Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে শুরু হয়েছিলো আমেরিকার গৃহযুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৮৬১ সালে সংঘটিত হওয়া গৃহযুদ্ধ এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। দক্ষিণের এগারোটি রাজ্য বনাম যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল ইতিহাসে তা ‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধ’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। দাস প্রথার অবসান এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলো দাস প্রথা অবসানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সব রাজ্যের সিদ্ধান্ত না মেনে স্বাধীনভাবে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা সে প্রশ্নেই শুরু হয়েছিলে এই বিবাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ বনাম উত্তরের রাজ্যগুলোর মধ্যকার ঘরোয়া এক বিবাদ। তবে দাস প্রথা এই যুদ্ধের প্রধান কারণ হলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরো নানা ঘটনা। এজন্য আমাদেরও একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।

শিল্প বিপ্লব না কৃষির উন্নয়ন?

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তরের রাজ্যগুলো কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ভাবনা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে এনে শিল্পবান্ধব অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে ব্যাপক হারে নির্মিত হতে থাকে  নানা শিল্প-কলকারখানা। অর্থনৈতিকভাবে উত্তরের রাজ্যগুলো দ্রুতগতিতে বিকশিত হতে থাকে।

স্বাধীনতার পর থেকেই আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলো শিল্পবান্ধব অর্থনীতি গড়ে তোলে; Source: YouTube

অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। ফলে উত্তরের রাজ্যগুলোর মধ্যে যত দ্রুত উন্নতি ঘটছিল, তার বিপরীতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উন্নতি তুলনামূলকভাবে শ্লথই ছিল। ফলে দুই রাজ্যের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

দাস প্রথার বিলোপ

দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছিল কৃষিনির্ভর। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিপুল পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা হত, বিশেষ করে তুলা এবং তামাক। আর এসব কৃষিকাজে ব্যবহার করা হতো দাসদের। অন্যদিকে উত্তরের শিল্প কলকারখানায় দাসদের প্রয়োজনীয়তার কমে আসছিল। সুতরাং যখন আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথা বিলোপের ঘোষণা দেন, তখন দক্ষিণ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর শ্বেতাঙ্গ মানুষদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাদের মনে হয়, এটি তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এক হীন ষড়যন্ত্র।

দক্ষিণের দাস প্রভাবাধীন রাজ্যগুলোতে শ্রমিক নির্ভর কৃষি অর্থনীতির ফলে দাস প্রথা বিলুপ্তিতে রাজ্যগুলোতে বিরূপ প্রভাব পড়ে; Source: thegreatfiction.com

এ কারণে দক্ষিণের ৭টি রাজ্য (সাউথ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, অ্যালাবামা, জর্জিয়া, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস) আমেরিকান ইউনিয়নের বিপক্ষে চলে যায়। দাসদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া এবং কৃষিতে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ার ভয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ভূমি মালিক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরা ক্ষেপে যান কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে, যা পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।

গৃহযুদ্ধের সময় এবং তার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে দাস মুক্ত এবং দাস প্রভাবাধীন রাজ্যের সংখ্যা; Source: Wikimedia commons

রাষ্ট্রীয় অধিকার

রাজ্যগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় অধিকার সম্পর্কিত বিষয়সমূহ পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। এই বিষয়টি গৃহযুদ্ধের সূচনা হিসেবে উঠে আসে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে। আমেরিকার স্বাধীনতার পর যে সংবিধান প্রথম রচিত হয় তাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কতটা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকবে, আর কতটা রাজ্যগুলোর মধ্যে বন্টন করা হবে তা নিয়ে একটা বিতর্ক সেসময় উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রথম থেকেই ছিল। উত্তরের রাজ্যগুলো এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হলেও দক্ষিণের রাজ্যগুলো অনুভব করতে লাগলো যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের অধিকার ও ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে। আর এ বিষয়টি ছিল দক্ষিণের রাজ্যগুলোর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আরও একটি কারণ।

উত্তর ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলোর মধ্যে শক্তিসাম্য

স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপের দরুণ কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাঞ্চল সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে নতুন রাজ্যগুলো উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে বন্টন হতে লাগলো। তবে এক্ষেত্রে উত্তরের রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায়। সম্ম্প্রসারিত বেশিরভাগ অঞ্চলই উত্তরের সাথে যুক্ত হতে লাগলো। ফলস্বরূপ শক্তির নিরীখে উত্তরের রাজ্যগুলোর ক্ষমতা বাড়তে লাগলো।

