আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে জিম জোন্স নামক একজন ক্যারিশম্যাটিক আমেরিকান ধর্মীয় গুরু সারা বিশ্বে তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বর গায়ানার এক গভীর জঙ্গলে তিনি তার হাজার খানেক আমেরিকান অনুসারীর মাঝে সায়ানাইড মিশ্রিত এক ধরনের পানীয় বিলি করেন এবং তা পান করে সবাইকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেন। গুরুর নির্দেশ অলঙ্ঘনীয়! তাই সেখানে উপস্থিত প্রায় সবাই সেই পানীয় পান করে ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করিয়ে জন্ম দেয় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণ-আত্মহত্যার।
অবশ্য এই ঘটনাকে বিশ্ব মিডিয়া গণ-আত্মহত্যার পরিবর্তে গণহত্যা হিসেবেই প্রচার করে এবং এটি 'জোন্সটাউন গণহত্যা' বা 'জোন্সটাউন ম্যাসাকার' হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। ৯/১১ এর পূর্বে এটিই ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একসাথে সবচেয়ে বেশি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা। ৯০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায় এই গণহত্যায়, যার মধ্যে একটি বড় অংশই ছিল শিশু।
জিম জোন্সের জন্ম হয়েছিল আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান এবং কিছুটা অদ্ভুত স্বভাবের। কিশোর বয়স থেকেই ধর্মের প্রতি তার টান ছিল প্রবল। Pentecostalism এর মত সংস্কারবাদী খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদগুলোর প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। তরুণ বয়স থেকেই তিনি রাস্তায় রাস্তায় ধর্ম প্রচার শুরু করেন। বর্ণবাদ প্রথার বিরুদ্ধে তখন থেকেই তার ছিল বলিষ্ঠ কণ্ঠ।
একসময় খ্রিস্টান ধর্মের সাথে কম্যুনিজম এবং সোশ্যালিজম জুড়ে দিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের ধর্ম প্রচার শুরু করেন। জিম জোন্সের স্বকীয় ধর্ম প্রচার কৌশল, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার কণ্ঠ, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি এবং সর্বোপরি তার তারুণ্যের উদ্যম খুব দ্রুতই তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। বেশ কিছু ভক্ত জুটে যায় তার। তিনি তার নতুন প্রচারিত মতবাদের নাম দেন 'পিপল'স টেম্পল'।
১৯৬৫ সালে জিম জোন্স তার অনুসারীদের ইন্ডিয়ানা থেকে ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়ে বসবাস করার নির্দেশ দেন। সেসময় তার বয়স ছিল ৩৫ বছরের কাছাকাছি। তিনি ধীরে ধীরে সনাতন খ্রিস্টান বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন এবং নিজেকে একজন মসিহা বা নবী বলে দাবি করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের মতো মহাপুরুষ হিসেবে জোর প্রচারণা চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে জোন্স ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়াতে পিপল'স টেম্পলের একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে।
জিম জোন্স তার অনুসারীদেরকে নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। অভাবগ্রস্থ মানুষদেরকে সাহায্য করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। কীভাবে সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠীদেরকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়নে তাদের কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে কাজ করা শুরু করেন এই টেম্পলের অনুসারীরা। অবশ্য আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে নিজের দর্শনের প্রতি আকর্ষিত করাও এসব জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।
ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা সময়েই জোন্স একবার দাবি করে বসেন যে তিনি নাকি বিভিন্ন ধরনের মোজেজা (Miracle) দেখাতে পারেন। তার মধ্যে একটি ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে সারিয়ে তোলা। যদিও আদতেই তিনি কাউকে কখনো সারিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। অবশ্য তার ভক্তকূল এই প্রচারণাটি বেশ আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিল।
