Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইক: যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়নে

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগপর্যন্ত প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল, যেটিকে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ বা ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি। কোরীয় যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ও মার্কিন বৈমানিকরা কোরীয় উপদ্বীপের আকাশে আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সোভিয়েত স্পেৎসনাজ কম্বোডিয়ায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছিল, স্নায়ুযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ও মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী পরস্পরের বেশকিছু গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত করেছিল এবং আফগান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি সোভিয়েত সৈন্যরা মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাস মোতাবেক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই একে অপরের সীমানার মধ্যে সামরিক আক্রমণ চালায়নি।

তবে এটি ভুল তথ্য। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্ততপক্ষে একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বিমান হামলা চালায়, এবং ভালো সম্ভাবনা ছিল যে, এর ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভও হয়ে যেতে পারে। আর এই বিমান হামলা (Airstrike) সংঘটিত হয় ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর।

এসময় কোরীয় যুদ্ধ চলছিল। উল্লেখ্য, ‘কোরিয়া জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ বা ‘উত্তর কোরিয়া’র সঙ্গে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের (এবং বর্তমান রুশ ফেডারেশনের) দূরপ্রাচ্য (Дальний восток, ‘দালনি ভোস্তক’) অঞ্চলের স্থল ও নৌসীমান্ত রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৭ কি.মি. এবং ১২ নটিক্যাল মাইল।

মানচিত্রে উত্তর কোরিয়ার চংজিন থেকে সুখায়া রেচকার দূরত্ব; Source: Хочу все знать

১৯৪৮-৫০ সালে ‘কোরিয়া প্রজাতন্ত্র’ বা ‘দক্ষিণ কোরিয়া’য় দক্ষিণ কোরীয় ও মার্কিন সৈন্যরা নিষ্ঠুরভাবে দক্ষিণ কোরীয় কমিউনিস্টদের বিদ্রোহ দমন করে এবং ১৯৫০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বহুবার সীমান্ত সংঘর্ষ হয়, যেগুলোর অধিকাংশই দক্ষিণ কোরিয়া শুরু করেছিল। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সমর্থনে কমিউনিস্ট-শাসিত উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে। সোভিয়েত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত উত্তর কোরীয় সৈন্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে দক্ষিণ কোরীয় সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং ২৮ জুন উত্তর কোরীয় সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল দখল করে নেয়।

১৯৫০ সালের ২৭ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেআইনিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে ‘সিদ্ধান্ত নং ৮৩’ গ্রহণ করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। একই দিনে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনী উত্তর কোরীয় সশস্ত্রবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তর কোরীয় সৈন্যরা দক্ষিণ কোরীয় ও মার্কিন সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকাংশ স্থান দখল করে নেয়।

১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্চনের যুদ্ধে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত উত্তর কোরীয় সৈন্যদের উত্তর কোরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং শীঘ্রই দক্ষিণ কোরিয়ার সমস্ত অঞ্চল পুনর্দখল করে নেয়। ১ অক্টোবর মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনী ৩৮তম অক্ষরেখা অতিক্রম করে এবং উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণ করে।

কোরীয় যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ার পূর্ব উপকূলে ওনসান শহরের দক্ষিণে অবস্থিত রেলপথের ওপর মার্কিন বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণের দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

অর্থাৎ, এ সময় কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিস্টদের অবস্থান সুবিধাজনক ছিল না এবং মার্কিন সশস্ত্রবাহিনী সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের খুব কাছে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছিল। তখনও চীনা সৈন্য ও সোভিয়েত বৈমানিকরা কোরীয় উপদ্বীপে প্রবেশ করেনি, যদিও উত্তর কোরীয় সশস্ত্রবাহিনীতে বেশ কিছু সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টা ছিল।

অবশ্য কোরীয় যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই দূরপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। যেমন: ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমান লিবাউ নৌঘাঁটির কাছাকাছি সোভিয়েত সীমান্ত লঙ্ঘন করে। ৪টি সোভিয়েত ‘লাভোচকিন লা-১১’ যুদ্ধবিমান মার্কিন বিমানটিকে আক্রমণ করে ভূপাতিত করে। ১৯৫০ সালের মে মাসে সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের চুকোৎকা অঞ্চলে ২টি মার্কিন ‘পি-৫১ মুস্টাং’ অনুপ্রবেশ করে এবং একজোড়া সোভিয়েত ‘লাভোচকিন লা-১১’ বিমান সেগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ১টি মার্কিন বিমানকে ভূপাতিত করে।

কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও এরকম ছোট ছোট সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৯৫০ সালের ২৬ জুন, অর্থাৎ কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের দিন, কয়েকটি দক্ষিণ কোরীয় যুদ্ধজাহাজ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় সোভিয়েত নৌবাহিনীর কেবল শিপ (cable ship) ‘প্লাস্তুন’-এর ওপর গোলাবর্ষণ করে এবং এর ফলে জাহাজটির কাপ্তান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কোলেসনিকভ নিহত হন ও কয়েকজন নাবিক আহত হয়। সোভিয়েত জাহাজটি পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করলে দক্ষিণ কোরীয় জাহাজগুলো পশ্চাৎপসরণ করে।

১৯৫০ সালে চীনা সৈন্যদের ইয়ালু নদী অতিক্রমের দৃশ্য। কোরীয় যুদ্ধে চীন মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল; Source: Wikimedia Commons

১৯৫০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াওনিং প্রদেশে অবস্থিত সোভিয়েত দালনি নৌঘাঁটি থেকে ২৬ কি.মি. দূরে একটি অপরিচিত ডেস্ট্রয়ার দেখা দেয়। সেটির গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য একটি ‘এ-২০ঝা বোস্তোন’ গোয়েন্দা বিমান এবং ২টি যুদ্ধবিমানকে প্রেরণ করা হয়। ডেস্ট্রয়ারটি ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর এবং এটির কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১১টি মার্কিন যুদ্ধবিমান সোভিয়েত বিমানগুলোকে আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষে সোভিয়েত গোয়েন্দা বিমানটি সাগরে বিধ্বস্ত হয় এবং বিমানচালক লেফটেন্যান্ট কনস্তান্তিন কর্পায়েভ-সহ ৩ জন নিহত হয়।

দূরপ্রাচ্যে এরকম উত্তেজনাকর সামরিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মার্কিন যুদ্ধবিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে একটি বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে!

কোরীয় যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যবেক্ষণ করে মস্কো সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের (Дальний восток, ‘দালনি ভোস্তক’) নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর অংশ হিসেবে দূরপ্রাচ্যের প্রিমোরস্কি অঞ্চলে (Приморский край, ‘উপকূলীয় অঞ্চল’) সামরিক অনুশীলন (military exercise) চালাতে ও অঞ্চলটিতে অবস্থিত বিমানঘাঁটিগুলোতে নতুন ইউনিট মোতায়েন করতে আরম্ভ করে। এই বিমানঘাঁটিগুলোর একটি ছিল সুখায়া রেচকা বিমানঘাঁটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক হাজারেরও বেশি ‘পি-৬৩ কিংকোবরা’ যুদ্ধবিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করেছিল; Source: Хочу все знать

সুখায়া রেচকা (Сухая Речка) প্রিমোরস্কি অঞ্চলের খাসানস্কি জেলায় (Хасанский район) অবস্থিত একটি গ্রাম। গ্রামটি প্রিমোরস্কি অঞ্চলের রাজধানী এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় সোভিয়েত (বর্তমানে রুশ) সমুদ্রবন্দর ভ্লাদিভোস্তক (Владивосток) থেকে ১৬৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত। গ্রামটি ‘সুখায়া রেচকা’ (‘শুষ্ক নদী’) নামক একটি নদীর তীরে অবস্থিত। গ্রামটির ২ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে বিমানঘাঁটিটি অবস্থিত ছিল।

সুখায়া রেচকা বিমানঘাঁটিটি ছিল সোভিয়েত নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের (Тихоокеанский флот) অধীনস্থ। কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই এখানে এক স্কোয়াড্রন ‘পলিকারপভ পো-২ কুকুরুজনিক’ বাইপ্লেন মোতায়েন ছিল। এই স্কোয়াড্রনটির দায়িত্ব ছিল খাসানস্কি উপকূলীয় প্রতিরক্ষা সেক্টরে অবস্থিত ১৩০ মি.মি. নৌ কামান (naval artillery) ব্যাটারিগুলোকে এয়ার কাভার দেয়া ও গোলাবর্ষণের দিকনির্দেশনা প্রদান করা। কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অঞ্চলটিতে গৃহীত সামরিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে ঘাঁটিটিতে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর ১৯০তম ফাইটার এয়ার ডিভিশনের ৮২১তম ফাইটার এভিয়েশন রেজিমেন্টকেও মোতায়েন করা হয়।

১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ১৭ মিনিটে মার্কিন বিমানবাহিনীর দুটি ‘লকহিড পি-৮০সি শুটিং স্টার’ যুদ্ধবিমান উত্তর কোরিয়া থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় ১০০ কি.মি. অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং এই বিমানঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়।

সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকে অংশ নিয়েছিল দুটি মার্কিন ‘পি-৮০সি শুটিং স্টার’ যুদ্ধবিমান; Source: Lockheed Martin

মার্কিন বিমান হামলার ফলে বিমানঘাঁটিতে অবস্থিত ৭টি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এদের মধ্যে একটি সম্পূর্ণরূপে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত বিমানগুলো ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘বেল পি-৬৩ কিংকোবরা’ যুদ্ধবিমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ‘লেন্ড-লিজ’ (Lend-lease) প্রকল্পের আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধবিমানগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রদান করেছিল জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। অর্থাৎ, সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকে মার্কিন বিমানবাহিনী মার্কিন-নির্মিত সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল!

তবে কিছু কিছু বেসরকারি রুশ সূত্রমতে, এই আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরো বেশি। তাদের মতে, এই আক্রমণে কমপক্ষে ২০টি মার্কিন-নির্মিত সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কিছু বৈমানিক নিহত হযন। অবশ্য সোভিয়েত সরকারের আর্কাইভে এই আক্রমণে কোনো সোভিয়েত বৈমানিক নিহত হওয়ার কোনো উল্লেখ নেই।

উল্লেখ্য, মাত্র ১ বছর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এবং এজন্য এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যেকোনো যুদ্ধই হয়ে উঠতে পারত পারমাণবিক যুদ্ধ। তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বিমান হামলা চালালো? এর উদ্দেশ্য কী ছিল?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর দক্ষিণ কোরিয়ার তায়েগু বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীর ৪৯তম ফাইটার-বম্বার গ্রুপের দুইটি ‘লকহিড পি-৮০সি শুটিং স্টার’ যুদ্ধবিমান উত্তর কোরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উত্তর হামগিয়ং প্রদেশের রাজধানী চংজিন শহরে অবস্থিত উত্তর কোরীয় বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটির ওপর বোমাবর্ষণের জন্য রওনা হয়। এদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিমানের পাইলট ছিলেন অ্যাল্টন কুয়ানবেক, যিনি পরবর্তীতে মার্কিন সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি ও সিআইএ-এর একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। অন্য যুদ্ধবিমানটির পাইলট ছিলেন অ্যালেন ডাইফেনডর্ফ, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ২টি জার্মান বিমান ধ্বংস করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

সোভিয়েত সামরিক সংবাদপত্র ‘ক্রাসনায়া জ্ভেজদা’য় (লাল তারকা) সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইক সম্পর্কিত খবর; Source: TheBestofMoscow.ru

পথিমধ্যে মার্কিন বিমান দুটি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় এবং তীব্র বাতাসের কারণে গন্তব্যস্থল থেকে আরো উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য ক্লাসিফায়েড থাকায় সাইবেরিয়া ও সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের আবহাওয়া সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। মাটিতে কোনো পরিচিতিমূলক চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না এবং রেডিও নেভিগেশনও ছিল না। সমস্ত হিসেব করা হয়েছিল বাতাসের দিক ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।

মার্কিন বৈমানিকরা চংজিন বিমানঘাঁটিটি শুধুমাত্র মানচিত্রে দেখেছিল এবং ঘাঁটিটি বাস্তবে দেখতে কেমন সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। দিকভ্রান্ত হয়ে তারা পৌঁছে যায় সোভিয়েত সুখায়া রেচকা বিমানঘাঁটিতে। বিমানঘাঁটিটিতে প্রায় ২০টি মার্কিন-নির্মিত সোভিয়েত ‘বেল পি-৩৯ অ্যারাকোবরা’ এবং ‘বেল পি-৬৩ কিংকোবরা’ যুদ্ধবিমান সারিবদ্ধ অবস্থায় ছিল। বিমানগুলোতে সাদা রঙের চক্রবেড়ে বড় লাল রঙের তারকা অঙ্কিত ছিল এবং এটি ছিল উত্তর কোরীয় বিমানগুলোতে অঙ্কিত চিহ্নের অনুরূপ। এজন্য মার্কিন বৈমানিকরা সোভিয়েত বিমানঘাঁটিটিকে উত্তর কোরীয় বিমানঘাঁটি ভেবে ভুল করেছিল। বিমান দুটোর জ্বালানিও শেষ হয়ে আসছিল, এজন্য তাদের চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। তারা বিমানগুলোর ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে দেয়।

