Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেসব রাষ্ট্রে ব্রিটিশরা কখনো আক্রমণ করেনি (পর্ব – ৪): শাদ ও তাজিকিস্তান

[তৃতীয় পর্বের পর]

শাদ

‘শাদ প্রজাতন্ত্র’ (ফরাসি: République du Tchad; আরবি: جمهورية تشاد, ‘জুমহুরিয়াত শাদ’) উত্তর–মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত একটি বৃহৎ স্থলবেষ্টিত ‘আফ্রো–আরব’ রাষ্ট্র। ১২,৮৪,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তরে লিবিয়া, পূর্বে সুদান, দক্ষিণে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ–পশ্চিমে ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়া এবং পশ্চিমে নাইজার অবস্থিত। রাষ্ট্রটির সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, এজন্য পরাক্রমশালী ব্রিটিশ নৌবহরের পক্ষে শাদের ভূখণ্ডে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু শাদের পার্শ্ববর্তী সুদান ও নাইজেরিয়া ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ, সুতরাং অ্যাংলো–স্যাক্সন সাম্রাজ্য চাইলে স্থলপথে বর্তমান শাদের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারত। কিন্তু ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনাবলির কারণে তাদের আর সেরকম কিছু করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য তাই বলে এই অঞ্চলে যে ব্রিটিশরা একেবারেই কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি, এমন নয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত বর্তমান শাদের ভূখণ্ড বিভিন্ন আঞ্চলিক রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮২০–এর দশকে একটি ক্ষুদ্র ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল ‘শাদ হ্রদে’র (Lake Chad) তীরে পৌঁছায়। তারাই ছিল সুবৃহৎ শাদ হ্রদের তীরে পৌঁছাতে সক্ষম প্রথম ইউরোপীয় অভিযাত্রী দল। ধারণা করা হয়, সেসময় উক্ত ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলটির সদস্যরা বর্তমান শাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এটি যেহেতু কোনো আক্রমণাত্মক বা শত্রুভাবাপন্ন অভিযান ছিল না, সেহেতু একে শাদের ভূখণ্ডে ব্রিটিশদের ‘আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।

১৮৮০–এর দশকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয় এবং এই ভাগাভাগিতে বর্তমানে শাদের ভূখণ্ড ফ্রান্সের ভাগে পড়ে। ১৯০০ সাল থেকে ফ্রান্স শাদকে একটি ফরাসি উপনিবেশে পরিণত করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করে, কিন্তু ১৯২০ সালের আগে অঞ্চলটি একটি পুরোদস্তুর ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়নি। এদিকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং এসময় ব্রিটিশ সৈন্যরা শাদের ভূখণ্ডের সন্নিকটে (ও সম্ভবত শাদের অভ্যন্তরে) সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

মানচিত্রে শাদ; Source: Encyclopedia Britannica

উল্লেখ্য, সুদানের দারফুর অঞ্চল শাদের সীমান্তে অবস্থিত। ১৮৯৯ সালে ব্রিটেন ও ব্রিটেনের কার্যত আশ্রিত রাষ্ট্র (কিন্তু আইনত ওসমানীয় রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ) মিসর সম্মিলিতভাবে সুদান দখল করে নেয় এবং সুদান একটি ইঙ্গ–মিসরীয় কন্ডোমিনিয়ামে (যৌথভাবে শাসিত অঞ্চল) পরিণত হয়। একই বছর দারফুর সালতানাত ইঙ্গ–মিসরীয় সুদানের একটি করদ রাষ্ট্রে (tributary state) পরিণত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দারফুর ক্রমশ ওসমানীয়পন্থী নীতি গ্রহণ করতে থাকে। এসময় ব্রিটিশরা আশঙ্কা করতে থাকে যে, দারফুর সরাসরি ওসমানীয় রাষ্ট্রের (অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শক্তির) পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে এবং ইঙ্গ–মিসরীয় সুদানে আক্রমণ চালাতে পারে। দারফুর যাতে এরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা দারফুরের আরব গোত্রগুলোকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে।

