Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিয়ানমারের কয়েকটি জাতির সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত

মিয়ানমারের অধিবাসীদের কথা বললেই মনে পড়ে বৌদ্ধ বর্মীদের কথা। বস্তুত শাসকদল আর সেনাবাহিনীতে বর্মীদের আধিক্যই এমন একটি চিত্র তৈরিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু মিয়ানমারে বর্মীদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬৮ শতাংশ। বাকি ৩২ ভাগ জনগণ সব মিলিয়ে মোট ১৩৫ খানা জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর বাইরেও আরো বেশ কিছু জাতি রয়েছে যাদেরকে মিয়ানমারের সরকার নিজেদের লোক বলে স্বীকার করে না। এর মধ্যে আছে রোহিঙ্গা, অ্যাংলো বার্মিজ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ ইন্ডিয়ানসহ আরো বেশ কিছু জাতি।

হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছে মিয়ানমারে বসতি স্থাপনের জন্য। আর কত বিচিত্র মানুষই না এখানে এসেছে! অস্ট্রালয়েড জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরা এসেছে দক্ষিণ থেকে, উত্তর-পূর্বের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এসেছে মঙ্গোলয়েড জাতির অধিবাসীরা। আর সেদিনের ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রাম তথা ভারত থেকেও মানুষ জুটেছে এই সমৃদ্ধ দেশটিতে। ফলে নানা জাতি আর ভাষার এক অসাধারণ ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি। এদের অনেকেই বর্মী রাজাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছে। ফলে স্বাধীনতার পর বর্মী সরকার তাদেরকে আর কাছে টেনে নিতে চায়নি। সেই থেকেই মিয়ানমারে অসংখ্য গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা আজও চলমান। আজ আপনাদের জানাবো এমনই কিছু জাতির ইতিহাস।

জেনে রাখা ভালো, এই ১৩৫টি জাতিকে মিয়ানমার সরকার আবার ৮টি প্রধান ভাগে ভাগ করেছে। এই ভাগাভাগি হয়েছে প্রদেশ অনুসারে। জাতিগুলোর আসল পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। কাজেই যেসব জাতিগুচ্ছকে শান বা কাচিন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের মধ্যেও মূলধারার শান বা কাচিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতিসত্তার অনেকগুলো গোষ্ঠী আছে।

শান

তাই ভাষাভাষীদের মধ্যে অন্যতম বড় জাতি হলো শান। মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ প্রদেশ শান প্রদেশে এদের বসবাস। আনুমানিক ৪০ থেকে ৬০ লক্ষ শানের বসত মিয়ানমারে। এরা অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিতে বিভক্ত। স্টেটের রাজধানীর নাম তায়ুংগি। পেশায় এরা মূলত কৃষক, ধর্মে বৌদ্ধ। এদের আছে নিজস্ব ভাষা।

শানেরা যোদ্ধা জাতি। ১৩-১৫ শতকে উত্তর মিয়ানমারে তারা আভা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। পরে বার্মিজ রাজারা তাদেরকে বর্তমান শান প্রদেশে ঠেলে দেন। ব্রিটিশ আমলে শান প্রদেশ কিছুটা স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করতো। পরে ১৯৪৮ সালে তারা নিজস্বতা বজায় রেখেই ইউনিয়ন অব বার্মাতে যোগ দেয়। তবে ১৯৬১ সালে জেনারেল নে ইউন ক্ষমতায় এসে শানদের সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিলে বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ।

