কেউ সরাসরি স্বীকার করুক আর না করুক, রাজনৈতিক যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো যেকোনো দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সরকারি বা বিরোধী দলীয় উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। কেউ কেউ এসব ঘটনার কথা জেনে বিনোদিত হয়, কেউ বা তা ফাঁস হওয়ার কারণে পড়ে যায় বিপাকে। বর্তমান সময়ে নির্বাচনের আগ দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনা মানে নির্বাচনের মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়া। আপাতদৃষ্টিতে ধারণাটিকে নতুন বলে মনে হলেও এ ধরনের ঘটনার প্রতি পাঠক বা দর্শকের আগ্রহ কিন্তু অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান।
মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিটের বরাতে জানা যায়, মেলানিয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে অ্যাডাল্ট ফিল্মের অভিনেত্রী স্টেফানি ক্লিফোর্ডের (পেশাগত নাম স্টর্মি ডেনিয়াল) সাথে সম্পর্ক ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক মাস আগে দীর্ঘদিনের আইনজীবী মাইকেল কোহেনের সাহায্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে স্টেফানির মুখ বন্ধ রাখেন ট্রাম্প।
পরবর্তীতে এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে ট্রাম্প বারংবার তা অস্বীকার করলেও সেই বক্তব্য ধোপে টেকে না স্টেফানি ও ট্রাম্পের একটি ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে আরেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও হোয়াইট হাউজের শিক্ষানবিশ তরুণী মনিকা লিউনেস্কির কথা। সেসব কথার সূত্রপাত কোত্থেকে ঘটেছে সে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে মারিয়া আর হ্যামিল্টনের সাড়াজাগানো যৌন কেলেঙ্কারির কথা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের রক্ষিতা মারিয়া রেনল্ডসকে নিয়ে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে গণমাধ্যম। মারিয়াকে হ্যামিল্টনের রক্ষিতা বলাটাও খুব একটা ঠিক হবে না, কেননা মারিয়ার স্বামী জেমস রেনল্ডসকে প্রায় ১৩ হাজার ডলার দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখে হ্যামিল্টন। জেমসের চাপে পড়ে তার স্ত্রীর সাথে প্রায় বছরখানিক এই যৌন সম্পর্ক স্বীকার করতে বাধ্য হওয়া হ্যামিল্টন-মারিয়ার কেসটিকে বলা হয় আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক যৌন কেলেঙ্কারি।
যৌন কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো অন্যান্যদের ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করে, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের জন্য সেটির মাত্রা আরও ভয়ঙ্কর। খুব সহজেই বাইরের দুনিয়ার সাধারণ মানুষগুলোও এই ঘটনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিপাকে ফেলে দিতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে। আর যার নামে এমন অভিযোগ উঠছে, তার চরিত্রের গরিমা নিয়ে উপসংহার টেনে দিতে কেউ বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। বেচারার পূর্বের সমস্ত কীর্তি চাপা পড়ে যায় এক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়েই। এমনটাই ঘটেছিল আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের সাথেও।
সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন যথাক্রমে জর্জ ওয়াশিংটন এবং জন অ্যাডামস। তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ সচিব আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের মধ্যে অন্যতম বলা হয়। তার হাতেই লেখা হয়েছিল জর্জ ওয়াশিংটন প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতিমালা। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ পত্রিকা চালু করা, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লেখা, ফেডারেলিস্ট পার্টি গঠন, কোস্ট গার্ড বাহিনী গড়ে তোলার মতো বহুবিধ বিষয়ে অগ্রগামী ভূমিকার জন্য তাকে ভীষণ পছন্দ করতো আমেরিকানরা। বিশেষত দেশটির অর্থনীতি আর সামরিক বাহিনীকে একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদান করায় তার কাছে ঋণী ছিল সবাই। তবে নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তখনকার দিনে নিজের অবস্থান বেশ হালকা করে ফেলেন হ্যামিল্টন, যে কারণে পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে ১০০ পৃষ্ঠার বই বের করে সবার কাছে মাফ চাইতে হয় তাকে। পরিণতি শোনার আগে বরং পরিস্থিতি জেনে নেয়া যাক।
মারিয়া রেনল্ডস খ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি লাভ করেন হ্যামিল্টনের সাথে জড়িয়ে। এই খ্যাতির জন্য ‘রেনল্ডস প্যামফ্লেট’ নামের সেই নাতিদীর্ঘ বইটিকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। এখনো পর্যন্ত মারিয়া-হ্যামিল্টনের সেই ক্ষণস্থায়ী প্রেমকাহিনীকে অমর করে রেখেছে বইটি। কিন্তু মারিয়ার গল্পটা শুরু হয়েছিল এই ঘটনার আরও অনেক আগেই। ১৭৮৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে জেমস রেনল্ডসের সাথে বিয়ে হয় মারিয়ার। বিপ্লবী যুদ্ধের সময় রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন জেমস। বিয়ের পর নবদম্পতি নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় চলে আসে। ১৭৮৫ সালে জন্ম নেয় তাদের একমাত্র কন্যা সুসান রেনল্ডস। এই ঘটনার আরও বেশ কয়েক বছর পরে হ্যামিল্টনের সাথে পরিচয় হয় মারিয়ার।
