জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গসংগঠনের মধ্যে সাধারণ পরিষদ একটি। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান অথবা, উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে থাকে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিয়ে অনেকসময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, এবং এই সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বেশ কিছু নজিরবিহীন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি কিউবান বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন সমর্থিত ফুলগেনসিও বাতিস্তার স্বৈরশাসন উৎখাত করে ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এরপর ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ফিদেল কাস্ত্রো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। প্রায় ২৬৯ মিনিট চলমান সেই ভাষণ সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্রনেতাদের রাখা ভাষণগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সময়ব্যাপী। সেই দীর্ঘ ভাষণে ফিদেল কাস্ত্রো যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনমূলক এবং সাম্রাজ্যবাদী’ কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেন। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এই ভাষণ ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। এমনকি এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিকট একটি প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করা হয়, যেখানে ফিদেল কাস্ত্রো কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগগুলো নাকচ করা হয়।
১৯৬০ সালের ১২ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটি অধিবেশনে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের ফার্স্ট সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভ এক নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেন। সেই অধিবেশনে অংশ নিয়ে ফিলিপাইনের প্রতিনিধি দলের প্রধান লরেঞ্জো সুমোলং তার দেওয়া বক্তব্যের একপর্যায়ে ‘পূর্ব ইউরোপ এর কয়েকটি রাষ্ট্রের জনগণের নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চনার’ অভিযোগ তুলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করলে নিকিতা ক্রুশ্চেভ মেজাজ হারিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিল চাপড়াতে থাকেন। অন্যদিকে, কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়- এই সময় নিকিতা ক্রুশ্চেভ জুতো দিয়ে সজোরে টেবিলে আঘাত করতে থাকেন।
১৯৬৪ সালের ২৮ মে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পিএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত রেজুলেশন ৩২১০ অনুযায়ী, জাতিসংঘ পিএলও-কে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে সাধারণ পরিষদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর ‘পিএলও’ এর প্রতিনিধি হিসেবে ইয়াসির আরাফাত সাধারণ পরিষদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ব্যতীত প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা, যিনি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বপ্রথম ভাষণ প্রদানের সুযোগ লাভ করেছেন। সেই ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণে ইয়াসির আরাফাত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন; যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, এবং ইহুদি জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকতে পারবে। এই ভাষণে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সংকট সমাধানের লক্ষ্যে তার অবস্থান তুলে ধরেন। সেই বক্তব্যে তিনি ‘জলপাই পাতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বন্দুক’– দুটোই ধারণ করার উল্লেখ করে বিশ্বনেতৃবৃন্দের কাছে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান যাতে তার হাত থেকে শান্তির প্রতীক জলপাই পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। উক্ত ভাষণের প্রায় পাঁচ দশক সময় ব্যবধানে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ইয়াসির আরাফাতের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও অধরা রয়ে গেছে।
২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাখা ভাষণে ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো চ্যাভেজ তীব্র ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের প্রতি আক্রমণ করেন। সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের দেওয়া ভাষণের পর দিন সেই অধিবেশনে রাখা বক্তব্যে চ্যাভেজ বুশের ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় তাকে ‘শয়তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, “গতকাল শয়তানটি ঠিক এখানে এসেছিল, এবং সালফারের সেই গন্ধ এখনও রয়েছে।” উল্লেখ্য, রাসায়নিক বিস্ফোরক তৈরি করতে সালফার বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন নেতৃবৃন্দ চ্যাভেজের এমন বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন।
২০০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪ তম অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে আফ্রিকান ইউনিয়ন এর তৎকালীন চেয়ারপার্সন এবং লিবিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফি প্রায় ৯৬ মিনিট ব্যাপী একটি বক্তব্য রাখেন। লিবিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যোগদান করে গাদ্দাফি নিজেকে ‘রাজাধিরাজ’ হিসেবে সম্বোধন করেন। এ সময় তিনি জাতিসংঘ সনদের একটি অনুলিপি ছিড়ে ফেলে সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন, এবং ইরাকে হামলা চালানোর জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি দেন। সেই বক্তব্যে তিনি আফ্রিকা মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনে চালানো ধ্বংসযজ্ঞের জন্য প্রায় ৭.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, এবং ‘সোয়াইন ফ্লু’ সামরিক পরীক্ষাগারে তৈরি করা জৈবিক অস্ত্র কিনা– এই বিষয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। এছাড়াও দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পরিবর্তে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংকট নিরসনে মুয়াম্মার গাদ্দাফি “Isratine” নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন, এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল– এমন প্রসঙ্গও তার বক্তব্যে উঠে এসেছিল।
২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন/ইলেভেন হামলা) হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন। তিনি এই হামলার উদ্দেশ্য হিসেবে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পতনশীল অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে জায়োনিস্ট শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা’ করার বিষয়টি তুলে ধরেন। এর পরের বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাখা বক্তব্যে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ আবারও ‘নাইন/ইলেভেন হামলা’র ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে বক্তব্য প্রদান করে ‘হলোকাস্ট’কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দেওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন। ২০১০ এবং ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ভাষণ চলাকালে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একযোগে অধিবেশন থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন কার্যক্রম চালু করার অভিযোগ তুলে, এই কর্মসূচি বন্ধে জাতিসংঘের প্রতি একটি ‘সুস্পষ্ট সীমারেখা’ নির্ধারণ করার আহবান জানান। তিনি সেই বক্তব্যে পারমাণবিক বোমা উৎপাদনের একটি বর্ণনাচিত্র উপস্থাপন করেন। কয়েকটি পর্যায় সম্বলিত সেই বর্ণনাচিত্রে তিনি পারমাণবিক বোমা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সেই সময় পর্যন্ত ইরানের অগ্রগতি তুলে ধরে, পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর পূর্বেই দেশটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দাবি জানান। অন্যদিকে, ইরান সবসময়ই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করার দাবি করে এসেছে।
২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা এর মিত্রদের রক্ষা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ‘উত্তর কোরিয়াকে পুরোপুরি ধ্বংস’ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন’কে ‘রকেটম্যান’ সম্বোধন করে তিনি দেশটির কার্যক্রমকে ‘আত্মঘাতী’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রেক্ষিতে দেশটিকে ‘বেপরোয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে দেশটির বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোকে ‘গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কতন্ত্র শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৮ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত চুক্তিতে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে যাওয়া ঘোষণা দেন। একইসাথে, তিনি সেই চুক্তির শর্তানুযায়ী ইরানের উপর থেকে প্রত্যাহার করা কয়েকটি অবরোধ আবারও পুনর্বহাল করেন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সিঙ্গাপুরের সান্তোসা দ্বীপে ঐতিহাসিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন এবং এই বৈঠকের মাধ্যমে বৈরী দেশ দুটোর সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়।
এভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বিশ্বনেতৃবৃন্দের মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্য প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সবসময়ই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
Language: Bangla
Topic: Some surprising incidents at the united nations
References:
1. Angry, surprising and downright bizarre: Strange scenes at the United Nations - Independent
2. Quirky moments: The other side of the UN General Assembly - CGTN
3. Banging shoes and ripping charters: Where does Trump's 'rocket man' speech rank in UN history? - CNN
4. Did Nikita Khrushchev Really Bang His Shoe in Defiance at the U.N.? - How Stuff Works
5. Status of Palestine - Palestine UN
6. Throwback to former Libyan leader Gaddafi's historic speech at the UN - Africa News
7. Ahmadinejad tells U.N. most blame U.S. government for 9/11/11 - Reuters
8. Ready, set, walk out! Protesting Ahmadinejad at U.N - Reuters
Feature Image: Middle East Eye