শান সেনাদল; source: atimes.com

১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শান স্টেট আর্মি তাদের অস্ত্র কেনার টাকা জোগাড় করতো আফিম চাষ করে। বস্তুত ক্রমাগত যুদ্ধের খরচের চাপেই মিয়ানমারসহ আশেপাশের দেশজুড়ে কুখ্যাত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের সৃষ্টি হয়। খুন সা নামের এক ভুঁইফোঁড় নেতা নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন করে ফেলেন এই আফিমের টাকা দিয়ে। প্রায় ৫০ বছর ধরে শান প্রদেশে যুদ্ধ চলে। নানা সময়ে চীনা কুয়োমিন্টাং বাহিনী, বিভিন্ন শান বিদ্রোহী দল, মিয়ানমার সেনাবাহিনী, থাই সেনাবাহিনী এবং কম্যুনিস্ট যোদ্ধারা শান পর্বতমালা এবং আফিমের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও বিদ্রোহীরা সক্রিয় আছে। শানদের সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ ধর্ম আর নানা প্রাচীন পাহাড়ী বিশ্বাসের সংমিশ্রণ দেখা যায়। পুরুষ ও নারী উভয়ই গায়ে উল্কি আঁকে।

কারেন

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমারে কারেনদের বাস। মূলত অনেকগুলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাভাষীদেরকে কারেন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা হয়। কারেন লোকগাঁথা অনুসারে, তাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছে মঙ্গোলিয়ার গোবি অঞ্চল থেকে। মিয়ানমারে মোট ৫০ লক্ষের মতো কারেনের বাস।

কারেন; source: startribune.com

কারেনরা ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিল। বহু কারেন খ্রিস্টান হয়ে যায়। এই শিক্ষিত কারেনরাই ১৮৮১ সালে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন গঠন করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কারেনরা জাপানী এবং বার্মিজ ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করায় স্বাধীনতার পর তাদেরকে প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ। বিশেষ করে ‘৮০ এর দশকে এর ভয়াবহতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

আজ অবধি কারেন প্রদেশে থেমে থেমে যুদ্ধ চলমান। বহু কারেন পালিয়ে গিয়েছে থাইল্যান্ডে। পেশায় মূলত কৃষক এই জাতির লোকেদের নিজস্ব ভাষা আছে এবং মিয়ানমারের অন্য অনেক জাতিগোষ্ঠীর মতোই তাদের ধর্মাচারণে অনেক প্রাচীন ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

কাচিন

মিয়ানমারের সর্ব উত্তরের কাচিন প্রদেশে এই জাতির লোকেরা বাস করে। কাচিন জনগোষ্ঠীর অধিবাসীদের চীনের ইউনান প্রদেশেও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে এরা জিংপো নামে পরিচিত। অনেকগুলো সিনো তিব্বতীয় ভাষায় তারা কথা বলে। বেশিরভাগ কাচিনই ধর্মে খ্রিস্টান। বাকিরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। কাচিনরা তাদের রণকৌশল, কুটির শিল্প এবং বিচিত্র সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে আছে ঢোল ও তরবারি সহকারে বিখ্যাত মানাউ নাচ। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে গোটা অঞ্চল জুড়ে মানাউ নাচের আয়োজন করা হয়।

কাচিন যোদ্ধা; source: cnn.com

১৯৬১ সাল থেকে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। কাচিন অঞ্চলে প্রচুর মূল্যবান রত্ন, সোনা এবং বনজ সম্পদ পাওয়া যায়। এগুলোর চোরাকারবার করেই কাচিন বিদ্রোহীরা মূলত অস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। অঞ্চলটি মাদকের কারবারের জন্যেও কুখ্যাত।

মন

আদিকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাস ছিল মনদের। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে যুদ্ধবাজ খেমার জাতির লোকেরা মনদেরকে ঠেলে থাইল্যান্ড আর মিয়ানমারের দক্ষিণ অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়। অদ্যবধি সেখানেই বাস করে তারা। মিয়ানমারে প্রায় ১১ লক্ষ মনের বাস। এরা পশ্চিমা মন বলে পরিচিত। মনদের সাথে বর্মীদের ঐতিহাসিক সংযোগ খুব নিবিঢ়। মন রাজারা দীর্ঘদিন বর্মীদের বিরুদ্ধে নিস্ফলা যুদ্ধ করেছেন বটে, কিন্তু মনদের উন্নত সংস্কৃতি ঠিকই বর্মী রাজদরবারে স্থান করে নিয়েছে। বর্মী ভাষা লেখা হয় মন অক্ষরে।

