অ্যান অর্ডিনারি ডে
আগস্ট ৬, ১৯৪৫
নাগাসাকির অন্য আর আট-দশটা উষ্ণ, আর্দ্র গ্রীষ্মের দিনের মতোই ছিলো আগস্ট মাসের ৬ তারিখটি। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সাচিকো। দরদর করে ঘামছিলো সে। তার পরনের কাপড়গুলোও গায়ের সাথে লেগে যাচ্ছিলো এজন্য। সাকামোতো ইন্টারন্যাশনাল সিমেট্রি পেরিয়ে পাহাড়ে উঠে গেলো সে, যেতে থাকলো স্যানো শিন্তো মঠের সংকীর্ণ রাস্তাটি ধরে, কর্পূর গাছগুলোর দিকে। গাছের নিচের পরিবেশ কিছুটা ঠাণ্ডাই হবে।
সূর্যের উত্তাপ ঝলসে দিচ্ছিলো সাচিকো, সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো শিন্তো মঠ এবং পুরনো কর্পূর গাছগুলোকে। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিলো উরাকামি উপত্যকার কাঠের বাড়িগুলোর ছাদের ধূসর-রঙা টাইলসগুলোর উপর। নাগাসাকি মেডিকেল কলেজও এর বাইরে ছিলো না। পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সাথে জাপানকে পরিচিত করিয়ে দেয়া পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে ছিলো এ কলেজটি।
উত্তপ্ত হচ্ছিলো এশিয়ার সর্ববৃহৎ চার্চ হিসেবে খ্যাত উরাকামি ক্যাথেড্রাল এবং ছোট্ট দেজিমা দ্বীপটি, যেখানে চার শতাব্দী পূর্বে আগমন ঘটেছিল পর্তুগিজ বণিকদের। যখন জাপানের অন্যান্য এলাকার সাথে বহির্বিশ্বের কোনো যোগাযোগ ছিলো না, তখনও নাগাসাকির সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো পাশ্চাত্য দুনিয়ার। এই নাগাসাকিতেই প্রাচ্যের সাথে মিলন ঘটেছিলো পাশ্চাত্যের।
যুদ্ধের ফলে নাগাসাকিও জাপানের অন্য আর আট-দশটা শহরের মতো দুঃসহ পরিণতি বরণে বাধ্য হয়েছিল। খেলার মাঠ এবং পার্কগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করা হয়েছিল, যেমন- মিষ্টি আলু ও কুমড়া। পার্শ্ববর্তী পাহারগুলোতে বিমান হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছিলো স্কুলের শিক্ষার্থীরা। বোমা হামলার ফলে উৎপন্ন আগুনের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করা হয়েছিল পানির ট্যাংক। একদিকে জাপানী সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মার্কিন আক্রমণ প্রতিরোধের, অন্যদিকে দেশটির স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে আত্মরক্ষা র।
স্যানো মঠের কাছাকাছিই চলে এসেছিলো সাচিকো। কর্পূর গাছগুলোর ছিলো তার আর একটু দূরেই। গাছগুলোর ছিলো প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। দাদীমার গামলার মতো ছিলো এই গাছের পাতাগুলো, যেগুলো সূর্যের উত্তাপ থেকে সুরক্ষা দিতো। এই গাছগুলোর পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো স্যানো মঠের বৃহদাকার, দোপেয়ে, পাথুরে গেটটি। আধ্যাত্মিকতার চাদরে মোড়া এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাচিকো মনে মনে একটি জিনিসই চাইলো- প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি!
গত এপ্রিলের কথা। চারদিকের পরিবেশ তখন চেরি ফুলের গন্ধে সুশোভিত। জাপানের স্কুলগুলোর নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম সবেমাত্র শুরু হয়েছে। বাবা সাচিকোকে নিয়ে জেনজা প্রাইমারি স্কুলে গেলেন। বাচ্চা মেয়েটির মন ছিলো আনন্দে পরিপূর্ণ। বাবা তাকে বললেন, “স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলো সাচিকো। তারা তোমাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেবেন।”
কিন্তু যখন বাবা এবং সাচিকো স্কুল-প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলেন, শিক্ষকদের চোখ-মুখ জুড়ে তখন ছিলো আতঙ্কের ছাপ। মার্কিন বিমান হামলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিলো। বিমান হামলার সাইরেনের জন্য সেদিন সকালে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছিলো। সাচিকো কেবলমাত্র তার নতুন শিক্ষকের সামনে (সম্মানপূর্বক) মাথা নোয়াতে পেরেছিলো। এরপরই প্রিন্সিপ্যাল স্কুল বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেন।
সাচিকোর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির স্বপ্ন সেখানেই মিলিয়ে যায়। পড়াশোনা শেখার বদলে সে শিখেছিলো আঙুল দিয়ে কান এবং চোখগুলো ঢেকে রাখতে। সেই সাথে শিখেছিলো বাইরে থাকাকালে ‘টেকি’ (শত্রুপক্ষের বিমান) শব্দটি শুনলে সাথে সাথেই মাটিতে শুয়ে পড়ার বিদ্যা!