এই পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল যে, আরব গোত্রগুলো দারফুরের সুলতান আলী দিনারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। কিন্তু উক্ত আরব গোত্রগুলো দারফুর অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী শাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং সেখানে বসবাসরত প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রগুলোর ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। অর্থাৎ, দারফুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আরব গোত্রগুলোকে অস্ত্রসজ্জিত করার ব্রিটিশ নীতি পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয় এবং উল্টো শাদের অভ্যন্তরে আন্তঃগোত্রীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ১৯১৬ সালে ব্রিটেন ও ব্রিটেনের আশ্রিত রাষ্ট্র মিসর যৌথভাবে দারফুর আক্রমণ করে এবং দারফুর সালতানাতের পতন ঘটিয়ে অঞ্চলটিকে ইঙ্গ–মিসরীয় সুদানের অন্তর্ভুক্ত করে। এসময় দারফুর ও শাদের মধ্যবর্তী সীমান্ত স্পষ্টভাবে নির্ধারিত ছিল না, এজন্য দারফুর অভিযান চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যরা বর্তমান শাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু তারা শাদের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি, সেহেতু একে শাদের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সাল নাগাদ ফ্রান্স শাদকে একটি পূর্ণাঙ্গ উপনিবেশে পরিণত করে এবং ‘ফরাসি নিরক্ষীয় আফ্রিকা’র অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালের জুনে ফ্রান্স জার্মানির নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং ফ্রান্সের ভূখণ্ডে ‘ভিশি ফ্রান্স’ নামক জার্মানির একটি আশ্রিত রাষ্ট্র স্থাপিত হয়। কিন্তু বেশকিছু ফরাসি সামরিক নেতা এই রাষ্ট্রকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং ‘মুক্ত ফ্রান্স’ (Free France) নামক একটি বিকল্প সরকার গঠন করেন। শাদের ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসন ভিশি ফ্রান্সকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং এর পরিবর্তে ভিশিবিরোধী ‘মুক্ত ফ্রান্সে’র প্রতি নিজেদের আনুগত্য ঘোষণা করে। ভিশি ফ্রান্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর ব্রিটেন ফ্রান্সের উপনিবেশগুলো দখল করে নিতে শুরু করে। কিন্তু শাদ ‘মুক্ত ফ্রান্স’ ও মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে এবং সেজন্য ব্রিটেন শাদের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি। উল্টো উত্তর আফ্রিকায় অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শাদ মিত্রশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

দারফুর অভিযানের সময় ইঙ্গ–মিসরীয় বাহিনীর একজন উটবাহী সৈন্য। দারফুর অভিযান চলাকালে ব্রিটিশ/মিসরীয় সৈন্যরা শাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হয়; Source: Frank G. Carpenter/Library of Congress via Wikimedia Commons

উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘লং রেঞ্জ ডেজার্ট গ্রুপ’ দক্ষিণ লিবিয়ায় অবস্থিত ইতালীয় ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য মুক্ত ফ্রান্স–নিয়ন্ত্রিত শাদের ভূখণ্ডকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। এরকম একটি অভিযানে তারা শাদের ভূখণ্ড থেকে ইতালীয়–নিয়ন্ত্রিত লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে এবং সেখানকার মুরজুক শহরে অবস্থিত ইতালীয় বিমানঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। উল্লেখ্য, লিবিয়া সেসময় ইতালির একটি উপনিবেশ ছিল এবং ইতালি জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির অংশ ছিল।

শুধু তা-ই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বর্তমান শাদের ভূখণ্ড ব্রিটেনের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধ চলাকালে ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার সিংহভাগ অঞ্চল অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এবং এজন্য তাদের নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমা দিয়ে বিমানযোগে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় মোতায়েনকৃত ব্রিটিশ সৈন্যদলকে রসদপত্র ও অতিরিক্ত সৈন্য সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। সমুদ্রপথে রসদপত্র ও অতিরিক্ত সৈন্য পরিবহন করা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং বিপদসঙ্কুল, কারণ অক্ষশক্তির বিমান ও নৌবাহিনী প্রায়ই ব্রিটিশ জাহাজগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করত। এজন্য পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় মোতায়েনকৃত ব্রিটিশ সৈন্যদলগুলোকে রসদপত্র ও অতিরিক্ত সৈন্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা একটি নতুন পথ ব্যবহার করতে শুরু করে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ওয়েস্ট আফ্রিকা রিইনফোর্সমেন্ট রুট’ নামে পরিচিত ছিল।

