Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তারিম মমি: ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বিস্ময়কর মমির গল্প

পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসের মাঝে চীন সাম্রাজ্যের ইতিহাস অন্যতম সমৃদ্ধ। এর পেছনে মূল কারণ হলো চীনের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে চীনের পথে ঘাটে, অলিতে-গলিতে, দেয়ালের কারুকার্যে, ভাস্কর্যে এবং মন্দিরের বেদিতে। এছাড়াও বিখ্যাত পণ্ডিত এবং পরিব্রাজকদের ব্যক্তিগত নথিপত্রে চীনের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যদি পৃথিবীর বাকি ইতিহাসে ফাঁকি থাকার বিন্দুমাত্র অবকাশও থাকে, সেটা চীনের ক্ষেত্রে কখনও সম্ভব নয়।

কিন্তু ১৯৭৮ সালের দিকে চীনের তারিম অববাহিকা অঞ্চলে বেশ কিছু লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের কাছে লাশগুলো ‘তারিম মমি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চীনের ঝিংঝিয়াং প্রদেশে আবিষ্কৃত তারিম মমিগুলো প্রায় ৪ হাজার বছর পুরাতন। গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা যা জানতে পারলেন, তা এর আগে কেউই জানতো না। এমনকি ইতিহাসবিদরাও দ্বিধায় পড়ে গেলেন। কারণ মমির গল্পের সাথে মিলছে না ইতিহাসের উপাখ্যান। চীনের সমৃদ্ধ ইতিহাসের মুকুটে সূক্ষ্ম খাদ হয়ে আবির্ভূত হলো তারিম মমি।

তারিম মমি আবিষ্কার

১৯৭৮ সালের ঘটনা। চীনের ঝিংঝিয়াং অঞ্চলে অবস্থিত তারিম অববাহিকায় প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করেন চীনা গবেষক ওয়াং বিংঘুয়া। সেই অভিযানে ঘটনাক্রমে তিনি মাটিতে উল্টানো একটি নৌকা আবিষ্কার করেন। কৌতূহলী বিংঘুয়া নৌকা ফের সোজা করতেই বেরিয়ে আসে কয়েকটি লাশ। নৌকাটি মূলত একটি ‘সমাধিক্ষেত্র’ ছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, লাশগুলো ছিল প্রায় অক্ষত। তিনি তার এই অনুসন্ধানের কথা কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর আশেপাশের এলাকায় অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি লাশ উদ্ধার করা হয়। গবেষকদের মতে এর উৎপত্তি প্রায় চার হাজার বছরের পুরাতন হতে পারে।

মানচিত্রে তারিম অববাহিকার অবস্থান; source: Wikimedia Commons

কী সর্বনাশ! এতদিন ধরে লাশগুলো অক্ষত থাকলো কীভাবে? প্রাচীন মিশরে লাশগুলো মমি বানিয়ে সংরক্ষণ করা হতো, ফলে মমির দেহ অক্ষত থাকতো বছরের পর বছর। কিন্তু এদের দেহ মিশরীয় মমির মতো ব্যাণ্ডেজে মোড়ানো ছিল না। কিন্তু এই লাশগুলো ছিল প্রাকৃতিক মমি। তাই এদের নাম দেয়া হয় ‘তারিম মমি’। পরবর্তীতে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, শুষ্ক আবহাওয়ার কারণেই মমিগুলো হাজার বছর ধরে অক্ষত ছিল। বিশেষ করে তারিম অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত তাকলামাকান মরুভূমির আবহাওয়া প্রচণ্ড শুষ্ক। আবহাওয়ার শুষ্কতার কারণে লাশগুলোর দেহ পচন থেকে রক্ষা পায়।

মরুভূমির শুষ্কতার কারণেই মমিগুলো অক্ষত ছিল; source: Pinterest

তবে গবেষকদের বিস্ময়ের কারণ ছিল অন্যদিকে। লাশগুলো দেখতে স্থানীয় চীনাদের মতো ছিল না। এমনকি এশিয়া অঞ্চলের কোনো জাতির সাথে এদের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অক্ষত লাশগুলোর অনেকেরই চুল ছিল পশ্চিমাদের মতো সোনালী। এদের চোখের মণির রঙ ছিল ইউরোপীয়দের মতো নীল। এদের পরনের পোশাকও ছিল পশ্চিমাদের মতো। তাই তাৎক্ষণিকভাবে মমির উৎপত্তি নিয়ে কেউই একমত হতে পারলেন না। তাই মমিগুলো গবেষণার জন্য ইতিহাসবিদদের হাতে তুলে দেয়া হয়।

অদ্ভুত মমির গবেষণা শুরু

গবেষণার শুরুতে মমিগুলোর কার্বন ডেটিং টেস্ট সম্পন্ন করার জন্য বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। টেস্টের ফলাফল অনুযায়ী জানা যায়, সেগুলো প্রায় ৩,৯৮০ বছর পুরাতন। এছাড়াও জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এর ডিএনএ টেস্টও সম্পন্ন করা হয়। সেটা নিয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা করা হবে।

মমির ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইতিহাসের অধ্যাপক ভিক্টর মেয়ার। তিনি তারিম মমি নিয়ে বেশ কয়েকটি জার্নাল প্রকাশ করেন। সেগুলো থেকে জানা যায়, বেশ কয়েকটি মমির মাথায় এক প্রকার টুপি পরা ছিল। সেগুলো প্রাচীন টাইরোলিয়ান টুপির সদৃশ। লাশের কফিনের ভেতর বেশ কিছু গুল্ম পাওয়া যায়। গুল্মগুলো প্রাচীনকালে ইউরোপে শেষকৃত্যে মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর নৌকার মাধ্যমে সমাধিস্থ করার রীতি ভাইকিংদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

