Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাচিকো: পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল যে মেয়েটি (পর্ব – ১৬)

সাচিকো

১৯৬১-১৯৬২

বাবার মতো হওয়া?

মুহূর্তের মাঝেই সাচিকোর মনটা বিষাদে ভরে গেলো, বুকটা খা খা করতে লাগলো। কীভাবে সে বাবার শূন্যস্থান পূরণ করবে? সে তো কেবল বাবাকে মিসই করতে পারে!

সুউচ্চ কর্পূর গাছগুলোও এবার আর সাচিকোকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাতে পারলো না। মাত্র বিশ বছর বয়সে এসেই সাচিকো অল্পতে ক্লান্ত হয়ে যেতে লাগলো। তার মনে লাগলো, সে বুঝি খুবই আস্তে-ধীরে চলছে। কিন্তু নাগাসাকির সবারই কি এমন ক্লান্তিবোধ হতো না?

মায়ের জোরাজুরিতে অবশেষে ডাক্তারের কাছে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে যায় সাচিকো। তার গলা এবং গ্রন্থি পরীক্ষা করে ডাক্তারের ভ্রু-যুগল কেমন যেন কুঁচকে গেলো। তিনি সাচিকোর থাইরয়েডের কোষের সামান্য নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য সেগুলো ল্যাবরেটরিতে পাঠালেন।

পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সাচিকো। কিন্তু ফলাফলে যা আসলো, সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।

তার থাইরয়েড ক্যান্সার হয়েছে!

কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? তার কোনো ব্যথা ছিলো না, গলাও তেমন একটা ফুলে যায়নি, আবার অসুস্থতার তেমন কোনো উপসর্গও দেখা যায়নি- কেবল ভয়াবহ রকমের ক্লান্তিই তাকে ঘিরে ধরেছিল।

বোমা হামলার ফলে সৃষ্ট বিকিরণ থেকেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল সাচিকো।

একুশ বছর বয়সী সাচিকো; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

হিরোশিমা আর নাগাসাকির ডাক্তাররা হিবাকুশাদের মাঝে থাইরয়েডসহ নানা ধরনের ক্যান্সার হওয়ার হার হিসাব করে রাখছিলেন। তারা ধারণা করছিলেন, সম্ভবত বিকিরণের শিকার হবার ফলেই এই ক্যান্সারগুলো দেখা দিচ্ছে। তাদের গবেষণা বলছিলো, এই দুটো শহরেই মূলত থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হুট করে বেড়ে গিয়েছে।

সাচিকোর অসুস্থতা নিয়ে খুব বেশি একটা কালক্ষেপণের সময় ছিল না। খুব দ্রুতই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করতে হতো তার। রোগ দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের টিউমারটি দ্রুত অপসারণ করতে হতো।

… … … …

সাচিকোর অপারেশন হলো। সে যখন হাসপাতালের অপারেটিং টেবিলে শুয়ে ছিল, মা তখন একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করছিলেন কাছেরই একটি মঠে। হাত জোড় করে স্রষ্টার কাছে মেয়ের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন তিনি।

… … … …

জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালের রিকভারি রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলো সাচিকো। পুরো গলা জুড়েই তখন অসহ্য ব্যথা। মনে কেমন যেন এক ভয়ের শিহরণ খেলে গেলো। বিছানায় শুয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। সমস্যা হচ্ছিলো ঢোক গিলতেও। মনে হচ্ছিলো, আবারও সে যেন সেই শৈশবের মতো বোমা হামলার ঠিক পরমুহূর্তে ধ্বংসস্তূপের নিচেই পড়ে আছে।

আস্তে আস্তে মুখ খুলে কারো সাহায্য চাইতে শব্দ করতে চাইলো সাচিকো, কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোলো না।

হঠাৎ করেই ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে গ্রীষ্মের সেই সকালবেলার স্মৃতিগুলো একে একে সাচিকোর মনের জানালার উঁকি দিয়ে যেতে থাকলো।

বন্ধুবান্ধবদের সাথে হাঁড়ি-পাতিল খেলা, কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানানো।

বোমা বিষ্ফোরণ।

প্রচণ্ড উত্তাপ।

বিস্ফোরণের ধাক্কা তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো।

পাথর, কাচ, পাতা, গাছের ডাল, ছাদের টাইলস- সবই তার উপর একে একে স্তূপাকারে জমা হতে লাগলো।

চিৎকার-চেচামেচি।

চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা।

সাকামোতো সিমেট্রির গা ছমছমে নীরবতা। কাঁপতে কাঁপতে মায়ের গা ঘেষে বসা। তখনও সাচিকো কোনো কথাই বলতে পারেনি।

Image Source: historyhit.com

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আবারও কাউকে ডাকতে চাইলো সাচিকো, কিন্তু তার গলা দিয়ে এবারও কোনো আওয়াজ বেরোলো না। চরম হতাশা তাকে গ্রাস করে ফেললো।

কিছুক্ষণ পর একজন নার্স এসে তার হাতে নোটপ্যাড ও কলম দিয়ে গেলো। কিন্তু সে কী লিখবে?

