Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সম্রাট আকবরের দুর্ভেদ্য চিতোর বিজয়

রাজপুতদের ব্যাপারে আকবরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই সোজাসাপ্টা। শান্তিপূর্ণভাবে রাজপুতদের আনুগত্য অর্জন করা এবং হিন্দুস্তান শাসনে রাজপুতদের সহশক্তি হিসেবে মুঘল সাম্রাজ্যের পাশে পাওয়া। কিন্তু, যদি কোনো রাজপুত রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার না করে, শুধুমাত্র তাহলেই শক্তি প্রয়োগ করা।

আকবরের রাজপুত নীতিতে বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজা সন্তুষ্ট হয়ে আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। আবার অনেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের মুসলিম পরিচয়ে ঘৃণা প্রকাশ করে কথিত ‘ভিনদেশি’-দের হাত থেকে হিন্দুস্তানের ‘স্বাধীনতা’ রক্ষায় সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর মাঝে যে কয়টি রাজপুত রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছিল মেবার তাদের মধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। কাজেই মেবারকে দমন করে তা দখল করে নেওয়া ছিল আকবরের জন্য আবশ্যিক। কারণ, মেবার যদি মুঘলদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হতো, তাহলে অন্যান্য রাজপুত রাজ্যগুলোও মুঘলদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ করতে উৎসাহী হতো। আবার মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে শান্তিচুক্তির অধীনে আসা রাজ্যগুলোও তখন বিদ্রোহী হয়ে উঠতো।

রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও মেবারের রাজধানী চিতোর দখলের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কারণ ছিল। যদিও সম্রাট হুমায়ুন গুজরাট দখল করেছিলেন, কিন্তু নিজেদের অদূরদর্শীতার কারণে তা ধরে রাখতে পারেননি। আকবরের শাসনামলে এসে গুজরাটের রাজনৈতিক অবস্থা বেশ অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে আরব সাগরের তীরে হওয়ায় মুঘলরাও সমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুজরাট দখল করতে চাইছিল।

গুজরাটের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সেই প্রাচীনকাল থেকে উল্লেখযোগ্য। সমুদ্রপথে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য মুসলিম ভুখণ্ডগুলোর সাথে যোগাযোগের সহজ পথ হচ্ছে গুজরাটের এই বন্দরগুলো। তাছাড়া রাজস্থানের ভূখণ্ডগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারে বড় বাঁধা ছিল মেবারের চিতোর দুর্গটি। কাজেই চিতোর দুর্গ দখল করতে পারলে আকবর বিভিন্ন দিক থেকেই সুবিধা পাবেন।

সবদিক বিবেচনা করে ১৫৬৭ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে আকবর তার চিতোর অবরোধ শুরু করেন। এ সময় মেবারের রাজা হিসেবে আকবরের প্রতিপক্ষ ছিলেন রানা দ্বিতীয় উদয় সিংহ। মেবারের মহারানা সংগ্রাম সিংহের চতুর্থ পুত্র ছিলেন এই দ্বিতীয় উদয় সিংহ, যিনি নিজেও তার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় ব্যয় করেছিলেন মুঘলদের বিরোধীতায়। ১৫২৬ সালে সম্রাট বাবর সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে হিন্দুস্তান বিজয় করেন। রানা সংগ্রাম সিংহ তখন থেকেই উঠেপড়ে লাগেন মুঘলদের হিন্দুস্তান থেকে বিতারিত করতে।

সম্রাট বাবর তার বাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে খুবই আন্তরিক আচরণ করতেন, তাদের সাথে রাজকীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে অযথা দূরত্ব তৈরি করতেন না; Image Source: weaponsandwarfare.com

কিন্তু মুঘলদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তিতে একা পারবেন না তা বুঝতে পেরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে ছোট ছোট রাজপুত রাজ্যগুলো নিয়ে একটি রাজপুত কনফেডারেশন গঠন করেন। এরপর প্রায় ২ লাখ সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মার্চ করেন। আম্বার, মারওয়ার, রামপুরা, গড়গাঁও, চান্দেরি, বুন্দি, রায়সিন, সিক্রি, আজমিরসহ অন্যান্য হিন্দু শাসনাধীন অঞ্চল থেকে শুরু করে এমনকি আফগানদের থেকেও সামরিক সহায়তা পান তিনি। মুঘলদের বিরুদ্ধে এ যেন আক্ষরিক অর্থেই বাঁধভাঙা সৈন্যের এক স্রোত! অন্যদিকে সম্রাট বাবরের হাতে তখন মাত্র ২০ হাজার সৈন্যের এক ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী। 

