বিজ্ঞানের জগতে আর্কিমিডিস এক চিরপরিচিত নাম। তার কথা উঠলে যে দৃশ্যটি প্রথমে ভেসে ওঠে, তা হচ্ছে একজন লোক গোসলখানা থেকে নগ্ন অবস্থায় “ইউরেকা, ইউরেকা” চিৎকার করতে করতে গ্রিসের রাস্তা মাতাচ্ছেন। একাধারে গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী, আবিষ্কারক ও অস্ত্র নির্মাতাকারী, কী ছিলেন না তিনি!
অসম্ভব প্রতিভাবান এবং সময়ের অগ্রবর্তী এই মানুষটি জন্মেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৭ সালে। জন্মস্থান তার ভূমধ্যসাগরের সিসিলি দ্বীপে। সেসময় এ দ্বীপের নামকরা শহর ছিল সিরাকিউজ এবং জায়গাটিতে ছিল গ্রিকদের বসতি। ভৌগোলিক কারণে আদর্শ শহর হওয়ায় সিরাকিউজকে যুদ্ধের কবলে পড়তে হয়েছে অনেকবার। আর্কিমিডিসের সময়েও রোমের সাথে সিরাকিউজের যুদ্ধ সৃষ্টি হয়। যার নেই কোনো যুদ্ধশিক্ষা, না তিনি ছিলেন সেনাপতি; শুধু বুদ্ধির জোরে আটকিয়ে রাখলেন সেকালের সেরা রোমান বাহিনীকে। নগররক্ষার জন্য আর্কিমিডিস যে চমকপ্রদ ব্যবস্থাগুলো করে রেখেছিলেন, রোমান বাহিনী তা কল্পনাও করতে পারেনি। আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের গল্প আমরা কম-বেশি সবাই জানি, আজ বলা হবে তার যুদ্ধের গল্প।
খানিকটা ইতিহাস
সিসিলির পূর্ব উপকূলে করিন্থিয়ান এবং টিনিয়ান গ্রিকরা খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩৪ সালে সিরাকিউজ নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তৎকালীন প্রাচীন গ্রিসে ঘটে যাওয়া পরাশক্তিগুলো যুদ্ধের মাঝে এটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল এবং সেসময় অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আয়নিয়ান সাগরের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় সিরাকিউজ জায়গা হিসেবে আদর্শ এবং আকর্ষণীয় ছিল। এ আকর্ষণ পেয়ে বসে এথেন্সকে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ সালে স্পার্টার সাথে পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে সিরাকিউজ আক্রমণ করে বসে এথেন্স।
অবশ্য শুধু আকর্ষণই নয়, স্পার্টার সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়াই মূলত এর উদ্দেশ্য ছিল। যেহেতু সিরাকিউজ ছিল সিসিলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধশালী শহর। এজন্য সিরাকিউজকে অধিগ্রহণ করতে পারলে স্পার্টার সাথে জয় পাওয়াটা এথেন্সের জন্য আরও নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু উল্টো তারা দুর্বিপাকে পড়ে যায় এবং সিরাকিউজ অধিগ্রহণে ব্যর্থ হয়। স্পার্টার সাথে যুদ্ধকালীন অবস্থায় এ পরাজয় পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে স্পার্টার জয়ী হওয়ার জন্য ছিল একটি সন্ধিক্ষণ।
এ বিতর্কিত অবস্থা চলমান থাকা সত্ত্বেও সিরাকিউজ বিজ্ঞান, শিল্প ও বাণিজ্যের বাতিঘরে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে এটি যে সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের চূড়ায় পৌঁছেছিল, তা এথেন্সকেই প্রতিদ্বন্দ্বিত করে। আর্কিমিডিসের সময়ে এসেও সিরাকিউজ তার ঐতিহ্য-খ্যাতি ধরে রেখেছিল।
