Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাচিকো: পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল যে মেয়েটি (পর্ব – ১৯)

সিকাডা ইয়ার্স

১৯৬৮ – ১৯৯২

ঘুরঘুরে পোকার নিম্ফরা মাটির নিচে অনেকদিন সময় কাটায়। মাটির নিচে সুরক্ষিত অবস্থায় গাছের শিকড়ের শীর্ষভাগ থেকে পুষ্টিকর দ্রব্য শুষে নেয় তারা। কালের পরিক্রমায় মাটির নীচে থেকে উঠে এসে গাছের ডালে জায়গা করে নেয় তারা। সূর্যের আলোতে পাতলা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা, ডানাটাকে শুকিয়ে নেয় আর এরপরই শুরু হয়ে যায় তাদের গ্রীষ্মের গান।

হেলেন কেলার; Image Source: CNN

পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি, নিজের ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট- এই সবকিছু নিয়েই সাচিকো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘুরঘুরে পোকার নিম্ফের মতো সে-ও পুষ্টিদ্রব্য শোষণ করতো বাবার জ্ঞানরুপ বৃক্ষের শেকড় থেকে; হেলেন কেলারের সাহস থেকে এবং ভালোবাসা, অহিংসা ও ন্যায়বিচারের প্রতি গান্ধীজি ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বিশ্বাস থেকে।

মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র; Image Source: The Gale Blog

দেখতে দেখতে একটি দশক পেরিয়ে গেলো। সাচিকোও দুঃসহ অতীত পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বিখ্যাত মারুজেন বুকস্টোরে একাউন্টেন্ট পদে চাকরির জন্য আবেদন করলো সে। পাশ্চাত্য দুনিয়া থেকে সংগ্রহ করা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার মূল্যবান সব বইয়ের জন্য দোকানটি ছিল সুপরিচিত। চাকরিটা তার হয়েও গেলো। অফিসে দ্রুততা ও দক্ষতার সাথেই কাজ করতো সাচিকো, মেলাতো যাবতীয় হিসাবনিকাশ, চেক করে দেখতো সব অর্ডার করা বই ঠিকমতো যাচ্ছে কি না। পেছনে চলতে থাকতো রেডিও। দুপুরে খাবারের বিরতির সময় সে রেডিওতে বিশ্বের খবর শোনার পাশাপাশি বইয়ের তাকগুলো হাতড়ে বেড়াতো। সে এমন লেখকদের বই খুঁজতো যারা তাকে নতুনভাবে এই বিশ্বটা চিনতে শেখাবে। সে এমন বই খুঁজতো যা তার জ্ঞানভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করবে। সে যত পড়াশোনা করতে লাগলো, দিন-দুনিয়ার নানা বিষয়ে তার ধারণা ততই গভীর ও পরিষ্কার হতে থাকলো।

এই সময়ে খবরের কাগজ পড়া এবং মায়ের সেবাযত্নের জন্য সাচিকো সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠতে শুরু করলো। প্রতি বছরের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে দাদীমার গামলাটা তারা বরফ দিয়ে পূর্ণ করতো। প্রতিবছরই এই দিনটিতে এক চাপা কষ্ট তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতো। বোমা হামলার এই স্মৃতিগুলো দিয়ে সে আসলে কী করতে পারতো? বাস্তব জীবনে এগুলোকে কোন কাজেই বা লাগানো যেত?

অন্যান্য হিবাকুশার মনেও ঠিক একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কয়েকজন হিবাকুশা নেতা সাহস করে সামনে এগিয়ে আসলেন, সবার সাথে শেয়ার করলেন তাদের বেঁচে যাবার অলৌকিক ঘটনা ও বিস্ফোরণ পরবর্তী দুঃসহ জীবনের কথা এবং অন্য হিবাকুশাদেরও বললেন তাদের মতো এভাবে এগিয়ে আসতে।

বছর বছর যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বরফ খণ্ডগুলো গলে যেত দাদীমার গামলায়, সেই সাথে বেজে যেত সাচিকোর বাসার টেলিফোন। সে কি তার হিবাকুশা জীবনের গল্প সবাইকে শোনাতে পারবে? স্কুলের শিক্ষার্থীদের কি সে তার কাহিনী বলতে পারবে। তাদের জন্য এসব জানাটা ছিল খুবই জরুরি।