রাতগুলো দুঃস্বপ্নের নামান্তর হয়ে উঠতে লাগলো।
বিমান হামলার সাইরেন বাজার সাথে সাথেই পরিবারকে ঘুম থেকে তুলে বাবা পাহাড়ের বুকে তৈরি গুহাগুলোর দিকে এগোলেন। সাকামোতো সিমেট্রির কাছেই ছিলো সেগুলো। ইচিরোর হাত ধরে সাচিকো ভেজা ঘাসের মধ্য দিয়ে ছুটছিলো। তার গলায় ঝোলানো ব্যাগে রাখা বিস্কুটগুলো বারবার বুকে এসে আঘাত করছিলো।
গুহার প্রবেশপথে এসে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে গেলো সাচিকো, গিয়েই উবু হয়ে বসে পড়লো। ভেজা খড়কুটো বিছানো মেঝের শীতল পরশ তাকে শিহরিত করে তুললো। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো গুহার উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যাচ্ছিলো। ওদিকে গুহার ভেতরে সাচিকোর মাথার উপর ভনভন করে উড়ছিলো অজস্র মশা।
বোমারু বিমানগুলোর গর্জন থামলো না। দূরে মানুষজনের ছায়া নড়াচড়া করছিলো। সাচিকো দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। আকির সামনে বসে মিসা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মায়ের কোলে তোশি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে মিসা আর তোশির দিকে এগিয়ে দিলো সাচিকো।
সময় কেটে যাচ্ছিলো। বি-২৯ বোমারু বিমানগুলোর ইঞ্জিনের আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। শহরের লাউড স্পিকারগুলো থেকে একটি সাইরেন বেজে উঠলো। বিপদ কেটে গেছে!
আকি বাবা-মায়ের দিকে তাকালো। সাচিকো ইচিরোর দিকে হাত বাড়ালো। আপাতত বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, নাগাসাকিবাসীর জন্য দিনটি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেকটি সাধারণ দিন। কিন্তু হিরোশিমাবাসীর জন্য তেমনটা ছিলো না। সেদিন সকালে তাদের শহরে একটি পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরিত হয়েছিল।
লিটল বয় এন্ড ফ্যাট ম্যান
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, রাত দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বি-২৯ বোমারু বিমান এনোলা গে’র ককপিটে বসেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল টিবেটস। গত প্রায় এক বছর যাবত টিবেটসসহ আরো বেশ কয়েকজন পাইলট জাপানের উপর পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।
এনোলা গে’র সাথে আরো দুটি প্লেনের থাকার কথা। সেগুলো আরো আগেই রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলো। তাদের একটির কাজ ছিলো বিষ্ফোরণের ছবি তোলা এবং অপরটির কাজ ছিলো বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। কাঙ্ক্ষিত সংকেত পাবার পরপরই এনোলা গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট্ট দ্বীপ টিনিয়ানের বুক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হিরোশিমার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, মাঝখানে ছিলো প্রায় ১,৫৬৭ মাইলের (২,৫২২ কিলোমিটার) দূরত্ব। সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ৯,৭০০ পাউন্ড (৪.৪ মেট্রিক টন) ওজনের ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি পারমাণবিক বোমা, যার সাংকেতিক নাম ছিলো লিটল বয়।
সকাল ৮টা ৯ মিনিটে কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই হিরোশিমার উপর দিয়ে উড়ে গেলো এনোলা গে। আকাশ থেকে বোমা নিক্ষেপের জন্য হিরোশিমা ছিলো বেশ চমৎকার একটি টার্গেট। এই যুদ্ধের সময়েও শহরটির জনসংখ্যা ছিলো ৩,৪০,০০০ এর কাছাকাছি। এখানে এর আগে বোমা হামলাও হয়নি। বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, দোকানপাট এবং সামরিক স্থাপনাগুলো অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলো। মেঘমুক্ত আকাশের নিচে আরেকটি কর্মব্যস্ত দিন শুরু করেছিল শহরটির মানুষগুলো।
