ইংরেজি 'কাল্ট (Cult)' শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় অর্চনা বা কোনো কিছুর প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা। প্রায়োগিক অর্থে কাল্ট হলো যেকোনো ধরনের সংগঠন যা এক বা একাধিক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি বড় অংশের মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা জীবনাচরণ অনুসরণ করতে বাধ্য করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাল্টের নেতা ধর্মের শিক্ষা ও বিশ্বাস নিজের মনমতো ব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করেন ও মানুষকে আকৃষ্ট করেন। ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যার সাথে থাকে কাল্ট নেতার ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। কাল্টের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, অনুসারীদের বোঝানো হয় যে তারা কাল্টে যোগদানের মাধ্যমে সামাজিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, কাল্টগুলো তথাকথিত আধ্যাত্মিক নেতাদের অর্থ লুট, শোষণ ও যৌন নিপীড়নের হাতিয়ার মাত্র।
প্রিয় পাঠক, চলুন বিশ্বের এমনই কিছু অদ্ভুত কাল্টের কথা জেনে নেয়া যাক। আজ ৩য় পর্বে থাকছে মাতামোরোস-এর নরবলি দেয়া কাল্টের কথা।
মাতামোরোস এর নার্কো-স্যাটানিস্ট কাল্ট
আচ্ছা বলুন তো, অপরাধ করে আইনের ধরা-ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার জন্য নরবলি দেবার বুদ্ধিটা কেমন? নরবলি দিয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে খুশি করলেন আর পুলিশ আপনার টিকিটিও খুঁজে পেল না। বিদঘুটে শোনাচ্ছে তো? তবে এটাই কিন্তু ছিল মাদক ব্যবসায়ী ও কাল্ট নেতা এদলফো কন্সতাঞ্জোর অপরাধ করে পার পাওয়ার বুদ্ধি।
যেভাবে শুরু
বলি দেয়া ব্যাপারটির সাথে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত ছিলেন এদলফো কন্সতাঞ্জো। তার কিউবান মা ও নানী ছিলেন স্যান্তেরিয়া ধর্মের অনুসারী। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের সাথে আফ্রিকার বহু-ঈশ্বরবাদ মতবাদের সম্মিলনে স্যান্তেরিয়ার উদ্ভব। দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য প্রাণী উৎসর্গ করার রীতি ছিল এই ধর্মে। ফলে মাকে মুরগি, ছাগল ইত্যাদি বলি দিতে দেখে বড় হয়েছেন কন্সতাঞ্জো। ধীরে ধীরে নিজেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন ভুডু, কালো জাদু আর পালো মেয়ম্বে নামের একটি কিউবান-আফ্রিকান ধর্মের প্রতি। পালো মেয়ম্বে ধর্মেও প্রাণী উৎসর্গ করার চল আছে। একটি ডেকচিতে প্রাণীর হাড় ও অন্যান্য সরঞ্জাম রেখে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়, যাকে বলা হয় এনগাঙ্গা (nganga)। অতি উৎসাহীরা মানুষের হাড়ও দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়।
অতিপ্রাকৃত জগতের সাথে অপরাধ জগতও শৈশব থেকে কন্সতাঞ্জোর কাছাকাছি ছিল। মা ও সৎ বাবা প্রায়ই ছোটখাট চুরির জন্য পুলিশের কাছে ধরা পড়তেন। বলা যায় একটা অসুস্থ ও অস্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন কন্সতাঞ্জো।
১৯৮৪ সালের দিকে তিনি মেক্সিকো সিটিতে চলে যান ও জাদুটোনার পসার জমিয়ে বসেন। ঘটা করে প্রাণী উৎসর্গ করা এ কাজের বড় অংশ ছিল। আচারানুষ্ঠানের নাটকীয়তার জন্য মানুষ আকৃষ্ট হতে শুরু করে। শহরের নামিদামী রাজনীতিবিদ, তারকা ও মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। কন্সতাঞ্জোর কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে, এরকম একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। ভক্ত সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন কন্সতাঞ্জো যে তিনি 'দ্য গডফাদার' উপাধি পেয়ে যান। এভাবে কাল্ট পুরোদমে চালু হয়ে গেল। এ সময় থেকে প্রাণীর বদলে কবর থেকে চুরি করা মৃতদেহের হাড় আচারানুষ্ঠানে ব্যবহার হতো।
