মৃত্যু আমাদের জীবনের এমনই এক সত্য যা থেকে মুক্তি মিলবে না কারোরই। তবে সবাই চায় স্বাভাবিক এক মৃত্যু, যা পাওয়া হয়ে ওঠে না অনেকেরই। আজকের লেখায় আমরা কয়েকজন রাজা-রানীর মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানবো, যাদের মৃত্যুর কারণ ছিলো এতটাই অদ্ভুত যে, সেটা বিশ্বাস করাও কষ্টকর।
১. রাজা দ্বিতীয় জেমস
স্কটল্যান্ড
১৪৩৭-১৪৬০ পর্যন্ত টানা ২৩ বছর স্কটল্যান্ডের ক্ষমতার মসনদে ছিলেন রাজা দ্বিতীয় জেমস। ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ রাজ্যের উন্নয়নে নানাবিধ কাজই তিনি করেছিলেন। ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগোর প্রতিষ্ঠা ছিলো এর মাঝে অন্যতম উল্লেখযোগ্য। তবে এটাও বলতে হয় যে, আর্ল অফ ডগলাসের খুনের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টিও তার খ্যাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, নেতৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এমন যে কাউকে সরিয়ে দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।
স্কটিশদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ততদিনে শেষ হয়ে গেলেও সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা তখনও ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। এর মাঝে একটি ছিল রক্সবার্গ দুর্গ। রাজা ভেবেছিলেন, ওয়্যার অফ রোজেসের মাধ্যমে ইংরেজদের শক্তি দুর্বল হয়ে গেলে তিনি হয়তো এই দুর্গটি পুনরায় অধিকার করে নিতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই চিন্তাভাবনাই রাজার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
জেমস অস্ত্রশস্ত্র খুব পছন্দ করতেন। সেনাবাহিনীর জন্য ফ্ল্যান্ডার্স থেকে কামান আনিয়েছিলেন তিনি। খুব শখ ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলোর কাজকারবার দেখবেন। সেই আশাতেই একটি কামানের খুব কাছে গিয়ে দেখছিলেন তিনি। কিন্তু শত্রুপক্ষের দিকে গোলা নিক্ষেপের পরিবর্তে কামানটি নিজেই বিস্ফোরিত হয়ে যায়! ত্বরিতগতিতে ছুটে আসা কামানেরই একটি অংশের আঘাতে অল্প সময়ের মাঝেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাজা।
শখের কামানগুলো শত্রুপক্ষের হন্তারক হবার আগে রাজাকেই পরপারের টিকিট ধরিয়ে দিলো।
২. রাজা অষ্টম চার্লস
ফ্রান্স
রাজা অষ্টম চার্লস ১৪৮৩ সালে যখন ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। এত অল্প বয়সে রাজ্য চালানোর মতো গুরুদায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না বলে তার রাজপ্রতিভূ হয়ে আসেন বড় বোন অ্যান এবং অ্যানের স্বামী ডিউক অগ বোর্বন। চার্লসের পুরো রাজত্বকালের অর্ধেক সময়ই বলতে গেলে তারা তার রাজপ্রতিভূ হয়ে ছিলেন।
রাজা হিসেবে তার সময়কালটা ছিলো একেবারেই নিরুত্তাপ। রাজনীতি, রাজ্য পরিচালনার মতো বিষয়গুলো তাকে একেবারেই আকর্ষণ করতো না। ক্ষমতা দৃঢ় করতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহের সাথে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি, যার ফলে ফ্রান্সের সাথে ইতালির বেশ কিছু অঞ্চলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ঝামেলাকে বরাবরই এড়িয়ে চলতে চাওয়া এই রাজার মৃত্যু এতটা অদ্ভুতভাবে হয়েছিল যে, সেভাবে যে আসলেই কারো মৃত্যু হতে পারে সেটাই কল্পনা করা যায় না।
