Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রোম সাম্রাজ্যের উত্থান (পর্ব-৩৫): রোমে দাসবিদ্রোহ

প্রাচীন রোমের ইতিহাস ঘাঁটলে তিনটি প্রধান দাসবিদ্রোহের কথা পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৎকালীন ঐতিহাসিকগণ রোমের অন্যান্য ঘটনার মতো দাসবিদ্রোহ খুব বিস্তৃত আকারে বর্ণনা করেননি। এ সম্পর্কে বেশিরভাগ বিবরণ এসেছে দিওডোরাস, প্লুতার্ক, অ্যাপিয়ানের মতো প্রাচীন ইতিহাসবেত্তাদের লেখনী থেকে।

প্রাচীন রোমের অর্থনীতি ছিল মূলত দাসভিত্তিক। সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে দাস রোম ও তার প্রদেশগুলোতে বিক্রি হতে থাকে। রীতিমতো বাজার বসিয়ে হাজার হাজার মানুষকে বিক্রি করা হতো। অধিকাংশ দাসই ছিল যুদ্ধবন্দি, এছাড়া জলদস্যুরাও অনেক লোককে ধরে এনে এখানে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিত। দাসদের মধ্যে শক্তসমর্থ যারা, তাদের অনেককে গ্ল্যাডিয়েটর স্কুলে পাঠানো হতো, বাকিদের ঠাঁই হতো তাদের মালিকদের ঘরে। সেখানে উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। থাকা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকুই ছিল। পান থেকে চুন খসলেই নেমে আস্ত অকথ্য নির্যাতন। তবে এর মধ্যেও দুয়েকজন সদয় দাসমালিকও ছিলেন।

রোমান দাস; Image Source: blogs.kent.ac.uk

প্রথম দাসবিদ্রোহ (১৩৬-১৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

আকাশে বাতাসে ভাসছিল অশুভ ইঙ্গিত।

রোমে এক দাসীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল চার হাত-পা, চোখ, কান সম্বলিত এক দানব (খুব সম্ভবত জোড়া লাগানো যমজ)। মাউন্ট এটনার উদগীরণ হলো সিসিলিতে। সেখানে ফেনিয়ে উঠছিল দাসদের অসন্তোষ।

সিসিলির প্রায় ছয় লাখ জনসংখ্যার দুই লাখই ছিল দাস। এদের মধ্যে ইউনাসের আলাদা পরিচিতি ছিল। ইউনাসের জন্ম সিরিয়ার আপামিয়াতে। খুব সম্ভবত সিসিলিয়ান জলদস্যুরা তাকে ধরে এনে বিক্রি করে দেয়। সিসিলিয়ান দাসমালিক পাইথো ছিলেন তার প্রথম মালিক, পরে অ্যান্টিজেনেস তাকে কিনে নেন। তার বসবাস ছিল এনা শহরে।

ইউনাস; Image Source: holidayezine.blogspot.com

ইউনাস তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খুব দ্রুতই মালিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি মাঝে মাঝেই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, যার কিছু ঘটনাক্রমে মিলে গিয়েছিল। ফলে ‘ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে’র মতো করে ইউনাসের নামডাক ছড়াতে থাকে। আগুনের খেলা দেখাতেও ইউনাস পাকা ছিলেন। এসব কারণে অ্যান্টিজেনেস অনেক অনুষ্ঠানে তাকে রাখতেন। অতিথিরা তার কাজকর্মে মুগ্ধ হলে অনেকেই তাকে তাদের পাতের খাবারের কিছু অংশ দিতেন।

ইউনাস প্রায়ই দাবি করতেন, তিনি একদিন রাজা হবে। যে-ই শুনত, সে তো হেসেই বাঁচতো না। দাস হবে রাজা! কিন্তু কে জানত, একদিন তার এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হবে।

বিদ্রোহের সূচনা

এনা শহরে বাস করত এক গ্রিক বংশোদ্ভূত এক ধনী সিসিলিয়ান, ডেমোফিলাস। দাসদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা ছিল অবর্ণনীয়। তার স্ত্রী, মেগালিস ছিল আরো এক কাঠি উপরে। প্রতিদিনই এক বা একাধিক দাস তাদের হাতে প্রহৃত হতো কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই। অতিষ্ঠ হয়ে তারা মনিবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করল। কিন্তু চাইলেই তো আর বিদ্রোহ করা যায় না। ব্যর্থ হলে শাস্তি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে তিলে তিলে মৃত্যু। সফল হতে হলে চাই দেবতাদের সুনজর। কিন্তু দেবতাদের মনের ভাব বুঝবে কে? কেন! ভবিষ্যতদ্রষ্টা ইউনাস!