শেষপর্যন্ত খানুয়ার প্রান্তরে সম্রাট বাবর তার ছোট্ট মুঘল সেনাবাহিনী নিয়ে রাজপুতদের দম্ভ এমনভাবে নিঃশেষ করেছিলেন যে সেই অবস্থা থেকে রাজুপুতরা আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারেননি।

মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ;  Image Source: Wikimedia Commons

চিতোরের কথায় আসা যাক। অবস্থানগত কারণেই চিতোরের এ দুর্গটি ছিল বেশ দুর্গম। ভূপৃষ্ঠ থেকে থেকে প্রায় ৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত হওয়ায় আক্রমণকারী যেকোনো শক্তির জন্য দুর্গটি জয় করা এক কথায় অসম্ভব ছিল। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা, দুর্গমতা আর প্রচণ্ড শক্তিশালী হওয়ায় দুর্গটি রাজপুতদের গৌরব হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু, মজার বিষয় হচ্ছে আকবরের পূর্বেও দুর্গটি দুইবার বিজিত হয়েছিল। হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১৩০৩ সালে ও গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ ১৫৩৫ সালে দুর্গটি জয় করেছিলেন।

১৭ শতকের দিকে অঙ্কিত সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির একটি তৈলচিত্র; Image Source: Wikimedia Commons

অবশ্য সময়ের পরিক্রমায় দুর্গটি আবারো রাজপুতদের হস্তগত হয়।  প্রায় ৩ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এ দুর্গটি বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই চার বছর টিকে থাকার মতো করে ডিজাইন করা হয়েছিল। আক্রমণকারী শক্তির জন্য এটাও ছিল দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ, এতদিন এ রকম শক্তিশালী একটা দুর্গের বিরুদ্ধে অবরোধ ধরে রাখা এক কথায় অসম্ভব।

১৮৫৭ সালে অঙ্কিত একটি চিত্রে চিতোর দুর্গ; Image Source: Wikimedia Commons

১৫৬৭ সালের অক্টোবরের ২০ তারিখে সম্রাট আকবর চিতোর দুর্গ অবরোধ শুরু করলেন। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এবং অবস্থানগত কারণে অল্প সৈন্য দিয়েই অবরোধ মোকাবিলা করার মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় আকবরকে দুর্গের অবরোধ ধরে রাখতে মোতায়েন করতে হলো প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য।

এদিকে, আকবর যখন চিতোর অবরোধ করতে এগিয়ে আসছিলেন, চিতোর দুর্গের অধিপতি মেবারের রানা দ্বিতীয় উদয় সিংহ মুঘলদের ভয়ে অভিজাতদের পরামর্শে তার পুত্র ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে গোগুন্দায় চলে যান। চলে যাওয়ার পূর্বে চিতোর দুর্গ রক্ষার ভার দিয়ে যান রাও জয়মল ও পাট্টা সিসোদিয়ার উপর। দুর্গ রক্ষার্থে রেখে যান ৮,০০০ রাজপুত সৈন্য আর বিপুল অস্ত্রশস্ত্র।

এদিকে আকবর যখন দুর্গ অবরোধে ব্যস্ত তখন আসফ খানকে প্রেরণ করা হলো চিতোর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের রামপুরে। অন্যদিকে হোসেন কুলি খান গেলেন উদয়পুর আর কুম্বলগড় বরাবর। দুইজনই নিজ নিজ দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করলেন।

অবরোধ দীর্ঘায়িত না করতে আকবর তার বাহিনীকে আক্রমণাত্মক কৌশলে মোতায়েন করলেন। দুর্গের দেয়াল উড়িয়ে দিতে দুর্গের সামনে মাটির উঁচু ঢিবি তৈরি করে এর উপরে কামান মোতায়েন করলেন। মুঘল সেনাবাহিনীর কামানগুলো মুহূর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে লাগলো। তবে দুর্গটি বেশ উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় কামানগুলো খুব অল্পই সাফল্য পাচ্ছিল।