১৯৭০ সালের দিকে এসে পিপল'স টেম্পল রাজনৈতিক দলগুলোর সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়। এসময় জোন্সের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সখ্য গড়ে ওঠে। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকার কারণে জিম জোন্স ও তার পিপল'স টেম্পল অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং হার্ভি মিল্ক এর মতো বামপন্থী নেতার এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো বিপ্লবী কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলা সংগঠনের সুদৃষ্টি লাভ করে। ব্ল্যাক প্যান্থারের সুদৃষ্টি থাকায় বিপুল সংখ্যক আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পিপল'স টেম্পলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
জীবনের বেশিরভাগ সময় আমেরিকায় কাটানো জিম জোন্স কোনো এক কারণে আমেরিকার নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কিত থাকতেন। তার ধারণা ছিল, খুব শীঘ্রই আমেরিকার ওপর নিউক্লিয়ার হামলা হবে। কিন্তু কেন হবে বা কারা তা করবে, সে সম্পর্কে তিনি কখনোই সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি। বরং এই নিউক্লিয়ার হামলার ধারণা তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে সজোরে প্রচার করতে থাকেন। নিজের মতাদর্শ এবং অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি সবাইকে নিয়ে আমেরিকা ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সবার থাকার মতো ভূখণ্ডের খোঁজ চলতে থাকে।
অবশেষে গায়ানার এক গহীন জঙ্গলের পরিত্যক্ত বিশাল একটি এলাকা পছন্দ হয় জোন্সের। ১৯৭৭ সালে তিনি ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দল বেঁধে রওনা হন গায়ানার উদ্দেশে। সেখানে তারা পিপল'স টেম্পলের নতুন চার্চ স্থপন করেন।
গায়ানার ওই জঙ্গলে এক নতুন শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন জোন্স। তবে সরকার এবং গণমাধ্যমবিহীন ওই সমাজের প্রধান সমস্যা ছিল বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে জোন্সের অনুসারীরা সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। তারা আশেপাশের বনজঙ্গল কেটে সেগুলোকে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করেন। শুরু হয় কৃষিভিত্তিক এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, যা পরবর্তীতে জোন্সটাউন নামে খ্যাতি লাভ করে।
জোন্সটাউনের সদস্যদের দিনের বেলায় বাধ্যতামূলক ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সন্ধ্যার পর থাকত জিম জোন্সের বক্তৃতা শোনার পর্ব। সপ্তাহের কিছু কিছু রাতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হতো। অবশ্য চলচ্চিত্রের পরিবর্তে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ভীতিমূলক বিভিন্ন তথ্যচিত্রই বেশি প্রদর্শিত হতো। বাইরের সমাজের সাথে যোগাযোগ না থাকায় জোন্সটাউনে খাদ্যের অভাব ছিল প্রবল। তার ওপর যেকোনো ভুল কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা তো ছিলই।
জোন্সটাউনে থাকা অস্থায় জোন্সের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তিনি ধীরে ধীরে বাস্তব জগত এবং কাল্পনিক জগতের মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। অবশ্য এসবের পেছনে উচ্চমাত্রার ড্রাগ গ্রহণ অন্যতম কারণ ছিল। একসময় তিনি তার অনুসারীদেরকে বাইরের শত্রুর আক্রমণের ভয় দেখাতে শুরু করেন।
জোন্সটাউন গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা একজন বলেন,
"জোন্স আমদের প্রায়ই বলতেন যে, আমেরিকায় আফ্রো-আমেরিকানদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছে। সেখানে তাদের ওপর মানবতাবিরোধী অত্যাচার চালানো হচ্ছে। আমেরিকানরা এই গায়ানাতেও আমাদের রেহাই দেবে না, কারণ আমরা নতুন এক সমাজ গঠন করেছি। তারা এখানে এসে আমাদের হত্যা করবে।"
জোন্সটাউনে আমেরিকানদের এই কাল্পনিক আক্রমণের একটি সমাধানও বের করে ফেলেন জোন্স। আর তা হলো গণ-আত্মহত্যা! অবশ্য জোন্স এর নামকরণ করেছিলেন 'বিপ্লবী মৃত্যু'। তিনি তার অনুসারীদের বলেন যে, যদি কখনো শত্রুপক্ষ জোন্সটাউন আক্রমণ করে, তবে সবাই যেন এই বিপ্লবী মৃত্যু স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়।
১৯৭৮ সালের দিকে যখন বর্ণবাদ এবং দারিদ্র্যমুক্ত জোন্সটাউনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন একজন আমেরিকান কংগ্রেসম্যান- লিও রায়ান, জোন্সটাউন প্রকল্প পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৮ জন সদস্যের একটি পরিদর্শক দল নিয়ে গায়ানার উদ্দেশে রওনা হন এবং ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৮ তারিখে জোন্সটাউনে জিম জোন্স এবং তার অনুসারীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
