নরখাদক আঘোরীদের ইতিকথা

উত্তর প্রদেশের বেনারাস শহরে ছুটি কাটাতে এসেছেন গগনবাবু। ছুটি কাটানোর জন্য বেনারাস শহর যে কীরকম তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি, তীর্থযাত্রীদের ভীড়ে জান যায় যায় অবস্থা। তবে গঙ্গার খোলা হাওয়া শান্তির যে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে তাও কম না, অন্তত কলকাতার মত শহরে এ জিনিস আশা করাই পাপ।

বেলা বাড়তেই ভীড় হওয়ার কারণে আজ একটু সকাল করেই বেরিয়েছেন হাওয়া খেতে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কী একটা যেন পায়ের ধাক্কায় ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। জিনিসটা চোখে পড়তেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তার, এ যে নর মস্তকের খুলি! পাশে ফিরতেই একটা ধাক্কা খেলেন গগনবাবু। গেরুয়া বসনে গাঁজার কলকে হাতে রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত সাধুকে তো প্রতিদিনই দেখতে পান। কিন্তু এ সাধুর চোখ তো ভাটার আগুনের মতোই লাল, আর সেটা তার দিকেই চেয়ে রয়েছে। কোনোমতে মাথার খুলিটি নিয়ে সাধুর সামনে রেখেই ভোঁ দৌড় হোটেলের দিকে। সাধুকে দেখার পরেই মাথা ঝিমঝিম করছে কলকাতার স্বনামধন্য ডাক্তারের। হোটেলের রুমে ঢুকে শুয়ে পড়তেই ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে এল চোখজোড়া।

ঘোরের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিশাল এক খোলা মাঠে। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলেন না প্রথমে। হঠাৎ করেই তার পিলে চমকে দিয়ে পাশেই আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের কাছে যেতেই দ্বিতীয়বার চমকে উঠলেন তিনি, চন্দন কাঠের চিতায় যে তার মতোই দেখতে কাউকে শোয়ানো হয়েছে। বেশি কিছু চিন্তা না করে পালানোর কথা ভাবতেই সামনে দেখলেন তার সব পথ আটকানো। একদল নগ্ন আঘোরী সাধু তাকে আর সেই চিতাকে গোল করে ঘিরে ঢাকের তালে তালে উদোম তালে নাচছেন! ধীরে ধীরে নাচের বৃত্ত ছোট হতে শুরু করেছে, এমন সময় এক সাধু নাচের বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে পোড়ানো মৃতদেহ থেকে এক টুকরো মাংস ছিড়ে নিয়ে মুখে পুরে দিলেন!

চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠলেন গগনবাবু। “উঃ, কী দুঃস্বপ্নরে বাবা!” হোটেলের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সূর্যমামা ডুবে গেছে। আকাশের রক্তিমাভা থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়লেন সেই সাধুর সন্ধানে, পেয়েও গেলেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সাধুর মুখ থেকে একটি বাক্যই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল, “এবার কমের উপর দিয়ে গেল, পরেরবার সাবধান থাকিস!

লেখাটা যখন আঘোরী সাধুদের নিয়েই, তখন এরকম কিছু গল্প দিয়েই শুরু করা ভাল। এখন মনে প্রশ্ন হতে পারে আঘোরী কারা? উপরের গল্পের সাথে তাদের কি আদৌ কোনো মিল রয়েছে? লেখার শেষ পর্যন্ত যেতে যেতে আশা করি উত্তরটা পেয়ে যাবেন।

ভারতীয় জনগোষ্ঠীর উপর বেশ বড় রকমের প্রভাব রয়েছে এই আঘোরী সম্প্রদায়ের সাধুদের, বলা যায় ভারতকে চিহ্নিত করতে হলে যেসব চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তার একটা এই সাধুরা। বেনারাসসহ ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এ সাধুদের লোকজন যেমন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, ঠিক তেমনভাবে তাদেরকে ভয় পাওয়া লোকসংখ্যাও কম নয়। আঘোরীদের সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে প্রথমেই জানতে হবে কীভাবে একজন আঘোরী সাধু হওয়া যায়। অন্যান্য সাধুদের থেকে আঘোরী সাধুরা অনেক দিক থেকেই আলাদা। সেগুলোই তুলে ধরা হল –

