Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য ব্যাটল অভ মোগাদিসু: ব্ল্যাকহক ডাউন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করেছে। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ বা ‘গণতন্ত্র’ উদ্ধার ইত্যাদি বিভিন্ন অজুহাতে পৃথিবীর নানা দেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর পায়ের ধূলা পড়েছে। কখনো মার্কিন জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সমান পারদর্শী, দুর্ধর্ষ কমান্ডোরা কাকপক্ষীর অগোচরে অন্য দেশের ভেতরে গিয়ে গোপন অপারেশন পরিচালনা করে শত্রু নিধন করে এসেছে। আবার কখনো মার্কিন সেনাবাহিনী একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভিনদেশে যুদ্ধ করতে গিয়েছে।

এসব ক্ষেত্রে ধুরন্ধর মার্কিনীরা বেশিরভাগ সময়ই সফল হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো বিদেশের মাটিতে চরম পরাজয়ের স্বীকারও হতে হয়েছে আমেরিকাকে। ২০০৫ সালে আফগানিস্তানে ‘অপারেশন রেড উইংস‘ পরিচালনা করার সময় তালিবানের হাতে পরাজিত হয়েছিল মার্কিন কমান্ডো বাহিনী। এর আগে ১৯৯৩ সালে সোমালিয়াতেও শত্রুপক্ষের কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিল মার্কিন সৈনিকরা। সেই বছর সোমালিয়ার মোগাদিসুতে একজন ওয়ারলর্ডকে গ্রেপ্তার করার এক মিশনে ১৮ জন মার্কিন সৈনিক সোমালি মিলিশিয়াদের হাতে নিহত হয়। ভিয়েতনামের পর মোগাদিসুর এই যুদ্ধটিই হচ্ছে মার্কিন ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ ও মারাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজয় আফ্রিকায় মার্কিন নীতির ওপর যেমন প্রভাব ফেলেছিল তেমনিভাবে বিদেশে মার্কিন রণনীতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। চলুন জেনে নেওয়া যাক ‘দ্য ব্যাটল অভ মোগাদিসু‘র আদ্যোপান্ত।

ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার; Image Source: Lockheed Martin

সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ

১৯৬০ সালে সোমালিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তী নয় বছর গণতান্ত্রিক সরকার দেশটি শাসন করে। ১৯৬৯ সালে একটি সামরিক অভ্যুদয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন মোহাম্মদ সাইয়াদ বারি। সোমালিয়াকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক’ উপায়ে পরিচালনা করার ব্যর্থ চেষ্টার ফলস্বরূপ বারি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও করুণ দশার দিকে ঠেলে দেন। দুর্ভিক্ষ, খরা এসব সোমালি জনগণের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়ার সাথে এক দশকের যুদ্ধ। সবমিলিয়ে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে সোমালি জনগণ অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়। ১৯৯১ সালে বারিকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার বিরোধী শক্তির দলগুলো। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায় গোষ্ঠীভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের মধ্যে। রাজধানী মোগাদিসু পরিণত হয় মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্রে। ‘ব্ল্যাক হক ডাউন’ উপন্যাসের লেখক মার্ক বাউডেন ঐ সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিকে উল্লেখ করেছেন ‘যাবতীয় নরকের রাজধানী’ হিসেবে।

যুদ্ধের পরিণাম হিসেবে ১৯৯১ সালের শেষার্ধে শুধু মোগাদিসুতেই হতাহত হয় প্রায় বিশ হাজারের বেশি মানুষ। যুদ্ধের কারণে দেশটির কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, মানুষ খেয়ে-না খেয়ে কোনোরকম বেঁচে থাকে। সোমালিদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাঠানো খাদ্যসামগ্রীর প্রায় ৮০ শতাংশ যুদ্ধোন্মাদ দলগুলো ছিনিয়ে নেয়। ফলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ সোমালি অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯২ সালের জুলাইয়ে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর জাতিসংঘ সোমালিয়ায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ও ত্রাণকাজের নিরাপত্তা দিতে ৫০ জন সামরিক পর্যবেক্ষক পাঠায়।