সাংস্কৃতিক ব্যবধান

উত্তরের রাজ্যগুলোর জনগণের মধ্যে দাস প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে, দাস প্রথা অমানবিক, অচিরেই তার বিলোপ হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে শ্রমিকদের শ্রমের ওপর নির্ভরশীল ছিল,  সেই শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশই ছিল আফ্রিকা থেকে আনা কালো অধিবাসীরা, যাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাই দক্ষিণের জনগণ দাস প্রথার বিলোপ এবং দাসদের সমঅধিকারের বিষয়টি কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। আর সে কারণে এ বিষয়ে বারবার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল দাস প্রথার বিলোপ দক্ষিণের জনগণের অধিকারের ওপর অযথা হস্তক্ষেপ এবং দক্ষিণের অর্থনীতি দুর্বল করার জন্য উত্তরের রাজ্যগুলোর চক্রান্ত। আর এজন্যই দক্ষিণের রাজ্যগুলো গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

দাস প্রথা অবসানের পটভূমি

উনবিংশ শতাব্দী থেকেই দাস প্রথার বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ জমাট বাঁধতে শুরু করে। মার্কিন জনসাধারণের এক বিপুল অংশ আর মেনে নিতে পারছিল না জঘন্য এই প্রথা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সময়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, “জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই সমান।” চলমান ক্রীতদাস প্রথা ছিল স্বাধীনতার এই ঘোষণার সঙ্গে একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে এই বিষয়টি প্রধান এজেন্ডা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

দাস প্রথা অবসানের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থানরত রাজ্যগুলো; Source: Thomas’ Legion

১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে জয় লাভ করেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারে দাস প্রথা অবসানের প্রতিশ্রুতিও দেন। আর তাই লিঙ্কনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাও বুঝিয়ে দেয় আমেরিকার সাধারণ মানুষের মতামতের হাওয়া এদিকেই বইছে। দাস প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া জনগণ আশায় বুক বাঁধতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন; Source: Wikimedia commons

নির্বাচিত হয়েই লিঙ্কন এই ঘোষণা দেন, যে রাজ্যগুলোতে দাসপ্রথা প্রচলিত রয়েছে সেখানে তা বিলুপ্ত করার চেষ্টা তিনি করবেন না, বরং রাজ্যগুলোকে উদ্বুদ্ধ করবেন যাতে তারা দাস প্রথা অবসানে এগিয়ে আসে। কিন্তু এই অঙ্গীকার তিনি করেন যে, ভবিষ্যতে নতুন কোনো রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে, সেসব রাজ্যকে অবশ্যই দাস প্রথার অবসান ঘটাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কোনো রাজ্যে দাস প্রথার প্রচলন করা যাবে না। তিনি জানতেন, তার এই নীতির ফলে দাসমুক্ত রাজ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষিণের দাস প্রভাবাধীন রাজ্যগুলো শক্তি ও প্রভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে।

আব্রাহাম লিঙ্কন তার মন্ত্রিসভায় দাস প্রথা অবসানের প্রথম খসড়াটি উপস্থাপন করেন; Source: Wikimedia commons

লিঙ্কন সরাসরি দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দাস প্রথা অবসানের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিলেও উত্তরের রাজ্যগুলোতে দাস প্রথার অবসান এবং দাস প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠায় তার আঁচ গিয়ে পড়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতেও। ফলে মার্কিন ফেডারেল সরকার আর দক্ষিণের দাসনির্ভর কিছু রাজ্যের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিতে শুরু করে। স্বাধীনতার সময়ে একদিকে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সমান’, আবার অন্যদিকে সংবিধানে লেখা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত সব রাজ্যই তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে অবস্থিত ৭টি রাজ্যের অভিমত ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে এই সাতটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণের আরও চারটি রাজ্য তাদের সাথে যোগ দেয়।

১৮৬১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণের এই ১১টি রাজ্য একত্র হয়ে ঠিক করলো, তারা এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।  নতুন এক যুক্তপ্রদেশ বা  কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করা হলো। জেফারসন ডেভিস হলেন সেই যুক্তপ্রদেশের প্রেসিডেন্ট।

কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জেফারসন ডেভিস; Source: Wikimedia commons

দক্ষিণের রাজ্যগুলোর এই হাঁকডাকের জবাবে উত্তরের রাজ্যগুলোও নির্দ্বিধায় জানালো, কোনোমতেই এই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাঙা চলবে না। এই ১১টি রাজ্য বাদ দিয়ে দাসবিরোধী বাকি রাজ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন বা উত্তর নামে পরিচিতি পায়। এই ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি ছিলেন নির্বাচিত আব্রাহাম লিঙ্কন।

যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন এবং কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকার মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা ; Source: sutori.com

শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। ক্রীতদাসরা স্বাধীন হবে কিনা এই প্রশ্নে যে বিবাদ শুরু হয়েছিল, তা এবার ঘুরে গেল অন্যদিকে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সম্মিলিতভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে কিনা, তা-ই প্রধান হয়ে সামনে উপস্থিত হলো।

ফিচার ইমেজ- americancivilwar.info

Related Articles