Image Source: Truman Library

সবসময়ই সাচিকো মানা করে দিতো। সে এমন কিছুই বলতে চাচ্ছিলো না, যা তার বাবা কিংবা মায়ের জন্য কোনোরকম অসম্মান বয়ে আনে। সেই সময়ে মায়ের পাশে থাকা খুব দরকার ছিলো। তিনি অসুস্থ ছিলেন, তার লিউকেমিয়া ধরা পড়েছিল।

তবুও এই নীরবতাই তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো, কারণ তার ভেতর থেকে কেউ ক্রমাগত বলে যাচ্ছিলো এই কাহিনীগুলো সবার সাথে শেয়ার করার জন্য।

নিয়মিতভাবেই সাচিকো খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছিলো, রেডিওতে শুনছিলো পুরো দুনিয়ার খবর। ১৯৮৯ সালে সম্রাট হিরোহিতো পরলোকগমন করেন। এর মধ্য দিয়েই পুরো জাপানবাসী যেন একটি যুগের পরিসমাপ্তিও দেখলো। ১৯৯১ সালে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের। সেই সাথে সমাপ্তি ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলমান স্নায়ুযুদ্ধেরও। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসেরও বিশাল একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। শুরু হবে হয়তো নতুন আরেকটি অধ্যায়ের।

সম্রাট হিরোহিতো; Image Source: The Telegraph

এখন তাহলে বিশ্বের যুদ্ধের অর্থ কী দাঁড়াবে? শান্তিরই বা কী অর্থ হবে?

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেউই সঠিক করে কিছু বলতে পারে না, তবে সাচিকো কেবল একটি কথাই জানতো- পৃথিবীকে আর কোনোদিনই পারমাণবিক যুদ্ধের সম্মুখীন হতে দেয়া যাবে না।

কখনোই না।

কিন্তু এই ‘কখনোই না’ মনোভাবের সাথে বিশ্বকে পরিচিত করিয়ে দেবার উপায়টা কী? আর সাচিকো কীভাবেই বা সেই পার্থক্যটা গড়ে দেবে?

এই বিষয়গুলোই সাচিকোর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

এভাবেই চলতে লাগলো দিনগুলো। ১৯৯২ সালে সাচিকোর সর্বশেষ আপনজন, তার মা, তাকে ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমালেন। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য হিসেবে সে-ই রইলো, যার পক্ষে পারমাণবিক বোমা হামলার পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা দেয়া সম্ভব। এটা প্রকৃতপক্ষে বেশ বড়সড় একটি দায়িত্ব। তার মনে নাহয় অনেক কিছুই ঘুরপাক খায়, কিন্তু যদি তাকে কথা বলবার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে সে ঠিক কোন বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবে?

মাকে ছাড়া একা একাই বাসায় বসে রইলো সাচিকো। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো একে একে তার মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যেতে লাগলো। সেই ডিম, ছোট্ট তোশির হাততালি, হাড়ি-পাতিল খেলা, বোমার বিস্ফোরণ, তোশি, ইচিরো, আকি, মামা, মিসা, বাবা, মা- সবকিছুই, সবার কথাই।

ইচিরোর শেষ কথাগুলো ছিলো, “সবার খেয়াল রেখো।” কিন্তু কীভাবে?

অন্ধকার থেকে আলোর বুকে আসতে, নিজের মনের কথাগুলোকে ঠিকমতো গুছিয়ে আনতেই সাচিকোর বছরের পর বছর সময় চলে গিয়েছিল। বাবা, হেলেন কেলার, মহাত্মা গান্ধী এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, যাদেরকে সাচিকো শান্তির বার্তাবাহক হিসেবেই দেখতো, তাদের কথাই একে একে মনে করতে লাগলো সে। এমন পরিস্থিতিতে তারা তাকে ঠিক কোন কাজটি করতে বলতেন?