মমিগুলোকে ভাইকিংদের মতো উল্টো নৌকার সাহায্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো; source: Wikimedia Commons

মমি প্রাপ্তিস্থানের আশেপাশে কোনো বসতির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ থেকে বোঝা যায় এরা নৌকায় করে এই অঞ্চল দিয়ে ভ্রমণ করছিলেন। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, এই অববাহিকায় প্রাচীনকালে একটি ছোট নদী প্রবাহিত হতো। কিন্তু চার হাজার বছর পূর্বে যখন মমিগুলো জীবিত ছিল, তখন সেই নদীর অবস্থা মৃতপ্রায় ছিল। সমাধিস্থলে তোখারিয়ান ভাষায় রচিত কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। প্রাচীন চীনে তোখারিয়ান ভাষার প্রচলন থাকলেও ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলের এর ব্যবহারের কথা জানা যায়। এছাড়াও মমিগুলো ককেশীয় ছিল বলে তিনি মনে করেন। মেয়ারের মতে, তাদের মাতৃভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয়।

মমিগুলো দেখতে প্রাচীন ইউরোপীয়দের মতো ছিল; source: slavorum.org

এসব বিশ্লেষণ থেকে মমির ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য পরিষ্কার হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতায় ঝিংঝিয়াং-এর আদিম অধিবাসী হিসেবে উইঘুর জাতির নাম থাকলেও, তাদের আগমন ঘটে প্রায় ৮৪২ খ্রিস্টাব্দের দিকে। অপরদিকে মমিগুলোর আগমন ঘটে প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বে। অর্থাৎ চীনের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই মমিগুলো। তারিমের স্থানীয় হিসেবে উজবেক, রুশ, কাজাখদের নাম উঠলেও কখনও পশ্চিমাদের ব্যাপারে ইতিহাসবিদরা কোনোরূপ আলোকপাত করেননি। তারিম মমি প্রাচীন চীনের সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতির অপূর্ব মিশ্রণের কথা ইঙ্গিত করে, যা এর আগে জানা ছিল না। হতে পারে উইঘুরদের দেহে বয়ে চলেছে পশ্চিমা রক্ত, যা সম্পর্কে তারা অবগত নয়।

ডিএনএ টেস্টের ফলাফল

ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি বিজ্ঞানীরাও রোমাঞ্চকর তথ্য নিয়ে হাজির হন। ড. হুই ঝাউয়ের নেতৃত্বে মমিগুলর ডিএনএ টেস্ট সম্পন্ন করা হয়। তিনি টেস্টের ফলাফল নিয়ে BMC Biology নামক জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মমিগুলোর ডিএনএতে প্রাচীন ইউরোপীয় এবং সাইবেরিয়ানদের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ লক্ষণীয়। এদের ডিএনএ-এর Y ক্রোমোজোম বর্তমান পূর্ব ইউরোপ এবং সাইবেরিয়া অঞ্চলের পুরুষদের Y ক্রোমোজোমের সদৃশ। কিন্তু এর সাথে বর্তমান চীনাদের ডিএনএর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ড. লির উদ্যোগে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। গবেষণার মাধ্যমে মমিগুলো ইউরেশিয়ান বংশোদ্ভুত বলে প্রমাণিত হয়। মজার ব্যাপার হলো, মমিগুলোর ডিএনএর সাথে প্রাচীন ভারতীয়দের ডিএনএর খুব সামান্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও এর দ্বারা তেমন কিছুই প্রমাণিত হয় না।

মমির হাতে পশ্চিমা কায়দায় আঁকা ট্যাটু; source: slavorum.org

জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পরবর্তীতে এই ফলাফলের ব্যাখ্যা নিয়ে নতুন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধে তারা তাদের ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয়দের চীন আগমন নিয়ে নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন।

ড. লি এর মতে, “আফানাসেভো সংস্কৃতির মানুষদের সাথে ইউরেশিয়ানদের (সাইবেরিয়া) বিবাহ প্রথা চালু ছিল। তাদের সংমিশ্রণে উদ্ভুত জাতি পরবর্তীতে কাজাখ উপত্যকার মাধ্যমে উত্তর ঝিংঝিয়াং অঞ্চলে স্থানান্তরিত হন”।

এই আফানাসেভো সংস্কৃতির মানুষদের সাথে ইন্দো-ইউরোপীয়দের সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে চীনের স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে দাবি করা উইঘুরদের মৌলিকত্ব নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে দ্বিধার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে গবেষকদল আরো কয়েকটি জাতির সাথে সাইবেরিয়ানদের বিবাহের সম্ভাবনার কথা বলেন। BMC Biology জার্নালে গবেষকরা মমির বংশগতির সম্ভাব্য যাত্রাপথ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রকাশ করেন।

মমির বংশগতির সম্ভাব্য যাত্রাপথ; source: Forbes Magazine

তারিম মমি অনুসন্ধানকে চীনের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসন্ধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে চীনের ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন ইতিহাসবিদরা। শুধু চীন নয়, ইউরোপের সাথে এশিয়ার সম্পর্ক নিয়েও অনেক অজানা তথ্যের কথা উন্মোচিত হয় তারিম মমির মাধ্যমে।

ইংরেজিতে প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে- ‘Dead Men tell no tale’। অর্থাৎ মৃতব্যক্তি কোনো গল্প বলে না। কে বলেছে বলে না? তারিম মমি দিব্যি এক হারানো চীনের গল্প শুনিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো। তবে তার গল্প এখনও শেষ হয়নি। গবেষণা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে এই মমিগুলো আরো অজানা তথ্য প্রকাশের আমাদের আমাদের রোমাঞ্চিত করবে, সে ব্যাপারে কারো দ্বিধা নেই।

ফিচার ইমেজ- Pinterest

Related Articles