Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-২: পরশমণির খোঁজে আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল

খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক। গ্রিস। সম্রাট আলেক্সান্ডারের দরবার।

দূর দেশ থেকে বেড়াতে এসেছেন মারিয়া নামের এ সম্ভ্রান্ত বিদুষী নারী। তাকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। রাজ্যের সকল বিদ্বান ব্যক্তি তার জ্ঞানপিপাসা পূরণ করতে লাগলেন।

পরে এই মারিয়া ইতিহাসের প্রথম আলকেমিস্ট হিসেবে পরিচিতি পান (তার অবস্থান সর্বকালের শীর্ষ ৫২ জন আলকেমিস্টদের মধ্যে); তবে তিনি বেশি পরিচিত ‘ইহুদিনী মারিয়া‘ (Maria the Jewess) নামেই।

আলকেমিস্ট মারিয়া; Source: web.nli.org.il

এরপর তিনি যান মিসরে, মেমফিস নগরীতে। অষ্টম শতকের বাইজান্টিন ঐতিহাসিক জর্জ সিঙ্কেলাসের মতে, মেমফিসে তার সাথে পরিচয় হয় ডেমোক্রিটাস নামের একজনের, যাকে তিনি বাস্তব রসায়ন নিয়ে হালকা ধারণা দেন। ডেমোক্রিটাস তখন থেকে হয়ে গেলেন মারিয়ার ছাত্র। ইতিহাসে ডেমোক্রিটাসের নাম এখন স্মরণীয়, কারণ তিনি প্রথমবারের মতো পরমাণু তত্ত্ব দিয়েছিলেন।

ডেমোক্রিটাস @Hendrick ter Brugghen

মারিয়াকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি জানা যায় তৃতীয় শতকের আলকেমিস্ট এবং জ্ঞানবাদী (Gnostic) খ্রিস্টান লেখক জসিমসের (Zosimos of Panopolis) লেখনী থেকে। তিনি অবশ্য মারিয়ার জীবনকালের সময় নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না, তাই তারিখটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মাঝে বলে অনুমান করেন। মারিয়া অনেকগুলো রাসায়নিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছিলেন। 

মারিয়া’স বাথ; Source: Science History Institute

মারিয়া এক অনন্য জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন- তিনি সোনা বানাতে পারতেন। অন্তত লোকে তা-ই বলতো। তিনি জাবির ইবনে হাইয়ানের আগেই হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl) আবিষ্কার করেন বলে মনে করা হয়, তবে বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলি এটি অস্বীকার করে। আরবরা তাকে ডাকতো ‘প্লেটোর কন্যা’ বলে। 

মারিয়ার সকল লেখাই ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। তবে তৎকালীন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বগণ মারিয়ার নানা উক্তি ব্যবহার করতেন নিজেদের লেখায়। The Dialogue of Mary and Aros on the Magistery of Hermes নামের বইতে এমন কিছু প্রক্রিয়ার কথা লেখা আছে যেগুলো পরবর্তীতে আলকেমির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবারের মতো সেখানে আমরা কিছু এসিডিক লবণ আর এসিডের নাম পাই। উদ্ভিদ থেকে সোনা উৎপাদনের উপায়ও সেখানে বাতলে দেয়া হয়!

The Dialogue of Mary and Aros on the Magistery of Hermes; Source: eBay

রহস্যময়ী মারিয়া ইতিহাসের পাতা থেকে এরপর হারিয়ে যান। কিন্তু এরপর থেকে অনেক জায়গায় আলকেমি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। সাফল্য নাকি ব্যর্থতার সাথে, সেটা আমরা জানি না। হয়তো জানবও না।

অষ্টম শতক পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে আলকেমির কাজ। ঠিক তখন মুসলিম বিশ্বে আলকেমি সূচনা করেন জাবির ইবনে হাইয়ান। এবং প্রথমবারের মতো তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে স্রষ্টা বা আল্লাহ্‌র সাহায্যের কথা উল্লেখ করেন।