বিধ্বস্ত ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করছে সোমালি জনগণ; © Dominique Mollard/AP

জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা

১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো আমেরিকা সোমালিয়ার ব্যাপারে নজর দেয়। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ৪০০ সৈন্য ও দশটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান সোমালিয়ায় পাঠান জাতিসংঘের বহুজাতিক ত্রাণব্যবস্থাকে সহায়তা প্রদানের জন্য। ‘অপারেশন প্রোভাইড রিলিফ’ নামের এই সাহায্য মিশনে বিমানগুলো প্রায় ৪৮,০০০ টনেরও বেশি খাবারদাবার ও চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও সোমালিয়ায় প্রায় পাঁচ লাখ লোক মারা যায় এবং আরও পনের লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

ডিসেম্বর মাস, ১৯৯২ সাল। জাতিসংঘের মানবিক সাহায্যের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার উদ্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন রিস্টোর হোপ’ পরিচালনা করে। এটি ছিল একটি জয়েন্ট কমান্ড মিলিটারি মিশন। মার্কিন মেরিন কোর খুব দ্রুতই বিমানবন্দর ও নৌবন্দরসহ মোগাদিসুর এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

সোমালিয়ায় মার্কিন সৈন্য; © Martin Cleaver/AP

১৯৯৩ সালের জুন মাসে বিদ্রোহী নেতা ও গোষ্ঠীপ্রধান মোহাম্মদ ফারাহ আইদিদের নেতৃত্বে মিলিশিয়া বাহিনী সোমালিয়ায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানি শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি দলের ওপর হঠাৎ আক্রমণ করে। এছাড়া একই বছরের আগস্ট মাসে একটি বোমা হামলার কারণে কয়েকজন মার্কিন মিলিটারি পুলিশ প্রাণ হারায়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার জাতিসংঘের প্রতিনিধি আইদিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন ফোর্সকে আইদিদ ও তার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের গ্রেপ্তার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ছোটখাট গ্রেপ্তার মিশনটিই পরে প্রাণঘাতী ‘ব্যাটল অভ মোগাদিসু’-তে পরিণত হয়।

ব্ল্যাক হক ডাউন

১৯৯৩ সালের তেসরা অক্টোবর তারিখ ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি, এয়ার ফোর্স ও নেভি স্পেশাল অপারেশন ট্রুপস, ডেল্টা ফোর্স, ১০ মাউন্টেন ডিভিশন-এর সমন্বয়ে গঠিত ‘টাস্ক ফোর্স রেঞ্জার’ আইদিদ ও তার হাবর গিদর ক্ল্যানের দুই শীর্ষনেতাকে বন্দী করার উদ্দেশে মিশন শুরু করে। ১৬০ জন সেনা, ১৯টি হেলিকপ্টার ও ১২টি স্থল যুদ্ধযান নিয়ে গঠিত টাস্ক ফোর্স রেঞ্জারের পরিকল্পনা ছিল যত দ্রুত সম্ভব মিশন শেষ করে ক্যাম্পে ফিরে আসা। মোগাদিসুর কাছে শহরের উপকন্ঠে একটি পোড়া ভবনের ভেতর আইদিদ ও তার লেফটেন্যান্টরা সাক্ষাৎ করছে- এমন তথ্যই ছিল মার্কিন বাহিনীর কাছে।

সোমালিয়ার আকাশে মার্কিন ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩; © Alexander Joe/AFP/Getty Images

প্রাথমিকভাবে মিশনটি সফল হলেও বিপত্তি বাঁধে ফেরার পথে। কয়েক মিনিট সময়ের ব্যবধানে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়, এক ঘন্টার পাকড়াও মিশনটি পরিণত হয় একদিনেরও বেশি দীর্ঘ উদ্ধার অভিযানে।