আঘোরীদের বিশ্বাস

আঘোরীরা মূলত দেবতা ‘শিব’-এর পূজারী। তারা বিশ্বাস করে শিবই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, ধ্বংসকারী এবং সবকিছুর পরিচালনাকারী। শিবের মহিলা রূপ মৃত্যুর দেবী ‘কাল ভৈরব বা মহাকালী’-এর উদ্দেশ্যই তারা প্রার্থনা করে এবং এ কারণেই তারা মৃত্যুভয়কে পিছনে রেখে আসে। আঘোরীদের মতে, “শিবই সবকিছু। হিন্দুধর্মের সব দেবতাই শিবের কোনো না কোনো রূপ। কিন্তু শিব তার সৃষ্টির কাছে যা দাবী করে তা প্রায় সব হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে অগ্রহণযোগ্য। তাই আঘোরীরা শিবকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব নিয়েছে।”

আঘোরীদের বাসস্থান

কালো চুলের বিশাল জটাধারী আঘোরী সাধুদেরকে সহজেই চোখে পড়ে। ধ্যান করার জন্য সাধারণত তারা শ্মশানের মতো নির্জন জায়গাকেই বেছে নেয়। এছাড়াও হিমালয়ের ঠান্ডা গুহা, গুজরাটের নিষ্প্রাণ মরুভূমি এমনকি বাংলার ঘন জঙ্গলেও তাদের দেখা মেলে। তবে বেনারাস শিবের প্রিয় জায়গা হওয়ায় গঙ্গার তীরেই আঘোরী সাধুদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

আঘোরীদের পোষাক

আঘোরীদের জন্য চুল বা গোফ-দাড়ি কাটা নিষিদ্ধ। সাধারণত কালো পোষাক পরতে দেখা গেলেও অনেক সময় তাদেরকে দেখা যায় অর্ধনগ্ন অবস্থায়। শ্মশানে ধ্যান করার সময় তারা পোড়ানো মৃতদেহের ছাই সারা শরীরে মেখে তার উপরে বসেই ধ্যান করা শুরু করেন, এ সময় তাদের পরনে থাকে শুধুমাত্র একটি কৌপিন। এছাড়া রুদ্রাক্ষের মালা আর মানুষের খুলি তো গলায় রয়েছেই। এছাড়াও মাঝেমধ্যে তাদেরকে দেখা যায় সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়, পার্থিব সবকিছু ঝেড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে তারা এটি করে থাকেন!

আঘোরীদের খাবার

অন্যান্য সাধুদের চেয়ে আঘোরীদের একটি বড় পার্থক্য হলো খাবার। অন্যান্য সাধুরা যেখানে নিরামিষাশী, সেখানে আঘোরীরা খেতে পারে যেকোন কিছুই। আবর্জনা থেকে শুরু করে মানুষের মাংস এমনকি মানুষের মলমূত্র পর্যন্তও তারা খায়! কারণ? কারণ তারা বিশ্বাস করে শিব সবচেয়ে খারাপের মধ্যেও বিদ্যমান।

আঘোরীদের মূলমন্ত্রই হচ্ছে নোংরামির মধ্যে বিশুদ্ধতাকে খুঁজে বের করা। তাছাড়া তারা বিশ্বাস করে মলমূত্র খাওয়া তাদের ভিতরের আত্মঅহমিকাকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। বেঁচে থাকার জন্য তারা যতটুকু দরকার ততটুকুই খায়, তাদের কাছে খাবারের স্বাদ বা চেহারা কোনো বিষয় নয়। তবে বেনারাসের মতো জনবহুল শহরেও কেউ তাদেরকে নরমাংস খেতে বাঁধা দেয় না, কারণ তাদের খাওয়ার জন্য শ্মশানের পোড়ানো মৃতদেহ রয়েছেই।