সারা অল্ড্রেট - দ্য গডমাদার
গডফাদার তো পাওয়া গেল, এরপর ষোলকলা পূর্ণ করার জন্য গডমাদার হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হলেন সারা অল্ড্রেট।
টেক্সাস সাউথমোস্ট কলেজের ছাত্রী অল্ড্রেটও কন্সতাঞ্জোর মতো মাদক ব্যবসায়ের সাথে পরিচিত ছিলেন, সেই সাথে জাদুটোনাসহ অতিপ্রাকৃত সব বিষয়েও ছিল তার তুমুল আগ্রহ। ফলে এই কাল্টে তার যোগ দেয়া ছিলো সোনায় সোহাগা। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কাল্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদ লাভ করেন।
অল্ড্রেট তার সহপাঠী সেরাফিন হারনান্দেজ গার্সিয়ার মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ের জগতে পা রেখেছিলেন। পুরো হারনান্দেজ পরিবার মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। অল্ড্রেটের মাধ্যমে তারা কন্সতাঞ্জোর কাল্টে অতিপ্রাকৃত শক্তির আশীর্বাদ প্রার্থনা করতেন। একসময়ে দেখা গেলো হারনান্দেজ পরিবারের মাদক ব্যবসা কন্সতাঞ্জোই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছেন। মাতামোরোসের র্যাঞ্চ সান্তা এলেনাতে ঘাঁটি গেড়ে মাদক ব্যবসা ও কাল্টের কার্যক্রম চলতে লাগল।
ভক্ত-অনুসারীসহ কন্সতাঞ্জো নিজে এ সময় থেকে নতুন একটি ধারণা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। উৎসর্গ করা প্রাণী ও মৃতদেহের হাড়ের বদলে জীবিত মানুষ যদি বলি দেওয়া যায়, তাহলে অতিপ্রাকৃত শক্তি আরো বেশি তুষ্ট হবে ও তাদের সব রকম অনিষ্ট থেকে আরো ভালভাবে রক্ষা করবে। উল্লেখ্য, পালো মেয়ম্বে বা স্যান্তেরিয়া– কোনো ধর্মেই নরবলি দেওয়ার নির্দেশনা নেই। এটি ছিল ধর্মের অজুহাতে নিজেদের বিকৃত মনোবাসনা চরিতার্থ করার উপায় মাত্র।
নৃশংসতার নতুন মাত্রা
যে-ই কথা, সে-ই কাজ। নরবলি দেয়া শুরু হলো। মাদক ব্যবসায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বা অন্য সন্ত্রাসী দলের শত্রু – এরকম মানুষ খুঁজে এনে পুরো আচারানুষ্ঠান পালন করে খুন করা হত। নরখাদক প্রবণতাও ছিলো তাদের মধ্যে। এনগাঙ্গাতে মৃতদেহের অংশ সিদ্ধ করে সেই পানি পান করত সবাই। আর মেরুদণ্ডের হাড় দিয়ে মালা বানিয়ে পরতো গলায়। কারণ? এতে নাকি ব্যবসায়ে সমৃদ্ধি আসবে আর তারা অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা লাভ করবে। ফলে আইন ও পুলিশের গুলি তাদের কোনো দিন খুঁজে পাবে না। পৈশাচিকতা ও মানসিক অসুস্থতা একসাথে মিশে গেলে যা হয় আর কী। এভাবেই চলছিল, একদিন কী ভেবে কন্সতাঞ্জোর ইচ্ছে হলো মেধাবী কাউকে খুন করার। বোধ হয় ভেবেছিলেন যাকে খুন করা হবে তার মেধা লাভ করে অতিপ্রাকৃত শক্তি খুশি হবে!
তারপর এলো ১৯৮৯ সালের ১৪ মার্চ।
মার্ক কিলরয় হত্যাকাণ্ড
মার্ক কিলরয় ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়ছিলেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার বাসিন্দা, বয়স একুশ বছর। ১৯৮৯ সালের ১০ মার্চ বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ছু্টির কয়েকটা দিন মেক্সিকোতে কাটাবেন বলে। স্বপ্নেও ভাবেননি সামনে তার জন্য কী ভয়াবহ নিয়তি অপেক্ষা করছে।
মার্চের ১৩ মতান্তরে ১৪ তারিখে মাতামোরোস থেকে অপহৃত হন কিলরয়। র্যাঞ্চ সান্তা এলেনাতে নিয়ে যৌন নির্যাতনসহ অমানুষিক অত্যাচার করা হয় তার ওপর। কন্সতাঞ্জো নিজের হাতে খুন করেন কিলরয়কে। কিন্তু পৈশাচিকতা তারপরেও বাকি ছিল। এনগাঙ্গাতে কিলরয়ের মস্তিষ্ক নিয়ে তা সিদ্ধ করা হয়। মেরুদণ্ডের হাড় আলাদা করে ফেলা হয়, হাঁটু থেকে পা কেটে ফেলা হয়। তারপর আগের ভুক্তভোগীদের মতো তাকে র্যাঞ্চেই পুঁতে ফেলা হয়।
