Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রাইং বয় পেইন্টিং: এক অভিশপ্ত ছবির গল্প

ছেলেবেলায় মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে ড্রইং রুমে একটি বড়সড় ছবি চোখে পড়তো। চার-পাঁচ বছরের একটি বাচ্চার ছবি, কাঁদো কাঁদো মলিন মুখের দুঃখ ভারাক্রান্ত ছবি। কেমন যেন এক ধরনের বিষণ্ণতা এনে দিত মনে। ভেবে পেতাম না কেন টানানো হয়েছিল ঐ ছবি। তবুও কেমন যেন এক ধরনের মোহ কাজ করতো ছবিটির প্রতি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ছেলেটির চোখ দুটির দিকে। পরবর্তীতে জানলাম, এই ছবির নামই বিখ্যাত ‘ক্রাইং বয় পেইন্টিং’।

দি ক্রাইং বয়; Source: drdavidclarke.co.uk

ছবিটিকে কেন অভিশপ্ত বলা হয় তার পেছনে অনেক ব্যাখ্যাতীত কারণ রয়েছে। ছবিটির ব্যাপারে প্রথম সবার নজরে আসে ১৯৮৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকা ‘দি সানে’ প্রকাশিত ‘ব্লেজিং কার্স অফ দি ক্রাইং বয় পিকচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। এই প্রতিবেদনে রন এবং মে হল নামে এক দম্পতির বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়। বাড়িটির প্রায় সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু অক্ষত থেকে যায় একটি বাচ্চার পেইন্টিং। অভিযোগের তীর এসে পড়ে ছবিটির প্রতি। সেই ইংরেজ দম্পতির মতে, ছবিটির কারণেই তাদের এই দুর্গতি।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন; Source: drdavidclarke.co.uk

ঘটনার আবর্তে হয়তো একসময় এই কাহিনীটাও মুছে যেত সকলের মন থেকে, কিন্তু দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, পনেরটিরও বেশি বাড়িতে তিনি একই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। সব বাড়িতেই একটি বিষয় আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। সবকটি বাড়িতেই ছিল একই ধরনের ক্রন্দনরত বাচ্চার ছবি। বাড়ির সবকিছু আগুনে জ্বলে গেলেও ছবিগুলোর একাংশ পোড়া ছাড়া তেমন কোনো বিশেষ ক্ষতি হয়নি। এই খবরে আবার নড়েচড়ে বসে পত্রিকাটি। বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে এই ধরনের ঘটনার সত্যতা জানতে পারা যায়।

বাচ্চাটির ছবি নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপানো হতে থাকে পত্রিকাটিতে। সাথে সাথে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ব্যাপক ভয় ভীতি। চারপাশ থেকে অসংখ্য ফোন এবং চিঠি আসতে থাকে। অনেকে ভাবতে থাকেন ছবিটি বাইরে ফেলে দিলেও তাদের পিছু ছাড়বে না এটির অভিশপ্ত আত্মা। আবার অনেকে নাকি আগুন জ্বালিয়ে পুড়তে গিয়েও ব্যর্থ হন। সমাধান এলো ‘দি সান’ পত্রিকার হাত ধরেই। ১৯৮৫ সালের হ্যালোইনের রাতে সকল ছবি পত্রিকা অফিসে জমা দেয়ার আহ্বান করা হয়। দমকল বাহিনীর সামনে কয়েকবারের চেষ্টায় পোড়ানো হয় শত শত ছবি।

আগুনে পোড়া হচ্ছে শত শত ছবি; Source: drdavidclarke.co.uk

এখন প্রশ্ন হলো, কী করে এতো সুন্দর একটি বাচ্চার ছবি অভিশপ্ত হয়ে উঠল? কার হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছিল এই অভিশপ্ত ছবি? এর উত্তরে অনেক ধরনের মতামত রয়েছে। সান পত্রিকার মতে, বিভিন্ন ছবিতে ‘গিয়াভোনি ব্রাগলিন’ নামে সিগনেচার রয়েছে। কিন্তু এই আর্টিস্ট সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা, বিভিন্ন ছদ্মনামে আঁকতেন বলে আসল আঁকিয়ে আড়ালে রয়ে গেছেন। তবে ২০০০ সালে প্রকাশিত কিছু অমীমাংসিত গল্পের সংকলন ‘হন্টেড লিভারপুল’-এ এই ছবি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। বইটিতে বলা হয় জর্জ মেলোরি নামে একজন স্কুল শিক্ষক এই ছবির আর্টিস্টকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সেই আর্টিস্টের আসল নাম ছিল ফ্রেঞ্চট সেভিল। পরবর্তিতে মেলোরি এবং সান পত্রিকার বিভিন্ন সূত্র ধরে জানা যায়, ডন বনিলো নামে এক দরিদ্র বাচ্চাকেই রঙতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন এই আর্টিস্ট।

‘অভিশপ্ত’ বাচ্চার ছবি; Source: verityholloway.com

১৯৬৯ সালের দিকের ঘটনা। ইতালির ভেনিসের রাস্তায় ঘুরছিল একটি শিশু। শিশুটির চোখে মুখে অপার বিস্ময়। মলিন মুখে মায়া মায়া চাহনি। পাদ্রিরা কেন জানি সেই ছেলেটির মধ্যে অশুভ আত্মার খোঁজ পান। তাদের মতে, বাচ্চাটি তার বাবা-মাকে আগুনে জ্বলতে দেখে সেখান থেকে পালিয়ে আসে। তারা বাচ্চাটিকে পিশাচ বলে ডাকতে থাকেন। কারও বাসায় বাচ্চাটিকে আশ্রয় পর্যন্ত দিতে নিষেধ করে দেন।