কিন্তু নবম থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত অনেক মুসলিম রসায়নবিদ বা কেমিস্টের (আলকেমিস্ট নয়) কাছেই জাবিরের আলকেমি তত্ত্ব বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত আল-বিরুনি আর ইবনে সিনা। তারা ছিলেন বিরোধী পক্ষ। তাদের মতে, কখনোই এক পদার্থকে অন্য পদার্থে রূপান্তর করা সম্ভব না।

জাবির ইবনে হাইয়ান; Source: Buy art on Artmajeur

সম্ভবত জাবিরের সমসাময়িক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে আর ফিলিস্তিন এলাকায় আলকেমির প্রসার ঘটে। অভাবনীয় প্রসার ঘটে। তখনকার আলকেমিস্টদের কিছু পান্ডুলিপি যোগাড়ের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন ইউরোপের আলকেমিস্টগণ। তারা কি পেরেছিলেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে?

ত্রয়োদশ শতকের একজন জার্মান বিশপ ছিলেন অ্যালবারটাস ম্যাগনাস। কথিত আছে, তিনিই মধ্যযুগে প্রথম ধাতুকে সোনায় পরিণত করেন, তার কাছে ছিল পরশমণি! তাকে পরবর্তীতে ক্যাথলিক চার্চ সাধু হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি আলকেমি আর জাদুবিদ্যা অধ্যয়ন করতেন। তার মতে, জাদুবিদ্যাকে ভালো কাজে ব্যবহার করা উচিৎ। এই সেইন্ট অ্যালবার্ট ‘স্বচক্ষে’ ধাতুকে সোনাতে পরিণত হতে দেখেছেন বলে লিখেছিলেন!

অ্যালবারটাস ম্যাগনাস; Source: Providence College

সেইন্ট অ্যালবার্ট সেই জ্ঞান তিনি হস্তান্তরিত করে দেন তার ছাত্র থমাসের কাছে, যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হন সেইন্ট থমাস অ্যাকিনাস নামে।

সেইন্ট থমাস অ্যাকিনাস; Source: Catholic Exchange

ঠিক এ সময়ে দৃশ্যপটে আগমন ঘটে এমন একজনের, যার নাম এমনিতেই চলে আসে আলকেমি আর ফিলোসোফারস স্টোন বা পরশমণির কথা বলতে গেলে।

তার নাম ছিল নিকোলাস ফ্লামেল (Nicolas Flamel)। জে কে রোলিং-এর হ্যারি পটার সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র ছিলেন তিনি, শতাব্দীর পর শতাব্দী তিনি বেঁচে ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয় সিরিজে। কিন্তু আপনি কি ভাবছেন, জে কে রোলিং এ চরিত্রের স্রষ্টা? একদমই না, অবাক হলেও সত্য, নিকোলাস ফ্লামেল ছিলেন রক্ত মাংসের একজন মানুষ, বাস করতেন প্যারিসে! তার নামে রয়েছে প্যারিসের একটি সড়ক!

ফ্লামেলের নামে আছে সড়ক; Source: Inverse

তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আলকেমিস্ট নামে পরিচিত; অবশ্য ইতিহাসের পাতায় তার আলকেমি নিয়ে আদৌ কোনো কাজ করবার প্রমাণ নেই, তার আলকেমিস্ট হবার পুরোটাই আমরা লোকমুখে প্রচলিত কথা থেকেই শুনতে পাই। তার নিজের হাতে লেখা বিয়ের দলিল থেকে শুরু করে নিজের উইল- এগুলো সংরক্ষিত আছে প্যারিসের The Bibliotheque Nationale-এ। যেহেতু আমরা এ সিরিজে অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে যেকোনো গল্পেরই অনুসন্ধান করব, হোক সেটা ইতিহাসের কষ্টিপাথরে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত, তাই চলুন এবার তার গল্পটাই শুরু করা যাক। 

