১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নবাব সিরাজউদৌল্লাহ'র পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার শেষ সলতেটুকু নিবে যায়। বাংলার মানুষরা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, তারা কী হারিয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াদি শাসন। কোম্পানিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো বাংলার তৎকালীন কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত জমিদার। সে বছরই পলাশীর যুদ্ধ জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য রাজা নবকৃষ্ণদেব কোলকাতার শোভাবাজারের বাড়িতে অত্যন্ত ধুমধামের সাথে দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন। লর্ড ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এই উৎসবে যোগ দেন। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে পালিত এই দুর্গা পুজোয় কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তাদের আগমনে তা বিজয় উৎসবে পরিণত হয়।
১৯১৯ সাল। সারা বাংলা জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। কোলকাতা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সবত্রই স্বদেশী ভাবধারায় জেগে উঠছে এক নতুন প্রজন্ম। এখানে সেখানে প্রতিদিন গড়ে উঠছে ছোটখাটো বিপ্লবীদের দল। এমন কয়েকটি বিপ্লবীদের আড্ডায় ঠিক হলো, সবাইকে এক ছাদের তলায় আনতে হবে। তবেই স্বদেশী আন্দোলনে সফলতা আসবে। তার জন্য সেরা উপায় হল দুর্গা পুজো। ঠিক করা হলো, দুর্গা পুজোকে উপলক্ষ করে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুবকদের একত্র করা হবে। উৎসবও হবে আর দেবী বন্দনার সাথে সাথে দেশ মাতৃকার বন্দনায় তরুণ প্রজন্মকে জাগরিত করার আয়োজন চলবে।
এর মধ্যেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস বারোয়ারি দুর্গোৎসবকে বেছে নিলেন। ১৯২৭ সালে বার্মার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কোলকাতায় ফিরে এসে নেতাজি বিভিন্ন সামাজিক এবং সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সে সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু বারোয়ারি দুর্গা পুজোর সাথে যুক্ত হন। দক্ষিণ কোলকাতার আদি লেক পল্লীর পুজো, মধ্য কোলকাতার ৪৭ পল্লীর পুজো, উত্তর কোলকাতার বাগবাজার, কুমারটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি- এই বারোয়ারি পুজোগুলোর সাথে নেতাজী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন।
তিনি পুজোগুলোয় উপস্থিত হয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে একতা আর জাতীয় চেতনা গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। দুর্গা পুজোকে উপলক্ষ করে এই অঞ্চলের মানুষের মনে স্বদেশী ভাবধারা জাগিয়ে তোলাই ছিল এই পুজোর উদ্যোক্তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এসব পুজো প্রাঙ্গণে পুজোর ক'দিন স্বদেশী গান-বাজনার ব্যবস্থা হতো। স্বাধীনতা সংগ্রামী চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এসব সার্বজনীন দুর্গা পুজোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ফলে পূজা মণ্ডপগুলো হয়ে উঠলো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মিলনস্থল। নেতাজি পুজো প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য মানুষের ঢল নামতো।
ঋষি অরবিন্দ ও বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতি ছিল লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা, কুস্তি খেলা প্রভৃতি শেখার প্রধান আখড়া। দেশমাতৃকার আরাধনার উদ্দেশ্য নিয়ে অতীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির উদ্যোগে দুর্গোৎসব শুরু করেন। সারা বছরের শরীর চর্চা আর সাহসিকতার পরীক্ষার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হতো মহাষ্টমীর দিনটিকে। এই দিনটি তারা বীরাষ্টমী দিবস হিসেবে পালন করতেন।
এই বীরাষ্টমী অনুষ্ঠানে দেবী দুর্গার সামনে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ আর তরবারি খেলার মাধ্যমে সাহস আর শক্তি দেখানোর পরীক্ষা হতো। সুভাষ চন্দ্র বোসের সাথে এই বারোয়ারি পুজো কমিটির গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি বেশ কয়েক বছর এই বীরাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯২৮ সালের সিমলা ব্যায়াম সমিতির তৃতীয় বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, সে বছর খুব জাঁকজমকভাবে বীরাষ্টমী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। উৎসবে উপস্থিত ছিলেন শরৎচন্দ্র বোস, সুভাষচন্দ্র বোস, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, কিরণ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিরা।
১৯৩০ সালে নেতাজি কোলকাতা পুরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরেই সিমলা ব্যায়াম সমিতি সভাষচন্দ্র বসুকে প্রথম কোনো সার্বজনীন পুজো কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করে। নেতাজির উদ্যোগে ও স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোতে প্রতিমাকে তখন দেশীয় খাদি বস্ত্র পরানোর চল শুরু হয়। দেবীর পরনের অলঙ্কার সবই মাটির। অস্ত্র দেশীয় লোহা, তামার। বীরাষ্টমী উৎসব ছাড়াও মণ্ডপে পুতুল খেলা, যাত্রা পালা ও কবিয়াল গানের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হতো।