প্রথমে ব্রিটিশরা তাদের বিমানের অংশগুলো জোড়া না লাগিয়েই কিট আকারে সেগুলোকে ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত ঘানার তাকোরাদিতে প্রেরণ করত। সেখানে বিমানের অংশগুলোকে জোড়া লাগানো হতো এবং এরপর সেগুলোতে রসদপত্র তোলা হতো। সেখান থেকে বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটি হয়ে বিমানগুলো ইঙ্গ–মিসরীয় সুদানের রাজধানী খার্তুমে পৌঁছাত এবং সেখান থেকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের কাছে পৌঁছে যেত। এই বিমানঘাঁটিগুলোর মধ্যে একটি অবস্থিত ছিল ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত শাদের ফোর্ট–লামিতে, যেটির বর্তমান নাম এন’জামেনা।

‘মুক্ত ফ্রান্সে’র সশস্ত্রবাহিনীর একজন শাদিয়ান সৈন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শাদ ‘মুক্ত ফ্রান্স’ ও ব্রিটেনের জন্য একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল; Source: Office of War Information/Library of Congress via Wikimedia Commons

অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে শাদের ভূখণ্ডে ব্রিটেন বিস্তৃত সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, কিন্তু এগুলোকে শাদের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৬০ সালে শাদ ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, এবং বিগত ৬০ বছরেও ব্রিটেন শাদের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করেনি। এজন্য শাদ সেই স্বল্প সংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যেখানে ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালিত হয়নি।

তাজিকিস্তান

‘তাজিকিস্তান প্রজাতন্ত্র’ (তাজিকি: Ҷумҳурии Тоҷикистон, ‘জুমহুরি তোজিকিস্তোন’; রুশ: Республика Таджикистан, ‘রেসপুবলিকা তাদঝিকিস্তান’) মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত ‘ইন্দো–ইরানি’ রাষ্ট্র। ১,৪১,৪০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তরে কিরগিজস্তান, পশ্চিমে উজবেকিস্তান, দক্ষিণে আফগানিস্তান এবং পূর্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন অবস্থিত। রাষ্ট্রটি স্থলবেষ্টিত, সুতরাং ‘সমুদ্রের রাণী’ (Mistress of the Sea) ব্রিটেনের পক্ষে নৌপথে এই অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। অবশ্য বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডের পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তান প্রায় চার দশক ধরে ব্রিটেনের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র ছিল এবং ব্রিটিশরা চাইলে ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষ থেকে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাতে পারত। কিন্তু ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে তারা এটা করতে পারেনি। অবশ্য সরাসরি আক্রমণ না চালালেও তারা এই অঞ্চলে গোলযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টাও কম করেনি।

বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ড ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র/সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী নাগাদ বর্তমান তাজিকিস্তানি ভূখণ্ড দুইটি বৃহৎ মধ্য এশীয় রাষ্ট্র (বুখারা আমিরাত ও খোকান্দ খানাত) এবং বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের অবসানের পর ব্রিটেন ও রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং এক্ষেত্রে ব্রিটেন প্রথম মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি রুশবিরোধী জোট গঠনের ব্রিটিশ প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং প্রথম ব্রিটিশ–আফগান যুদ্ধে ব্রিটেন শোচনীয়ভাবে আফগানদের নিকট পরাজিত হয়। এর ফলে তারা কয়েক দশকের জন্য মধ্য এশিয়ায় সতর্কতামূলক নীতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে, রুশরা একে একে খোকান্দ, বুখারা ও খোরেজম অধিকার করে নেয় এবং মধ্য এশিয়ার অবশিষ্ট ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকেও করায়ত্ত করতে শুরু করে।

