Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শাকা জুলু: জুলু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নির্দয় এক রাজার গল্প

প্রতিটি মহাদেশের ইতিহাস ঘাটলে এমন কিছু বীর যোদ্ধার খোঁজ পাওয়া যাবে যাদেরকে ঐ মহাদেশের মানুষ মনে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষেত্রে এমনই এক নাম হলো ‘শাকা’, যিনি ছিলেন জুলু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিখ্যাত একজন রাজা। তার স্বল্পকালীন দুর্ধর্ষ রাজত্বকালে তিনি প্রায় কয়েকশ এঙ্গুনি সরদারিকে একত্রিত করেছিলেন। তার হাত ধরেই ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী রূপ নিয়েছিল বিশাল জুলু সাম্রাজ্যে। কেমন ছিলেন সেই রাজা? আর কেমনই বা ছিল তার সাম্রাজ্য? চলুন আজকে জেনে নেওয়া যাক তার সম্পর্কে।

শাকার জন্ম হয় ১৭৮৭ সালে, আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে যা বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকা নামে পরিচিত। তার বাবা সেঞ্জাংগাখোনা ছিলেন ‘জুলু’ নামের ছোট্ট এক সরদারির নেতা। শাকার মায়ের নাম ছিল নান্দি। তবে সেসময় তিনি সেঞ্জাংগাখোনার বৈধ স্ত্রী ছিলেন না।

শাকার একটি স্কেচ; Source: deviantart.com

ফলে শাকার জন্ম হলে তাকে অবৈধ সন্তান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তাকে ও তার মাকে সেঞ্জাংগাখোনার বাড়ি হতে নির্বাসিত করা হয়। নির্বাসিত হওয়ার পর তারা লাঙ্গেনি সম্প্রদায়ে আশ্রয় নেন ও সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তবে অবৈধ সন্তানকে এঙ্গুনি গোত্রের মধ্যে কখনোই ভালো চোখে দেখা হতো না। তাই ছোটবেলা থেকেই শাকাকে নানাভাবে নানা রকম নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করতে হতো।

লাঙ্গেনি সম্প্রদায়ের মানুষের এই নির্যাতন ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শাকাদের জীবন। ফলে সেখানে কিছুকাল থাকার পর শাকাকে নিয়ে তার মা লাঙ্গেনি সম্প্রদায় ত্যাগ করে একদিন থেথোয়া সম্প্রদায়ে এসে আশ্রয় নেন। সেসময় এই সম্প্রদায়ের নেতা ছিল ডিংগিশোইয়ো। এখানেই শাকা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন ও একসময় ডিংগিশোইয়োর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছোট থেকেই যুদ্ধের প্রতি শাকার ছিল অদম্য আগ্রহ। ফলে সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন খুব শীঘ্রই শাকা যুদ্ধের নানা কৌশল রপ্ত করে নেন। শুধু তা-ই না, তার চমৎকার দৈহিক গড়ন আর কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে খুব শীঘ্রই তিনি ধীরে ধীরে উপরের পদ লাভ করতে থাকেন এবং একসময় তিনি প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। অন্যের উপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ দক্ষতা গড়ে ওঠে তার ভিতর।

একটি জুলু গ্রাম; Source: wikimedia.org

১৮১৬ সালের কোনো এক সময় শাকার বাবা মারা যান। ফলে গ্রামের নতুন সরদার কে হবে তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। এসময় ডিংগিশোইয়ো তার শিষ্য শাকাকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তার সাহায্যেই শাকা তার বড় ভাইদের হত্যা করে ও তাড়িয়ে দিয়ে জুলু গ্রামের সরদারি দখল করে নেন। এসময় জুলু সম্প্রদায় ছিল খুবই ক্ষুদ্র। গোটা সম্প্রদায়ে প্রায় ১,৫০০ জনের মতো মানুষ ছিল তখন। তবে শাকার শাসনকালে সবকিছুই ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে।

রাজত্ব লাভের পর বসে না থেকে শাকা কিছু সময়ের মধ্যেই তার পার্শ্ববর্তী সম্প্রদায়টি জয় করে নেন। এই যে শুরু হলো, এভাবে একটি একটি করে নানা সম্প্রদায়কে নিজের শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন শাকা। তার দখলকৃত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সেই ছোটবেলায় কিছুকাল কাটানো লাঙ্গেনি সম্প্রদায়টিও ছিল, যারা একসময় নির্যাতন করেছিল শাকাকে। সেনাবাহিনী গঠনের চমৎকার দক্ষতার কারণে শাকা সামরিকভাবেও খুব দ্রুত সফলতা লাভ করেন। তিনি তার সৈন্যদের জন্য নতুন রণকৌশল ও নতুন অস্ত্র চালু করেন। তার সৈন্যদলের ব্যবহৃত নতুন অস্ত্রের নাম ছিল ‘ইকলোয়া’। ইকলোয়া হলো ছোটখাটো বর্শার মতো একটি অস্ত্র, তবে এর বিশেষত্ব হলো এর বিশেষ লম্বা ও ধারালো ফলা। প্রতিপক্ষের জন্য এই আসেগাই ছিল এক আতঙ্কের নাম। এর আঘাত প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছিল প্রাণঘাতী। শুধু অস্ত্র নয়, তার সৈন্যদলের প্রতিটি যোদ্ধা ছিল মানসিক বলে বলিয়ান। প্রতিটি যুদ্ধ কিংবা অভিযানে যাওয়ার আগে শাকা তার সৈন্যদলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিতেন, “জয় অথবা মৃত্যু”। অর্থাৎ, হয় জিততে হবে নয়তো মরতে হবে।