বর্তমান এনা শহর; Image Source: italymagazine.com

সুতরাং দাসেরা ইউনাসের কাছে গিয়ে হাজির হলো, তাদের কাজে দেবতাদের সায় আছে কি না তা জানতে। তিনি তাদের আশ্বস্ত করে অবিলম্বে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উদ্বুদ্ধ করলেন। প্রায় চারশো দাস মধ্যরাতে শহরের বাইরে তার নেতৃত্বে জড়ো হলো। তাদের সাথে ছিল যেন-তেন প্রকারে জোগাড় করা হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র। সিসিলিতে এর আগে দীর্ঘদিন শান্তি বজায় থাকায় শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল যৎসামান্য। দাসেরা তাই সহজেই ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাড়ি বাড়ি থেকে অন্য দাসেরা বেরিয়ে এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।

রক্তের নেশায় উন্মক্ত দাসেরা এনার অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে, তাদের পৈশাচিকতা থেকে দুগ্ধপোষ্য শিশুও রক্ষা পায়নি। হত্যা আর ধর্ষণের মধ্য দিয়ে নিষ্পেষিত দাসেরা তাদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। ইউনাস নিজে অ্যান্টিজেনেস আর পাইথোকে হত্যা করলেন। তবে যেসব সিসিলিয়ান এর আগে ইউনাসকে তাদের খাবারের ভাগ দিয়েছিল, তাদের রেহাই দেওয়া হয়। এছাড়াও শহরের কামার ও অস্ত্র নির্মাতাদের না মেরে বন্দি করা হলো।

দাসেরা এবার চলল শহরের বাইরে ডেমোফিলাসের বাগানবাড়ির দিকে। সেখান থেকে তাকে এবং তার স্ত্রীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসা হলো এনার অ্যাম্ফিথিয়েটারে। ডেমোফিলাসের তরুণী কন্যা, যে কি না দাসদের প্রতি সবসময় সদয় আচরণ করেছে এবং তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিত, তার গায়ে কেউ আঙুল তুলল না। তাকে নিরাপদে অন্য শহরে তার আত্মীয়দের কাছে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।

অ্যাম্ফিথিয়েটারে ডেমোফিলাসের বিচার করবে বলে দাসেরা ভেবেছিল। কিন্তু তারা এই সিসিলিয়ানের অসাধারণ বাগ্মিতাকে হিসেবে নেয়নি। ডেমোফিলাস অত্যন্ত গুছিয়ে তার আচরণের যৌক্তিকতা আর ন্যায্যতা তুলে ধরতে থাকে। দাসদের মধ্যে কিছুটা বিভক্তি দেখা দেয়। যারা ডেমোফিলাসের মালিকানায় ছিল না, তাদের অনেকেই তার পক্ষ নিতে থাকে। এই সময় হার্মিয়াস ও জিউক্সিস নামে দুই দাস, যারা সম্ভবত তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত, তারা ডেমোফিলাসের দিকে এগিয়ে গেল। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে একজন তাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করে, অপরজন কুঠার দিয়ে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মেগালিসকে তুলে দেয়া হলো নারী দাসেদের হাতে। তারা তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। 

ইউনাসের ক্ষমতা সুসংহতকরণ

ইউনাসকে দাসেরা নিজেদের রাজা নির্বাচিত করল। ইউনাস তার স্ত্রীকে রানী ঘোষণা করে তাকে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত লোকদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করলেন। তার মধ্যে ছিল এক গ্রিক, আকিউস। সমরকৌশলে তার দক্ষতা ছিল। সে দাসদের সতর্ক করল এ-ই বলে যে, খুব শিগগিরি তাদের রোমান বাহিনীর মোকাবেলা করতে হবে। আটক কামার আর অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের বাধ্য করা হলো যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে। ইউনাস তিনদিনের মধ্যে ৬,০০০ দাসের এক বাহিনী গড়ে তুললেন। তার বাহিনী নিয়ে তিনি আশেপাশের অঞ্চলে লুটতরাজ চালাতে লাগলেন। ক্রমেই তার দল ভারি হতে হতে বিশ হাজার ছাড়িয়ে গেল।

