মামলুক সুলতান বাইবার্সকে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি স্বরণ করা হয় একজন ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে। সেই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি তামাম দুনিয়ার সেনাপতিদের আইডল হয়ে আছেন রণক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের গুণাবলির কারণে। তার কূটনৈতিক কৌশল ছিল সেই সময়ে অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
বাইবার্স ছিলেন চতুর্থ মামলুক সুলতান এবং মামলুক শাসকদের ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিনি মিসর এবং সিরিয়া শাসন করেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তারপর নিজের গড়া 'বাহরি সাম্রাজ্যের' গোড়াপত্তন করেন।
একজন সুলতান হিসেবে সাফল্যের সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো তার জন্য কখনোই সহজসাধ্য ছিল না। একজন ক্রীতদাস থেকে সিংহাসনের অধিপতি হওয়ার পেছনে ছিল আকাশছোঁয়া স্বপ্নের বীজ, আর একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করার কঠিন অধ্যবসায়। লড়েছেন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে, তলোয়ার তুলে নিয়েছিলেন ভূপৃষ্ঠের ত্রাস মঙ্গোল বধের গল্প রচনা করতে।
আজ আমরা বাইবার্সের ক্রীতদাস থেকে সুলতান হওয়ার গল্প শুনব, আর শুনব কীভাবে তিনি মোঙ্গল আর ক্রুসেডারদের আধিপত্য, সকল অংহকারকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
বাইবার্সের পুরো নাম আল মালিক আল জহির রুকন আল-দীন বাইবার্স আল বান্দুকদারী। ১২২৩ সালে ব্ল্যাক সি এর উত্তরে কিপচাক তুর্কসে জন্মগ্রহণ করেন। মোঙ্গলরা যখন কিপচাক তুর্কসে আক্রমণ করে, তখন অন্যদের মতো বাইবার্সকেও ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে মিশর ও সিরিয়ার সুলতান নাজম আল-দীন-আইয়ুব অন্যান্য ক্রীতদাসদের সাথে কিনে নেন।
সুলতান নতুন ক্রীতদাসদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত করেন সবসময়। এবারও নতুন কিনে আনা ক্রীতদাসদের প্রশিক্ষণের জন্য নাইলে পাঠিয়ে দেন। এখানে তাদের সুলতানের সৈনিক হিসেবে তৈরি করা হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় থেকেই বাইবার্স সবার নজর কেড়ে নিতে সমর্থ হন। অন্যদের চেয়ে তার আলাদা নৈপুণ্য আর পরিশ্রমী মানসিকতার কারণে সেরা হিসেবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করেন। তাকে সুলতানের ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং একটি ছোট দলের কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।
সিংহাসনে আরোহণ
১২৪৯ সালে ফ্রান্সের রাজা লুইস মিশরে নবম ক্রুসেডের সূচনা করেন। পোর্ট সিটি ডামিয়েটার পতন হলে লুইসের সেনাবাহিনী নভেম্বরে কায়রোর দিকে যাত্রা করে। ঠিক একই সময়ে সুলতান আল-দীন-আইয়ুবীর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ক্রুসেডাররা কায়রোর দিকে যাত্রা করলেও মিশরকে নিজেদের করতলে আনার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের। তারই ধারাবাহিকতায় ১২৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংগঠিত আল মানসুরার যুদ্ধে ক্রুসেডাররা পরাজিত হয়। রাজা লুইসকে বন্দি করা হয় এবং পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আর এই যুদ্ধে ক্রুসেডারদের বিপক্ষের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন বাইবার্স। এটি তার জন্য কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাবার পরপরই একটি বড় বিজয়।
আল-দীন আইয়ুবী ছিলেন আইয়ুবী সাম্রাজ্যের শেষ যোগ্যতম শাসক, যিনি সফলভাবে মিশর এবং সিরিয়া শাসন করতে পেরেছেন। পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত হন আল-মোহাজ্জেম তুরানশাহ, যদিও তিনি কিছুদিনের ভেতর মামলুকদের হাতে নিহত হন। যোগ্যতম শাসকের অভাবে এখানেই আইয়ুবী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং শাসনক্ষমতা চলে যায় মামলুকদের হাতে। মামলুক সালতানাতের প্রথম সুলতান হন আইবেক। সুলতান আইবেকের সাথে বাইবার্সের পূর্ব শত্রুতা ছিল। যার জেরে তিনিসহ তার অনুগত বাহিনী নিয়ে সিরিয়ায় গা ঢাকা দেন এবং বেশ কিছু বছর এভাবেই কাটান।
১২৬০ সালে মামলুকদের তৃতীয় সুলতান কুতুজের আমন্ত্রণে বাইবার্স আবার মিশর গমন করেন। তাকে স্বপদে বহাল করা হয় এবং তার বাহিনীর থাকার জন্য একটি গ্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঠিক সেই সময় মোঙ্গলরাও মিশর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময়ের দুই শক্তিধর যোদ্ধা জাতি পরস্পর মুখোমুখি হয় প্যালেস্টাইনের জিজরিল উপত্যকায়, ইতিহাসে যা আইন জালুতের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই যুদ্ধে বাইবার্স মামলুকদের কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন এবং পুরো যুদ্ধজুড়ে তার অসাধারণ নেতৃত্বগুণ সকলের নজর কেড়ে নেয়। বড় বড় মোঙ্গল নেতাকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার হিসেবে বাইবার্স সিরিয়ার আলেপ্পো উপহার হিসেবে চাইছিলেন, কিন্তু সুলতান এতে রাজি ছিলেন না। মামলুক সুলতান কুতুজ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি, ফেরার পথে বাইবার্সের কথিত একদল আততায়ীর হাতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে।
