ভারতভূমিতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস অনেক পুরনো। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের ইতিহাসের পাতা খুললে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোই পাওয়া যায় রক্তস্নাত। এই রক্ত সাধারণ মানুষের হাতে ঝরানো তার প্রতিবেশীর রক্ত, তার বন্ধুর রক্ত। নানা জাত, নানা ধর্মের মানুষের বৈচিত্রে ভরা ভারতভূমি সংখ্যালঘুদের জন্য কখনোই নিরাপদ আবাস হতে পারেনি। উপরন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা অর্জনের পথে বলি হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
মুসলিমরা ভারতে সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। কিন্তু মুসলিম বাদেও ভারতে আরও অনেক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রয়েছে। এবং তাদের সাথেও রয়েছে সংখ্যাগুরুদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস। ঠিক এমনই একটি ভয়াবহ দাঙ্গা ঘটেছিল ১৯৮৪ সালে। শিখ সম্প্রদায়ের উপর চালানো ভয়াবহ সেই হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ আর লুটতরাজের ঘটনা এখনও দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে বেড়ায় সেই সময়ের সাক্ষী মানুষগুলোকে। এই পাশবিকতা শুরু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসের এই পাতাটি রক্তস্নাত, তাই চাইলেই একে ছিঁড়ে ফেলে দেয়া যায় না।
ভারত থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে ১৯৮৪ সালে সংঘটিত হয় শিখ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সে বছর ৬ জুন পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের স্থাপনাগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অগণিত সাধারণ শিখ জনতা নিহত হয় সেনাবাহিনীর হাতে। আর এরই প্রতিশোধস্বরুপ, সে বছরই ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দুই শিখ দেহরক্ষী তাকে গুলি করে হত্যা করে।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনতিবিলম্বে সাধারণ জনতার বিশাল একটি অংশের ভেতর শিখদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে একটি সুসংবদ্ধ দাঙ্গার মাধ্যমে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র তথা ভারতের প্রভৃতি অঞ্চলজুড়ে প্রায় ৩,৩২৫ জন শিখকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে শুধু দিল্লিতেই হত্যা করা হয় ২,৭৩৩ শিখকে। কংগ্রেসের কর্মীরা লোহার রড, ছুরি, লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে যায় শিখ নিধনের উদ্দেশ্যে। দাঙ্গার ফলস্বরূপ অগণিত শিখ মহিলা ধর্ষণের শিকার হন। শিখদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে, চলে গণহারে লুটপাট। এক বিচিত্র বন্যতায় মেতে ওঠে পুরো ভারত।
৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা শিখ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে শুরু করে। ঘর থেকে টেনে বের করে শিখদের পেটানো ও হত্যা করা হয়। নিউ ইয়র্কের ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোর ফার্মাকোলজির প্রফেসর সৎপাল সিং সেই দাঙ্গার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও শিকার।
তিনি হায়দ্রাবাদ থেকে ট্রেনে অমৃতসর যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ভোপালে হঠাৎ ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ে এবং কিছু দাঙ্গাবাজ ট্রেনে উঠে পড়ে। তারা সৎপাল সিংকে মেরে অচেতন করে মৃত ভেবে রেললাইনে ফেলে রেখে চলে যায়। এই সময় কেউ তাকে ডেকে বলে, "জলদি ট্রেনে উঠে এসো, তুমি বেঁচে আছো জানলে তোমাকে পাথর মেরে মেরে ফেলবে।” তিনি বলেন, নভেম্বরের সেই রাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মৌন ভূমিকা অবলম্বন করে। এমনকি তিনি এটাও বলেন, “আমি পুলিশদের দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্য করে বলতে শুনেছি, সবগুলোকে মেরে ফেলো, ওরা আমাদের মাকে হত্যা করেছে।”
ট্রেন যখন গোয়ালিয়রে থামে, তখন সৎপাল নেমে এক সেনা অফিসারের কাছে সাহায্য চান। উত্তরে তিনি জানান, সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার কোনো নির্দেশনা পায়নি। তার জন্য ভালো হবে পুলিশের কাছে যাওয়া। দিশেহারা সৎপাল পুলিশ স্টেশনে ছুটে গেলে কর্তব্যরত অফিসার তাকে পরের ট্রেন ধরে দিল্লি চলে যেতে বলেন। সৎপাল যখন জানান যে দিল্লিতে কী হচ্ছে সে বিষয়ে তার পরিষ্কার ধারণা আছে, তখন অফিসার বলেন, “সর্দারজি, আপনার কপালে যা আছে, তা আমি কী করে বদলাবো?”