রোলিং এর উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড সিরিজে নিকোলাস; Source: Nerdist

আনুমানিক ১৩৩০ সাল। প্যারিসের পন্টয়েজ নামের এক মফস্বল এলাকায় জন্ম নেন কিংবদন্তী নিকোলাস ফ্লামেল।

তার শিশুকাল নিয়ে আমরা তেমন কিছু জানতে পারি না। তবে, এটুকু আমরা জানি, ১৩৫০ সালের দিকে তরুণ নিকোলাস প্যারিসে খুলে বসেন একটা ছোট্ট বইয়ের স্টল। ছোট থেকেই বইয়ের প্রতি অসম্ভব নেশা ছিল তার। ‘স্টল’ বলা হলো কেন? কারণ, ওটা দোকান ছিল না। নীলক্ষেতের ফুটপাতে যেমন বই বিক্রেতারা বসে থাকেন, সেরকম দুই ফুট বাই আড়াই ফুট একটি স্টল নিয়ে বসলেন নিকোলাস। কিন্তু নিজের সব শ্রম তিনি ঢেলে দেন তার বইয়ের দোকানের জন্য। ধীরে ধীরে নিকোলাসের ব্যবসায় লাভ বাড়তে থাকে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বড়সড় দোকান দেবার।

প্যারিসের পুরনো মারিভাক্স সড়কে তিনি একটা বাড়ি কিনে ফেললেন, তার নিচের তালায় তিনি দোকান দিলেন। শুধু তা-ই নয়, একসময় মানুষকে চাকরি দিতে লাগলেন নিকোলাস। 

প্রত্যেক লোকের জীবনেই হয়তো এমন এক নারী আসে, যাকে দেখেই মনে হয়, হ্যাঁ, এ-ই হলো আমার যোগ্য সঙ্গিনী, এর সাথেই আমার জীবন কাটাতে হবে। নিকোলাসের জীবনে সেই নারী ছিলেন পেরেনেল।

পেরেনেল ছিলেন বিধবা কিন্তু সুন্দরী। ছিলেন সম্পদশালীও। বয়সে নিকোলাসের চেয়ে কিছুটা বড় যদিও। তবে বয়স বাধা মানেনি। তারা বিয়ে করে ফেললেন। নিকোলাসের স্ত্রী হলেন পেরেনেল ফ্লামেল (Perenelle Flamel), ১৩৬৮ সালে।

পেরেনেল কেবল সুন্দরীই ছিলেন না, ছিলেন খুবই জ্ঞানপিপাসু, নিকোলাসের জন্য যাকে আদর্শ বললেও কম বলা হবে। পেরেনেল স্বামীর ভবিষ্যৎ জীবনের গোপন কথাগুলো চেপে রেখেছিলেন সার্থকভাবে। নিকোলাসের লেখাগুলো আজ না পাওয়া গেলে আমরা হয়তো এ নারীর জ্ঞানপিপাসা সম্পর্কে জানতেই পারতাম না কিছু। লোককথা বলে, তারা দুজন পরশমণি ব্যবহার করে অমরত্ব অর্জন করেন, নিজেদের ভুয়া মৃত্যু লোকের সামনে নাটক করেন। সে কথা আসবে পরে।

স্বামী-স্ত্রী একত্রে; Source: Booke of Hieroglyphicall Figures

নিকোলাস প্রথম জীবনে ছোট্ট সেই বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন যখন, তখন থেকেই তিনি এমন সব বই পড়তে থাকেন, যা সাধারণের চোখে নিষিদ্ধ বিবেচিত ছিল। যেমন, নিষিদ্ধ আলকেমির বই। মিসরীয়, গ্রিক আর আরবদের আলকেমি নিয়ে লেখা বইগুলো তিনি শেষ করে ফেলেন। একপর্যায়ে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, কোথাও না কোথাও আলকেমির এ গোপন নথিপত্রগুলো সাংকেতিক বা ‘কোডেড’ (coded) ভাষায় লুকিয়ে রাখা আছে। অথবা, বিশেষ ব্যক্তিদের কাছে আছে; কিন্তু একজন বইয়ের দোকানীর জন্য এমন কাউকে খুঁজে বের করা খুবই দুষ্কর।