টেনিস খেলার কারণেই মৃত্যু হয় রাজা অষ্টম চার্লসের। তবে সেখানে তিনি খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন না, ছিলেন কেবলই একজন দর্শক হিসেবে। চলাচলের একপর্যায়ে একটি দরজার উপরের দিকের কাঠের সাথে সজোরে ধাক্কা খান রাজা। তখন সেই ব্যথাকে উড়িয়ে দিলেও খেলা শেষ হবার পরপরই তিনি কোমায় চলে যান। ঘণ্টাখানেক পরই মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়েন তিনি।
৩. সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ
অস্ট্রিয়া
অস্ট্রিয়ার ইতিহাসে দীর্ঘসময় ধরে যারা সিংহাসন ধরে রেখেছিলেন, সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ তাদের মাঝে অন্যতম। সম্রাট প্রথম ফ্রাঞ্জ জোসেফের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর ৪৪ বছর ধরে তিনি অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী এবং হাঙ্গেরির রানীর পদটি নিজের করে রেখেছিলেন।
১৮৯৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লুইজি লুচেনি নামক এক আততায়ীর হামলায় প্রাণ হারান এলিজাবেথ। অদ্ভুত বিষয় হলো, তিনি কিন্তু মোটেও লুচেনির টার্গেট লিস্টে ছিলেন না। বরং ‘ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকা’ বলে যে একটা কথা আছে, সেটিকে আরও একবার সত্য প্রমাণ করতেই যেন প্রাণ দিতে হয় সম্রাজ্ঞীকে।
ইতালীয় নৈরাজ্যবাদী লুচেনির রাগ ছিলো রাজপরিবারের সকল সদস্য এবং সকল ধনীর প্রতিই। এই রাগ ঝাড়ার জন্যই তিনি টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ডিউক অফ অর্লিন্স প্রিন্স ফিলিপকে।
দিনক্ষণ ঠিক করে রাখলেও জেনেভায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায় লুচেনির। ফলে টার্গেট মিস করে বসেন তিনি। একটি পত্রিকা নিয়ে তাই খুঁজতে থাকেন পরের টার্গেট কে হতে পারে তাকে। দুর্ভাগ্যবশত সেই নামটি ছিলো এলিজাবেথের। সম্রাজ্ঞী কোথায় আছেন সেটি বের করে সরাসরি সেখানে চলে যান তিনি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন এলিজাবেথ বেরিয়ে আসেন, তখনই সুযোগ বুঝে তার বুকে ছুরি নিয়ে হামলে পড়েন লুচেনি।
নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপও লক্ষ্য করা যায়নি এই আততায়ীর মাঝে। জেলে নিজের কক্ষেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
৪. রাজা আলেকজান্ডার
গ্রিস
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এই রাজা আমাদের সকলের পরিচিত ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ নন। বরং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি গ্রিসের সিংহাসনে বসেছিলেন। অবশ্য ক্ষমতার স্বাদ বেশি দিন পাননি তিনি। ক্ষমতারোহণের মাত্র তিন বছর পরই রাজ-চিড়িয়াখানার এক বানরের কামড়ে মারা যান আলেকজান্ডার। তখন তার বয়সও ছিলো অল্প, মাত্র ২৭ বছর।
রাজা একদিন তার পোষা কুকুরের সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় চিড়িয়াখানার এক বানরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে কুকুরটি। নির্বোধ প্রাণীগুলোকে থামাতে গিয়েই একটি বানরের কামড় খেয়ে বসেন রাজা। তার ক্ষতস্থানটি পরিষ্কার করে ড্রেসিংও করে দেয়া হয়েছিল। রাজাও বিষয়টিকে এতটা আমলে না নিয়ে রাজকার্যে মনোযোগ দেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে রাজার, কারণ ক্ষতস্থানটি ঠিকমতো পরিষ্কারই করা হয়নি। ফলে সেটি আস্তে আস্তে তার দেহে প্রভাব ফেলতে থাকে। কোনো চিকিৎসক যদি রাজার পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, তাহলেই হয়তো বাঁচানো যেত তাকে। কিন্তু কেউই সেই পরামর্শটি দেবার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি। টানা তিন সপ্তাহ রোগে ভুলে অবশেষে ১৯২০ সালের ২৫ অক্টোবর মারা যান তরুণ এই রাজা।
