল বুরিয়াত, বাশখির, তাতার, মঙ্গোল আর মাঞ্চুদের মতো ঘোড়সওয়ার সেনারা। এদের অনেকেই জারের সেনাবাহিনীতে ফেরত, নৃশংস আর পোড় খাওয়া যোদ্ধা। স্টার্নবার্গ গর্ব করে বলতেন, তার সেনাদলে ১৬ জাতির লোক আছে।

কলচাকসহ অন্যান্য শ্বেত জেনারেলরা রেড আর্মির কাছে একের পর হারের সম্মুখীন হতে থাকলে স্টার্নবার্গ সেমিওনভকে ত্যাগ করে নিজেই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবার তোড়জোড় আরম্ভ করেন। 

১৯২০ সালের রাশিয়া; Image Source: youtube

মঙ্গোলিয়া

মঙ্গোলিয়া ভূখন্ডটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ইনার মঙ্গোলিয়া অংশটি চীনের অধীনে আছে। আর বর্তমান মঙ্গোলিয়াসহ আরো কিছু অংশ আগে পরিচিত ছিল আউটার মঙ্গোলিয়া নামে। ১৯১৫ সালের এক সমঝোতা অনুযায়ী, আউটার মঙ্গোলিয়া ছিল স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল এবং চীনা বা রুশরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতো না।

এবারে একটু চীনের দিকে তাকানো যাক। ১৯১৬ সাল থেকে সেখানে একাধিক যুদ্ধবাজ নেতা এলোমেলো এবং অস্থিতিশীল সরকার চালাতেন। এদের মধ্যে আনহুই অঞ্চলের কয়েকজন নেতার বিশেষ দৌরাত্ম্য ছিল। এরাই ১৯১৯ সালে আউটার মঙ্গোলিয়ায় সৈন্য পাঠায়। কিছুদিন পর আনহুই নেতাদের পতন ঘটলে এসব সেনারা আউটার মঙ্গোলিয়ায় বিদ্রোহ আর লুটপাটের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। স্টার্নবার্গ এই গোলমালের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ইতোমধ্যেই তিনি প্রিন্সেস জা নামের এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এবার সেমিওনভকে বাদ দিয়ে তিনি আউটার মঙ্গোলিয়া করায়ত্ত্ব করবার পরিকল্পনায় নামলেন।

আলোচ্য সময়ে উত্তর-পূর্ব এশিয়া; Image Source: Chinese Dispatches

আউটার মঙ্গোলিয়ার ধর্মীয় গুরু বোগদ খানকে চীনারা বন্দী করে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন অষ্টম জেবসানডাম্বা খুতুকতু। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে সম্মানের দিক দিয়ে দালাই লামা আর পাঞ্চেন লামার পরই এই পদবীর স্থান। স্টার্নবার্গ তার দেড় হাজার সৈন্য নিয়ে মঙ্গোলিয়ায় হানা দিলেন। প্রায় হাজার সাতেক চীনা সৈন্য ছিল সেখানে।

স্টার্নবার্গের সৈন্যরা চীনাদেরকে পরাস্ত ও বিতাড়িত করে রাজধানী উলানবাটর দখল করে নেয়। বোগদ খানকে উদ্ধার করা হয়। গোটা মঙ্গোলিয়া জুড়ে চীনাদের পাশাপাশি কম্যুনিস্টদের খুন করা হতে থাকে। 

বোগদ খান; Image Source: The Mad Monarchist

১৯২১ এর ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গোলিয়া নিজেকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। স্টার্নবার্গকে ‘খান’ উপাধি দেওয়া হয়। বোগদ খান ক্ষমতায় বসলেও দেশের মূল নিয়ন্ত্রণ স্টার্নবার্গের হাতেই ছিল। কয়েক শত বিদেশীর পাশাপাশি অনেক মঙ্গোলকেও খুন করে তার সেনারা। মঙ্গোলিয়াকে চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করায় অনেক মোঙ্গল নাকি এই ইউরোপীয় খানকে চেঙ্গিস খানের পুনরুত্থিত রূপ বলে বিশ্বাস করতো।  

আবার যুদ্ধ ও পতন

অনেক মঙ্গোলই রাশিয়ার মতো নিজেদের দেশেও একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার দেখতে চাইতেন। ১৯১৭ এর বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকেই মঙ্গোলিয়ায় কম্যুনিস্ট এজেন্টরা ঢুকতে থাকে। ১৯২১ এর পর তো তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধই শুরু করে দেয়। স্টার্নবার্গ ভেবেছিলেন, তিনি যদি সৈন্যদের নিয়ে সাইবেরিয়ায় ঢুকে যান, তাহলে সেখানকার কসাক ও সাধারণ মানুষেরা তার সাথে যোগ দেবে। কাজেই তিনি পাল্টা সাইবেরিয়াতে হানা দিলেন।

ততদিনে অবশ্য সেখানে সোভিয়েত রাজ পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছেন, কাজেই বিশেষ কোনো সমর্থন মিললো না। ফেরার উপায় না দেখে তিনি পরিকল্পনা করেন তিব্বতে পালিয়ে যাওয়ার। এই খামখেয়ালী পরিকল্পনার কথা শুনে কিন্তু স্টার্নবার্গের সেনারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। তার ডানহাত মেজর জেনারেল রাজুখিনকে হত্যা করা হয়। স্টার্নবার্গ পালিয়ে যাওয়ার পথে সোভিয়েতদের হাতে ধরা পড়েন। ১৯২১ এর সেপ্টেম্বরে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। দামদিন সুখবাতার নামের এক মঙ্গোল কম্যুনিস্ট মঙ্গোলিয়ায় ক্ষমতা দখল করেন।

রোমান স্টার্নবার্গ; Image Source: Pinterest

রোমান ভন স্টার্নবার্গ ক্ষ্যাপাটে আর চরম নৃশংস সেনানায়ক ছিলেন। তবে যুদ্ধে তার বাড়াবাড়ি সাহসের কারণেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। মঙ্গোলদের মতোই পোশাক আশাক পরতেন তিনি, পূর্ব এশীয় সংস্কৃতিতেও ভীষণ অনুরক্ত ছিলেন। মঙ্গোলদের তিনি স্বপ্ন দেখাতেন আবার বিশ্ববিজেতা হওয়ার। বোগদ খান স্টার্নবার্গের বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। স্টার্নবার্গের মৃত্যুর পর রাজধানী উলান বাটরে বোগদ খানের নির্দেশে শোকানুষ্ঠান পালন করা হয়েছিল। বিচিত্র এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে বহু বই আর সিনেমা বানানো হয়েছে।

ফিচার ইমেজ- Youtube

Related Articles