যে মাত্রই না টাস্ক ফোর্স রেঞ্জাররা ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে শুরু করে, তখনি তাদের ওপর আক্রমণ চালায় সোমালি মিলিশিয়া ও সশস্ত্র সিভিলিয়ানরা। রকেটতাড়িত গ্রেনেড (আরপিজি) ব্যবহার করে দুটো ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারকে ভূপাতিত করে মিলিশিয়ারা। আরও তিনটি হেলিকপ্টার মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রথম ব্ল্যাকহকের পাইলট ও কো-পাইলট দুজনই ঘটনাস্থলে মারা যান। কপ্টারে থাকা পাঁচজন সৈন্য আহত হন যাদের একজন পরে মৃত্যুবরণ করেন। দুর্ঘটনায় আহত সৈনিকদের অনেককেই উদ্ধার করা হলেও কয়েকজন মিলিশিয়াদের গুলির মুখে অকুস্থলে আটকা পড়েন। তাদের রক্ষা করার জন্য বাকি সৈনিকরা কাভার ফায়ারে অংশ নেন। মূলত দুর্ঘটনায় আটকা পড়া সৈন্যদের রক্ষা করতে ও উদ্ধার করার জন্যই মিশনটি দীর্ঘায়িত হয়। ডেল্টা ফোর্সের দুজন যোদ্ধা সার্জেন্ট গ্যারি গর্ডন ও সার্জেন্ট ফার্স্ট ক্লাস র‍্যান্ডাল শুগার্ট আহতদের রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরে ১৯৯৪ সালে তাদেরকে মরণোত্তর ‘মেডেল অব অনার’ প্রদান করা হয়।

প্রথম ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারটির পতন হলে দ্বিতীয় ব্ল্যাকহকটি এর চারপাশে কাভার ফায়ার করার সময় মিলিশিয়াদের আরপিজির মুখে পড়ে। তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পাইলট মাইকেল ডুরান্টের মেরুদণ্ড ও পা ভেঙে যায়, তাকে বন্দী করে সোমালি মিলিশিয়া বাহিনী।

Image Source: Hulton Archive/Getty Images

মাইকেল ডুরান্ট ও অন্যদের উদ্ধার করার জন্য টাস্ক ফোর্স রেঞ্জারদের ৩ তারিখ রাত ও পরের দিন অর্থাৎ ৪ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত টানা ১৫ ঘন্টা মোগাদিসুর অলিতে গলিতে সোমালি মিলিশিয়া ও সশস্ত্র সিভিলিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।

পাইলট ডুরান্ট শারীরিকভাবে নিগ্রহের শিকার হলেও ১১ দিন পর তাকে ছেড়ে দেয় মিলিশিয়ারা।

মোগাদিসুর যুদ্ধে ১৮ জন মার্কিন সৈনিক নিহত ও ৭৩ জন আহত হন। সোমালি মিলিশিয়া ও সিভিলিয়ানদের হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। তবে এই সংখ্যাটা কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার বলে ধারণা করা হয়। রেড ক্রিসেন্টের এক হিসেব অনুযায়ী প্রায় ২০০ এর মতো আক্রমণকারী সোমালি সিভিলিয়ান যুদ্ধে প্রাণ হারায়।

পাল্টে গেল মার্কিন রণনীতি

মোগাদিসুর যুদ্ধে আপাতভাবে মার্কিন বাহিনী পর্যুদস্ত হলেও পরবর্তী সময়ে এই যুদ্ধটিকে একটি দিকে থেকে সফল হিসেবে ধরা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, মাত্র দেড়শ জনের মতো মার্কিন সৈন্য এক হাজারের অধিক সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত মিলিশিয়াকে দীর্ঘক্ষণ ধরে আটকে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এই যুদ্ধের সামগ্রিক কৌশলগত ভুলগুলো ভবিষ্যতের মার্কিন যুদ্ধকৌশলগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে।

নব্বইয়ের দশকে মোগাদিসুর ঘটনার পর আরও অনেকবার মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন শান্তিরক্ষা ও মানবিক সাহায্যের কাজে অংশগ্রহণ করেছিল। এসব মিশনের পরিণতি যেন সোমালিয়ার মতো না হয় সেজন্য কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট তৎপর ছিল। এছাড়া মোগাদিসুর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ৯/১১ পরবর্তী সময়েও কাজে লেগেছিল।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফ্র্যান বুডেট ছিলেন ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি স্পেশাল অপারেশন কমান্ডের প্রধান। মোগাদিসুর অপারেশনের জন্য টিম সিলেক্ট করেছিলেন তিনি। আর্মি টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

