
লেখার শুরুতেই নিচের ছবিটি দেখুন। কৃষ্ণাঙ্গদের চুলে এমন ডিজাইন সিনেমা-সিরিয়ালে আমরা অনেকেই দেখেছি। তবে মজার বিষয় হলো, চুলের এই বাহারি ডিজাইন কিন্তু একসময় কৃষ্ণাঙ্গরা সিক্রেট মেসেজ অর্থাৎ গোপন বার্তা আদান-প্রদানের কাজেও ব্যবহার করত!

আটলান্টিক স্লেভ ট্রেডের সময় অধিক জীবাণুমুক্ত করার অজুহাত দেখিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের চুল কেটে দেয়া হতো, যাকে বলে একদম ন্যাড়া মাথা। পাশাপাশি, তাদের আগের সংস্কৃতি-পরিচয় ভুলিয়ে নতুন পরিচয় দেয়াও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
তবে সব কৃষ্ণাঙ্গ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া এই অমানবিক প্রথা মানতে রাজি হতো না। তারা কেবল চুলই বড় করত না, পাশাপাশি সেই বড় করা চুলে এমন বিনুনি কাটতো যে সেটা কোনো স্বাভাবিক নকশা হতো না, সেটা হতো তাদের পালাবার মানচিত্র! প্রতিবাদ, প্রতিরোধের এক নতুন ভাষাই তারা বের করেছিল চুলের অভিনব বিনুনির মাধ্যমে।
উদাহরণস্বরুপ সপ্তদশ শতকের আফ্রিকার এক অঞ্চলের রাজা বেঙ্কোস বিয়োহোর কথা বলা যায়। তিনি ধরা পড়েন পর্তুগিজ দাস ব্যবসায়ী পেদ্রো গোমেজের হাতে। শেষপর্যন্ত ভাগ্য তাকে নিয়ে আসে কলম্বিয়ায়। সেখান থেকে দুবারের চেষ্টায় পালাতে সক্ষম হন বিয়োহো। এরপর সান বাসিলিও দি প্যালেনকিউ নামে পালিয়ে আসা আফ্রিকান দাসদের নিয়ে এক গ্রামই গড়ে তোলেন তিনি। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এক নতুন ভাষাই উদ্ভাবন করেন বিয়োহো, গড়ে তোলেন শক্তিশালী গোয়েন্দা-দল।
এর পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেন আফ্রিকান নারীদের চুলে বিনুনি কাটার বিশেষ পদ্ধতিকেও, যেমনটা দেখানো হয়েছে ছবিতে। নারীদের মাথায় বিভিন্ন নকশার বিনুনি বিভিন্ন মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা কিংবা গোপন বার্তা আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হয়েছে।

পালিয়ে আসা দাসদের কথা বাদ দিয়ে যদি বন্দী দাসদের কথাও বলা হয়, সেখানেও এই কৌশল চালু ছিল। কেন? কারণ আফ্রিকান এই দাসদের হাতে লেখার উপকরণ আসতো কালেভদ্রে। আবার যদি আসতোও, সেটা দিয়ে কেউ যদি গোপন বার্তা লিখে ধরা পড়তো, তবে তার উপর অমানুষিক নির্যাতনের খড়গ নেমে আসাটাও ছিল খুবই স্বাভাবিক। তাই তারা বেছে নিয়েছিল এই বিশেষ পদ্ধতিকে। এর ফলে শ্বেতাঙ্গ মনিব এবং তার অনুগত অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ চ্যালাদের সামনে দিয়েই সিক্রেট মেসেজ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত দাসরা, করত পালাবার পরিকল্পনা, ওদিকে মালিকপক্ষের লোকজন টের পেত না কিচ্ছুটিই!
যেমন ধরা যাক, পালানোর পরিকল্পনা হয়েছে, তাহলে নারীদের চুলে যে নকশাটি ফুটিয়ে তোলা হতো, তার নাম ছিল ‘ডিপার্টেস’। এ সময় নারীরা তাদের মাথায় বেশ শক্ত ও মোটা করে বিনুনি কাটতো। এরপর সেগুলো একত্রিত করে মাথার উপরে সুন্দর ঝুঁটি করা হতো। আগে থেকে সব দাসকে যেহেতু এই সংকেত সম্পর্কে জানানো থাকত, তাই নারীদের অমন চুলের ডিজাইন দেখে সবাই বুঝে যেত যে, পালাবার সময় চলে এসেছে!
কখনও কখনও আঁকাবাঁকা নকশা ফুটিয়ে তুলতো তারা চুলে। শ্বেতাঙ্গ মালিকপক্ষ যখন সেটাকে আরেকটা ডিজাইন হিসেবেই দেখত, তখন ক্রীতদাসদের কাছে তা ছিল পালিয়ে যাবার মানচিত্র! সেটা অনুসরণ করেই তারা খুঁজে পেত মুক্তির ঠিকানা।
শুধুই কি সংকেত বা গোপন বার্তা! এর পাশাপাশি চুলের এই প্যাচের মাঝে তারা স্বর্ণ ও বিভিন্ন গাছের বীজও নিয়ে যেত। ফলে নতুন জায়গায় গিয়ে যেমন তাদের হাতে অর্থ থাকত, তেমনই শস্য বুনে ধীরে ধীরে নতুন জীবন শুরু, নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্নও তারা দেখতে পারত।
কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের বেলাতেই না, আরও দুটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যায়, যেসময় গোপন বার্তা পাঠাবার সময় সাহায্য নেয়া হয়েছে আমাদের মাথায় থাকা এই চুলেরই।
প্রথমটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। প্রাচীন গ্রীক শহর মিলেটাসের স্বৈরশাসক হিস্টিয়াস পার্সিয়ান রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে একই শহরের নেতা অ্যারিস্টগোরাসকে উদ্বুদ্ধ করতে একটি মেসেজ পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু সেই মেসেজটি পাঠাতে হবে খুবই গোপনে যেন শত্রুপক্ষের হাতে তা না পড়ে।