সকাল ৮টা ১৪ মিনিট, ওটা নদীর উপরস্থ আইওয়া ব্রিজের দিকে নজর গেলো এনোলা গে’র পাইলটের। অটোমেটিক কন্ট্রোল সুইচে চাপ দিলেন তিনি। সাথে সাথে বোমাটির পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো।
হিরোশিমার দিকে তুমুল বেগে ধেয়ে যাচ্ছিলো লিটল বয়। আনুমানিক ১,৯০০ ফুট (৫৮০ মিটার) উপরে বোমের ভেতরে থাকা গান মেকানিজম ফায়ার করার সাথে সাথেই নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়, যা থামানোর কোনো উপায় ছিলো না। ১৫,০০০ টন (১৩,৬০০ মেট্রিক টন) টিএনটির (ট্রাইনাইট্রোটলুইন) সমতুল্য ক্ষমতা নিয়ে বিষ্ফোরিত হলো লিটল বয়, বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো ভয়াবহ বিকিরণ, শক ওয়েভ ছড়িয়ে গেলো সবদিকে।
বিষ্ফোরণের ফলে যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হলো, তার তাপমাত্রা ছিলো প্রায় ১৮,০০,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১০,০০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), যা সূর্যের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। হাইপোসেন্টারের (বিষ্ফোরণের কেন্দ্রস্থল) তাপমাত্রা ছিল ৫,৪৩২-৭,২৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (৩,০০০-৪,০০০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস) মতো।
হাইপোসেন্টারের ৫০০ মিটারের ভেতর থাকা সকল জীবিত প্রাণী পুড়ে মারা গেলো। দশ মিনিটের মাথায় তৈরি হলো বিশালাকার এক পারমাণবিক মেঘ। প্রায় ৬০,০০০ ফুট (১৮,২৯০ মিটার) উচ্চতায় থাকা এ মেঘে ছিলো কেবলই ধূলিকণা এবং নানা জিনিসের ধ্বংসাবশেষ। তেজস্ক্রিয় এ কণাগুলো কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির মতো পড়তে লাগলো।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালের বোমা হামলায় হিরোশিমা নগরীর ৯২ শতাংশই ধ্বংস হয়ে যায়, মারা যায় প্রায় সত্তর হাজারের মতো নাগরিক। আঘাত, দহন এবং বিকিরণজনিত অসুস্থতায় পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা এর দ্বিগুণে গিয়ে দাঁড়ায়।
বিষ্ফোরণের কথা টোকিওতে গিয়ে পৌঁছালো। হিরোহিতো বুঝতে পারলেন না ঠিক কী করা উচিত। তাই তিনি আরও বিলম্ব করাকেই সমীচীন মনে করলেন।
ঐ একই দিনে মার্কিন জনগণের কাছে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের কথা জানালেন,
(জাপানের নেতারা) যদি এখনও আমাদের শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে তাদের ওপর আকাশ থেকে ধ্বংসের (বোমার) বৃষ্টি নেমে আসবে, পৃথিবীর ইতিহাসে যা আগে কোনোদিনই দেখা যায়নি।
তিনদিন পর, ৯ আগস্ট সকালবেলা, বি-২৯ বোমারু বিমান বক্সকারের ককপিটে বসে ছিলেন মেজর চার্লস সোয়েনী। প্লেনটিতে ছিলো প্লুটোনিয়ামের তৈরি 'ফ্যাট ম্যান' ছদ্মনামের একটি পারমাণবিক বোমা, যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিলো ২১,০০০ টন (১৯,০৫০ মেট্রিক টন) টিএনটির সমতুল্য।
উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুতই ছিলেন সোয়েনী। তার প্রধান লক্ষ্য ছিলো শিল্পনগরী কোকুরা। যদি কোনো কারণে কোকুরার মিশনটি ব্যর্থ হতো, তাহলে লিস্টে পরের নামটিই ছিলো নাগাসাকির।
জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে উড়ে গেলো বক্সকার। আর ওদিকে পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুযায়ী স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ চালালো জাপান-নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়ায়। নাগাসাকি কিংবা আমেরিকা- কোনো অংশের মানুষজনই জানতো না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব - ১
২) পর্ব -২
This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.
Reference Book
1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson
Feature Image: History