মনরা ধর্মে বৌদ্ধ; source: Youtube

ব্রিটিশ শাসনামলে মনরা বর্মীদের হাত থেকে রক্ষা পেতো। পরিবর্তে তারা ব্রিটিশদের সাহায্য করতো। পরে অবশ্য মনরাও স্বাধীনতা দাবি করতে থাকে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হলে কর্তারা আবার মনদের ওপরে নির্যাতন চালাতে থাকেন। কিছুদিন যুদ্ধ চলে। এখনো পরিস্থিতি যে শান্ত হয়েছে তা বলা যাবে না তবে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতির তুলনায় মনরা অপেক্ষাকৃত বেশি নিরুপদ্রব জীবনযাপন করে বলা যায়।

পালা-পর্বনে জাইলোফোন সহকারে খুব জাঁকজমকপূর্ণ নাচের আয়োজন করে থাকে মনরা। ধর্মগত দিক থেকে তারা বৌদ্ধ। মজার কথা হলো, থাইল্যান্ডের রাজ পরিবারও জাতিতে মন। পূর্ব-দেশীয় মন জাতির লোকেরা কিভাবে থাইল্যান্ডের ক্ষমতা পেল সেটা অবশ্য আলাদা গল্প।

ওয়া

মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দুর্গম সব পাহাড়ে বাস করে দুর্ধর্ষ ওয়া জাতি। কবে এরা এখানে এসে জুটেছিল তা কেউ জানে না। তবে সেই ১২০০ শতাব্দীর চীনা ইতিহাসবিদেরাও ওয়াদের কথা লিখে গিয়েছেন। বিংশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশরা ওয়াদের সাক্ষাত পায়। সাক্ষাতটা খুব একটা শুভ হয়নি বলাই বাহুল্য। ওয়ারা তাদের প্রতিপক্ষের মাথা কেটে নিতো। তাদের বিশ্বাস- এতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশরা ওয়াদেরকে অসভ্য আর বর্বর মনে করলেও উঁচু পাহাড়ে ছাওয়া এই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ অধিবাসীদের সাথে লড়াইয়ে নামবার বোকামি করেনি।

ওয়া সেনাদল; source: hscentre.org

স্বাধীনতার পর ওয়ারা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। বেঁধে যায় যুদ্ধ। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি এবং পার্টির। তবে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সরিয়ে জায়গাটা দখল করে নেয় মাদক। ওয়া অঞ্চলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের অংশ হলেও ওয়ারা একরকম স্বাধীনভাবেই থাকে। নিজস্ব সেনাবাহিনী তাদের বিস্তীর্ণ আফিম ক্ষেতগুলোকে সুরক্ষা দেয়। সীমান্তের ওপাশে চায়নায় গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট ক্যাসিনো। টাকার ঝনঝনানি শুনে ওই অঞ্চলের লোকেরা মাদককেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমারে যত ইয়াবা উৎপন্ন হয় তার অর্ধেকই আসে ওয়া অঞ্চলগুলো থেকে।

ওয়া নাচ; source: ecns.cn

ওয়াদের সাথে ভারতের নাগাদের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। নাগাদের মতো ওয়ারাও পূজো আচ্চায় মহিষ বলি দেয়। মানুষের মুণ্ডু কাটার ঝোঁক অবশ্য এখন আর তাদের নেই। পালা-পার্বণে মদ্যপান করে নাচগান করা ওয়াদের খুব পছন্দের বিষয়। তাদের সমাজে বিয়ের আগে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়। তবে বিয়ের পর বহুগামিতা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

ফিচার ইমেজ – www.japantimes.co.jp

Related Articles