বর্তমান সময়ে চিতোর দুর্গ;  Image Source: Wikimedia Commons

আর্টিলারী বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি দুর্গ দখল তরান্বিত করতে আকবর দুর্গ বরাবর সুরঙ্গ তৈরি করারও নির্দেশ দিলেন। আকবরের নির্দেশে প্রায় ৫,০০০ শ্রমিক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে দুর্গ পর্যন্ত দুটি সুরঙ্গ খনন করে ফেললেন। দুর্গ প্রাচীরে ফাটল ধরাতে এ সুরঙ্গ দুটির দুর্গ সংলগ্ন অংশে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ জড়ো করা হলো।

১৫৬৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে এই সুরঙ্গ দুটিতে আগুন ধরানো হয়। প্রথম সুরঙ্গটি ঠিকঠাকভাবেই ফেটে দুর্গপ্রাচীরে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়। কিন্তু, অসাবধানতাবশত দ্বিতীয় সুরঙ্গটি বিস্ফোরণের পূর্বেই মুঘল ও রাজপুত সৈন্যরা দুর্গ প্রাচীরের কাছে জড়ো হয়। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় সুরঙ্গটি বিস্ফোরিত হলে দুই পক্ষেরই প্রায় ১০০০ সৈন্য হতাহত হয়।

সুরঙ্গ খনন করে দেয়ালের পাশে মাইন বিস্ফোরিত করা হলে রাজপুত ও মুঘল দুই পক্ষেই ব্যাপক হতাহত হয়; Image Source: Wikimedia Commons

সুরঙ্গ বিস্ফোরণের মাধ্যমে চিতরের দুর্গ প্রাচীরে ফাটল ধরাতে সক্ষম হলেও রাজপুতদের প্রবল বাধার মুখে মুঘল সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো না। যুদ্ধ যদিও তখনো রাজপুতদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল, কিন্তু দুই পক্ষই রাজপুতদের পরাজয়ের আভাস পাচ্ছিল।

চিতোর দুর্গে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে;  Image Source: Wikimedia Commons

২৩ অক্টোবর রাতে দুর্গের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে মুঘল সৈন্যরা বিস্ফোরক দিয়ে আরেকবার চেষ্টা চালান। দুর্গের দেয়ালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও রাজপুতরা দ্রুতই দেয়াল মেরামত করে ফেলছিল। ফলে এবারও মুঘল সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রাচীর ভেদ করে দুর্গে প্রবেশ করা সম্ভব হলো না। শক্তিশালী মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চিতোর মূলত তার দুর্গমতা আর রাজপুতদের মরনপণ মনোভাবের জন্যই টিকে যাচ্ছিল।

চিতোর দুর্গের আরেকটি তৈলচিত্র (১৮৭৮ সাল);   Image Source: Wikimedia Commons

আকবর পরবর্তী চার মাস অবরোধ ধরে রাখলেন। এ দীর্ঘ সময়ে দুই পক্ষেই সংঘর্ষ চলতে লাগলো। কিন্তু কোনো পক্ষই তেমন সাফল্য পেল না। অবশেষে ১৫৬৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে এই অচলাবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেল। এই দিন ভোর বেলায় স্বয়ং সম্রাট আকবরের নিক্ষিত গুলিতে প্রথমে আহত ও পরে নিহত হন রাজপুত কমান্ডার রাও জয়মল। রাও জয়মলের মৃত্যুতে রাজপুত সেনাবাহিনীর কমান্ড গিয়ে পরে পাট্টা সিসোদিয়ার উপরে। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু, যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি আহত হয়ে বন্দী হন। পরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

স্বয়ং আকবরের নিক্ষিপ্ত গুলিতে আহত রাও জয়মল;  Image Source: Wikimedia Commons

আকবর তার চিতোর বিজয় সম্পন্ন করে দিল্লি ফিরে গিয়ে চিতোর অবরোধের ঘটনাবলীর বিবরণ নিয়ে একটি ঘোষণা জারি করেছিলেন। ঘোষণাটি ‘ফাতাহনামা-ই-চিতোর’ নামে পরিচিত। এই ঘোষণাপত্রে রাও জয়মল কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আকবর বলেছেন,