অমরজিৎ সিং ওয়ালিয়া নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ২০১৪ সালে একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করেন সেই রাতের কাহিনী। বর্তমান ঝাড়খন্ডের অন্তর্গত ডাল্টনগঞ্জের এক বাজারে অমরজিৎ গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন। সে রাতে তার কিছু হিন্দু বন্ধু অবস্থা বেগতিক বুঝে তাকে বাড়ি না ফিরতে পরামর্শ দেন। তিনি কমলেশ নামে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে থেকে যান। পরদিন সকালে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন, প্রায় ৬০০ লোক হাতে রড আর কেরোসিন নিয়ে বাজারে লুটপাট চালাচ্ছে। তারা তার দোকানে ঢুকেও লুটপাট চালায়। নিকটস্থ তার ভাইয়ের দোকানেও তারা লুটপাট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। অমরজিৎ বলেন, এসব লোকের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল যাদের সাথে তিনি সন্ধ্যাবেলা একসাথে বসে চা পান করতেন।
তার বর্ণনায় আরও আছে, নিকটস্থ গুরুদ্বারটি রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো। সেখানকার মূল পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছিল। জানালার ভাঙা কাঁচগুলো ঘন্টাব্যাপী পাথর নিক্ষেপের চিহ্ন হয়ে ছিল। ট্রেনে শহর ছাড়ছিল এমন বেশ কিছু শিখকে ট্রেন থেকে নামিয়ে এনে হত্যা করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাঙ্গাবাজদের ভয়ে শিখদের ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা শর্ত দেয়, চিকিৎসা পেতে হলে তাদের পাগড়ি ফেলে দিয়ে তাদের লম্বা চুলের গোছা কেটে ফেলতে হবে। এই পাগড়ি শিখদের জন্য সম্মানের প্রতীক। জীবন বাঁচাতে অনেকেই সেই সম্মান বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। অমরজিৎ লিখেছেন, “যেকোনো ধরনের হত্যাই খারাপ। কিন্তু এটা আরও বেশি খারাপ যখন পুরো জাতি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে ফেলে।”
হিন্দুস্তান টাইমসের ২০১৭ সালের একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায় ’৮৪ এর দাঙ্গার আরেক ভুক্তভোগী আত্তার কৌরের কথা। আত্তার তার স্বামীসহ তার যৌথ পরিবারের ১১ জন সদস্যকে হারিয়েছেন সেই দাঙ্গায়। তারা কংগ্রেস সমর্থক ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার সংবাদে তারাও মর্মাহত হয়েছিলেন। কিন্তু উত্তেজিত দাঙ্গাবাজদের অত কিছু দেখার সময় বা ইচ্ছে ছিল না। ১ নভেম্বরের সকালে দুর্বৃত্তরা পূর্ব দিল্লির ত্রিলোকপুরীতে তাদের এলাকায় হামলা করে। আত্তারের স্বামী কৃপাল সিং তার কিছু আত্মীয়ের উপর আক্রমণের খবর পেয়ে গুরুদ্বারের দিকে ছুটে যান। ব্যতিব্যস্ত আত্তার স্বামীকে বলারও সময় পাননি যে, ‘সাবধানে থেকো।’ তিনি তার ৭টি সন্তান আর তার শ্বাশুড়িকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার মুসলিম প্রতিবেশীরা তার দুই ছেলের জীবন বাঁচাতে তাদের চুল কেটে দেয় এবং লোহার ট্রাঙ্কের ভেতর লুকিয়ে রাখে। দাঙ্গাবাজরা চলে যাবার পরে তিনি জানতে পারেন তার স্বামীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। স্বামীকে আর দেখা হয়নি আত্তারের। তিনি বয়স আর স্মৃতির ভারে ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখের জল এখনও সজীব। ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “ছাগল-ভেড়ার মতো সব লোকগুলোকে মেরে ফেললো... জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিলো!”