এদিকে এনার এক মাসের মধ্যে ক্লিওন নামে এক সিসিলিয়ান দাস কয়েকশো সঙ্গী নিয়ে সিসিলির দক্ষিণের বন্দর অ্যাক্রেজ দখল করে নেয়। সেখান থেকে উত্তর দিকে মার্চ করে সে এনাতে এসে পৌঁছল। এখানে ইউনাসের রাজত্ব স্বীকার করে ক্লিওন তার সাথে যোগ দেয়। সে ইউনাসের প্রধান জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণ করে।   

সিসিলির গভর্নর লুসিয়াস স্থানীয় গ্রিক আর রোমানদের নিয়ে গঠিত মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে ইউনাসের দিকে এগিয়ে এলে দাসদের বিশাল বাহিনীর হাতে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ক্লিওন পূর্ব উপকূলের রাস্তার পাশে অবস্থিত টরোমেনিয়াম, ক্যাটিনা আর মর্গান্টিনা শহর অধিকার করল। আত্মবিশ্বাসী দাসবাহিনী এমনকি সিরাকিউজ শহরও অবরোধের চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলেও ইউনাস সিরাকিউজের পার্শ্ববর্তী লিওন্টিনির উর্বর ভূমিতে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হলেন। অধিকৃত এলাকা জুড়ে ইউনাস নতুন এক রাষ্ট্র কায়েম করলেন। সেখানে আলাদা মুদ্রাব্যবস্থা চালু হলো।

ইউনাসের প্রবর্তিত মুদ্রা © British Museum/livyarrow.org

ইতালির অন্যান্য অংশে উত্তেজনা

ইউনাসের সফলতার খবরে রোমে ১৫০ জন দাস বিদ্রোহ করে। অ্যাটিকাতে হাজারের উপরে দাস সমবেত হয়। ডেলোস আর রোমের অধীন অন্যান্য স্থানেও উত্তেজনা দেখা দিল। কিন্তু স্থানীয় শাসকেরা ত্বরিত ব্যবস্থা নিলেন। সমস্ত জায়গাতে সরকারি বাহিনী দাসদের দমন করে বিদ্রোহীদের শাস্তি প্রদান করে।

ইউনাসের বিরুদ্ধে অভিযান

ইউনাসের দল কিন্তু দিনে দিনে বেড়ে উঠছিল। তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে প্রায় চার বছরে তার বিরুদ্ধে প্রেরিত আটজন ভিন্ন ভিন্ন রোমান সেনানায়ককে পরাজিত করেন। এদের মধ্যে অন্তত দুজন প্রিটর-ম্যানলিয়াস ও লেন্টিলাস এবং ফ্ল্যাকাস নামে একজন কন্সালও ছিলেন। প্রতিটি রোমান বাহিনী নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।

অবশেষে ১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কন্সাল পিসো সিসিলিতে অবতরণ করলেন দুটি লিজিওন নিয়ে। তিনি শক্ত হাতে সিসিলির বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিরক্ষা জোরদার করে সেনাদের কঠিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিলেন। অভিযানের শুরুর দিকে টাইটাসের অধীনে রোমান অশ্বারোহীদের একটি দল ইউনাসের সেনাদের হাতে পরাস্ত হয়। শাস্তি হিসেবে তার গোসল নিষিদ্ধ করে শতছিন্ন কাপড় পরিহিত অবস্থায় পিসোর শিবিরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। পিসো যতদিন ছিলেন, ততদিন টাইটাসকে এই শাস্তি পেতে হয়েছিল। 

পিসো নিজেই এবার মাঠে নামলেন। মর্গান্টিনা রোমানদের হাতে চলে আসে। ৮,০০০ দাস বন্দি হয়, তাদের সকলকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো। তিনি এবার এনার দিকে অগ্রসর হলেন। ইউনাস সরাসরি পিসোর সাথে শক্তি পরীক্ষা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি শহর থেকে বের হলেন না। পিসো এনা অবরোধ করলেন। এর মধ্যেই পরের বছর চলে আসায় রোমান সেনানায়ক পরিবর্তন হলো। দায়িত্ব নিলেন রুপিলিয়াস নামে এক কঠোর সেনানায়ক।