এজন্য হিস্টিয়াস এক অদ্ভুত কাজ করলেন। প্রথমেই তিনি তার দূতের মাথা কামিয়ে দিলেন। এরপর সেই টাক মাথায় মেসেজটি লিখে দিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন দূতের চুল গজানোর জন্য। চুল গজালে তিনি দূতকে পাঠিয়ে দিলেন গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে শত্রুর হাতে ধরা পড়লেও যে আর ভয় নেই। কারণ সকল গোপন সংবাদ যে টাকে লুকোনো! দূত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলে এরপর তার মাথা আবার কামিয়ে কাঙ্ক্ষিত গোপন মেসেজটি উদ্ধার করা হতো! এভাবেই তাদের মাঝে চলতো এক অদ্ভুত, গোপন সংবাদ আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া।
টাকবার্তার ইতি টানা যাক ত্রয়োদশ শতকের একটি ঘটনা দিয়ে। আজকের লেখায় যে ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো, সেসবের মাঝে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ, যার সাথে জড়িত আছে স্বয়ং চেঙ্গিস খানের নাম, যে ঘটনা পতন ঘটিয়ে দিয়েছিল এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের।
মুসলিম বিশ্বের পূর্বপ্রান্ত তখন শাসন করছিল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য, যার শাহ তথা সম্রাট হিসেবে ছিলেন আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ। আব্বাসীয় খলিফাদের লাগামহীন ভোগ-বিলাস ও নানাবিধ কর্মকাণ্ড কালক্রমে আব্বাসীয় খিলাফাহর সাথে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শত্রুতার জন্ম দেয়।
এই শত্রুতা অবধারিতভাবেই সেই সময়ের আব্বাসীয় খলিফা আল নাসিরকে বেশ ক্ষেপিয়ে তোলে। তার মাঝে খলিফাকে উৎখাত করতে ১২১৪ সালে আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ এক অভিযান পরিচালনা করেন, যার বদৌলতে একসময় পুরো উত্তর ইরাক তার অধীনে চলে আসে। পরবর্তীতে অবশ্য তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গেলে অভিযান অসমাপ্ত রেখেই ফিরতে হয় মুহাম্মাদ শাহকে।

মুহাম্মাদ শাহর এই অভিযান মোটেও ভালভাবে নেননি খলিফা নাসির। তাই তিনি খাওয়ারিজম আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান মোঙ্গলাধিপতি চেঙ্গিস খানকে! তবে এই উদ্দেশ্যে যে দূত পাঠানো হয়েছিল, তাকে আবার যেতে হতো খাওয়ারিজমের উপর দিয়েই। এমন পরিস্থিতিতে গোপনে বার্তা পাঠাবার এক অভিনব উপায় বের করেন খলিফা নাসির। দূতের মাথায় ছুরির তীক্ষ্ম ডগা দিয়ে তিনি লিখে দেন,
আমাকে আপনার বন্ধু হিসেবেই জানবেন। আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি খাওয়ারিজমের শাহ মুহাম্মাদকে ধ্বংস করুন।
লেখার পর সুরমা দিয়ে তা ভরাট করে চুল গজানোর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করা হয়। চুল বড় হলে দূত বেরিয়ে পড়ে কারাকোরাম অভিমুখে, চেঙ্গিস খানের দরবারের উদ্দেশ্যে। পথে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের প্রহরীরা দূতকে তল্লাশী করেছিল ঠিকই, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে তাকে ছেড়েও দেয়।
কারাকোরাম পৌঁছলে দূত তার মাথা কামিয়ে ফেললে সেখানে লেখা বার্তা চেঙ্গিস খানকে পড়ে শোনানো হয়। শুরুতে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সাথে বিদ্যমান সন্ধির কথা ভেবে সেখানে আক্রমণের চিন্তা বাদ দেন তিনি। তাই দূতকেও ফিরিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু এরপর আস্তে আস্তে মনোভাব পরিবর্তন হয় চেঙ্গিস খানের। তিনি হিসাব করে দেখেন, খলিফার মনোভাবই যদি এমন হয়, তাহলে তিনি (চেঙ্গিস খান) আক্রমণ করলে অন্যান্য সাম্রাজ্য এর প্রতিকারে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। ফলে মোঙ্গল বাহিনীর ঝড় পুরোটাই যাবে খাওয়ারিজমের উপর দিয়ে, মোঙ্গলদেরও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কম হবে। ওদিকে রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতির সুবর্ণ সুযোগ তো রয়েছেই। ফলে ১২১৯ সালে দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনী নিয়ে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে হামলে পড়েন চেঙ্গিস খান। তারপর? তারপর মোঙ্গলদের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন, লুন্ঠন, গণহত্যার, নারীদের সম্ভ্রমহানির সাক্ষী হয়ে কেবল ইতিহাসের পাতাতেই আশ্রয় খুঁজে নেয় খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য।