যারা মোগাদিসুর যুদ্ধে চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে ও সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন রেখেছে, তারা বারবার আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব, বন্ধন ও সাহসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সোমালি শিশুরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হেলিকপ্টারের ওপর খেলছে; © Alexander Joe/AFP/Getty Images

বুডেট নিজে মোগাদিসুর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তী অপারেশনগুলো পরিচালনা করতে সাহায্য করেছিল বলে তিনি স্বীকার করেন।

মার্কিন ৭৫ রেঞ্জার রেজিমেন্টের কমান্ডার কর্নেল ব্র্যান্ডন টেটমেয়ারের মতে, মোগাদিসুর যুদ্ধের বীরত্ব ও সাহসিকতা বর্তমান সৈনিকদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে এবং তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করার জন্য।

মোগাদিসুর যুদ্ধে একটি নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয় মার্কিন বাহিনী আর সেটা হচ্ছে বিস্তৃত এলাকায় ইতস্তত ছড়িয়ে পড়া সিভিলিয়ানদের বাঁচিয়ে গুলি চালানো তথা যুদ্ধ করা। মার্কিন বাহিনীগুলোর পরবর্তী প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় এই বিষয়টি যোগ করা হয়। বিশেষত আফগানিস্তান, ইরাক হাইতি ইত্যাদি জায়গায় প্রথমদিকে যুদ্ধপ্রস্তুতিতে মোগাদিসুর যুদ্ধের কৌশলগত ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া হয়।

মোগাদিসুতে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের খুব কাছেই ছিল মার্কিন বাহিনীর বেজক্যাম্প। কিন্তু আফগানিস্তান ও হাইতির ক্ষেত্রে সৈনিকরা মূল ওয়ার জোনের কাছাকাছি এলাকায় গ্রাউন্ড বেজ স্থাপন করেনি, বরং এক্ষেত্রে তাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল দূরবর্তী ক্যাম্প থেকে হেলিকপ্টার বা বিমানে চড়ে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের আশপাশে অবতরণ করা।

মোগাদিসুর যুদ্ধের পর মার্কিন বাহিনীর প্রশিক্ষণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। এরপর থেকে মেডিকের পাশাপাশি প্রতিটি রেঞ্জারকে মেডিকেল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া রেঞ্জারদের মার্কসম্যানশিপ, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, যুদ্ধ কসরত ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়।

৯/১১ পরবর্তী সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে, তখন মোগাদিসু ভেটেরানদের অনেকেই মিশন ও অপারেশন পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন।

মোগাদিসুর যুদ্ধে সময় পরিকল্পনা নিয়েও ব্যর্থ হয় মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা। তাদের ধারণা ছিল ক্যাপচার মিশনটি মাত্র এক থেকে দুঘন্টা স্থায়ী হবে। ফলে অনেক সৈন্যই মিশনে যাওয়ার আগে অল্প পরিমাণ গোলাবারুদ সঙ্গে নিয়েছিলেন। তাদের কাছে পানির ক্যান্টিন ছিল না। নাইট ভিশন গগলস না নেওয়ায় রাতের বেলা প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছিলেন সৈনিকরা। এছাড়া রেঞ্জাররা সাথে করে কোনো ভারী অস্ত্র ও যুদ্ধযান, যেমন- গ্রেনেড লাঞ্চার, আর্মাড ভেহিকল নিয়ে যায়নি। তাদের হামভিগুলোতে (সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত ফোর-হুইলার জীপ) পয়েন্ট ফাইভ জিরো ক্যালিবার মেশিনগান ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। আবার শহরের ভেতর জনাকীর্ণ স্থানে সংঘর্ষ হওয়ায় হেলিকপ্টার থেকেও মিসাইল নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি, শুধু ক্লোজ রেঞ্জ এয়ার সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল।