এছাড়াও পুজো প্রাঙ্গনগুলোতে বিভিন্ন বাণী লেখা পোস্টার শোভা পেত। সে সময়ের ইংরেজি পত্রিকা ‘অ্যাডভান্স’ এ সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোকে ‘স্বদেশী ঠাকুর’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার সাহস করতো না। কিন্তু সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোয় বিপ্লবীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় ১৯৩২ সালে ইংরেজ সরকার এই পুজোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরপর তিন বছর এ পুজো নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৩৯ সালে আবার নতুন করে এই পুজো শুরু হয়। এবার এ পুজোয় অগ্রণী ভূমিকা নেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র দত্ত।
১৯১৯ সালে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব শুরু হয়। শোনা যায়, কয়েকজন যুবক কোনো অভিজাত বাড়ির পুজো দেখতে গিয়ে অপমানিত হয়ে এই সার্বজনীন পুজো শুরু করার উদ্যোগ নেন। ‘নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজা’ নামে এই পুজো প্রথম শুরু হয়।
১৯২৯ সালে বাগবাজারের এই পুজোয় এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালে কোলকাতা পুরসভার ওল্ডারম্যান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি হন। তারই উদ্যোগে এই পুজো এক নতুন রূপ পায়। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশিকতার চেতনাবোধ জাগাতে তিনি এই পুজোর নামকরণ করেন, ‘বাগবাজার সার্বজনীণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’। প্রকৃতপক্ষে ওই বছর থেকেই এই পুজোর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু।
এই দুর্গাপুজোর যে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো, তা স্বদেশী শিল্পমেলায় রূপান্তরিত হয়। দুর্গাচরণের উদ্যোগেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় শিল্প সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী। গ্রামীণ শিল্পের সাথে কোলকাতার মানুষদের পরিচয় করিয়ে দিতেই মূলত তার এই পদক্ষেপ। সে বছরই সুভাষচন্দ্র এই পুজোর সাথে যুক্ত হন। সুভাষ চন্দ্র ১৯৩৮-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া ১৯৩০ এবং ১৯৩৯ সালে তিনি বাগবাজারের সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন।
সেই সময় অনুশীলন সমিতির লাঠিখেলা, শরীর চর্চা ইত্যাদি প্রদর্শন করার জায়গা ছিল বাগবাজার সার্বজনীন পূজা প্রাঙ্গণ। এই অনুষ্ঠানটি হতো বীরাষ্টমী উৎসবের দিনে। ১৯৩৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবীর পরিচালনায় বাগবাজারে সর্বপ্রথম বীরাষ্টমী উৎসব শুরু হয়। এই পুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন,
“কাপুরুষতা, ভীরুতা সব মায়ের চরণে অর্পণ করে দেশমাতৃকার পুজোর জন্য তৈরি হতে হবে। সে পূজার জন্য প্রয়োজন শুধু ত্যাগ।”
উল্লেখ্য, আজও মহাষ্টমীর দিনে এখানে বীরাষ্টমী উৎসব পালিত হয়। জাতীয়বাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই পুজোর সূচনা বলে এই দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল স্বদেশ ভাবনার এক নব জাগরণ। সুভাষ চন্দ্র ছাড়াও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নলিনীরঞ্জন সরকার এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই পুজোর সাথে যুক্ত ছিলেন।
পরাধীন ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল। বিরাট জনসমাগম দেখলেই ইংরেজরা ভয় পেতে শুরু করে। এভাবেই বারোয়ারি পুজোর মাধ্যমেও বহু মানুষকে একত্র করার পরিকল্পনা তখন পরাধীন দেশের বিভিন্ন অংশে শুরু হয়ে যায়। খানিকটা এভাবেই উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৩২ সালে হরিমোহন পালের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক দ্বারিকানাথ দাসের নেতৃত্বে কুমোরটুলি অঞ্চলের কিছু যুবক কুমারটুলি সার্বজনীন দুর্গোৎসবের শুভ সূচনা করেন।
১৯৩৮ সালে সুভাষ চন্দ্র বোস এই সার্বজনীন পুজো কমিটিরও সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে সে বছরই দুর্গা পুজোর পঞ্চমীর দিন পূজামণ্ডপটি ভস্মীভূত হয়। ফলে সে বছর পুজোটি নিরানন্দভাবে সম্পন্ন হয়। তখন নেতিাজির অনুরোধে ভাস্করশিল্পী গোপেশ্বর পাল এই পুজোতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন।
এভাবে দুর্গােপুজোর মাধ্যমে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে স্বদেশী চেতনার এক নব জাগরণ। বিভিন্ন জায়গায় সার্বজনীন পুজোর মাধ্যমে ঘটতে থাকে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার এক নব উন্মেষ। সে উদ্যোগের মধ্যমণি হিসেবে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের নাম জড়িয়ে থাকলেও তার সাথে জড়িয়ে আছে আরও অনেক সাহসী বিপ্লবী যোদ্ধার নামও। বাঙালির ঐতিহ্য, সাহসিকতা, আত্মসম্মানবোধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পর্ব এর মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়।
This article is in Bengali language. This is a brief history about Durga Puja, the journey from a Zamindari status symbol to a nationalism project. The ostentatious celebration of Durga Puja helped the zamindars in asserting their influence in an era of drastic political and social change in Bengal.
All the sources are hyperlinked inside the article.
তথ্যসূত্র:
১। সুভাষ রচনাবলী
২। সুভাষ স্মৃতি
৩। রাধারমণ রায় ও বিমলকুমার ভট্টাচার্য রচিত প্রাসঙ্গিক রচনা
Featured Image: DailyO