সুলতান হিসেবে বাইবার্স
সুলতান কুতুজের মৃত্যুর পর মিশরের সুলতান হন বাইবার্স। সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি নজর দেন সিরিয়ায় ঘাঁটি তৈরি করা ক্রুসেডারদের প্রতি। তিনিও সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অনুকরণে তার সেনাবাহিনীকে তৈরি করেন। ১২৬৫-৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে সিরিয়ায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন তিনি। ফলে এসব অঞ্চলে দীর্ঘসময় ধরে থাকা ক্রুসেডাররা ভেতর থেকে দুর্বল ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে।
১২৬৬ সালের জুলাইয়ে বাইবার্স সাফেদ অবরোধ করেন, নাইট টেম্পলার গেরিসন হার স্বীকার করে নিলে সাফেদ মামলুকদের অধিকারে চলে আসে। এর দুই বছর পর জাপ্পা অভিমুখে সেনাবাহিনী পাঠালে সেটাও বিনা বাধায় জয় করে নেয় তারা। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বাইবার্সের সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল 'আন্তিওচ' এর দখল নেওয়া। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বহু আগে থেকে মুসলিম এবং ক্রুসেডাররা একে অপর উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাইবার্স আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান এবং মোঙ্গলদের বিরুদ্ধেও দফায় দফায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং সফলও হন। এসব অভিযান মামলুকদের শক্তি, সামর্থ্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল বহুগুণ। এককালের প্রতাপশালী মোঙ্গলবাহিনী আর মুসলিম বিশ্বকে কোণঠাসা করে ফেলা ক্রুসেডাররা বাইবার্সের দোড়গোড়ায় এসে যেন নিভে যাচ্ছিল। তারা তাদের আগের জৌলুশ আর কখনো ফিরে পায়নি। ইসলামি সভ্যতা নিরাপত্তা পেয়ে আবারও তাদের ডালপালা মেলতে শুরু করে। যেখানে একসময় চতুর্মুখী আক্রমণে মুসলিমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই নিজের বাহু মেলে ধরে মুসলিমদের হারানো সম্মান ফেরাতে শুরু করেন বাইবার্স।
সমরে সুলতান বাইবার্স ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্বগুণে মুগ্ধতা ছড়াতে থাকেন। তার নেতৃত্বদানের বাইরেও আরও একটি গুণ ছিল। কূটনৈতিকভাবেও সফল বাইবার্স বিশাল বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে তারই প্রমাণ দেন। বাইজেনটাইন বসফরাস দিয়ে নৌপথে মিশরীয়দের পণ্য আমদানি-রফতানির সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি আশপাশের রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেন তিনি। বিভিন্ন রাজ্যে রাজপ্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে তাদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরির দিকে নজর ছিল তার। মামলুকদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দেন বাইবার্স।
তিনি যেহেতু একজন ভিনদেশি ছিলেন, তাই একটি রাজ্যের অভ্যন্তরভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেটা তিনি জানতেন। তিনি রাজ্যের ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দ্রুততর করার জন্য কায়রো এবং দামাস্কাসের ভেতর পোস্টাল সার্ভিস চালু করেন। ফলে বিশাল একটি অঞ্চলজুড়ে ত্বরিত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়। মাত্র চারদিনের ভেতর এসব এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। ইসলামী শরিয়ার চারটি প্রধান প্রতিষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন এবং রাজ্যজুড়ে অসংখ্য খাল খনন করেন। নিজের নামে অনেকগুলো মসজিদ এবং লাইব্রেরিও গড়ে তোলেন বাইবার্স।
বাইবার্স অবসর পেলেই শিকারে বেরিয়ে পড়তেন সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে। প্রতিযোগিতামূলক যেকোনো খেলাই তাকে আকর্ষণ করতো। তার আনুকূল্যে কায়রোতে শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি ঘটে, বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তিনি উৎসাহিত করতে থাকেন সবাইকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আধুনিকতাকে বাদ দিয়ে নিজেদের এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যদিও তিনি আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিতেন, কিন্তু আদতে তিনি ইসলামি অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করতেন।
এই মহান মামলুক সুলতান ১২৭৭ সালে দামাস্কাসে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু হয়েছিল বিষপানে, যা তিনি ভুলবশত পান করেছিলেন। পরে তাকে তারই গড়া দামাস্কাসের জহিরিয়া লাইব্রেরিতে শায়িত করা হয়। আজও লাইব্রেরির গম্বুজের নিচে তার সমাধি অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
This article is about mamluk sultan baibers, who defeated mongols and cruseders!
Sources:
1. From slave to sultan- ancient origin
2. The slave warriors who saved muslim world- bahath
3. baybars I- Britannica
4. Baibers: the father of conquest- ummah
Featured Image: ancient-origins.net