কিলরয়ের পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় একমাস পর্যন্ত তার খোঁজ করে ব্যর্থ হয়। তারপর একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে তার হদিস পায় পুলিশ।
হারনান্দেজ পরিবারের কথা মনে আছে? সেই পরিবারের একজন, এলিও হারনান্দেজ রিভেরা একদিন পুলিশের নিয়মমাফিক তল্লাশিতে গাড়িতে মারিজুয়ানাসহ ধরা পড়েন। জেরার মুখে একসময় কয়েক মাদক ব্যবসায়ীর নাম বলেন, সেই সাথে বলেন র্যাঞ্চ সান্তা এলেনার কথা। হারনান্দেজকেসহ পুলিশ সেখানে যায় ও তল্লাশি করে আরো মারিজুয়ানা পাওয়া যায়।
যেকোনো জায়গাতে কিলরয়ের কথা জিজ্ঞেস করা তখন পুলিশের নিয়মে পরিণত হয়েছে। এবার র্যাঞ্চের আশেপাশে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই আশার আলো পাওয়া গেল। এক কেয়ারটেকার কিলরয়ের ছবি দেখে তাকে চিনতে পারেন। শেষ কোথায় দেখেছিলেন তা-ও দেখিয়ে দেন। র্যাঞ্চের এক কোণের দিকের একটা টিনশেড ঘর, কাল্টের মূল ঘাঁটি। পুলিশ এবার সেদিকে এগোল। তবে যে দৃশ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না কেউ।
ঘরের মধ্যে রক্তাক্ত মেঝে, এখানে সেখানে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরের টুকরো ছড়ানো। এনগাঙ্গাতে কাঠ, লোহা, মানুষের মস্তিস্কসহ বিভিন্ন উপকরণ। এক পাত্রে রক্ত, চুল ও দেহাবশেষ। আর রক্তে ভেজা অস্ত্র।
কোনো রকম মাটিচাপা দেওয়া মৃতদেহগুলো তখন দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। হারনান্দেজদের দিয়ে জোর করে পুলিশ কবরগুলো খোঁড়ায়। আর খোঁজ মেলে মার্ক কিলরয়ের। শেষ পর্যন্ত এভাবে উদ্ধার হয় এ মেধাবী তরুণের দেহাবশেষ। কিলরয় ছাড়াও আর ১৪টি মৃতদেহের খোঁজ পায় পুলিশ। প্রতিটি দেহ ক্ষত-বিক্ষত ও অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার।
কাল্টের কয়েকজন তখন ধরা পড়লেও কন্সতাঞ্জো ও অল্ড্রেট ধরা পড়েন আরো মাসখানেক পর, ১৯৮৯ সালের মে মাসে।
কন্সতাঞ্জোর মৃত্যু
এই নৃশংস খুনগুলো করা কন্সতাঞ্জোর ধরা পড়াটা অনেকটা হাস্যকর বলা যায়। মেক্সিকো সিটির এক প্রান্তে এক এপার্টমেন্টে কন্সতাঞ্জো, অল্ড্রেট ও অন্যান্যরা লুকিয়ে ছিলেন। পুলিশের ধারণা ছিলো কন্সতাঞ্জো আশেপাশেই আছেন, কিন্তু ঠিক কোথায় সেটা জানতে বাকি ছিলো। সেটা জানিয়ে দেন কন্সতাঞ্জো নিজেই। এলাকার মধ্যে পুলিশ দেখে ভেবে নেন তার অবস্থান পুলিশ জেনে গেছে, আর সোজা আক্রমণ করে বসেন। পুলিশের তাতে আরামই হলো, নিজেদের কষ্ট করে আর খুঁজতে হল না। পাল্টা আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর দলের একজনকে কন্সতাঞ্জো আদেশ করেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে। গুরুর আদেশ শিষ্য মেনেও নেয়। পুলিশ এসে কন্সতাঞ্জোর মৃতদেহ উদ্ধার করে। অল্ড্রেটসহ বাকিরা ধরা পড়েন। প্রত্যেকে বর্তমানে সাজা ভোগ করছেন।
কন্সতাঞ্জোর সাধের অতিপ্রাকৃত শক্তি তাকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করেনি। এমনকি পুলিশের কাছে নিজের অবস্থান নিজেই ফাঁস করে দেওয়া যে বোকামি হবে, সেই বুদ্ধিটুকু দিয়েও সাহায্য করেনি।
মেক্সিকোর একটি সংবাদপত্র এই কাল্টকে 'নার্কো-স্যাটানিস্ট কাল্ট' বলে অভিহিত করে। বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে এই কাল্ট নিয়ে। কুসংস্কার, বদ্ধসংস্কার, লোভ ও পৈশাচিকতা একসাথে মিশে গেলে কী হয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে এই কাল্ট।
এই সিরিজের পূর্বের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
This Bengali article discusses about some of the cults of the world.
Reference:
1. Deadly Narcosatanist Cult Performed Human Sacrifices For Drug Cartels
2. The Believers: Cult Murders in Mexico
3. Black magic, voodoo, and murder occurs at Rancho Santa Elena
4. Leader in Cult Slayings Ordered Own Death, Two Companions Say