রুপিলিয়াস প্রথমে টরোমেনিয়ামের চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন। শহরের বিদ্রোহী সেনাদলের নেতা ছিলেন ক্লিওনের ভাই কোম্যানুস (Comanus)। প্রচণ্ড অবরোধে শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। প্রাচিন ঐতিহাসিকেরা দাবি করেন যে, ক্ষুধার তাড়নায় বিদ্রোহীরা নরমাংস খেতে বাধ্য হয়েছিল। কোম্যানুস ও তার কিছু সাথী শহরের বাইরে এসে রোমানদের সাথে বীরের মতো লড়াই করে নিহত হন। তারপরেও শহরে প্রবেশ করা সহজ ছিল না। কিন্তু সেরাপিওন নামে এক সিরিয়ান দাস ক্ষমার আশ্বাসে বিশ্বাসঘাতকতা করল। সে দরজা খুলে দিলে রোমান সেনারা নগরে প্রবেশ করে। বেঁচে থাকা সব বিদ্রোহীকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে হত্যা করা হয়।

সিজ অভ টরোমেনিয়াম © Mary Evans Picture Library/ fineartamerica.com

ইউনাসের বিদ্রোহের অবসান

রুপিলিয়াস এনার দিকে নজর দিলেন। সেখানে অবরোধ শক্তিশালী করা হলো। ১৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষের দিকে তীব্র অবরোধে এনা কাতর হয়ে পড়ল। শহরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। রোগবালাইয়ের আঘাতে ইউনাসের অনুসারীরা কাবু হয়ে পড়ে। ক্লিওন তার সেনাদের নিয়ে বেরিয়ে এসে রোমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রুপিলিয়াস সকলকে হত্যা করেন। ক্লিওনের ক্ষতবিক্ষত দেহ শহরের সামনে প্রদর্শন করা হয়। এখানেও কোনো এক বিশ্বাসঘাতক দরজা খুলে দিলে রোমানরা ঝড়ের গতিতে শহরে ঢুকে পড়ে।

এনা নগরীর ধংস; Image Source: steamcommunity.com

নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। এই ফাঁকে ইউনাস এক হাজার দেহরক্ষী নিয়ে শহর ত্যাগ করে পাহাড়ি এলাকার দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রুপিলিয়াস তাকে ধাওয়া করে শেষে এক পাহাড়ের উপর বিদ্রোহীদের ছোট এই দলকে আটকে ফেলেন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে ইউনাসের দেহরক্ষীরা রোমানদের হাতে ধরা না দেয়ার সংকল্প করল। তারা একে অপরকে হত্যা করে। তবে ইউনাস ও তার চার সঙ্গীকে- তার বাবুর্চি, রুটি প্রস্তুতকারক, গা টিপে দেয়ার লোক এবং তার অনুষ্ঠানের বিনোদনদায়ক; রোমানরা এক গুহার ভেতর থেকে ধরে ফেলে। তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। দিওডোরাসের মতে, সেখানে মাংস পচে গলে পড়া রোগে ইউনাসের মৃত্যু হয়।

ইউনাসের বিদ্রোহ তুলনামূলক বিচারে সবচেয়ে সফল দাসবিদ্রোহ, এমনকি স্পার্টাকাসের থেকেও। ইউনাস নিজের জন্য একটি রাষ্ট্র ও মুদ্রা চালু করতে পেরেছিলেন। তার বিদ্রোহের স্থায়িত্বও অনেক বেশি ছিল। তবে পরবর্তী সব বিদ্রোহের মতো তিনিও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় দাসবিদ্রোহ (১০৪-১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