… … … …

১৯৯৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলা এবং একইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়। জাপানী এবং আমেরিকান, উভয় জাতির প্রত্যেক সদস্যই শোকস্তব্ধ হৃদয়ে স্মরণ করেছিল যুদ্ধে চিরতরে হারিয়ে ফেলা আপনজনদের।

এই পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপনের জন্য পুরো জাপান জুড়েই শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেবার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সম্মেলন করে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূলের দাবি জানানো হয়। নাগাসাকির জনগণের আবেগের বহিঃপ্রকাশটা একটু বেশিই ছিলো। ছ’বছর আগে নাগাসাকির জনপ্রিয় ও স্পষ্টবাদী মেয়র হিতোশি মোতোশিমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার নিজেদের কাঁধে টেনে আনার জন্য সম্রাট হিরোহিতোর সমালোচনা করেছিলেন। এই মোতোশিমাকেই ১৯৯০ সালে এক জাপানী নাগরিক ক্রোধের বশে গুলি করে বসে। তার দাবি ছিল, জাপানে পুনরায় সশস্ত্র সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনা হোক।

হিতোশি মোতোশিমা; Image Source: The Telegraph

১৯৯৬ সাল থেকে যাত্রা শুরুর কথা ছিলো নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা জাদুঘরের। কিন্তু এটা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়। কিছু জাপানী সমালোচক মনে করছিলেন, এই জাদুঘরে যেসব বিষয়বস্তু প্রদর্শিত হচ্ছে, তাতে হিবাকুশাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছাপ খুব কমই আছে। এর জবাবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, যুদ্ধ চলাকালে এশীয় অঞ্চলে জাপানী সেনারা যেসব বর্বরতা চালিয়েছিলো, সেসবের উপর করা গবেষণার ফলাফল তারা প্রকাশ করে দেবে। উল্লেখ্য, এগুলো এর আগে কোথাও প্রকাশ করা হয়নি। এর মাঝে নানকিং গণহত্যা এবং মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবন্দীদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া বাটান ডেথ মার্চের নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিলও ছিলো। জাদুঘরটির এমন প্রস্তাবনা স্বাভাবিকভাবেই জাপানের বিভিন্ন রক্ষণশীল রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিকে ক্ষেপিয়ে তোলে।

নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা জাদুঘর; Image Source: nagasakipeace.jp

একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত স্মিথসোনিয়ানের ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বেশ বড়সড় এক প্রদর্শনী আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নানা আলোকচিত্র, সংগ্রহ, জাপানী জাদুঘরগুলো থেকে সংগৃহীত হিবাকুশাদের কাহিনী, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে চালানো পারমাণবিক বোমা হামলা নিয়ে বিভিন্নজনের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এবং স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা নিয়ে নানাবিধ জিনিস প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিছু কিছু মন্তব্য এমনও ছিলো, যা ট্রুম্যান প্রশাসন বোমা হামলাকে বৈধতা দানের জন্য যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এমনকি স্মিথসোনিয়ান কর্তৃপক্ষ এমন প্রস্তাবনাও দেয় যে, হিরোশিমায় বোমা হামলার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বি-২৯ বিমান এনোলা গে-কে পুনর্নির্মাণ করেও তারা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবে।

এনোলা গে; Image Source: Air & Space Magazine

স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের এমন প্রদর্শনী পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই বিতর্কের ঝড় তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাসদস্য এবং মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের কাছ থেকেও বিষয়টি তুমুল সমালোচনার শিকার হয়। তাদের মতে, এই ছবি এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলো প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং সকলের কাছে নেতিবাচক রুপে উপস্থাপন করবে। শেষপর্যন্ত ছবি এবং মন্তব্যগুলো সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় স্মিথসোনিয়ান কর্তৃপক্ষ। থেকে যায় কেবলমাত্র এনোলা গে বিমানটি।

পঞ্চাশ বছর পরেও প্রশান্ত মহাসাগরের দু’পাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এতটুকু শুকায়নি।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) পর্ব – ১  ||  ২) পর্ব – ২  ||  ৩) পর্ব – ৩  ||  ৪) পর্ব – ৪  ||  ৫) পর্ব – ৫  ||  ৬) পর্ব – ৬  ||  ৭) পর্ব ৭ ||  ৮) পর্ব ৮  ||  ৯) পর্ব ৯  ||  পর্ব ১০  ||  পর্ব ১১  ||  পর্ব ১২  ||  পর্ব ১৩  ||  পর্ব ১৪ ||  পর্ব ১৫  ||  পর্ব ১৬  ||  পর্ব ১৭  ||  পর্ব ১৮

This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.

Reference Book

1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Feature Image: Fine Art America

Related Articles