‘যেসব তীরন্দাজ অন্ধকার রাত্রে একটি পিঁপড়ার চোখও বিদ্ধ করতে সক্ষম এবং যেসব বর্শা নিক্ষেপকারী ভূমি থেকে দুর্গের  ভাঙ্গা অংশ পর্যন্ত বর্শা নিক্ষেপ করতে সক্ষম, তারা খুব ভোরে হাতির পিঠে আরোহণ করে আক্রমণ শুরু করে। গত তিনদিন আর তিনরাত আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছিলাম। সেনাবাহিনীর কামানগুলো থেকে বৃষ্টির মতো গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। জয়মলের জন্য নির্ধারিত ছিল যে, সে বিশ্বাসীদের হাতে নরকের নিকৃষ্টতম স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।’

নেপালের ভক্তপুরের Nyatapola মন্দিরের সামনে রাও জয়মল ও পাট্টা সিসোদিয়ার মূর্তি;  Image Source: Wikimedia Commons

নিজেদের রাজার পলায়ন ও একের পর এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুর পর দুর্গে অবস্থানকারী রাজপুত যোদ্ধারা আশা হারিয়ে ফেললেন। তবে শেষ চেষ্টা হিসেবে রাজপুতরা সর্বাত্মক একটি আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে তা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। বিপুল পরিমাণ রাজপুত যোদ্ধা যুদ্ধে নিহত হলে রাজপুতদের চূড়ান্ত পরাজয় শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

দুর্গের দখল নিয়ে যখন একদিকে চলছে মরণপণ লড়াই, দুর্গ দেয়ালের ভেতরে তখন ভিন্ন এক দৃশ্য। দুর্গ পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালে রাজপুত নারীরা তখন জওহরব্রত পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জওহরব্রত রাজপুত নারীদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তৎকালীন সময়ে কিংবা বর্তমান সময়েও যুদ্ধে পরাজয়ের পর পরাজিত পক্ষের নারীদের অত্যন্ত অমানবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, হতে হয় গণহারে ধর্ষণের শিকার। এ কারণে রাজপুত নারীরা নিশ্চিত পরাজয়ের আভাস পেলেই বিশাল অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে তাতে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করে নিজেদের সতীত্ব রক্ষা করতেন।

রাজপুত নারীরা জওহরব্রত পালন করছেন;  Image Source: Wikimedia Commons

আকবর যখন খবর পেলেন যে দুর্গের অভ্যন্তরে জওহর ব্রত পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তখনই তিনি বুঝে গেলেন অসাধ্য সাধন করে তিনি দুর্গটি দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। আজ থেকে তিনিও মহান সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী আর বাহাদুর শাহের কৃতিত্বের অংশীদার। ১৫৬৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বাত্মক একটি আক্রমণ পরিচালনা করে মুঘল সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করলেন।

চিতোর এখন মুঘলদের পদানত। মুঘল সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে বলতে গেলে রাজপুত বাহিনীর পুরোটাই মাটিতে মিশে গিয়েছিল। তবে আকবর জানেন, সুযোগ পেলেই রাজপুতরা আবারও চিতোরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্টার চেষ্টা চালাবে। আকবর তাই নিহত রাজপুতদের খন্ডিত মাথা ঝুলিয়ে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করলেন। বিষয়টি আসলে মনস্তান্ত্বিক একটি লড়াই। রাজপুতরা যদি কখনো যুদ্ধের মাধ্যমে চিতোর বিজয়ের চেষ্টা চালায়, তাহলে এইসব বিভীষিকার কথা তাদের মনে পরবে।

যা-ই হোক, চিতোরে নিজেদের বিজয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে আকবর ‘ফাতাহনামা-ই-চিতোরে’ বলেছেন,

‘আমরা যুদ্ধে আমাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছি এবং মহান আল্লাহর সহায়তায় অবিশ্বাসীদের শহর আর দুর্গগুলো পদানত করতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহ তাদের পরিত্যাগ করুন এবং হিন্দুস্তানের সর্বত্র ইসলামের মহান পতাকা উত্তোলিত করুন।’

চিতোর বিজয়ের পর স্মারক হিসেবে চিতোর দুর্গের মূল ফটকটি আগ্রায় প্রেরণ করা হয়। আগ্রায়ও চিতোর বিজয়ের স্মারক তৈরি করা হয়। চিতোর অবরোধে মুঘল সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা দুটি হাতির মূর্তি তৈরি করে আগ্রা দুর্গের সামনে স্থাপন করা হয়। যদিও চিতোরে রাজপুতদের পরাজয় হয়েছিল, কিন্তু তারা বীরের মতো যুদ্ধ করেই পরাজিত হয়েছিল। আর রাজপুতদের এ বীরত্বের মূল কারিগর ছিলেন রাও জয়মল ও পাট্টা সিসোদিয়া। তাই তাদের শ্রদ্ধা জানাতে এ হাতিদুটোর পিঠে রাও জয়মল আর পাট্টা সিসোদিয়ার দু’টি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু, মূর্তি তৈরির এ বিষয়টি ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হওয়ায় পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে এই মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন।

