Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুখ্যাত কয়েকজন লাতিন একনায়ক

একনায়ক বা স্বৈরশাসক বলতে এমন নেতাকে বোঝায় যিনি রাষ্ট্রের সকল সংস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার সকল কাজে স্বেচ্ছাচার করেন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো একনায়কদের কবলে পড়ে কম দুর্ভোগ পোহায়নি। ঐতিহাসিকভাবেই এই দেশগুলোর সরকার ব্যবস্থা দুর্বল আর দুর্নীতিগ্রস্থ। বৈচিত্র্যময় এই অঞ্চল শাসন করার জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার না থাকায় লাতিন আমেরিকার ইতিহাস বারবার বিদ্রোহ আর রক্তপাতে রঞ্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এসব দেশের ইতিহাসে ঘন ঘন দেখা দিয়েছেন অত্যাচারী আর নৃশংস সব শাসকেরা। উল্লেখ্য, ফিদেল ক্যাস্ট্রো বা সিমন বলিভারের মতো ব্যক্তিত্বদের এই তালিকায় রাখা হয়নি, কেননা তাদের মূল্যায়নের ব্যাপারে জনমত অতিরিক্ত মাত্রায় দ্বিধাবিভক্ত।

আনাসতাসিয়ো সমোজা দিবায়লে

দেশ: নিকারাগুয়া

শাসনকাল: ১২ বছর

আনাসতাসিয়ো সমোজা দিবায়লের বাবা ও বড় ভাই মিলে ৩১ বছর ধরে নিকারাগুয়ার মসনদ কব্জা করে রেখেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ক্ষমতায় এসে দিবায়লে দেখিয়ে দিলেন দুর্নীতি বা অত্যাচারে তিনি তাদের থেকে অনেক বেশি দক্ষ। সমোজা পরিবারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দহরম মহরম ছিল। একই সাথে কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোসহ বাম ঘরানার লাতিনদের কাছে তিনি ছিলেন চক্ষুশূল।

আনাস্তাসিয়ো সমোজা ডিবায়লে; Image Source: International Center of Photography

সমোজার শাসনকাল ছিল মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতিতে ভরপুর। দেশের মানুষের শিক্ষাদীক্ষার প্রয়োজন তিনি অনুভব করতেন না। তার ভাষ্যমতে, শিক্ষিত মানুষের থেকে ষাড়ের প্রয়োজন নাকি বেশি। ১৯৭২ সালে এক মারাত্মক ভূমিকম্পে রাজধানী মানাগুয়া পুরোপুরি গুঁড়িয়ে গেলে সমোজার কপাল খুলে যায়।

আন্তর্জাতিক রিলিফ পকেটে পুরে তিনি বিপুল ধনী হন। ১৯৭৯ সালে সমাজতান্ত্রিক সান্দানিস্তা গেরিলারা সমোজার শাসনকালের ইতি টানেন। সমোজা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। সাথে নিয়ে যান ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিকারাগুয়ার কোষাগার আক্ষরিক অর্থেই ফাঁকা করে দেন দুর্নীতিবাজ এই মানুষটি। সমোজা কিন্তু তার অপরাধের উচিত শাস্তিই পেয়েছিলেন। সান্দানিস্তারা তাদের শত্রুকে নজরে নজরে রেখেছিল।

সান্দিনিস্তা গেরিলা; Image Source: Pinterest

যুক্তরাষ্ট্র সমোজাকে আশ্রয় দেয়নি। তিনি গেলেন প্যারাগুয়েতে, আরেক স্বৈরশাসক আলফ্রেডো স্ট্রয়েসনারের কাছে। সেখানে র‍্যাঞ্চ খুলে দিব্যি আয়েশে ছিলেন দিবায়লা। তবে বছরখানেকের মধ্যেই বেচারা নিজের বিলাসবহুল গাড়িটিসহ নিজেকে আবিষ্কার করলেন সাতজন সান্দানিস্তা গেরিলার অ্যাম্বুশের মাঝে। আরপিজির আঘাতে সমোজা ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। উল্লেখ্য, তার বাবাও একজন কবির হাতে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