মারিয়াসের সেনা সংগ্রহ এবং নতুন বিদ্রোহের উৎপত্তি

সিম্ব্রি ও টিউটনদের সাথে লড়াইতে প্রচুর রোমান ও ইটালিয়ান সেনা নিহত হয়। ফলে মারিয়াস যখন ক্যাম্পেইনের দায়িত্ব নিলেন, তখন নতুন করে সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। মারিয়াস সেনা চেয়ে তাই এশিয়া মাইনরের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছে চিঠি পাঠালেন। বিথাইনিয়া থেকে জবাব এলো, রোমান ব্যাংকারেরা ঋণ অনাদায়ে সেখানকার অস্ত্র বহনে সক্ষম প্রায় সকল পুরুষকে দাসত্বে আবদ্ধ করেছে। মারিয়াস সিনেটকে এ কথা জানালে তারা রোমান প্রদেশগুলোতে তার মিত্রদেশের কোনো নাগরিককে দাস হিসেবে ধরে রাখা অবৈধ বলে আইন জারি করে। নিজ নিজ এলাকার রোমান শাসকদের এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। সেই মতো সিসিলির  গভর্নর  নের্ভা প্রতিটি দাসের অবস্থা পর্যালোচনা করে কয়েকদিনের মধ্যে আট শতাধিক দাসকে মুক্ত করে দেন। সিসিলির দাসদের মধ্যে আশার সৃষ্টি হলো। তাদের অনেকেই মুক্তি প্রতীক্ষায় দিন গুনতে লাগল।

দাসমুক্তির আলোচনা চলছে © Granger/ fineartamerica.com

এদিকে শয়ে শয়ে দাস মুক্ত হয়ে যাওয়ায় ধনী দাসমালিকেরা প্রমাদ গুনল। দাসেরা না থাকলে বাড়িঘর, খেতখামারের কাজ কে করবে? তারা নের্ভার কাছে ধর্না দিল। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েই নের্ভা নতুন করে আর কোনো দাসের মুক্তির উদ্যোগ নিলেন না। ফলে দাসেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। হ্যালিসি অঞ্চলের কাছে ভ্যারিয়াস নামে এক দাসের নেতৃত্বে তিরিশ জন বিদ্রোহ করে। রাতের আঁধারে তারা তাদের মালিক দুই ভাইকে মেরে আশেপাশের বাড়িতে হামলা করল। দ্রুত তাদের দল ভারি হতে থাকে। সুরক্ষিত এক স্থানে বিদ্রোহীরা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে।  

নের্ভা তাদের অবস্থান অবরোধ করলেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য সেই শিবিরে আক্রমণ করতে ব্যর্থ হন। কাজেই তিনি কূটকৌশলের আশ্রয় নিলেন। এজন্য টাইটিনাস নামে এক স্থানীয় দস্যুকে কাজে লাগানো হলো। তাকে সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। টাইটিনাসের সাথে পলাতক দাসদের সুসম্পর্ক ছিল; সুতরাং সে যখন তার অনুচরদের নিয়ে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে উপস্থিত হলো, তারা তাকে সাদরে বরণ করে নেয়। এমনকি নিশ্চিত বিশ্বাসে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তার কাছে তুলে দেয়। টাইটিনাস ফটক খুলে রোমানদের আমন্ত্রণ করে ভেতরে নিয়ে এলে তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করল। অনেক দাস পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যাতে রোমানরা তাদের ধরতে না পারে। লুটতরাজ চালানোর পর নের্ভা সেনাদল ভেঙে দিলেন।

স্যালভিয়াসের উত্থান   

নের্ভার কাছে খবর এসে পৌঁছল, আশিজন দাস বিদ্রোহ করে রোমান ইকুইট ক্লনিয়াসকে মেরে ফেলেছে। তার কাছে তখন কেবল অল্প কিছু সৈন্য। তাদের নিয়েই নের্ভা দ্রুত মার্চ করলেন। এদিকে বিদ্রোহীরা ক্যাপ্রিয়ানাস পর্বতে শিবির করল। সেখানে দলে দলে দাস তাদের সাথে যোগ দেয়। অল্পদিনের মধ্যে দু’হাজারের অধিক লোক এখানে সমবেত হয়ে যায়। নের্ভা ততদিনে হেরাক্লিয়াতে এসে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি মার্কাস টাইটিনাসকে ৬০০ সেনার কম্যান্ড দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে পাঠালেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের অধিক সংখ্যার কাছে মার্কাস পরাজিত হন। তাদের কাছ থেকে বিদ্রোহীরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুটে নেয়।