জোন্সটাউনের পরিস্থিতি কংগ্রেসম্যান রায়ানের কাছে বেশ স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। জোন্সের অনুসারীরা যে স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে গায়ানায় এসেছেন, তা-ও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে গায়ানা ত্যাগের পূর্বে জোন্সের কাছে নিজের সন্তুষ্টির কথা অকপটে প্রকাশ করেন তিনি।
কিন্তু এরপরও কংগ্রেসম্যানের এই সফর নিয়ে জোন্সের উৎকণ্ঠা কাটলো না। তার ভয় হচ্ছিল, যদি রায়ান আমেরিকায় গিয়ে জোন্সটাউনের নামে কোনো বৈরী মন্তব্য করেন, তাহলে সরকার হয়তো তার গোটা জোন্সটাউন প্রজেক্টই বন্ধ করে দিতে পারে।
তা যাতে না হয়, সেজন্য জোন্স তার সিকিউরিটি ফোর্সকে পরিদর্শক দলের ওপর হামলা করার জন্য পাঠান। পরিদর্শক দল যখন গায়ানার বিমানবন্দরে পৌঁছে, তখন তাদের ওপর হামলে পড়ে জোন্সের বাহিনী। তাদের হামলায় চারজন পরিদর্শক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে কংগ্রেসম্যান লিও রায়ানও ছিলেন। তিনি মোট ২০টি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
আমেরিকান কংগ্রেসম্যান নিহত হয়েছেন। এখন তো জোন্স ও তার পিপল'স টেম্পল এর বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। আমেরিকান সরকার অবশ্যই তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাবে। তাই এই গ্রেফতার এবং গ্রেফতার পরবর্তী নির্যাতন এড়াতে জোন্স তার অনুসারীদেরকে গণ-আত্মহত্যার নির্দেশ দেন।
তবে একজন নারী অনুসারী এর আংশিক বিরোধিতা করে বলেন, "মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। মরতে আমি রাজি আছি। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদেরকে বাঁচার সুযোগ দেয়া হোক।" এর উত্তরে জোন্স বলেন, "বাচ্চাদের শান্তি প্রয়োজন। আমেরিকান বাহিনী আমাদের সাথে যা করতে যাচ্ছে, তা দেখার চেয়ে তাদের মৃত্যুবরণ করাটাই শ্রেয়।"
জোন্সের নির্দেশে সায়ানাইড মিশ্রিত একধরনের পানীয় ভর্তি ড্রাম নিয়ে আসা হয় চার্চ প্রাঙ্গনে। একে একে সবাই সেই পানীয় পান করে এবং ইঞ্জেকশনে করে নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। শিশুরাও বাদ যায়নি। তাদের শরীরেও ইঞ্জেক্ট করা হয় সায়ানাইড। এসময় জোন্স সবাইকে দ্রুত এই আত্মহত্যা কার্যক্রম শেষ করার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
অবশ্য জোন্স নিজে সায়ানাইডের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেননি। সায়ানাইড গ্রহণের পর তার অনুসারীদের যে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যু হচ্ছিল, তা দেখে তিনি ওই রাস্তা বাদ দেন। তার বদলে তিনি মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
পরবর্তীতে গায়ানার সেনাবাহিনী যখন কংগ্রেসম্যানের হত্যাকারীদের ধরতে জোন্সটাউনে যান, তারা ভেবেছিলেন হয়তো জিম জোন্সের অনুসারীরা তাদের ওপর আক্রমণ করে বসবে। কিন্তু কীসের কী! জোন্সটাউনে পৌঁছার পর তাদের সবার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাবার অবস্থা হয়। যত দূর চোখ যায়, শুধু লাশ আর লাশ। একজন আরেকজনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশু- কেউ বাদ যায়নি।
সেদিনের সেই লাশের মিছিলের মধ্যে শিশু ছিল ৩০০ জন, যাদেরকে তাদের পিতামাতা হত্যা করেছিল। বৃদ্ধ নাগরিকের সংখ্যাও ছিল ৩০০ জনের মতো। জোন্সটাউনের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় তাদের শরীরে সায়ানাইড প্রবেশ করানো হয়। বাকিরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিল মৃত্যুকে।
জোন্সটাউনের ঘটনাকে গণহত্যা বা গণ-আত্মহত্যা যাই বলা হোক না কেন তা আমেরিকার ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। ওইদিন যারা মৃত্যুবরণ করেছিল, এমন নয় যে তারা সবাই নিরক্ষর এবং চলমান নাগরিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে অজ্ঞ। বরং জিম জোন্সের অনেক অনুসারীই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাহলে কেনই বা এত বিপুল সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র একজনের কথায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে নিজেকে ধ্বংস করে দিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানাই রয়ে গেছে।
This article is written in Bengali language and it contains information about the story of Jonestown Massacre. All informations are hyperlinked inside this article.
Featured image: www.theguardian.com