ঐদিনটি ছিল রবিবার – ছুটির দিন। তদুপরি, ঘাঁটিতে অবস্থিত ৮২১তম ফাইটার এভিয়েশন রেজিমেন্টের কমান্ডার কর্নেল ভ্লাদিমির সাভেলিয়েভ বিমানঘাঁটিতে ছিলেন না। তার অনুপস্থিতিতে রেজিমেন্টের ডেপুটি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকোলাই ভিনোগ্রাদভ বিমানঘাঁটির দায়িত্বে ছিলেন। মার্কিন বিমান আক্রমণ চালানোর পর বিমানঘাঁটিতে কমব্যাট অ্যালার্ট জারি করা হলেও ভিনোগ্রাদভ তার বৈমানিকদেরকে আকাশে উড্ডয়নের নির্দেশ না দিয়ে বিমানগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য, ঘাঁটিতে থাকা পিস্টন ইঞ্জিনচালিত ‘পি-৩৯’ ও ‘পি-৬৩’ বিমানগুলো আক্রমণকারী ‘পি-৮০সি শুটিং স্টার’ জেট বিমানগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে পারতো কি না, সেটিও অনিশ্চিত। যা-ই হোক, সোভিয়েতদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মার্কিন বিমান দুটি নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়।

প্রত্যাবর্তনের সময় মার্কিন বৈমানিকরা উপকূলের কাছে একটি দ্বীপ দেখতে পায়। দ্বীপটি হচ্ছে পিটার দ্য গ্রেট উপসাগরে অবস্থিত ফুরুগেলম দ্বীপ (Остров Фуругельма)। এতে বৈমানিকরা খানিকটা অবাক হয়, কারণ চংজিনের আশেপাশে কোনো দ্বীপ নেই। মানচিত্র দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, নিশ্চয়ই তারা অন্য একটি উত্তর কোরীয় বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছিল!

সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন দূরপ্রাচ্যে মিগ-১৫ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। মিগ-১৫ যুদ্ধবিমান কোরীয় যুদ্ধে বিশেষ কার্যকারিতা প্রদর্শন করে; Source: Flickr

তারা দায়েগু বিমানঘাঁটিতে ফেরার পর বিশেষজ্ঞরা তাদের বিমানের ক্যামেরা রেকর্ড পরীক্ষা করে এবং সেটি থেকে জানতে পারে যে, তারা যেসব বিমানের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে সেগুলো মার্কিন-নির্মিত ‘পি-৬৩ কিংকোবরা’ যুদ্ধবিমান, যা উত্তর কোরিয়ার কাছে থাকার কথা নয়। তদুপরি, বৈমানিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় যে, বোমাবর্ষণের পর ঘাঁটিতে থাকা বিমানগুলো বিস্ফোরিত হয়নি, যার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে যে, সেগুলোতে জ্বালানি ছিল না। আর যুদ্ধাবস্থায় উত্তর কোরীয় বিমান জ্বালানি বিহীন অবস্থায় খোলা রানওয়েতে থাকবে এটি ছিল অযৌক্তিক সম্ভাবনা। ফলে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মার্কিন বৈমানিকরা যে বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে সেটি উত্তর কোরীয় বিমানঘাঁটি নয়!

এদিকে ক্রেমলিনের নেতারা এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। এই আক্রমণটি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সেটি তারা বুঝতে পারছিলেন না। সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকের পরবর্তী দিনই জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকোভ মালিক আনুষ্ঠানিকভাবে এই আক্রমণের নিন্দা জানান। তিনি একে ‘সোভিয়েত সীমান্তের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করেন।

২০ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান জাতিসংঘে এই ঘটনার জন্য দায় স্বীকার করেন এবং মার্কিন যুদ্ধবিমান কর্তৃক সোভিয়েত সীমান্ত লঙ্ঘন ও সোভিয়েত ক্ষয়ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, বৈমানিকদের ‘হিসেবগত ভুলে’র কারণে এই আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে। তিনি আরো জানান, এই ঘটনার জন্য দায়ী দুজন মার্কিন বৈমানিককে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে এবং তারা মার্কিন বিমানবাহিনীর যে রেজিমেন্টের অংশ সেই রেজিমেন্টের কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষতিপূরণ দেয়ারও প্রস্তাব দেন।

সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকে নিহত বৈমানিকদের উদ্দেশ্যে সুখায়া রেচকার নিকটবর্তী পেরেভজনোয়ে গ্রামে স্থানীয় উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে; Source: PrimaMedia.ru

সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকে অংশ নেয়া দুই মার্কিন বৈমানিককে আসলেও সামরিক আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে হালকা শাস্তি দেয়া হয়। অ্যাল্টন কুয়ানবেককে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জাপানের বিমানঘাঁটিতে এবং অ্যালেন ডাইফেনডর্ফকে ফিলিপাইনের বিমানঘাঁটিতে বদলি করা হয়।