পেলোপনিসিয়ান যুদ্ধের পর সিসিলি পুনরায় আঘাতের সম্মুখীন হয় প্রথম পিউনিক যুদ্ধ বা কারথাজিনিয়ান যুদ্ধে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৪ সাল থেকে শুরু হয়ে ২৪১ পর্যন্ত রোম ও কার্থেজের মাঝে এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় রোমই। এরপর সিসিলি চলে যায় রোমের নিয়ন্ত্রণে, যদিও দ্বীপটি রোমান রিপাবলিকের একটি প্রদেশে পরিণত হয়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিরাকিউজ তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে এবং ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।
রাজা দ্বিতীয় হিরোঁর শাসনামলে রোমের সাথে সিরাকিউজ শান্তিপূর্ণ পর্যায় অতিবাহিত করে এবং আর্কিমিডিসও রাজার সঙ্গে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। ফলে রাজা হিরোঁও তার রাজ্যের নানা জটিল সমস্যা সমাধানে আর্কিমিডিসের সহায়তা নিতেন। জটিলতার সৃষ্টি হতে থাকে ২১৫ খ্রিস্টপূর্বে রাজার মৃত্যুর পর।
রাজা দ্বিতীয় হিরোঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার নাতি হিরোঁনিমাস। হিরোঁনিমাসের অধীনে সিরাকিউজে কারথাজিয়ানপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার অধীনে সৃষ্ট আন্দোলনে তিনিসহ আরও কয়েকজন নেতার হত্যা হয়। জন্ম হয় একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের এবং তৈরি হয় কার্থেজের সাথে নতুন সম্পর্ক। শাসনক্ষেত্রে এ পরিবর্তন রোম সম্রাটকে চিন্তায় ফেলে দেয়। সিসিলির এই নতুন ক্ষমতাকে তিনি হুমকি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং শেষমেশ খ্রিষ্টপূর্ব ২১৪ সালে, দুই রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধের সূচনা
যদিও রোম তখন দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ লড়তে ব্যস্ত ছিল, কিন্তু এর মাঝেও তারা সময় ভাগ করে নেয় সিরাকিউজকে আক্রমণ করার জন্য। সিরাকিউজ আক্রমণ করার জন্য তখন সাগরপথে যাত্রা শুরু করেন সেকালের অন্যতম সেরা সেনাপতি মার্কাস ক্লডিয়াস মার্সেলাস।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় হিরোঁ বেচে থাকতেই তিনি আর্কিমিডিসকে শহর প্রতিরক্ষার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং সেসময় রক্ষাব্যূহের যন্ত্রাংশও তৈরি করিয়েছিলেন। একদিকে দুর্ধর্ষ রোমান বাহিনী, অন্যদিকে সিরাকিউজের সামান্য সৈন্য-সামন্ত। তাই যুদ্ধ করতে আর্কিমিডিসের সাথে এগিয়ে এসেছিল সাধারণ নাগরিকরাও।
কিন্তু মার্সেলাস যতবারই আক্রমণ করতে চাইলেন, ততবারই তাকে প্রতিহত করা হলো। আর্কিমিডিসের তৈরি লিভার দিয়ে সিরাকিউজের সৈন্যরা রোমান বাহিনীর উপর ছুঁড়তে লাগল বিরাট বিরাট পাথর। আর এসব যন্ত্র দ্বারা যে শব্দ তৈরি হচ্ছিল, তাতেই আরও পিছপা হয়ে গেল রোমের সৈন্যরা।
প্লুটার্ক, লিভি, পলিবিয়াসের মতো ইতিহাসবিদ থেকেও এ যুদ্ধ সম্পর্কে যা জানা যায়, তা শুনলে হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হবে অনেকের। তাদের বিবরণই বলে দেয়, আর্কিমিডিস এ যুদ্ধে কতটা গুরুতর প্রভাব ফেলেছিলেন। আর্কিমিডিসের সব প্রস্তুতি দেখে মার্সেলাসও বুঝে গিয়েছিলেন, এ যুদ্ধ ঢাল-তলোয়ারের নয়, বিজ্ঞানের। তাই তিনিও যুদ্ধব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে শুরু করলেন; তবে আর্কিমিডিসের সাথে পেরে ওঠা গেল না।
আর্কিমিডিস দুর্গের দেয়ালে লাগিয়েছিলেন বিশাল আকারের আয়না। জানা যায়, আয়নাগুলো সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে রোমান বাহিনীর জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিতে পারত। আরেকটি আবিষ্কার, যাকে ইতিহাসবিদরা নাম দিয়েছেন 'আর্কিমিডিসের থাবা'; এর ছিল ক্রেনের মতো বিশাল হুক, যা প্রাচীর থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারত। প্লুটার্কের মতবাদ অনুযায়ী, যন্ত্রটি একটি সম্পূর্ণ জাহাজকে পানি থেকে তুলে আবার ছেড়ে দিত। আর এর পরিণতি কী হতো, তা হয়তো পাঠক কল্পনাই করতে পারছেন।