১৭৯১ সালের গ্রীষ্মের কথা। মারিয়ার বয়স তখন ২৩। ৩৪ বছর বয়সী আলেকজেন্ডার হ্যামিল্টনের কাছে সাহায্য চাইতে যান তিনি। অত্যাচারী স্বামীর নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে বাড়তে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে মারিয়াকে দিনের পর দিন ঘরে আটকে রাখা শুরু করলো জেমস। তাই একদিন সুযোগ পেয়ে পরিচিতদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য হ্যামিল্টনের কাছে আর্থিক সহায়তার জন্য ছুটে আসে মারিয়া। কিছু টাকা পেলেই এই নরক ছেড়ে নিউ ইয়র্কে চলে যাবে সে, অন্তত তখন পর্যন্ত এমনটাই ইচ্ছে ছিল তার।
কিছুদিন পর কাঙ্ক্ষিত অর্থ নিয়ে মারিয়া যে বোর্ডিং হাউজে উঠেছেন, সেখানে দেখা করতে যান হ্যামিল্টন। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে হ্যামিল্টনের স্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় সহজেই দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সেই গ্রীষ্মেই জেমস তার ভুল স্বীকার করে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মারিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু হ্যামিল্টনের সাথে সেই অনৈতিক সম্পর্ক তখনো চলতে থাকে মেয়েটির।
খুব দ্রুতই ব্যাপারটি জেনে যায় জেমস। কিন্তু সে নিজেও স্ত্রীকে বারণ না করে বরং তা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। কেননা এই ঘটনা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে মাসে মাসে হ্যামিল্টনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করার সুযোগ ধূর্ত জেমস অন্তত ছাড়তে চায়নি। ১৭৯২ সালে বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করার দায়ে ভার্জিনিয়ান জ্যাকব ক্লিংম্যানের সাথে গ্রেপ্তার করা হয় জেমসকেও। ক্লিংম্যান আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে ছাড়া পেলেও জেমস যৌন কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়ে হ্যামিল্টনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অবৈধ সুবিধা পাওয়ার মতলব করছিল।
লোকমুখে গুঞ্জন যখন গুজবে পরিণত হচ্ছে, তখন বাধ্য হয়েই ১৭৯৭ সালে হ্যামিল্টন ১০০ পৃষ্ঠার একটি প্যামফ্লেট প্রকাশ করেন যা ‘রেনল্ডস প্যামফ্লেট’ নামে পরিচিত। লজ্জিত হ্যামিল্টন সেখানে মারিয়ার সাথে তার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে শুরু করে জেমসকে দেয়া ব্ল্যাকমেইলের অর্থ সবকিছু নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন।
“আমার আসল অপরাধ ছিল জেমসের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া। সেই একটি অপরাধের শাস্তি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা তো দিতে হয়েছেই, তার উপর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাকে যে সাজা দেয়া হয়েছে তার জন্যও আমার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা দাবী করে বসে সে,” লিখেছিলেন হ্যামিল্টন।
এরপরের ধারা বিবরণীতে তিনি অবশ্য সুবোধ বালকের মতো কেবল আর্থিক সহায়তা করতে মারিয়ার বাড়ি গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। মারিয়াই নাকি টাকার চেয়ে বরং তার সাথে প্রণয়ে বেশি আগ্রহী ছিল। তাই তো তিনি লিখেছেন,
“তার কথা শুনে মনে হতো অর্থের চেয়ে মানসিক সহযোগিতা তার বেশি প্রয়োজন”।
প্যামফ্লেট অনুযায়ী হ্যামিল্টন দাবী করেন, পরিস্থিতি এমনই জটিল হয়ে উঠেছিল যে, সব জেনেশুনেও এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।
“মারিয়া এমন পাগলামি শুরু করত যে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া একপ্রকার অসম্ভবই হয়ে দাঁড়ায়। তাকে ত্যাগ করা বা তার সাথে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করলেই সে আত্মঘাতী নানা পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিত।”
এই প্যামফ্লেট প্রকাশিত হওয়ার পর গণসমালোচনার সম্মুখীন হন মারিয়া। অনেক তদন্ত চালানো হয় তার ব্যাপারে। খুব শীঘ্রই বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করে জেমসের হাত থেকে মুক্তি পান তিনি। সে সময় কোনো নারীর পক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করে জয়ী হওয়া দুর্লভ ঘটনা ছিল। পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করেন জ্যাকব ক্লিংম্যানকে, যে তার প্রাক্তন স্বামীর খুব ভালো বন্ধু এবং যাবতীয় অপরাধের সঙ্গী ছিল। যৌন কেলেঙ্কারির অংশটুকু বাদ দিলে নারী অধিকার আদায়ে মারিয়া রেনল্ডস সে সময় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর এই আলোচনা-সমালোচনার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার রাস্তা প্রায় নিশ্চিত হওয়া স্বত্বেও ব্যর্থ হন হ্যামিল্টন।
হ্যামিল্টন এবং ট্রাম্প দুজনের ঘটনায় উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে ‘হাশ মানি’ বা মুখ বন্ধ করার জন্য ভিক্টিমকে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে। তবে হ্যামিল্টনকে ব্যবহার করে জেমস যেমন ফেডারেল আইন বিরোধী অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছিল, ট্রাম্পের বেলায় এখনো পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। তবে শেষ পর্যন্ত এই ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গিয়ে হ্যামিল্টনের মতো ট্রাম্পকেও প্যামফ্লেট বের করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয় কি না সেটাই প্রশ্ন!
This article is in Bangla language. It's main focus is on America's first political sex scandal.
References have been hyperlinked inside the article.
Feature Image: allthatsinteresting.com