৫. প্রথম ফ্রেডেরিক
রোম
রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক ১১৫২ সালে জার্মানির, পরবর্তীতে ইতালির এবং সর্বশেষ ১১৫৫ সালে রোমেরও রাজা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। সর্বমোট ৩৫ বছর রাজত্ব করেছেন তিনি। ১১৯০ সালে তৃতীয় ক্রুসেডে অংশ নিতে গিয়েই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বেশ অদ্ভুতভাবেই হয়েছিল তার সেই মৃত্যু।
সেই সময় মুসলিম সেনাদের নিয়ে তুরস্কে অবস্থান করছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী। ওদিকে জার্মান বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক। ফ্রেডেরিক তার বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দিয়েছিলেন তুরস্কের অভিমুখে। একসময় তারা তুরস্কের গোক্সু নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হন, যা সেই সময় সালেফ নামে পরিচিত ছিলো। অন্যরা পরামর্শ দিয়েছিল একটি ব্রিজ বানিয়ে তারপরই এই উত্তাল নদী পাড়ি দিতে। কিন্তু ফ্রেডেরিকের আর তর সইছিলো না। তাই তিনি বললেন, ঘোড়ার পিঠে চড়েই নদী পাড়ি দেয়া যাবে। নিজের বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করতে রাজা নিজেই প্রথমে নদী পার হতে শুরু করেন। কিন্তু তীব্র স্রোতের তোড়ে তাল হারিয়ে ফেলে ঘোড়াটি। গায়ে ভারি বর্ম থাকায় রাজা নিজেও ঠিকমতো সাঁতার কাটতে পারেননি। ফলে পানিতে ডুবেই মৃত্যু হয় রাজার।
৬. দ্বিতীয় চার্লস
নাভার
১৩৪৩ থেকে ১৩৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর নাভারের শাসনভার পরিচালনা করেছেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মাঝে চলমান হান্ড্রেড ইয়ার্স ওয়্যারের সময় তিনি সুবিধাবাদীর ভূমিকা পালন করেছেন। যখন যে পক্ষ থেকে কিছু লাভ করা যায়, তখনই সেই পক্ষে যোগ দিয়েছেন। ফলে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘চার্লস দ্য ব্যাড’ নামে।
চার্লসের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে নানারকম কাহিনীই শোনা যায়, যেগুলোর একটির সাথে আরেকটির খুব একটা পার্থক্য নেই। এর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো আঠারো শতকের ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস ব্লাংডনের সংস্করণটি। তাই এখানে সেটিই তুলে ধরা হচ্ছে।
একবার রাজা দ্বিতীয় চার্লস ভয়াবহ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাকে যেন গলা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত পুরো দেহ লিনেনের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়, যে কাপড় আবার ব্র্যান্ডিতে সিক্ত হতে হবে। চিকিৎসকের একজন সহকারী এটা সেলাই করে দিলেন, যেন রাজার গায়ে ভালোমতো তা আটকে থাকে। সেলাই শেষে দেখা গেলো কিছু বাড়তি অংশ রয়ে গেছে। এই কাজটি করা হয়েছিল রাতের বেলায়। সেই সহকারী চাননি কেঁচি দিয়ে সেটি কাটতে এই ভয়ে যে, যদি তাতে রাজার গায়ে আঁচড় লেগে যায়! তাই তিনি আগুন দিয়েই সেই বাড়তি অংশ নেভাতে চেয়েছিলেন। আফসোস, ব্র্যান্ডিতে সিক্ত কাপড়টি আগুনের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ফলে অগ্নিদগ্ধ হয়েই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হন রাজা।
This Bangla article discusses some strange deaths faced by kings & queens in history. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: hofburg-wien.at