অবরোধের সরঞ্জাম এবং কামান ছিল রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আর্কিমিডিসের প্রাথমিক অস্ত্র। তিনি এমনভাবে কামান বসিয়েছিলেন যে সেগুলো অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ দূরত্বেও নিখুঁতভাবে আঘাত করতে পারত। এছাড়া আরও ছোট ছোট কামানও তিনি বসিয়ে রেখেছিলেন দুর্গের সামনের দিকে। এগুলোর কাজ ছিল শুধু সৈন্যদের আঘাত করা। মার্সেলাস ধীরে ধীরে দিশেহারা হয়ে পড়তে লাগলেন। প্রায় দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে আর্কিমিডিস দুর্ধর্ষ রোমান বাহিনীকে অবরোধ করে রাখলেন। সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তির কাছে কাবু হয়ে পড়ল রোমান বাহিনী।
শেষের শুরু
খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে রোমান সৈন্যরা দেয়াল বেয়ে উঠতে সক্ষম হলেও তারা ভয়ে ছিলেন, আর্কিমিডিস তাদের জন্য কোনো ফাঁদ পেতে রেখেছেন কি না। কিন্তু সেবার আর্টেমিসের উৎসবের কারণে সিরাকিউজের সেনারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে, আর এ সুযোগে কিছু বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় রোমান সৈন্যরা সিরাকিউজে ঢুকে পড়ে।
যুদ্ধে শত্রু হলেও আর্কিমিডিসের প্রতি মার্সেলাসের অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল। তিনি সৈন্যদের আদেশ দিয়েছিলেন, আর্কিমিডিসের যেন কোনো ক্ষতি না করেই তার সামনে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হয়নি।
সৈন্যরা যখন আর্কিমিডিসের সামনে এসে হাজির হয়, তখন আর্কিমিডিস বালিতে জ্যামিতির আঁকিবুঁকি নিয়ে ব্যস্ত। তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হলো, কিন্তু জ্যামিতির সমস্যা সমাধান নিয়ে তিনি এতই মগ্ন ছিলেন যে সৈন্যের কথা তার গায়েই লাগল না। তিনি না তাকিয়েই বললেন, “এখন আমাকে বিরক্ত করো না”। সৈন্যরা আর্কিমিডিসকে চিনতে পারেনি, বিজয়ের গর্বে তখন উন্মাদ হয়ে তারা তলোয়ার চালিয়ে দিল।
মার্সেলাস যখন এ খবর পেলেন, তিনি বেশ অনুতপ্তই হয়েছিলেন। আর্কিমিডিসের জন্য তিনি তৈরি করলেন একটি সমাধি-সৌধ, এঁকে দিলেন তাতে আর্কিমিডিসের সবচেয়ে প্রিয় জ্যামিতিক আঁকটি।
আজ থেকে দু'হাজারেরও বেশি বছর আগে জন্ম নেওয়া মানুষটি যা করে গেছেন, তা আজও ভাবলে অবাক করে দেয়। বিজ্ঞানকে লালন করে তিনি অভিনব সব আবিষ্কার আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, যা আজও আমরা পড়ছি ও ব্যবহার করছি। বিজ্ঞান যতদিন থাকবে, ততদিন সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যাবেন আর্কিমিডিস। তিনি বুঝিয়ে গিয়েছেন, বিজ্ঞান শুধু কলম-কাগজে থাকার বস্তু নয়, বিজ্ঞান কাজে লাগে মানুষের এবং দেশের সেবায়।
This bengali article is about The Siege of Syracuse by the Roman Republic that took place in 214–212 BC and how Archimedes alone almost defeated Roman Army by using science.
References:
1. How a Mathematician Stopped the Roman Army: The Siege of Syracuse
3. Siege of Syracuse | Summary | Britannica
Featured Image: Getty Images