আঘোরীদের ধ্যান

ধ্যান করার জন্য আঘোরীরা বেছে নেয় শ্মশানকে। একেবারে মধ্যরাত থেকে তারা পোড়ানো মৃতদেহের উপর বসে ধ্যান শুরু করে। তারা বিশ্বাস করে এই সময়টিতে কোনো মানুষ বা কোনো আত্মা ঘোরাফেরা করে তাদের ধ্যানের মনোযোগ নষ্ট করতে পারবে না। এছাড়া তারা ধ্যান করার আগে খানিকটা গাঁজাও টেনে নেয় যাতে ধ্যানের মনোযোগ আরও সুদৃঢ় করতে পারে। এছাড়া তারা দাবী করে, গাঁজার ঘোর তাদেরকে আত্মা দেখতে সাহায্য করে! যদিও গাঁজা টানার পরেও তাদের চোখ থাকে শান্ত-নির্লিপ্ত।

আঘোরীদের ক্ষমতা

আঘোরীরা দাবী করে তাদের কাছে পৃথিবীর সব রোগেরই ঔষধ রয়েছে, যেগুলো ক্যান্সার এমনকি এইডসকেও সারিয়ে তুলতে পারে! তারা এগুলো পোড়ানো মৃতদেহগুলো থেকে সংগ্রহ করে এবং একে বলা হয় ‘মানুষের তেল’! তারা বিশ্বাস করে এগুলো দিয়ে সব রোগই সারিয়ে তোলা সম্ভব কিন্তু মানুষ এগুলো ব্যবহার করে না সামাজিক বাধার কারণে। যদিও বিজ্ঞান দিয়ে তাদের এই দাবীকে কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।

আঘোরীদেরকে বলা হয় পৃথিবীর সেরা কালো জাদুকর। যদিও তারা দাবী করে, তারা এই ক্ষমতা কখনো মানুষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে না, বরং মানুষের উপকার করে। কোনো অসুস্থ মানুষের রোগকে তারা কালো জাদুর সাহায্যে মৃতদেহে ঢুকিয়ে দেয় এবং মৃতদেহ পুড়িয়ে রোগটিকে ধ্বংস করে ফেলে!

আঘোরীদের মূলমন্ত্র – “নোংরামির মধ্যে বিশুদ্ধতা খোঁজা”

আঘোরীরা বিশ্বাস করে ডান বা ভাল পথের চেয়ে বাম বা খারাপ পথ দ্বারা দেবতার সান্নিধ্য পাওয়া যায় খুবই দ্রুত এবং এটি কার্যকরও হয় আরও গভীরভাবে। যদিও এভাবে সান্নিধ্য পাওয়ার মতো সাহস শুধু আঘোরীদেরই আছে। অমাবস্যার মধ্যরাতে তারা কালীকে খুশি করার জন্য মৃতদেহের সাথে মিলিত হয়! মেরোনাথ নামক এক আঘোরী সাধুর ভাষায়, “আমাদের এই কাজকর্ম বাইরের দুনিয়ায় অতি অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা নোংরামির মধ্যে বিশুদ্ধতা পাওয়ার চেষ্টা করি। যদি কেউ মৃতদেহের সাথে মিলিত হবার সময়ও দেবতার উপর মনোযোগ রাখতে পারে তবে বুঝতে হবে সে সঠিক পথে রয়েছে।” এছাড়াও তারা বিশ্বাস করে, এর ফলে তাদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সৃষ্টি হয়! মিলিত হবার সময় অন্যান্য সাধুরা বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র জপতে থাকে এবং শ্মশানে বাজতে থাকে ঢাকের বাজনা!

লেখার শুরুটা হয়েছিল গল্প দিয়ে, শেষটা করা যাক একটা বাস্তব ঘটনা দিয়ে।

আঘোরী সাধুদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন তৈলঙ্গ স্বামী। যা-ই হোক, বেনারাস শহরের কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের এক পুরোহিত একদিন দেখতে পান তৈলঙ্গ স্বামী তার গোপনাঙ্গ দিয়ে শিবের পূজা করছে! দেখার সাথে সাথে তিনি তৈলঙ্গ স্বামীকে চড় মেরে তাকে মন্দির থেকে তাড়িয়ে দেন এবং পরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়। পরদিন সকালেই পুরোহিত আকস্মিকভাবেই মারা যান কোনোরকম আঘাত বা বিষ প্রয়োগ ছাড়াই!

সবচেয়ে বিখ্যাত আঘোরী সাধু – “তৈলঙ্গ স্বামী”

 

Related Articles

Exit mobile version