রোমানদের বিপক্ষে জয়ের পর বিদ্রোহীরা জমায়েত হলো নেতা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে। তাদের মধ্যে ছিল এক বংশীবাদক, স্যালভিয়াস। তাকে সবাই রাজা মেনে নিল। স্যালভিয়াস সবাইকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনদিকে পাঠালেন। অল্প ক’দিনের মধ্যে তারা আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক লুণ্ঠন চালিয়ে প্রচুর মালামাল দখল করে নেয়। স্যালভিয়াসের অনুসারি হু হু করে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তার দলে ২০,০০০ পদাতিক আর ২,০০০ অশ্বারোহী সমবেত হয়। এদের নিয়ে স্যালভিয়াস এবার মর্গান্টিনা নগরী অবরোধ করে বসেন।

প্রাচীন মর্গান্টিনার ধ্বংসাবশেষ; Image Source: sitiarcheologiciditalia.it

মর্গান্টিনাকে মুক্ত করতে ১০,০০০ সিসিলিয়ান আর ইটালিয়ান সৈন্য নিয়ে সেই অঞ্চলের রোমান শাসক এগিয়ে এলেন। স্যালভিয়াস যখন অবরোধে ব্যস্ত, তখন ফাঁক দিয়ে তারা বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। স্যালভিয়াস ঘুরে পাল্টা আক্রমণ চালালেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, অস্ত্র সমর্পণ করলে কাউকে হত্যা করা হবে না। ফলে বহু ইতালিয়ান ও সিসিলিয়ান সেনাই অস্ত্র ফেলে দিল। রোমানদের ৬০০ সেনা নিহত আর ৪,০০০ বন্দি হলো।

স্যালভিয়াস আবার মর্গান্টিনার দিকে মনোযোগ দিলেন। শহর বিজয়ের পর সব দাসকে মুক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। কিন্তু মর্গান্টিনার দাসমালিকেরাও তাদের দাসদের শহর রক্ষার বিনিময়ে একই প্রতিশ্রুতি দেন। তারা মালিকদের পক্ষাবলম্বন করে। তাদের প্রবল প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত স্যালভিয়াস পিছু হটলেন। 

স্যালভিয়াসের সেনাদের আক্রমণ © North Wind Picture Archive/East News

অ্যাথেনিয়নের আবির্ভাব

সেগেস্টা আর লিলিবিয়ামের এলাকাতে অ্যাথেনিয়ন নামে এক সিসিলিয়ানের প্ররোচনায় দাসেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পাঁচদিনের মাথায় তিনি সহস্রাধিক লোক জড়ো করে তাদের রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেন। তিনি বেছে বেছে শক্তসমর্থ দাসদেরকেই নিজের দলের অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। অল্পদিনেই প্রায় দশ হাজার সেনার এক বাহিনী তার হাতে চলে আসে। অ্যাথেনিয়ন এদের নিয়ে লিলিবিয়াম অবরোধ করলেন।

কিন্তু, এর আগে পাইরাস এবং রোমানরাও লিলিবিয়ামের দুর্ভেদ্যতার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল। অ্যাথেনিয়নও অবরোধ করে কিছুই অর্জন করতে পারলেন না। ফলে তিনি অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ ফাঁকে জাহাজে করে লিলিবিয়ামের প্রতিরক্ষার জন্য একদল সেনা হিসেবে উপস্থিত হলো। অ্যাথেনিয়ন চলে যাবার সময় তারা হামলা করে তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। 

স্যালভিয়াস আর অ্যাথেনিয়নের মৈত্রী

এদিকে মর্গান্টিনা থেকে স্যালভিয়াস লিওন্টিনির দিকে মার্চ করেন। চলার পথে সমস্ত এলাকাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। লিওন্টিনিতে প্রায় তিরিশ হাজার সেনার জমায়েতে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ দিয়ে তিনি নতুন নাম নিলেন- ট্রাইফন। তার উদ্দেশ্য ছিল, অ্যাগ্রিগেন্টো প্রদেশের ট্রায়োকলা নগরীতে তার মূল ঘাঁটি স্থাপন করার। সেখানে গিয়ে স্যালভিয়াস নিজের প্রাসাদ তৈরি করলেন এবং প্রতিরক্ষার জন্যে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেন।

তিনি অ্যাথেনিয়নের কাছেও দূত পাঠালেন। কেউ যদি মনে করে থাকত, নেতৃত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে বচসার সূত্রপাত হবে, তাহলে ভুল করেছিল। ঠিক ক্লিওনের মতো অ্যাথেনিয়ন স্যালভিয়াসকে রাজা বলে মেনে নেন। তিনি ৩,০০০ সেনা নিয়ে ট্রায়োকলাতে এসে উপস্থিত হলেন, বাকি সেনাদের প্রেরণ করলেন আশেপাশের অঞ্চল থেকে আরো অনুসারী সংগ্রহ করে আনার কাজে।