রাও জয়মল ও পাট্টা সিসোদিয়ার এই মূর্তি দুটিই আগ্রা দুর্গের বাইরে হাতির পিঠে স্থাপন করা হয়েছিল;  Image Source: Wikimedia Commons

চিতোর বিজয় সম্পন্ন করে আকবর ১৫৬৮ সালের ৯ মার্চ আগ্রায় ফিরে আসেন। আকবরের জন্য এ বিজয় ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আকবর সবসময়ই স্বপ্ন দেখতেন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে অবিভক্ত হিন্দুস্তানের। আকবরের এ স্বপ্নে বাঁধা দানে একমাত্র রাজপুতরাই সক্ষম ছিল। রাজপুতদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করে আকবর রাজপুতদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বটে। তবে সব রাজপুত রাজাই তো আর সেই মিত্রতা গ্রহণ করেনি। ফলে যুদ্ধই অনিবার্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো।

আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, রাজপুতদের উদ্ধত শির নত করার মাধ্যমে আকবরই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি প্রধান হুমকিটিকে নির্মুল করতে পেরেছিলেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তাকেই মুঘল সাম্রাজ্যের মূল স্থপতি বলা হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, আকবর কিন্তু ধর্ম হিসেব করে কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। তিনি মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যারাই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে, তাদেরই মূলোৎপাটন করেছেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তিনি হিন্দু মুসলিম সবার সাথেই যুদ্ধ করেছেন। এই বিষয়ে Advanced Study in the History of Medieval India গ্রন্থে যশওয়ান্ত লাল মেহতা বলেছেন,

‘তিনি (আকবর) হিন্দুদের প্রতি বন্ধুত্বের নীতি অবলম্বন করেছিলেন। এমনকি অবিশ্বাসী (অমুসলিম) হওয়ায় তাদের নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করেননি। আকবর হিন্দু শাসকদের উপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন এটা সত্য, তবে আত্মসমর্পণ করলে খুশিমনেই নিজের তরবারি ফেলে দিতেন।’

তিনি আরো লিখেন,

‘আকবর দেশের রাজনৈতিক ঐক্য ও দেশের জনগণের জাতীয় সংহতির জন্য লড়াই করেছেন। তার বিজয় অভিযানে জাতীয় আবেগের কাছে আঞ্চলিকতাবাদ, বর্ণবাদ অথবা ধর্মীয় দিকটিকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছিল। …আকবর এ লক্ষ্য পূরণে তার সারাজীবন ব্যয় করেছেন এবং তার উত্তরসূরীরাও তার এই আদর্শ অনুসরণ করেছেন।’

চিতোর বিজয় হয়েছে, তবে তা আকবরকে খুব একটা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। চিতোর বিজয়ের মাধ্যমে একটি দুর্গ দখল হয়েছে মাত্র। মুঘল সাম্রাজ্যের বিরোধীতা করার জন্য আরও অনেকেই তখনো মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। মেবারের রানা তো চিতোর অবরোধের আগেই পালিয়ে বেঁচেছিলেন, তার বিষয়টা তো আছেই। নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে রণথম্বোর দুর্গটি থেকে। চিতোর পতনের পর রাজপুত সৈন্যদের বিশাল একটা অংশই আশ্রয় নিয়েছে রণথম্বোর দুর্গে। চিতোর উদ্ধার করতে তারা তখন শক্তি সঞ্চয় করছিল। আকবরকে তাই নতুন আরেকটি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হলো।

সে বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন সিরিজের পরবর্তী পর্বে। 

[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]

This article is written in Bengali language. It describes The Seige of Chittorgarh under Mughal Emperor Akbar.

References

1. ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

2. মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩

3. Akbar The Great Mogul (1542-1605), Vincent A. Smith, Oxford University Press, 1917

Feature Image: flickr.com

Related Articles