এমন জীবন সাচিকো কখনোই চায়নি।

হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল সাচিকোকে। প্রতিদিনই মা তার জন্য মিসো স্যুপ বানিয়ে আনতেন। প্রতিদিনই ডাক্তার-নার্সরা তাকে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে আসতো। এভাবেই একদিন তাকে পরীক্ষা করার সময় সে নাক দিয়ে ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করলো। তার মনোভাব বুঝতে পেরে ডাক্তার তাকে বললেন, “তুমি শীঘ্রই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।

কিন্তু আসলেই কি সে সুস্থ হবে? তখনও পর্যন্ত সে কোনো কথাই বলতে পারতো না। কল্পনায় সে এক অন্ধকার জগতে ঘুরে বেড়াতো; একা একা, অনাগত ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত হয়ে।

কণ্ঠস্বর ছাড়া আমি আসলে কে?” নিজেকে এই প্রশ্ন করে নিজেই চমকে গেলো সাচিকো।

একমাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলো সাচিকো। মায়ের সাথে বাড়ি ফিরলো সে। সবকিছু ঠিক আগের মতোই ছিলো। রান্নার ছোট চুলা, দাদীমার সেই পাতাকৃতির গামলা, তিন ভাই, বাবা, মিসা আর মামার দেহভস্ম ধারণকারী বাক্সগুলো- সবই। কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর ছাড়া সাচিকো যেন আর আগের সেই সাচিকো ছিলো না, কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল তার আসল সত্ত্বা।

রাতের বেলায় নানারকম দুশ্চিন্তা সাচিকোর মাথায় ভর করতো। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা সে কি আর কখনো করতে পারবে? সে কীভাবে নতুন করে জীবনটা শুরু করবে? মায়ের যত্নআত্তি করবে? নাকি পুরনো কাজে ফিরে যাবে? মাঝরাতে এসব ভাবতে ভাবতে ভয়ে আরো কুঁকড়ে যেত সাচিকো, সীমাহীন অন্ধকারের রাজ্যে হারিয়ে যেত সে। আশার সকল দরজাই যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার জন্য।

এমনই বিষাদময় এক রাতে হঠাৎ করেই সাচিকোর মাথায় কে যেন কথা বলে উঠলো। পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর যেন ফিসফিসিয়ে তাকে ভুলে যাওয়া একটি বার্তা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলো, “স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলো। তারাই তোমাকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন।

সাচিকোর বাবা-মা; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

বাবার কণ্ঠস্বর!

আত্মিকভাবে বাবার সাথে তার বন্ধন তখনও অটুট ছিলো। কিন্তু এখন, এই বয়সে কারা তাকে সেই পথের সন্ধান দেবে?

হঠাৎ করেই একটি ছবি ঝাপসাভাবে সাচিকোর স্মৃতির জানালায় উঁকি দিয়ে যেতে থাকলো, আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে উঠলো সেটি। গোল গোল চোখের সুন্দরী এক নারী, হাস্যোজ্জ্বল মুখ, মাথার হ্যাটটা সামান্য বাঁকা করা- হেলেন কেলার তখনও সেই নাগাসাকি স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

হেলেন কেলার; Image Source: history.com

দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হেলেন কেলার অন্ধকার আর নীরবতা ছাড়া আর কিছুই চিনতেন না। তারপরও হাসিমুখে তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অগণিত জনতার দিকে, আশার বীজ বুনে চলেছিলেন তাদের মনে, আর কথা বলছিলেন তার নিজের কণ্ঠের সাহায্যেই। হেলেন কেলার একবার লিখেছিলেন, “সুখের একটি দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায়, আরেকটি তখনই খুলে যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার দিকে এতটাই মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকি যে, পাশেই যে আরেকটি দরজা আমাদের জন্য খুলে গেছে, সেটা আমাদের নজরেই আসে না।

হেলেন কেলার তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছিলেন। সাচিকো কি তার কণ্ঠস্বর ফিরে পাবে?

সাচিকো তার প্রতিদিনকার চর্চা শুরু করলো। ঢোক গেলাটা ছিলো বেশ কঠিন। কিন্তু তারপরও প্রতিদিনই সে একটু একটু করে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো। কেবল নাক দিয়ে ঘোঁতঘোঁত শব্দ না করে সে ফিসফিস করে কথা বলার চেষ্টাও করতে লাগলো। নিজে নিজেই স্বরগ্রাম, ধ্বনি ও কণ্ঠস্বর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে লাগলো।

পুরো বিষয়টিই পাহাড়ে চড়ার মতো করে দেখছিলো সাচিকো। চূড়ার উদ্দেশ্যে করা এ যাত্রায় তার অবস্থান কতদূর? চূড়ায় পৌঁছতে আর কতদিন লাগবে? দুই মাস? চার মাস?

সাচিকো তার নিজের দৃঢ়তাকে হেলেন কেলারের দৃঢ়তার সাথেই তুলনা করছিলো। সেই সাথে নিজের মাঝে আশার বীজ বুনে চলেছিল। ছয় মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সাচিকোর ভোকাল কর্ড আবারও শব্দ উচ্চারণের মতো শক্তি ফিরে পেলো। এরপর সে ধীরে ধীরে বাক্যও উচ্চারণ করতে শুরু করলো। শেষপর্যন্ত সাচিকো আবারও আগের মতো কথা বলতে শুরু করলো।

হেলেন কেলারের জানা বিষয়টিই সাচিকো নতুন করে শিখলো। প্রতিটি শব্দই মূল্যবান!

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) পর্ব – ১  ||  ২) পর্ব – ২  ||  ৩) পর্ব – ৩  ||  ৪) পর্ব – ৪  ||  ৫) পর্ব – ৫  ||  ৬) পর্ব – ৬  ||  ৭) পর্ব ৭ ||  ৮) পর্ব ৮  ||  ৯) পর্ব ৯  ||  পর্ব ১০  ||  পর্ব ১১  ||  পর্ব ১২  ||  পর্ব ১৩  ||  পর্ব ১৪ ||  পর্ব ১৫

This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.

Reference Book

1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Feature Image: Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Related Articles