পোরফিরিও ডিয়াজ

দেশ: মেক্সিকো

শাসনকাল: ৩৫ বছর

১৮৭৬ সালে ক্ষমতায় বসবার পর টানা ৩৫ বছর মেক্সিকো শাসন করেছেন জেনারেল পোরফিরিও ডিয়াজ। তার শাসনামলকে বলা হয় পোরফিরিওতো। ১৮৭৬ সালে ক্ষমতায় বসবার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। ৮ বার মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ডিয়াজ তার কড়া শাসননীতির জন্য কুখ্যাত। তবে তার আমলে মেক্সিকানদের জীবনযাত্রার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়।

জেনারেল ডিয়াজ; Image Source: A&E Biography

১৮৩০ সালে মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন ডিয়াজ। ১৮৬২ সালে ফরাসি অনুগ্রহপুষ্ট সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিপক্ষে যুদ্ধে নামেন তিনি। ঐবছরই পুয়েবলোর যুদ্ধে মেক্সিকানরা ফরাসিদের পরাস্ত করে। জেনারেল ডিয়াজ যুদ্ধে তার দক্ষতার কারণে বিশেষ খ্যাতি পান। মেক্সিকোর সম্রাট বেশ কয়েকবার তাকে রাজসেনাদলে যোগ দিতে অনুরোধ করেন কিন্তু সম্রাটের সেনাদলে তিনি ফিরে গেলেন না। অনেকগুলো যুদ্ধ ও বারদুয়েক বন্দীত্ব বরণ করার পর, ১৮৭৬ সালে তার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হন। ডিয়াজ সে আমলে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিলেন। পরের বছর তিনি মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

ডিয়াজের শুরুর দিকের জনপ্রিয়তা অবশ্য পরে কমতে থাকে। মেক্সিকান সমাজে তার আনা সংস্কারগুলো যে আলোড়ন তুলেছিল তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তার। মার্কিন অর্থনীতির ওপরে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে মেক্সিকোতে ১৯০৭ সালে বড় ধরনের মন্দা দেখা দেয়। ব্যাংকিং খাতে গুটিকয় পুজিঁপতিদের আধিক্য এই সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯১১ সালে বিখ্যাত মেক্সিকান বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন বহু জাল নির্বাচনের হোতা এই একনায়ক। ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় চার বছর পরে তার মৃত্যু হয়।

অগুস্তো পিনোশে

দেশ: চিলি

শাসনকাল: ১৭ বছর

অগুস্তো পিনোশেকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিলির ক্ষমতা দখল করেন আয়েন্দেরই ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত পিনোশে। ক্ষমতা দখল করেই চিলির বাম ঘরানার ওপরে উতকট দমন নিপীড়ন চালান পিনোশে। আতাকামা মরুভূমির মধ্য এসব বন্দীদেরকে রাখা হতো।

চিলির সিক্রেট পুলিশ দিনা নৃশংসতার জন্য বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। বন্দীদের পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া, ধর্ষণ বা অনাহার ছিল নিত্য সঙ্গী। দিনা এজেন্টরা খোদ ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়ে আয়েন্দের ঘনিষ্ঠজন অরল্যান্ডো লেতেলিয়েরকে খুন করার পরও বিশ্বরাজনীতি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।

পিনোশে; Image Source: SFGate

পিনোশে চিলির অর্থনীতি ছেড়ে দেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গ্র্যাজুয়েটের হাতে। শিকাগো বয়েজ নামে পরিচিত এই শিক্ষিত চিলির অর্থনীতিবিদগণ ছিল শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যানের শিষ্য। ফ্রিডম্যান মুক্তবাজার অর্থনীতি আর বেসরকারীকরণের কট্টর ভক্ত ছিলেন। তার শিষ্যরা ফ্রিডম্যানের তত্ত্বের জন্য চিলিকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করলেন। চড়লো বেকারত্ব, ধনী-গরিব বিভেদও বেড়ে গেল এর ফলে। অসন্তোষ বাড়লেও পিনোশে সহজে ক্ষমতা ছাড়েননি।

