যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, মৃত্যুযজ্ঞ আর স্বজন হারানো কান্নার শব্দ। তবু মানবজাতি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মেতে রয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহে। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছু বদলালেও বদলায়নি কেবল যুদ্ধ, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। যুদ্ধের হাতিয়ার বদলেছে, কারণ রয়ে গেছে সেই একই, মানচিত্রের ভাগ। সকলেরই নিজের জায়গাটুকু বুঝে নেবার তাড়া।
এযাবৎ সংঘটিত হওয়া যুদ্ধের মাঝে দু'টি যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে জানি আমরা। এই দুই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো বিশ্বে। কোনো যুদ্ধ দেখার সুযোগ হয়েছে যে মানুষটির, সে-ই কেবল বলতে পারবে এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি ঘৃণার মাত্রাটি কেমন। তবু মানুষে মানুষে কোন্দল শেষ হয় না। বিনিময়ে বিপন্ন হয় অজস্র প্রাণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯১৯ সালে অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেয় একটি শিশু; নাম রাখা হয় হারম্যান মেইনার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারিয়ে অনাথ হন তিনি। ভাই-বোনদের আদরেই বড় হয়ে উঠেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভয়াবহ যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো, সেসব দেখে হারম্যান মেইনারের হৃদয় ব্যথায় জর্জরিত হয়। তিনি উপলব্ধি করেন, যুদ্ধ রোধ করার ক্ষমতা তার হাতে নেই, কিন্তু হয়তো যুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষদের পুনর্বাসনে কিছু করতে পারবেন। তিনি লক্ষ করেন যে, যুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষদের মাঝে সবথেকে অসহায় অবস্থায় থাকে শিশুরা। বাবা-মা, পরিবার-পরিজনকে হারিয়ে শিশুদের এই অসহায়ত্ব দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এই গৃহহীন-পরিবারহীন শিশুদের জন্যই তাকে কিছু করতে হবে।
তিনি হয়তো অনাথ আশ্রম গড়ে তুলতে পারতেন, এমনটি পুরো পৃথিবী জুড়ে আগেও বহুবার হয়েছে, অনেক দেশেই সরকারিভাবে সেই ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু আদৌ কোনো উপকার হচ্ছে কি শিশুদের? দু’বেলা খাবার, পোশাক আর উপেক্ষণীয় কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় সেসব অনাথ-আশ্রমে, কিন্তু তারা বেড়ে ওঠে রাস্তার শিশুদের মতোই, পরিবারহীন, অনাথ শিশুদের জীবন-সংগ্রাম আর শেষ হয় না।
অভিনব কিছু করার আশায় হারম্যান মেইনার পকেটে মাত্র ৬০০ অস্ট্রিয়ান শিলিং (তৎকালীন মূল্যমান প্রায় ৪০ ডলার) নিয়ে ১৯৪৯ সালে অস্ট্রিয়ার ইমস্ট নামক শহরে গড়ে তোলেন ভিন্নধর্মী একটি গ্রাম। বিশাল জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা গ্রামটিতে তৈরি করা হয় আবাসিক এলাকার ন্যায় ছোট ছোট বাসা। সেই বাসাগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পৃথক পরিবার, প্রতি পরিবারেই নির্দিষ্ট সংখ্যা হিসেবে স্থান পায় অনাথ শিশুরা। একটি পরিবারে যে আদর-মমতায় একটি শিশুর বেড়ে উঠবার কথা ছিলো, সেসবকিছুই মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজান হারম্যান মেইনার।
তার এই অভিনব ও নতুন ধাঁচের গ্রামের কথা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে বিশ্বমণ্ডলে, আসতে থাকে অনেক অনেক অনুদান। তার হাত ধরে বাড়তে থাকে গ্রামের সংখ্যাও। মৃত্যুকালে হারম্যান মেইনারের প্রতিষ্ঠিত গ্রামের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৩০-এ। মৃত্যুর মধ্য দিয়েও থেমে যায় না তার এ কাজ। তার পল্লীতেই বড় হয়ে ওঠা হেলমুট কুটিন দায়িত্ব নেন এই প্রাণের সংগঠনটির। দ্রুত গতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই সংগঠনটির অভিনব গ্রামগুলো।
এই গ্রামগুলোর নাম হলো এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী। বর্তমানে এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে ১৩৫টি দেশে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে নতুন এ স্বাধীন দেশটি ভ্রমণে এসেছিলেন হারম্যান মেইনার, সাথে ছিলেন তার সহকারী ও পরবর্তীতে সংগঠনটির নির্বাচিত সভাপতি হেলমুট কুটিন। দেশভ্রমণের পাশাপাশি তিনি দেখা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে নবগঠিত বাংলাদেশেও এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুও সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ১৭ই মে তারিখে তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লীর মাঝে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলত সংগঠনটি আমাদের দেশে তাদের কার্যক্রমগুলো শুরু করবার অনুমতি পায়।
সে বছরেই ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম এসওএস শিশু পল্লী। একে একে আরো পাঁচটি জেলা শহরে এই শিশু পল্লী প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী সংস্থাটি গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী অসহায় পরিবারবিহীন শিশুদের সহায়তা করার জন্য। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের মূল নীতির ভিত্তিতেই কাজ করে থাকে এই সংস্থাটি। অসহায় শিশুদের আবাসনের ব্যবস্থা ও একটি নতুন পরিবার উপহার দিতে হারম্যান মেইনার যে অভিনব প্রক্রিয়াটি চালু করেছিলেন, তা মূলত চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি শিশু সেই পল্লীতে অবস্থানকালে চারটি মূলনীতির সংস্পর্শে বড় হবে; একজন মা, একাধিক ভাই-বোন, একটি বাড়ি এবং একটি পল্লী।