দিল্লি পুলিশ কর্তৃক এই দাঙ্গার সাথে সংশ্লিষ্ট ৫৮৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২৪১টি পরবর্তীতে প্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ২০০৬ সালে ৪টি ও ২০১৩ সালে ১টি মামলার কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়। এসব মামলায় অভিযুক্ত হন ৩৫ জন। বাকি মামলাগুলো বন্ধই থেকে যায়। ২০০০ সালের মে মাসে ভারত সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত জি টি নানাবতী কমিশন ২০০৪ সালে দেয়া তাদের রিপোর্টে বলে, প্রাথমিকভাবে যা উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শুরু হয়েছিল, শীঘ্রই তা সংগঠিত হত্যাযজ্ঞে রূপ নেয়। এছাড়াও কমিশনের রিপোর্টে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির স্থানীয় অনেক নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে দাঙ্গায় উস্কানী ও মদদ দেয়ার বিশ্বস্ত প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কোনো লিখিত অভিযোগ না থাকার কারণে, শুধু প্রত্যক্ষদর্শীদের নেয়া নামের উপর ভিত্তি করে কমিশন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারেনি। অবশ্য এটিই একমাত্র কমিশন নয়, অন্তত দশটি এমন কমিশন তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর, ’৮৪ এর দাঙ্গার শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যেককে ৫ লাখ রুপী করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রস্তাবনা অনুমোদন করে। ২০১৫ এর ফেব্রুয়ারিতে ’৮৪ এর দাঙ্গার বন্ধ হয়ে যাওয়া মামলাগুলো পুনরায় পর্যবেক্ষণ করতে সরকার ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম’ (SIT) তৈরি করে। সর্বশেষ, SIT এর এই ৩ সদস্যের একজন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে টিম ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট অবশিষ্ট ২ সদস্যকেই পুনঃউন্মুক্ত করা ১৮৬টি মামলার পর্যবেক্ষণের কাজ চালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। এর আগে ২০১৮ এর নভেম্বরে ১৯৮৪ সালে ত্রিলোকপুরী এলাকায় দাঙ্গা, ঘরবাড়ি জ্বালানো ও কারফিউ লঙ্ঘনের অপরাধে দিল্লি হাইকোর্ট ৮৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ও প্রত্যেককে ৫ বছরের কারাদন্ডাদেশ দেয়। এছাড়া এই দাঙ্গার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারকে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেয় দিল্লি হাইকোর্ট।
’৮৪ এর দাঙ্গার শিকার সেই আত্তার কৌর এখন পশ্চিম দিল্লির তিলক বিহার বিধবা কলোনীতে বাস করেন। কলোনীর অন্য বিধবারা প্রেসের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। এক ভয়ানক স্মৃতি আর কতই বা রোমন্থন করবেন তারা! কিন্তু আত্তার কাউকে ফেরান না। তার নাতনী তাকে জিজ্ঞেস করে যে কেন তিনি ইন্টারভিউ দেন কাঁদতে হবে জেনেও। তিনি বলেন, “যে-ই আমাদের দুঃখের ভাগ নিতে আসে, তাকে স্বাগত জানানো উচিৎ।”
ইন্দিরা গান্ধী সম্বন্ধে পড়ুন 'ইন্দিরা গান্ধী' বইটি।
This article is in Bangla language. It discusses about the aftermath of the assassination of Indira Gandhi & the murder of the Sikh people. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: reddit.com