একজন জুলু যোদ্ধার স্কেচ; Source: wikimedia.org

শাকার সেনাবাহিনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নিয়মানুবর্তিতা। চমৎকার সব নিয়ম মেনে চলতে হতো এই সেনাবাহিনীর সদস্যদের। যেমন, সৈন্যদলের কেউই কোনো জুতা পায়ে দিতে পারবে না। এই নিয়মের পিছে শাকার উদ্দেশ্য ছিল যাতে সকল সৈন্য খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি কিংবা দৌড়াদৌড়ি করে তাদের পাকে আরো মজবুত করতে পারে। আর এই নিয়মের ফলেই জুলু সেনাবাহিনী একসময় সেখানকার সবচেয়ে গতিময় সেনাবাহিনীতে রূপ নেয়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের সেনাবাহিনীর থেকে জুলু সেনাবাহিনী এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে যায়।

এভাবে যত দিন যায় তত নতুন নতুন সম্প্রদায় জুলু সম্প্রদায়ের সাথে একত্রিত হতে থাকে। কোনো যুদ্ধে যে-ই বেঁচে থাকতো তাকে জুলুদের একজন করে নেওয়া হতো। আর কেউ জুলুদের সাথে যোগ দিতে অস্বীকার করলে তাকে অন্য স্থানে চলে যেতে হতো। এমনি করে ১৮২৩ সাল আসতে আসতে বদলে যায় জুলু সম্প্রদায়ের অবস্থা। এটি তখন আর কোনো তুচ্ছ রাজ্য নয়, বরং ভারতীয় সাগরের উপকূল জুড়ে ১১,৫০০ বর্গ মাইলের এক বিশাল সাম্রাজ্যের রূপ নেয় জুলু।

যুদ্ধে জুলু যোদ্ধাদের আসেগাই ব্যবহার; Source: pinterest.com

তবে মজার ব্যাপার হলো, নিজের মানুষের কাছে অত্যাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত শাকা কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন। ১৮২৪ সালে একদল সাদা চামড়ার ব্যবসায়ী নাটাল বন্দরে এসে পৌঁছায়। শাকা এই ব্যবসায়ীদের স্বাগত জানাতে কিছু প্রতিনিধি পাঠান ও তাদের বসবাসের জন্য নিজের এলাকায় কিছু জায়গা দেন। নতুন আগত এই মানুষগুলোর প্রতি শাকার ছিল আগ্রহ। হয়তো তিনি তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তবে একসময় তিনি এই বাইরের ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার শাসনকালে তাদের সাথে শাকার কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি।

জীবনের শেষের দিকে এসে শাকা তুমুল অত্যাচারী ও নির্দয় হয়ে পড়েন। ১৮২৭ সালে শাকার মা নান্দি মারা গেলে ঘটে এক বিপত্তি। তার মায়ের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে শাকার হঠাৎ মনে হয় কিছু কিছু মানুষ যথেষ্ট শোক পালন করছে না। ফলে ভীষণ রেগে যান শাকা। তার এই রাগ একসময় ধীরে ধীরে পাগলামিতে রূপ নেয়। এবং তিনি শত শত জুলুকে হত্যা করেন। শোনা যায়, স্বামীর সাথে সাথে গর্ভবতী স্ত্রীদেরও হত্যার আদেশ দেন তিনি। শাকা কখনো বিয়ে করেননি। তার কোনো বৈধ সন্তানও ছিল না। তার সন্তান জন্ম নিলে সে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে রাজ্য দখল করে নেবে এই ভয়েই তিনি কখনো বিয়ে করেননি। তবে অনেক রক্ষিতা ছিল তার। আর কোনো রক্ষিতা যদি কখনো গর্ভবতী হয়ে পড়তো সাথে সাথে তাকে হত্যার আদেশ দিতেন শাকা। এছাড়াও পূর্বে যারা তার কিংবা তার মায়ের সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করেছিল তাদেরকেও খুঁজে খুঁজে নৃশংসভাবে হত্যা করেন তিনি।

শাকা জুলুর একটি মূর্তি; Source: ancient-origins.com

আর এ ধরনের ঘৃণ্য কাজের ফলেই তার পতন এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে। একসময় শাকার নিজের ভাইয়েরাই তাকে হত্যার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ১৮২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শাকার এক সৎ ভাই তাকে হত্যা করে এবং কোনো এক অজানা স্থানে তার দেহ মাটির নিচে সমাধিস্থ করে ফেলে। এরপর সে হয় জুলু সম্প্রদায়ের নতুন রাজা। এভাবেই পতন ঘটে জুলু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শাকার। শাকার এই জীবন কাহিনী ও তার বর্বরতার গল্প এখনো আফ্রিকায় প্রচলিত। এর মধ্যে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তা নিয়ে অবশ্য অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।

ফিচার ইমেজ – pinterest.com

Related Articles