একটি পল্লীতে পৃথক পৃথক নির্দিষ্ট দূরত্বে ১০-১৬টির মতো বাড়ি থাকবে, বাড়িগুলোর প্রতিটিতে ৮ জন (৪ জন ছেলে ও ৪ জন মেয়ে) করে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান অবস্থান করে। একটি বাড়িতে এই ৮ জনের দেখভালের জন্য সংস্থা থেকে পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে একজন মহিলাকে মা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি শিশুদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাদেরকে মায়ের মতোই আদর করে বড় করে তুলেন, সন্তানের চোখে দেখে থাকেন। সন্তানেরাও সবাই তাকে মা বলে ডাকে। উক্ত বাড়িটিতে অবস্থানকারী মায়ের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে সবকিছু পরিচালিত হয়। কী রান্না হবে, কেমন বাজার-সদাই হবে, বাচ্চারা কী জামা-কাপড় পরবে, সবকিছুর সিদ্ধান্ত একজন মা নেন। মাকে সাহায্য করতে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয় খালা হিসেবে, তাকে বাচ্চারা সবাই খালা বলেই ডেকে থাকে।
একই বাড়িতে বসবাসকারী শিশুরা নিজেদের মাঝে ভাই-বোন পরিচয়ে বেড়ে ওঠে।
শিশু পল্লীতে একটি ছেলে শিশু অবস্থান করে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর বয়ঃসন্ধির প্রাক্কালেই ছেলে তাদের স্থান হয় শিশু পল্লীরই বিশেষায়িত সংস্করণ ‘এসওএস যুব পল্লী’ তে। যুগের সাথে যেন তাল মিলিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে- সেই লক্ষ্যেই যুব পল্লীতে ছেলেদের সঠিক পথ প্রদর্শন করা হয়। যুব পল্লী হলো ছেলেটির জন্য শিশু পল্লী এবং বাস্তব পৃথিবীর সেতুস্বরূপ। এখানকার পাট চুকিয়ে ছেলেটি বেরিয়ে পড়বে জীবিকার সন্ধানে।
মেয়ে শিশুরা শিশু পল্লীতে অবস্থান করতে পারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর মেয়েটির বিয়ের জন্য সকল ব্যবস্থা সংস্থা থেকেই করা হয়। প্রতিটি মেয়ের বিয়ের জন্য সংস্থা বরাদ্দ রেখেছে ১ লক্ষ টাকা, বিয়ের সেলাই মেশিন সহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দেবার রেওয়াজও চালু আছে এই সংস্থার নীতিমালায়।
ছেলেমেয়েরা নাড়ির টানে বারে বারে ফিরে আসে তাদের চিরচেনা পল্লীতে সবার সঙ্গে দেখা করতে, তাদের মায়ের কাছে। অনেকেই তাদের মাকে নিজের কাছে নিয়ে যায়, যে মা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে শিশুদের কল্যাণে, সেই মায়ের শেষ জীবন কাটে ছেলেটির কিংবা মেয়েটির নতুন জীবনের অংশ হয়ে, সম্পর্কটা যে আপন মায়েরই মতন।
সুবিধাবঞ্চিত এই অসহায় শিশুদের শিক্ষার সুবিধার্থে এসওএস সংস্থা বিভিন্ন জেলা শহরে নির্মাণ করেছে প্রয়োজনীয় স্কুল ও কলেজ; এর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ও বগুড়ায় অবস্থিত এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ এবং খুলনা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুল।
এছাড়াও এই সংস্থাটি ঢাকা ও চট্টগ্রামে সমাজের পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া তরুণ বয়সী ছেলেদের কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছে এসওএস ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার। এই ট্রেনিং সেন্টারদ্বয় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত। এখানে চালু থাকা কোর্সগুলোর মাঝে ইলেকট্রিক্যাল, মেশিনিস্ট, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল এবং রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং উল্লেখযোগ্য।
বাগেরহাটে রয়েছে যুব পল্লী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। শিশু পল্লী থেকে যদি কেউ পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, তবে তার স্থান হয় এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এখানে তারা বাগান করা, পোলট্রি, ডেইরি, পিসি কালচার ও এগ্রিকালচারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। ফলে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ শেষে আত্ম-কর্মসংস্থান করে নিতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় দরিদ্র আগ্রহীদের জন্যেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে এসওএস যুব পল্লী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি।
এছাড়াও পল্লীর মা এবং তাদের সহকর্মী খালাদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে এসওএস ন্যাশনাল ট্রেনিং সেন্টার।
প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বে, একজন যুদ্ধপীড়িত মানুষের দেখা অভিনব এক স্বপ্নের দুনিয়ায় ছেয়ে গেছে আজকের পৃথিবী, পৃথিবীর ১৩৫টি দেশ। আরো নতুন নতুন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এমন অসাধারণ সংস্থাটি। এই সংস্থার সাহায্যে হাত বাড়াতে পারেন আপনিও- একজন কর্মী হয়ে, একটি শিশুকে স্পন্সর করে, একটি সম্পূর্ণ পল্লী স্পন্সর করে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো অনুদানের মাধ্যমে।
স্রষ্টা এভাবেই ভালো কাজগুলোকে পৃথিবীজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে দিক আলোর দিশারীরূপে।
This is a Bangla article about an international organization called 'SOS Childrens' Villages'; their whole working system and ongoing works in Bangladesh.
Reference: All the references are hyperlinked.
Featured Image: SOS Childrens' Villages