অনেকে বলে থাকেন, কোন সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ, তা নির্ভর করে তা অন্য সংস্কৃতিকে কতটা গভীরভাবে নিজের মধ্যে নিয়ে নিতে পারে তার উপর। এই কথার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। তবে চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই উক্তি কিছুটা হলেও খাটে। চীনের সভ্যতা কখনও ধ্বংস হয়নি, শুধু রূপান্তরিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। সে হিসেবে এটি পৃথিবীতে ব্যতিক্রম।
ইতিহাসে দেখা যায়, চীনে বিভিন্ন সময় বাইরের বিশ্বের প্রভাব পড়েছে। তবে তা এই প্রাচীন সভ্যতাকে ততটা ধরাশায়ী করতে পারেনি। বরং চীনের সংস্কৃতির প্রভাবে বাইরের প্রভাবের বিভিন্ন দিকও সময়ের সাথে একেবারে বদলে গেছে।
চীনে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব সম্পর্কেও একথা বলা যায়।
ঠিক কখন থেকে চীনে মুসলিম সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক আগমন শুরু হয়, তা নিয়ে ইতিহাসে মতভেদ থাকতে পারে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের বেশ আগে থেকেই ব্যবসায়িক সূত্রে আরব বণিকদের সাথে চীনাদের পরিচয় ছিলো। প্রথমত ব্যবসায়িকদের হাত ধরেই মুসলিম সংস্কৃতি চীনে তার জায়গা করতে শুরু করে।
ট্যাং সাম্রাজ্য ক্ষমতাসীন থাকার সময় চীনের সাথে মুসলিম অঞ্চলগুলোর যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো, সং সাম্রাজ্য অধিষ্ঠিত হলে তা আরো প্রসারিত হয়। চীনে মুসলিম বসতি আগেই শুরু হয়েছিলো, তবে এ সময় তার প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের বৈদেশিক বাণিজ্য মুসলিমরা নিয়ন্ত্রণ করছিলো। রাজনৈতিক কারণেও চীনের সম্রাট বহুসংখ্যক আরব জনগোষ্ঠীকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে আসেন।
১৩৪৮ সালে চীনে মিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। এসময় মঙ্গোল জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে বেশ কিছু মুসলিম জনগোষ্ঠীও চীনে এসে বসবাস শুরু করে। তবে এ সময় সমুদ্রের তীরবর্তী বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে মুসলিমদের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। কারণ বিশাল চীন সাম্রাজ্য এ সময় বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছিলো।
তবে চীনা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ সময় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসছিলো। তারা স্থানীয় সংস্কৃতি গভীরভাবে গ্রহণ করতে থাকে। তারা চীনা নাম আত্মপরিচয় হিসেবে গ্রহণ করতে থাকেন। এ সময়ের মজার ঘটনা হচ্ছে, বহু পরিচিত মুসলিম নাম চীনা রীতিতে নতুন রূপ লাভ করেছিলো! নামের মধ্যে ‘হা’ ধ্বনি দ্বারা হাসান, ‘হু’ ধ্বনি দ্বারা হুসাইন ও ‘সাআ’ ধ্বনি দ্বারা ‘সাইদ’ নাম এসময় মুসলিমদের মধ্যে দেখা যেতে থাকে।
সময়ের সাথে সাথে মিং রাজবংশে মুসলিম উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। এমনকি সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতেও প্রশিক্ষক ও পদস্থ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মুসলিম চরিত্র দেখা গেলো।
লান ইয়ু ছিলেন এমন একজন মুসলিম সেনাধ্যক্ষ। তিনি মিং সম্রাট ঝু য়ুয়ানঝাং এর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। মিং সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত তিনজন সেনাপ্রধানের মধ্যে তাকে একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। সাম্রাজ্যের বহু সামরিক বিজয়ের সাথে তার নাম জড়িত। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উত্তর এশিয়ায় চেঙ্গিস খানের পরিবার চালিত মঙ্গোল শক্তির বিরুদ্ধে অভিযান। ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে তিনি অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশাল সৈন্যদলের জন্য খাদ্য ও রসদের স্বল্পতা নিয়েই তিনি যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, শত্রুপক্ষের প্রায় ৮০ হাজার পরাজিত যোদ্ধাকে তিনি বন্দী করেছিলেন, যার মধ্যে রাজপরিবারের সদস্যরাও ছিলো। এই যুদ্ধের ফলে মঙ্গোলরা আগের চেয়ে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো।
মিং সাম্রাজ্যের আরেকজন মুসলিম সেনাধ্যক্ষ ছিলেন মু য়িং। ধারণা করা হয়, তিনি ‘হুই’ জনগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও এখন অবধি এটি সত্য হিসেবে ধরা হয়। তার নামের ‘মু’ অংশটি ‘মুহাম্মদ’ শব্দ থেকে আগত বলে মনে করা হয়। মিং সাম্রাজ্যের প্রতি বিশ্বস্ততার পুরস্কার স্বরূপ তাকে য়ুনান প্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। তিনি ও তার বংশধররা মিং সাম্রাজ্যের শেষ দিন অবধি আস্থার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
চীনে মিং রাজত্বকালে সম্ভবত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সেনাধ্যক্ষ ছিলেন হু দাহাই। ঐতিহাসিকরা তাকে ইরান থেকে আগত মুসলিম হিসেবে গণ্য করে থাকেন। বর্তমান আনহুই প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উত্তর এশিয়ায় মিং রাজবংশের আক্রমণের সময়ই তিনি চীনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আনহুই অঞ্চলে মিং সাম্রাজ্যের অভিযানে তিনি বিরল সাফল্যের উদাহরণ রেখেছিলেন। প্রতিপক্ষ ‘মিয়াও’ রাজবংশের অনেক সেনাপতিকে তিনি বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইয়াংজি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল জিয়াংনান এলাকা তার শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়েছিলো। সান জু’র মতো হু দাহাই সামরিক কৌশল ও যুদ্ধনীতির বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন।