প্রাচীন ট্রায়োকলা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ; Image Source: flickr.com

রোমান অভিযান

সতের হাজার সেনা নিয়ে লিসিনাস সিসিলিতে পা রাখলেন। তাদের আসার সংবাদ পেয়ে স্যালভিয়াস যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। প্রথমে তিনি দুর্গের ভেতর থেকে রোমানদের প্রতিহত করার কথা ভাবলেও অ্যাথেনিয়ন সরাসরি লড়াইয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। তার প্রস্তাবই শেষে গৃহীত হয়। ৪০,০০০ সেনা নিয়ে অ্যাথেনিয়ন স্কিরথিয়াতে রোমান সেনাদের অনতিদূরে ক্যাম্প করলেন।

লড়াই শুরু হলে অ্যাথেনিয়ন ২০০ অশ্বারোহী নিয়ে বিপুল বিক্রমে রোমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বহু সেনাকে তিনি হত্যা করেন, কিন্তু নিজেও বাজেভাবে আহত হয়ে একপর্যায়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যান। তিনি মারা গেছেন মনে করে বিদ্রোহীরা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায়। মরার ভান করে পড়ে থাকা অ্যাথেনিয়ন রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে ট্রায়োকলার দিকে চলে যান। এই যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ বিদ্রোহী নিহত হয়।

লিসিনাস আশেপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নয়দিন পর বিদ্রোহীদের মূল ঘাঁটিতে এসে পৌঁছলেন। ততদিনে তারা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে ফেলেছিল। ফলে অনেক চেষ্টা করেও লিসিনাস কিছু করতে পারলেন না। তার ব্যর্থতায় রোমান সিনেট তাকে সেনাদায়িত্ব থেকে অপসারণ করে জবাবদিহিতার জন্য রোমে ডেকে পাঠায়। তার স্থানে সার্ভিলিয়াসকে পাঠানো হলো। লিসিনাস তার সেনাদল ভেঙে দেন এবং শিবিরের সমস্ত কিছু পুড়িয়ে ফেলেন। তিনি সার্ভিলিয়াসের কাজ যথাসম্ভব কঠিন করে তুলতে চাইছিলেন, যাতে তিনিও ব্যর্থ হন। তার ধারণা ছিল, এর ফলে সিনেট সব দোষ একলা তার ঘাড়ে চাপাতে পারবে না। যা-ই হোক না কেন, সার্ভিলিয়াস আসলেও কিছু করতে পারলেন না। এর মধ্যে স্যালভিয়াসের মৃত্যু হলে অ্যাথেনিয়ন রাজা হয়ে বসেন এবং রোমান সেনাপতিদের নিস্ক্রিয়তার সুযোগে চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে লাগলেন।      

বিদ্রোহের অবসান

১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

রোমান কন্সাল হিসেবে পঞ্চমবারের মতো দায়িত্ব নিয়েছেন মারিয়াস, তার সহযোগী কন্সাল অ্যাকুইলিয়াস। অ্যাকুইলিয়াস নিজেই অ্যাথেনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেন। মারিয়াস নিজের সেনাদল থেকে অতিরিক্ত সেনা দিয়ে তাকে সাহায্য করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর অ্যাথেনিয়নের বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বলা হয়, অ্যাকুইলিয়াস সম্মুখসমরে নিজে অ্যাথেনিয়নকে হত্যা করেন। এরপরেও প্রায় দশ হাজার বিদ্রোহী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। তাদের প্রত্যেককে তিনি খুঁজে বের দমন করেন।

অ্যাথেনিয়নের পরাজয়; Image Source: deviantart.com

সবশেষে স্যাটাইরিয়াস নামে এক দাসের নেতৃত্বে এক হাজার বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করে। তাদের রোমে নিয়ে গিয়ে হিংস্র পশুর সাথে অ্যাম্ফিথিয়েটারে ছেড়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহীরা রোমানদের বিনোদনের উপকরণ হতে চায়নি। তাই তারা একে অপরকে হত্যা করল। অবসান হলো দ্বিতীয় দাসবিদ্রোহের।

Related Articles