মানচিত্রে তাজিকিস্তান; Source: National Online Project

বুখারা ও খোকান্দ রুশ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রুশ শাসনাধীনে আসে। কিন্তু তখনো বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডের অংশবিশেষ রুশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এদিকে ১৮৭৮–১৮৮০ সালের দ্বিতীয় ব্রিটিশ–আফগান যুদ্ধে ব্রিটেন আফগানিস্তানকে পরাজিত করে এবং আফগানিস্তান ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বর্তমান তাজিকিস্তানের অবশিষ্ট ভূখণ্ডে রুশরা যাতে অগ্রসর হতে না পারে, সেজন্য ব্রিটেন আফগানিস্তানকে উক্ত ভূখণ্ডে আক্রমণ চালানোর জন্য প্ররোচিত করে। ১৮৮৩ সালে আফগানিস্তান শুঘনান ও বাদাখশান অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। কিন্তু স্থানীয় তাজিকদের সিংহভাগের কাছে আফগান শাসনের তুলনায় রুশ শাসন অধিক পছন্দনীয় ছিল। সোমাতাশ ও ইয়ায়মসের যুদ্ধে আফগান সৈন্যরা স্থানীয় তাজিকদের কাছে পরাজিত হয় এবং এই অঞ্চলকে আফগানিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

পরবর্তীতে অবশ্য তাজিক–অধ্যুষিত কিছু কিছু অঞ্চল আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন: ১৮৯০–এর দশকে ব্রিটিশরা তাজিক–অধ্যুষিত ওয়াখান অঞ্চলকে আফগানিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। ওয়াখান আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে ‘ওয়াখান করিডোর’ সৃষ্টি হয় এবং এই করিডোরটি রাশিয়া থেকে ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষকে পৃথক করে। এভাবে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে রাশিয়া ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে দেয়াল হিসেবে বজায় রেখে তাদের ‘মুকুটের রত্ন’স্বরূপ ভারতীয় উপনিবেশকে সুরক্ষিত রাখার প্রচেষ্টা চালায়। উল্লেখ্য, বর্তমানে চীন সীমান্তবর্তী উক্ত করিডোরটি তাজিকিস্তান থেকে পাকিস্তানকে পৃথক করে রেখেছে এবং মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তানি প্রভাব বিস্তারের পথে একটি ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে।

অর্থাৎ, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন সরাসরি বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এই ভূখণ্ডে আক্রমণ চালানোর জন্য নিয়মিতভাবে আফগানিস্তানকে উৎসাহ প্রদান করে এসেছে। এটিকে বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে ব্রিটেনের পরোক্ষ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যরা নিজেরা যেহেতু কখনো বর্তমান তাজিকিস্তানি ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি, সেজন্য ব্রিটেন প্রত্যক্ষভাবে তাজিকিস্তানে আক্রমণ চালিয়েছে, এমনটা বিবেচনা করা হয় না।

১৯২১ সালে ফারগানা উপত্যকায় বলশেভিকরা স্থানীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠক করছে। ব্রিটেন ১৯২০–এর দশক জুড়ে তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে সক্রিয় বিদ্রোহীদের সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছিল; Source: Wikimedia Commons

অবশ্য এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের আগ্রহ যে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এমনটা নয়। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর বলশেভিক কেন্দ্রীয় সরকার রাশিয়ার প্রান্তিক প্রদেশগুলোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে স্থানীয় বিদ্রোহীরা বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর ফলে ব্রিটেন এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য একটি নতুন সুযোগ লাভ করে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং এই আক্রমণের অংশ হিসেবে ব্রিটেন রাশিয়ার কাস্পিয়ান সাগরীয় অঞ্চলে একটি আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে। কাস্পিয়ান অঞ্চলে মোতায়েনকৃত ব্রিটিশ সৈন্যদল বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে সক্রিয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাদেরকে সহায়তা করতে শুরু করে।

কিন্তু ১৯২০ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা কাস্পিয়ান অঞ্চলে বলশেভিকদের কাছে পরাজিত হয় এবং এতদঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ব্রিটিশদের জন্য বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে সক্রিয় বিদ্রোহীদের কার্যকরভাবে সহায়তা প্রদানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশরা ১৯২০–এর দশক জুড়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে উক্ত বিদ্রোহীদের সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু ১৯৩০–এর দশকের প্রথমদিক নাগাদ বলশেভিকরা এই বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করতে সক্ষম হয় এবং এর মধ্য দিয়ে বর্তমান তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তারের এই ব্রিটিশ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে তাজিকিস্তানের নাম সেই স্বল্পসংখ্যক রাষ্ট্রের তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে, যাদের ভূমিতে ব্রিটেন কখনো আক্রমণ পরিচালনা করতে পারেনি।

Related Articles