সোভিয়েতরা মার্কিনদের অজুহাত গ্রহণ করে, কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে তারা ঘটনাটি গোপন রাখে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়। সুখায়া রেচকা বিমানঘাঁটির প্রধান কর্নেল সাভেলিয়েভ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভিনোগ্রাদভকে সামরিক আদালতের সম্মুখীন করা হয়। সামরিক আদালত তাদের অধীনস্থ বৈমানিকদের ‘নিম্নমানের প্রশিক্ষণে’র জন্য তাদেরকে বরখাস্ত করে।

তবে ঘটনাটিকে গোপন রাখলেও এই ঘটনার ফলে দূরপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে মস্কো সচেতন হয়ে ওঠে। এই দুর্বলতা দূরীকরণের জন্য তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সোভিয়েত বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক ‘মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-১৫’ যুদ্ধবিমান-সহ ৩০৩তম এয়ার ডিভিশনকে দূরপ্রাচ্যে প্রেরণ করা হয়। এছাড়া দূরপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য ৬৪তম এয়ার কোর সৃষ্টি করা হয়, বৈমানিকদের সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার নিয়ম প্রবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দূরপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়।

সুখায়া রেচকার ঘটনাটির পরও সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যের কাছাকাছি সোভিয়েত ও মার্কিনদের মধ্যে আগের মতো বিচ্ছিন্নভাবে আকাশযুদ্ধ চলতে থাকে। যেমন: একই বছরের ডিসেম্বরে প্রিমোরস্কি অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় একজোড়া মিগ-১৫ একটি মার্কিন ‘আরবি-২৯’ গোয়েন্দা বিমানকে ভূপাতিত করে। ১৯৫১ সালের ১৮ নভেম্বর পিটার দ্য গ্রেট উপসাগরে ৪টি মিগ-১৫ যুদ্ধবিমান এবং একদল মার্কিন ‘গ্রুম্যান এফ-৯ কুগার’ যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষে হয়, যার ফলে ২টি সোভিয়েত বিমান ভূপাতিত এবং ১টি মার্কিন বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর কুরিল দ্বীপপুঞ্জের ওপরে একজোড়া সোভিয়েত মিগ-১৯ যুদ্ধবিমান একটি মার্কিন ‘বোয়িং বি-২৯ সুপারফোর্ট্রেস’ বোমারু বিমানকে আক্রমণ করে ভূপাতিত করে।

সোভিয়েত বৈমানিক নিকোলাই সুতিয়াগিন কোরীয় যুদ্ধে ২২টি মার্কিন যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন; Source: Wikimedia Commons

বস্তুত সুখায়া রেচকা এয়ারস্ট্রাইকের ঘটনাটির রহস্য কখনোই মীমাংসা হয়নি। আসলেই কি এই আক্রমণটি অনিচ্ছাকৃত ছিল? নাকি এই আক্রমণটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল, যাতে সোভিয়েতরা মার্কিন বিমানবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা অনুধাবন করতে পারে এবং কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে?

যদি এই আক্রমণের উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভীতি প্রদর্শনই হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয় যে, সেটি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরীয় যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও সোভিয়েত সৈনিক ও বৈমানিকরা সক্রিয়ভাবে কোরীয় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৫২ সালে কোরীয় উপদ্বীপে কমপক্ষে ২৬,০০০ সোভিয়েত সৈনিক ও বৈমানিক মোতায়েন ছিল। সোভিয়েত বৈমানিকরা তাদের বিমানগুলোতে চীনা বা উত্তর কোরীয় বিমানবাহিনীর চিহ্ন সংযোজন করত এবং রেডিও যোগাযোগের সময় চীনা বা কোরীয় ভাষা ব্যবহার করত।

কোরীয় যুদ্ধে ২৯৯ জন সোভিয়েত সৈনিক ও বৈমানিক নিহত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩৩৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। এর বিপরীতে সোভিয়েত সৈনিক ও বৈমানিকরা মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ বাহিনীর ১,২৫০টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে। এগুলোর মধ্যে সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স সৈন্যরা ১৫৩টি এবং বৈমানিকরা ১,০৯৭টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল। কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত-সমর্থিত চীনা ও উত্তর কোরীয় সৈন্যদের হাতে ৫৪,২৬০ জন মার্কিন সৈন্য নিহত, ১,০৩,২৮৪ জন আহত এবং ৪,৭১৪ জন বন্দি হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।

Related Articles