ক্রন্দনরত বাচ্চার ছবির ক্যানভাস; Source: atlasobscura.com

চিত্রশিল্পীর চোখে পড়ে বাচ্চাটি। মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে তিনি অনেকটা নিজের করে নিয়েছিলেন। পাদ্রিদের হাজার বারণ সত্ত্বেও তিনি বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। আদর-আপ্যায়নে বড় করতে থাকেন শিশুটিকে। তার বিষণ্ণ ক্লান্ত মলিন মুখখানা ফ্রেমবন্দী করতে থাকেন তিনি, যা খুব অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাপক প্রসার লাভ করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছবিগুলোর অনেক কপি বিক্রি করেন সেভিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই এক রহস্যজনক কারণে তার স্টুডিওতে আগুন লেগে যায়। পুড়ে যায় তার কাজের সকল জিনিসপত্র। তখন পাদ্রিদের বলা কথাগুলো তার মনে পড়ে আর মনে মনে বিশ্বাস করেন যে, এই বাচ্চাটির জন্যই তার এই দুরাবস্থা। সাথে সাথে বাচ্চাটিকে সেখান থেকে বের করে দেন তিনি। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ক্রাইং বয়; Source: toptenz.net

এই প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে। ইংল্যান্ডের মাসিক পত্রিকা ‘ফরটিন টাইমস’ এর সাংবাদিক ড. ডেভিড ক্লার্ক এই ক্রাইং বয় সিরিজের ছবিগুলোর উপর গবেষণা করেন। তার মতে, এই সিরিজের ছবিগুলো প্রথম কে তৈরি করেছেন, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। কেননা এই ছবিগুলোর আর্টিস্ট বেশিরভাগ সময়ই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। গ্রিওভানি বেগোলিন ও সেভিলই সর্বাধিক উচ্চারিত নাম, যে সকল ছদ্মনামের পেছনে ব্রুনো এমাডিও প্রকৃত নাম হিসেবে ধরা হয়।

বলা হয়, ব্রুনো এমাডিও ইতালির ভেনিস শহরে কাজ করার সময় প্রথম ক্রাইং সিরিজের কাজ করেন। সেই সময় তিনি একটি বাচ্চার ক্রন্দনরত অবস্থার ছবি ফুটিয়ে তোলেন প্রায় ৬৫টি ছবিতে। সবগুলো ছবিতেই বাচ্চার বিমর্ষ ক্রন্দনরত মুখ আর মুখের থুতনিটা কিছুটা নিচের দিকে করে আঁকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের উদ্দেশ্য করে এসব ছবি তৈরি করা হয়। এই সকল ছবি সেই শিশুদের কথা বলে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এতিম হয়ে গিয়েছিল, যাদের আপনজন বলে কেউ ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ছবিগুলো এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ইংল্যান্ডেই এই ছবির পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি করা হয়।

এই ঘটনার বেশ কিছু বছর পর ১৯৭৬ সালের দিকে স্পেনের বার্সেলোনাতে এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। একটি চলন্ত কার সজোরে ধাক্কা দেয় একটি দেয়ালকে। সাথে সাথে লেগে যায় আগুন। গাড়ির ড্রাইভার সহ পুরো গাড়ি জ্বলে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। জ্বলন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সের খানিকটা অক্ষত অংশ থেকে জানা যায়, গাড়ি চালাচ্ছিল ১৯ বছর বয়সী ডন বনিলো নামের এক কিশোর। কিন্তু এই ছেলের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি কখনো। অভিশপ্ত ছবি নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন এই ঘটনা যেন পুনরায় হালে পানি দিল। গাড়িতে জ্বলে যাওয়া ঐ ছেলেটির সাথে এই অভিশপ্ত ছবির মিল বের করে ধারণা করা হয় বাচ্চাটির অভিশপ্ত আত্মা এখনো বন্দী রয়েছে ছবিগুলোর মধ্যে!

অভিশপ্ত সিরিজের আরেকটি ছবি; Source: charlesfortslocker.wordpress.com

ঘটনার ব্যাখ্যা যেমনই হোক না কেন, এই ধরনের অলৌকিক কিছু ঘটনা যে ঘটেছে তা কিন্তু একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। অনেকের মতে, বাড়িগুলোতে আগুন লাগার কারণ খামখেয়ালিপনা ও অসতর্কতা। আর ছবি না পোড়ার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন যে, ছবিটিতে এমন এক ধরনের পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে ছবিটি সম্পূর্ণভাবে পুড়তে পারে না।

২০১০ সালের দিকে স্টিভ পান্ট নামে এক ব্যক্তি একটি ক্রাইং বয়ের ছবি পোড়ানোর একটা ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেন। তার মতে শুধুমাত্র বাড়তি কাটতির আশায় সান পত্রিকাটি বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প তৈরি করেছিল, যা তাদের পক্ষেই কাজ করেছিল। কিন্তু এমন সহজ সমাধান কল্পনাপ্রবণ মানুষ যেন সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই আজও যারা এই ছবিটির ব্যাপারে কিঞ্চিৎ জ্ঞান রাখেন, তাদের বাড়িতে এই ছবি খুব একটা ঠাঁই পেতে দেখা যায় না।

ফিচার ইমেজ- ilxor.com

Related Articles