একদিনের ঘটনা। বইয়ের দোকানে বসে আসছেন নিকোলাস, এমন সময় এক ফেরিওয়ালা গোছের লোক এসে ঢুকে পড়ল, বই বিক্রি করতে চায় সে, কারণ তার অনেক টাকার টান পড়েছে। পুরনো অনেক বই নিয়ে এসেছে সে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন নিকোলাস, কিন্তু সেদিন বিশেষ একটি বইয়ের দিকে চোখ আটকে গেল তার। চমৎকার বাইন্ডিংয়ের খুব পুরনো সেই পাণ্ডুলিপিতে তার চোখে পড়লো খুবই আগ্রহ-জাগানিয়া কিছু চিহ্ন আর চিত্র। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এটা তিনি কিনবেনই। দামাদামি ছাড়াই দুই ফ্লোরিন দিয়ে কিনে নিলেন বইটি।

গ্রিক আর নিকোলাসের কাছে অচেনা এক ভাষায় লিখা সেই বইয়ের পাতাগুলো ছিল অসাধারণ, মোটেও সাধারণ পার্চমেন্ট (চামড়ার কাগজ) না। বইটা সাত ভাগে ভাগ করা ছিল, প্রতি ভাগে ছিল চারটি করে পৃষ্ঠা। প্রতি তিন পৃষ্ঠা পর একটি প্রায় ফাঁকা পৃষ্ঠা যেখানে কোনোকিছু লেখা ছিল না, কিন্তু অদ্ভুত সব ছবি ছিল, দেখতে রহস্যময় ঠেকতো। তবে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা হলো প্রথম পাতায় সুন্দর করে লেখা বইয়ের লেখকের নাম ‘ইহুদী যুবরাজ আব্রাহাম’। বইটির কোণাগুলো ছিল সোনায় মোড়ানো।

নিকোলাস যেহেতু এ ক’দিনে আলকেমি নিয়ে পড়েছেন তাই সে বইয়ের চিহ্ন দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না তার যে এটা আলকেমি নিয়ে বই। “আমি কি পারবো এ বইটি পড়তে?” ভাবলেন নিকোলাস। বইয়ের সব ভাষা যে তিনি পড়তে পারছেন না।

কী করবেন তিনি?

তিনি সেই বইয়ের কিছু পাতার লেখা নিজে লিখে নিলেন আর সেই লেখা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এমন কারো খোঁজে যিনি কি না বলতে পারবেন কী লেখা আছে এখানে।

কী হলো এরপর? কার দেখা পেলেন তিনি? কীভাবে? নিকোলাস ফ্লামেলের জীবনের রহস্যময় অধ্যায়ের গল্প হবে পরের পর্বে।

 

চলবে পরের পর্বে, পড়তে ক্লিক করুন:

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৩: নিকোলাস ফ্লামেলের রহস্যময় জীবন

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৪: নিকোলাস ফ্লামেলের ‘রহস্যময়’ অন্তর্ধান

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৫: যুগের শেষ ‘জাদুকর’ স্যার আইজ্যাক নিউটন

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৬: স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাইতুল মুকাদ্দাস গবেষণা

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৭: অমরত্বের সুধার খোঁজে

আগের পর্ব:

অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-১: আলকেমি আর পরশমণি

 

This article is in Bangla language and deals with the myths of the super-natural pursuits of mankind. For references, please visit the hyperlinked websites. 

Featured Image: zyzixun.com

Related Articles