১৯৮৭ সালে চিলি জুড়ে এক গণভোট হয়। বেশিরভাগ মানুষ পিনোশেকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ১৯৯০ সাল নাগাদ ক্ষমতা ত্যাগ করনে তিনি। তবে এরপরও চিলির সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আরো ৮ বছর তিনি সক্রিয় ছিলেন। গণতান্ত্রিক চিলিতে পিনোশের প্রভাব তখনো ছিল অপরিসীম। অসুস্থতার অজুহাতে তাকে কখনোই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দেওয়া হয়নি। ২০০৬ সালে তার মৃত্যু হয়।

পিনোশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিনা বিচারে হত্যাসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে। সত্তরের দশকে তিনি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়েসহ কয়েকটি লাতিন দেশের একনায়কদের সাথে একত্রে ‘অপারেশন কন্ডোর’ এর সূচনা করেন। প্রায় আশি হাজার মানুষ মারা যায় এই কম্যুনিস্ট বিরোধী অপারেশনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচারের সাথে পিনোশের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। আগ্রহী দর্শক চাইলে পিনোশে বিরোধী গণভোট নিয়ে সৃষ্ট চলচ্চিত্র ‘নো’ দেখতে পারেন।

ম্যানুয়েল নরিয়েগা

দেশ: পানামা                   

শাসনকাল: ৬ বছর

ম্যানুয়েল নরিয়েগা কখনোই পানামার প্রেসিডেন্টের পদটি অধিকার করেননি। নিজের পছন্দের লোককে বসিয়ে আড়ালে থাকতেই পছন্দ করতেন পানামা সেনাবাহিনীর এই অফিসার। কলম্বিয়ার সাবেক প্রদেশ পানামার ইতিহাস উত্থান পতনে ভরপুর। এরই ধারাবাহিকতায় ম্যানুয়েল নরিয়েগা নামের এক অর্থলোভী অফিসারের পথ খুলে যায়। প্রতিবেশী নিকারাগুয়া আর এল সালভেদরের গৃহযুদ্ধে অস্ত্র চালান দিয়ে রাতারাতি বড়লোক বনে যান তিনি। ১৯৮৩ সালে পানামার মিলিটারির প্রধান হয়ে বসার পরে গোটা দেশ কার্যত তার হাতের মুঠোয় চলে যায়।

জেলে নরিয়েগা; Image Source: The Berkshire Eagle

ম্যানুয়েল নরিয়েগা একজন মার্কিন এজেন্ট ছিলেন। লাতিন অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ দেখাশোনার ব্যাপারে, বিশেষ করে মাদকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতেন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে নরিয়েগা পানামাকে লুটপাট আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। তবে এই বাড়াবাড়ি মার্কিনদের পছন্দ হয়নি।

নরিয়েগা গোপনে মাদক আর অস্ত্রের চোরাকারবার চালাতেন, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হয়েও সেদেশে বিপুল মাদক পাচার করতেন। ১৯৮৯ এর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবী হুগো স্পাদাফোরাকে খুন করা হলে বিশ্বে নরিয়েগার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। অনেকটা বাধ্য হয়ে মার্কিন বাহিনী সেই বছরই পানামায় হামলা চালায়। 

পানামার যুদ্ধ; Image Source: Carib Flame

৫ দিনের মাথায় নরিয়েগা পালিয়ে যান এবং ভ্যাটিকানের দূতাবাসে আশ্রয় নেন। ভ্যাটিকানের দূতাবাসে মার্কিন বাহিনীর প্রবেশ নিষেধ, কাজেই তারা সেখানে লাউডস্পিকারে তারস্বরে দিনরাত গান-বাজনা চালাতে লাগলো। দূতাবাসের পাশেই ঘন ঘন হেলিকপ্টার ওঠানামা করতো স্রেফ নরিয়েগাকে বিরক্ত করার জন্য। শেষমেষ ১০ দিনের মাথায় তিনি আত্মসমর্পণ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর পানামার জেলে সাজা খাটবার পর ২০১৭ সালে তার মৃত্যু হয়।

ফিচার ইমেজ – Los Angeles Times

Related Articles