আনহুই প্রদেশ থেকেই মিং সাম্রাজ্যের আরেকজন মুসলিম সেনাধ্যক্ষ নাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন চ্যাং য়ুচান। চীনে মিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছেন। ১৩৫৫ সালে চীনে মঙ্গোল বিরোধী বিদ্রোহে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তা যুদ্ধে রূপ নিলে চীনারা বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। সেই যুদ্ধে চ্যাং য়ুচানের বীরত্ব আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়ে থাকে। মিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে ‘য়ুয়ানশুইয়াই’ বা মার্শাল র্যাংক প্রদান করা হয়। মিং সাম্রাজ্যের প্রধান শত্রুদের বিরুদ্ধে তিনি বেশ কিছু যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা পেয়েছিলেন। প্রচলিত ছিলো যে, চ্যাং য়ুচান একাই ১,০০,০০০ সৈন্যের বাহিনীর সমান বীরত্বপূর্ণ ছিলেন। ১৩৬৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে মিং সম্রাট শোকে অভিভূত হয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন।
শুধু সেনাবাহিনীর উচ্চ পদেই নয়, অভিযাত্রী ও সমুদ্রযাত্রার অধিনায়ক হিসেবেও চীনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর খ্যাতি ছিলো। এক্ষেত্রে চীনের ইতিহাসে ঝেং হে’এর নাম রীতিমতো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। একাধারে প্রশাসক, সেনাপতি, দপ্তরপ্রধান ও নাবিক হিসেবে তিনি বহুবিধ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৩৭১ সালে দক্ষিণ চীনের য়ুনান অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ শতকের শেষ দিকে আরব ও অন্যান্য অঞ্চলের সাথে চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক বেড়ে যায়। ফলে এসময় চীন সাম্রাজ্য বেশ কিছু অনুসন্ধানমূলক নৌ অভিযাত্রার আয়োজন করে। চীনের মিং সম্রাট ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকা অঞ্চলে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন।
১৪০৫ সালের ১১ জুলাই ঝেন হে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চীনের নৌ অভিযাত্রার এডমিরাল হিসেবে ভ্রমণ শুরু করেন। মোট ৩১৭ টি জাহাজ আর ২৮,০০০ সহযোগী নিয়ে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন জাভা, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, উত্তর আফ্রিকা ও আরব অঞ্চল। চীনের পক্ষ থেকে এসব অঞ্চলে নিয়ে গেছেন রেশম, স্বর্ণ, রূপা ও চীনামাটির শিল্পকর্ম। বিনিময়ে অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে চীনকে দেওয়া হয় উটপাখি, জেব্রা, উট ও হাতির দাঁতের অমূল্য নিদর্শন।
শুধু সেনাধ্যক্ষ বা অভিযাত্রী হিসেবে নয়, বিদ্যান ও দার্শনিক হিসেবেও চীনা মুসলমানরা খ্যাতি পেয়েছেন। লিন নু ছিলেন এমনই একজন চিন্তাশীল মনীষী। আনুমানিক ৩০ বছর বয়সে ১৩৭৬ সালে লিন নু পারস্য ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং এক পারসিক নারীকে বিয়ে করেন। তিনি কনফুসীয় মতবাদকে ইসলামের উদার ধর্মতত্ত্বের আওতায় এনে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। মিং সাম্রাজ্যের শেষ দিকের বিখ্যাত তাত্ত্বিক ও দার্শনিক লি ঝি তার বংশধর ছিলেন।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে চীন বিরাট ঐশ্বর্যের অধিকারী। ঐতিহাসিকভাবে এই বৈচিত্র্য সময়ের সাথে শুধু বেড়েই চলেনি, নিজের ভূখণ্ডের বাইরে প্রভাবও বিস্তার করেছে। ভৌগলিক কারণে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের সাথে মুসলিম অঞ্চলগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ একরকম অনিবার্যই হয়ে পড়েছিলো। ফলে তার থেকে সাংস্কৃতিক বিনিময়ও শুরু হয়। যার কারণে ধর্মবিশ্বাস হিসেবে চীনে ইসলামের যাত্রা বিস্তার লাভ করেছিলো। চীনের সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে মুসলিম আচার আচরণ ও সামাজিকতা রূপান্তরিত হয়ে নতুন আঙ্গিক লাভ করেছিলো। যা আসলে চীনকে বিভিন্ন দিক থেকে লাভবান করে তুলেছিলো। চীন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক বিস্তার, বাণিজ্যিক প্রসার অথবা বৈদেশিক সম্পর্কের সমৃদ্ধি- সব ক্ষেত্রেই চীনা বংশোদ্ভূত মুসলিম সেনাপতি, অভিযাত্রী ও বিদ্বানরা অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। চীনের প্রাচীন ও নতুন ইতিহাস লেখকরা মুসলিমদের এসব অবদানের কথা নির্দ্বিধায় আর মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন।
This Bangla article about the story the muslim generals, explorers and scholars of ancient China.
References:
01. Lan Yu -- An Extraordinary General in History of China Who Had to Die With His Best Friend
02. Zheng He: Famous Chinese Explorer Who Added Wealth and Power to the Ming Dynasty
03. Islam’s 1300-year history in China
04. Islam in China