মার্কিন বাহিনীর ব্যবহৃত হামভি; Image Source: nationalinterest.org

মোগাদিসুর যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর আরেকটি ভুল পদক্ষেপ ছিল একই যুদ্ধকৌশলের বারংবার ব্যবহার। এই যুদ্ধের আগে আরও ছয়বার একই যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করেছিল টাস্ক ফোর্স রেঞ্জার। একজন সোমালি মিলিশিয়া যুদ্ধের পর ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছিলেন,

আপনি যদি একই চাল দুবার ব্যবহার করেন তাহলে তৃতীয়বার আর সেটা ব্যবহার করবেন না। কিন্তু আমেরিকানরা মূলত একই চাল ছয়বার চেলেছিল।

যুদ্ধের পর সোমালিয়া

যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সোমালিয়া থেকে সকল ধরনের মার্কিন সেনা ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। ১৯৯৫ সালের মধ্যেই সোমালিয়ায় জাতিসংঘের সাহায্য প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফারাহ আইদিদ সোমালি জনগণের প্রশংসা লাভ করেন আমেরিকানদের ‘পরাজিত’ করার জন্য। তিন বছর পর আইদিদ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

বাড়ি ফেরার পালা। মার্কিন সৈন্যরা সোমালিয়া ত্যাগ করছেন; © Hocine Zaourar/AFP via Getty Images

সোমালিয়ার বর্তমান অবস্থা খুব একটা উন্নত নয়। দারিদ্র্য এই দেশটিকে এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ট্রাইবাল লিডারদের মধ্যকার যুদ্ধ চলমান থাকার কারণে দেশটি এখনো বিশ্বের ভয়ংকর দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশটিতে এখন আল শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

দ্য ব্ল্যাক হক ডাউন ইফেক্ট

সেদিন টেলিভিশনে মার্কিন সেনাদের লাশ মোগাদিসুর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে অনেক আমেরিকানেরই বুক কেঁপে উঠেছিল। মোগাদিসুর যুদ্ধ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর মার্কিন বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা যেমন সাধারণ মার্কিনীদের ধাক্কা দিয়েছিল, তেমনি ধাক্কা লেগেছিল আফ্রিকায় মার্কিন নীতির ওপরও। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যায় কোনোরূপ মার্কিন হস্তক্ষেপ না করার কারণ হচ্ছে মোগাদিসুতে মার্কিনীদের এই নাস্তানাবুদ হওয়া।

কিন্তু তা-ই বলে সোমালিয়াকে বেমালুম ভুলে যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। মানবিক সহায়তা মিশনের বদলে সোমালিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যেন শীর্ষক্ষমতা দখল করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোমালিয়ায় সরাসরি সৈন্য মোতায়েন না করলেও ইথিওপিয়ার সহযোগিতায় নিয়মিত কমান্ডো মিশন, বিমান হামলা চালিয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলার সন্দেহভাজনদের নিকেশ করার জন্য ২০০৭ সালে সোমালিয়ায় গানশিপ হামলা, ২০০৮ সালে বিমান হামলা ইত্যাদি। এছাড়া মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ নিয়মিত সোমালি উপকূলে জলদস্যুতা প্রতিরোধ টহল প্রদান করে।

ব্ল্যাক হক ডাউন সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: plejmo.com

রূপালি পর্দায়

মার্কিন সাংবাদিক মার্ক বাউডেন মোগাদিসুর যুদ্ধ কাভার করেন৷ পরে ঘটনার বিবরণ নিয়ে তিনি ‘ব্ল্যাক হক ডাউন’ নামের একটি বই লেখেন। এই বইটির ওপর ভিত্তি করে পরিচালক রিডলি স্কট ২০০১ সালে একই নামে একটি সিনেমা তৈরি করেন। ১৪৪ মিনিট দীর্ঘ সিনেমাটি ৯২ মিলিয়ন ডলার বাজেটের বিপরীতে বক্স অফিসে ১৭৩ মিলিয়ন ডলার আয় করে। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন জশ হার্টনেট, টম সিজমোর, এরিক বানা, অরল্যান্ডো ব্লুম, উইলিয়াম ফিচনার প্রমুখ।

This Bengali language article is about the 1993 Battle of Mogadishu. Necessary references are hyperlinked.

Featured Image © Alexander Joe/AFP via Getty Images

Related Articles